একটি ভ্রূণ ও কয়েকটি রক্তপদ্ম

উপলব্ধি (এপ্রিল ২০১৬)

মোঃ সাকিব চৌধুরী
  • ৩৮

মাধবী শুয়ে আছে।বিছানার চাদর ধবধবে সাদা।ঘরে টানানো পর্দাগুলোও সাদা।সাদা নাকি পবিত্রতার রং।কে বলেছে?যে বলেছে সে কি জানে সাদা শূন্যতারও রং।তাই কি মাধবীর আজ এতটা শুন্য লাগছে নিজেকে?

...মাধবী শুয়ে আছে নগরীর একটি খ্যাতনামা ক্লিনিকে।কিছুক্ষণ পর তার আবোরেশান করানো হবে। আবোরেশান এর সঠিক বাংলা যেন কি?সন্তান নষ্ট,গর্ভ নষ্ট নাকি গর্ভপাত?না কিছুতেই সঠিক বাংলাটা মনে পড়ছে না।এমন সময় হাতে একটা বোর্ড নিয়ে প্রবেশ করল নার্স।মাধবী আগেও খেয়াল করেছে সব হাসপাতালের নার্সদের চেহারাই কেমন যেন নিরাসক্ত ধরণের হয়ে থাকে।অনেকটা চাবি দেওয়া পুতুলের মত।কেউ একবার চাবি ঘুরিয়ে দিয়েছে,সেই ঘোরানো চাবির বলে তারা কাজ করে যাচ্ছে। কাজের বাইরে জগতে কি ঘটছে না ঘটছে তা নিয়ে এদের কোন কৌতূহল নেই।সারাক্ষণ অসুখ-বিসুখ আর মৃত্যুর মাঝে থাকে বলেই কি জীবন তাদের কাছে এতটা বৈচিত্র্যহীন?
:নাম কি?
:মাধবী
:মাধবী কি?
:মারজান হাসান মাধবী।
:বয়স?
:২২ বছর
:সাথে কেউ আসে নাই কেন?সাহেব কই?
মাধবী নিরুত্তর।শক্ত খড়িকাঠের মত আঙ্গুল দিয়ে পালস দেখতে দেখতে নার্স বললোঃবুঝছি।মহব্বতি কারবার।তা পিরিতের মানুষ এখন কই ভাগছে?মাধবীর বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো।শুকনো গলাটা জিহ্বা দিয়ে একটু ভিজিয়ে বললোঃনা তেমন কিছু না আসলে আমিই এখন চাচ্ছি না।এত কম বয়সে...
:আরে মেয়ে,আমার কাছে কি লুকাবা?বয়স তো কম হইল না।চোখের সামনে কত এমন দেখলাম।কত মহব্বত...কত পিরিতি...আর পেটে একটা জঞ্জাল জুটলেই মহব্বত করনেঅলারা পলায়।অশিক্ষিত মেয়েরা নাহয় না বুইঝা এই ভুল করে।কিন্তু আপনারা লেখাপড়া জানা মানুষ কেন এই ভুলটা করেন?......

মাধবীর খুব বিরক্ত লাগছিল।ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মন নতুন করে আর অবসাদ নিতে পারছে না।কিন্তু নার্সটা বকেই যাচ্ছে...
:তা ক’মাস হইছে?
:মানে?
:মানে কয় মাস হল পেটে ধরসেন?
:দুই।না না দুই না আড়াই মাসের মত হবে।

কত কঠিন একটা কাজ অথচ কত সহজে হয়ে গেল।মাত্র ঘন্টাখানেক সময় লাগল।পুরো প্রক্রিয়াটা বড় বেশি পৈশাচিক,বড় নিষ্ঠুর।মাধবী কি চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল?হয়তো কিংবা না।চেতন আর অচেতন এর মাঝে খুব সূক্ষ্ম একটা যায়গা রয়েছে যেখানে মানুষ খুব বেশি সচেতন থাকে।মাধবী এত কিছু বোঝেনি।তার শুধু নিজেকে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে।প্রচন্ড অবসাদে মন শূন্যতায় ভরে গেছে।

জ্যামের শহর ঢাকা।অসংখ্য গাড়ির সারির একটিতে রয়েছে মাধবী।ডাক্তার তাকে অনেক কথা বলে দিয়েছে।ভবিষ্যতে এমন হলে যেন তিন দিনের মাঝে একটা পিল খেয়ে নেয়।বার বার আবোরেশান করালে কি ক্ষতি হতে পারে এইসব নানা কথাবার্তা।মাধবীর মাথায় এসব কিছু নেই,তার মাথায় শুধু ঘুরছে কয়েকটা ছবি।অর্থহীন কয়েকটা ছবি...

প্রথম ছবিটা খুব আবছা...মাধবীর ১৯ তম জন্মদিন।বড় মামা খুব বিশাল একটা পার্টি দিল।অনেক মানুষ।তার মাঝে একজন ছিল রোমান।মামার বন্ধুর ছেলে।হাৎসোজ্জল তরুন।সবসময় হইচই করছে।লম্বা,সুদর্শন।ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ বর্ষে পরছে।এককথায় ভালো লেগে যাবার মত ছেলে বলতে যা বোঝায় তাই।

পরের ছবিটা খুব রঙিন।কোন এক পহেলা ফাল্গুনের দিন।উৎসব চলছে।হলদে-কমলা ছোপের সাদা শাড়িতে কিশোরী থেকে সদ্য তরুণী হয়ে উঠা মাধবী।হাতে পাঁচটা টকটকে লাল ফুল নিয়ে কোথা থেকে হঠাৎ হাজির হল রোমান।
:এগুলো কি ফুল?,মাধবীর প্রশ্ন
:রক্তপদ্ম
:ওয়াও!শুধু নাম শুনেছি কখনো দেখি নাই;কোথায় পেলে?
:ঢাকায় পাওয়া যায় না।বাইরে থেকে অনেক কষ্ট করে আনিয়েছি।অনলি ফর ইউ, মেডাম।

কে কাকে আগে ভালবেসেছিল?মাধবী নাকি রোমান?তার জানা নেই।সে শুধুই ভালবেসে গিয়েছিল।প্রচন্ড সেই ভালোবাসায় ছিল বিশ্বাস ও আস্থা...

তৃতীয় ছবিটা রঙ্গিন নয় কিন্তু খুব উজ্জল।এতটা উজ্জল যে হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় চোখ জ্বলে যাচ্ছে।কলেজের বিশাল হলরুমটাতে ছাত্রীদের মাঝে বসে আছে কিশোরী মাধবী।ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সিস্টার প্রিয়ংবদা।উনি কথা বলছেন কিন্ত মাধবীর মনে হচ্ছে সে কোন গান শুনছে।শুদ্ধ সুরেলা সঙ্গীত...

...কখনো ভেবে দেখেছ কি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিজগৎ কতটা রহসসময়?দু’জন
মানুষকে প্রকৃতি কিভাবে যেন এক করে দিল।তারপর প্রকৃতিই হয়তোবা তাদের মাঝে ভালোলাগা সৃষ্টি করে দিল।তাদের ভাললাগার ফসল,সৃষ্টিকর্তার সর্বোত্তম উপহার একটি সন্তান।একটা শুক্রানু আর একটা ডিম্বাণু মিলে নিষেক হয়ে গঠিত হল একটা ভ্রুন।সেই ভ্রুন থেকে যে শিশুটি জন্ম নিল হয়তো সে একদিন বড় একজন মানুষ হয়ে বিশাল একটা কাজ করবে।কিংবা সে খুব বড় কিছু না হয়ে খুব সাধারণ একজন মানুষ হবে।সাধারণ কিছু কাজ করবে সে এই পৃথিবীতে।তার কাজগুলো হয়তো ছোট কিন্তু পৃথিবীতে এর প্রয়োজন ছিল।প্রকৃতি কিংবা সৃষ্টিকর্তা উভয়ই প্রয়োজন ছাড়া কোন কাজ করে না।প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছু নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে এই পৃথিবীতে।আমরা জেনে বা না জেনে এই কাজগুলোই করে যাই।প্রত্যেকটা মানুষই প্রয়োজনীয়।প্রতিটি জীবনই সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টির একটা অংশ...

সর্বশেষ ছবিটা বর্ণহীন,সাদাকালো।ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে মুখোমুখি বসা মাধবী ও রোমান।রোমানের স্কলারশিপ পাওয়া চূড়ান্ত হয়ে গেছে।ভিসা হয়ে গেছে।প্লেনের টিকিটও কাটা শেষ।এক সপ্তাহের মাঝে জাপানে উড়াল দিচ্ছে রোমান।
:আমি তাহলে এখন কি করব?,মাধবীর প্রশ্ন।
:অপেক্ষা কর
:কতদিন?
:চার বছরতো লাগবেই।খুব বেশি হলে পাঁচ বছর...
:তোমাকে গত সোমবার একটা কথা বলেছিলাম,মনে আছে?
:কি কথা যেন।সরি!ভুলে গেছি।
:ভুলে গেছ!হোয়াট এ সারপ্রাইজ!যাক ভুলেই যখন গেছো তখন আবার বলছি,আই এম প্রেগন্যান্ট।ইউর চাইল্ড ইস গ্রোইং আপ ইন মাই ইউট্রেস।
:উফ!মাধবী তুমি কেন বুঝতে চাইছো না বলতো?তুমি জেতা চাইছো সেটা সম্ভব না।এখন আমার পক্ষে কোনভাবেই তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব না।আর আমি তো কতবার তোমাকে প্রোপার প্রোটেকশান নিতে বলেছি...
:তখন তো আমিও তোমাকে কত কথা বলেছিলাম।তুমি শুনেছিলে?
:ইউ আর ইম্পসিবল।এখন এসব কথায় কি লাভ?আগে আমার পিএইচডিটা কমপ্লিট করি।তারপর দেখা যাবে।
:আমাকে এখন কি করতে বল?
:সিম্পল,আবোরেশান করিয়ে নেও।
:এটাই তোমার শেষ কথা?
:হ্যাঁ।
রোমানের সাথে সেটাই ছিলো মাধবীর শেষ দেখা।চেনা রোমান একদিনেই কতটা অপরিচিত হয়ে গেল!

...কয়েকটা রক্তপদ্ম দিয়ে শুরু হয়েছিল রোমানের সাথে মাধবীর ভালবাসা,তাই কি সম্পর্কের শেষটা এত রক্তঝরা হল?গভীর রাতে ‘আবোরেশান’ শব্দটার সঠিক একটা অর্থ খুঁজে পেল সে-‘ভ্রূণহত্যা’।সে শুধু একটা ভ্রূণকেই হত্যা করেনি,সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টির একটা অংশ ধ্বংস করেছে।একটা মানুষকে খুন করেছে মাধবী।প্রকৃতির জন্য,পৃথিবীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জীবনকে শেষ করে দিয়েছে...

...পাঁচ বছর পর।মাধবী সম্প্রতি বিসিএস করে কলেজ শিক্ষকতায় ঢুকেছে।পোস্টিং গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর।সরকারী কোয়ার্টারে থাকে।তিনটা পর্যন্ত কলেজে ক্লাস নিয়ে ফেরে।আজও ফিরেছে।হাতে ছোট একটা কেক।আজ তুলতুলের জন্মদিন।একা একা বাসায় থেকে ছেলেটা এত জেদি হয়েছে!কোন কিছু বললেই ঠোঁট ফোলায়।গায়ের রং বাবার মত টকটকে ফর্সা হয়েছে।তা হোক,সমস্যা নেই।কিন্তু আজকাল প্রায়ই বলে চোখে নাকি কম দেখে।এই সমস্যাটাও কি বাবার থেকেই পেল নাকি?বেশি পড়াশোনার যা ফল চোখে হাই পাওয়ারের মোটা চশমা-কিন্তু সেটা উঠতি বয়সের ছেলে কিংবা পূর্ণবয়সের পুরুষকে মানায়।চার বছরের বাচ্চা চোখে চশমা দিলে সেটা দেখতে কেমন লাগবে কে জানে!
:আজ এত দেরি হল কেন?
:কলেজে মিটিং ছিল,বাবা।
:দেখ মামণি,আমি হাতে ব্যথা পেয়েছি।
:কোথায় ব্যথা পেয়েছো মা?
:এই,এইখানে।তুলতুল তার ডান হাতের আঙ্গুল তুলে অভিযোগ জানালো।
:দেখি তো ফুঁ দিয়ে দেই
:উঁহু।একটু আদর করে দাও।মাধবী তার চার বছরের সন্তানের হাতে চুমু খায়।

পাশের বাসায় থাকে সহকর্মী আজিজ সাহেব।উনার স্ত্রী মাজেদা অবাক হয়ে দেখেন ‘নতুন আপা’ মাঝেমাঝে একা একা বকবক করেন।উনি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেন-আপা একা একা কি কথা বলেন?মাধবী কিছু বলে না।মুখ টিপে হাসে।মাজেদাও আর ঘাটায় না।পাগল মানুষ বেশি ঘাটিয়ে লাভ কি?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রেজওয়ানা আলী তনিমা শেষটা পড়ে খুব কষ্ট লাগলো। উপলব্ধিগুলো কেন যে বড় দেরীতে আসে!
ধন্যবাদ, ঠিকই বলেছেন আপু, উপলব্ধি দেরীতে আসে বলেই মানুষের জীবন এত কষ্টের হয়।
কেতকী খ্যাতনামা ক্লিনিকের নার্সরা ভাষায় অনেক বেশি মার্জিত হয় বলে জানি। মেধাবী পুরুষের মেধাকে শান দিতে নারীকে ব্যবহারের ঘটনা নতুন না। গল্পে ভোট রইল।
আপু, এটা মার্জিত-অমার্জিতর ব্যাপার নয়, জাতিগত ভাবেই আমরা উপদেশ দিতে বেশি পছন্দ করি।আপনার ২য় কথাটিও হয়তো সত্য...কিন্তু আমি ঠিক সেই দৃষ্টিকোণ থেকে লেখাটি লিখিনি।আমার গল্পের প্রধান চরিত্রের উপলব্ধির যায়গাটিই আমার গল্পের মূল উপজীব্য।ধন্যবাদ ভোট ও অসঙ্গতির জায়গাগুলো দেখিয়ে দেবার জন্য।
মোহাঃ ফখরুল আলম N/A ভাল হয়েছে। ভোট পাবেন। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম।
ধন্যবাদ।জি সময় করে অবশ্যই পড়ার চেষ্টা করবো।
ইমরানুল হক বেলাল ছোট গল্প হচ্ছে একটি সাহিত্যের অন্যতম মননশীল আর্ট। সেই হার্ট সবাই জানে না। সুতরাং ঠিক মতো পাঠ ও হয় না। সাকিব ভাইয়ের গল্পটি পড়ে সেই ধারাবাহিকতা খোঁজে পেয়েছি। সত্যি দাদা, আপনি খুব গুছিয়ে লিখতে জানেন। আপনার শুভকামনা রইল। •••।
ধন্যবাদ! আপনার মন্তব্যও এবার খুব অসাধারণ লাগলো। শুভকামনার জন্য আবারও ধন্যবাদ...।।
ফেরদৌস আলম শেষের সাইকোলজিক্যাল বিষয়টা দারুণ লেগেছে !
ধন্যবাদ ভাইয়া... একজন পাঠক যখন এভাবে বলে তখন যে কি ভালো লাগে!
ধন্যবাদ ফেরদৌস ভাই, বিষয়টি সংশোধনে নিলাম। কিন্তু আমি কারো লেখা না পড়ে ভুল মন্তব্য দেই না। আমি সময় নিয়ে আগে পুরো লেখা পড়ি তার পর মন্তব্য করি। কিন্তু কারণটা হলো মন্তব্য লিখতে গিয়ে অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। এ বিষয়ে আমাকে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন।
গাজী সালাহ উদ্দিন ছুয়ে গেলো লেখাটি । শুভেচ্ছা ।
রুহুল আমীন রাজু N/A অনেক বাস্তব একটি লেখা ...ভালো লাগলো গল্পটি .
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রন রইল।

১৮ মার্চ - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পরগাছা”
কবিতার বিষয় "পরগাছা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুলাই,২০২৫