বাকা চাঁদের মত নুইয়ে পড়া শরীর নিয়ে আর মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে যতবারই দবির দা আমাকে নিজের নাতিনের মত মিষ্টি করে 'দাদুভাই' বলে সম্বোধন করে, ততবারই আমার মনের আকাশে একটা দারুণ আনন্দের উল্কা ছুটে যায় ক্ষিপ্র গতিতে! এই মধ্যাহ্নবেলায় তপ্ত রৌদ্র মাথায় নিয়ে, হাতে নিজের ছোট্ট শরীরের প্রায় কাছকাছি ওজনের বালতি-ভর্তি পানি সেই মসজিদের টিউবওয়েল থেকে টেনে নিয়ে এসেও সেই পুরনো নির্ভেজাল হাসির সাথে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে তার আজ পর্যন্ত এতটুকু ভুলও হয়নি৷ গেঁয়ো সম্পর্কে সে আমার দাদু আর আমি তার নাতিন, কিন্তু আজ অবধি তার আচার-ব্যবহারের দিক থেকে সে নামহীন সম্পর্কটি আরো অনেক গভীর মমত্বের আর নিকট-আত্মীয় ধাচেরই মনে হয়েছে আমার কাছে৷ ছোট্ট শরীরের সাথে বেশ মানানসই মায়াবী মায়াবী ছোট্ট একটা হাসিমুখ দবির দা'র ৷ নিরীহ গোছের এই মানুষটার গায়ের বর্ণ মেঘ-রঙা কালো হলেও তার বহুমূল্যের সরলতা গুণের বিপরীতে তা একান্তই অপস্রিয়মান৷ গরীব মানুষের নানা অভাব-অভিযোগ, টানাপোড়েন, আর নিত্যদিনের কলহ-বিবাদ লেগে থাকে বটে; কিন্তু একজন দরিদ্র মানুষ মনের দিক থেকে কোন মাত্রার ধনী হলে তার মনে কোন অভাববোধ থাকেনা-তা আমি দবির দা'কে না দেখলে কখনোই টের পেতাম না৷ তেলের অভাবে কেরোসিনের কুপিবাতির সলতেও পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে অন্ধকার দখল করে নিত তার ঘরের চার দেয়াল, তবুও তাকে সে কথা জিজ্ঞেস করলেই সে বলত, দেখ দাদু ভাই, আমার ঘরের চালের উপর কী অজস্র জ্যোৎস্নার মায়াবী আলো গড়িয়ে পড়ে সন্ধ্যারাত হতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত! এ কথা শোনার পর আমার শুধু মনে হয়, ঠিকই বলেছ দবির দা, আমাদের ঘর থেকে আঙ্গিনা পর্যন্ত বৈদুতিক আলোর ঝলকানি এত তীব্র যে তার আশেপাশেও জ্যোৎস্না কখনো উঁকি দেয়ারও ইচ্ছে করেনা, আমাদের ঘরে আলো থাকে তাই অঢেল, কিন্তু মনে থাকেনা একবিন্দুও! আর তোমার তো ঘর হতে মন, সবই অপূর্ব স্বচ্ছ আলোয় ভাসমান আজন্মকাল!
- তো দবির দা, কেমন আছেন? দবির দা'র মুখের সেই মিষ্টি হাসির জবাব,
- শোকর আলহামদুলিল্লাহ, দাদুভাই৷ আল্লাই তো খুবই ভালো রাখছে! কলেজ কি ঈদের ছুটি হইছে আপনাদের? কয় দিনের ছুটি দিল?
- এই তো দশ-বারো দিন৷ চা স্টলের পিচ্চি ছেলেটাকে হাঁক ছেড়ে বললাম দু কাপ চা দিতে৷ দবির দা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না না দাদুভাই, লাগবেনা, আপনিই খান না!
- আমি হেসে বললাম, আমি আপনাকে পাশে বসে রেখে কোনদিনও আপনাকে ছেড়ে চা খেয়েছি?
দবির দা বিনয়ের সাথে একপ্রস্থ হাসি দিয়ে বলল,
- না, না, দাদুভাই৷ তা তো আপনিই কখনো করবেনই না৷
- কালতো ঈদ৷ বাজার-ঘাট কিছু হয়েছে দবির দা?
- না দাদুভাই, আজ রাতে দোকানীরা কিছু কিছু করে দিলে বাজার করব৷
আমি যতদিন ধরে এই দবির দাকে চিনি ততদিনে তার বাজারের থলেটা একদিনের জন্যও ভরা দেখে আমার চোখদুটো জুড়ায়নি! মাঝে মাঝে তদারকি করার জন্য চোখ বুলাতাম আর দেখতাম ছোট্ট থলেটার একদম নিচে আধাকেজি চাল যেটা আবার বাজারের সবচেয়ে সস্তা আর মোটা চাল, আধাকেজি আধা-পাকা পটল, পোকা-ধরা আধাকেজির মত পোকা-ধরা বেগুন- ব্যস, এই শেষ! এর পরেও তার মুখে কোনদিনও এতটুকু অভাবের ছায়া দেখিনি৷ পাতলা ফিনফিনে স্যান্ডোগেঞ্জিটার অজস্র ফুটো দিয়ে তার কালচে বুক আর পিঠ দেখা যেত সবসময়৷ যেন ওগুলো স্বর্গের সুখ আর অপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য একেকটা দূরবীন৷ সে কারণেই তার মুখের উচ্ছ্বল হাসি দেখলে মনে হত ওটাই বুঝি তার মস্ত গৌরবের বিষয়, সারাজীবনে যার এতটুকু ক্ষয়ও সে হতে দেয়নি৷
– দোকানীরা কত দিবে আপনাকে? ঈদের জন্য বখশিস-টখশিস দেবে না?
– এমনি সময় সবাই দশ থেকে বিশ টাকার মধ্যেই দেয়৷ বেশী বালতি পানি দিলে বেশী টাকা দেয়৷ ঝাড়ুতে কম টাকাই দেয় সবাই৷ কিন্তু দূরের টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে তো এখন আর পারিনা দাদুভাই৷ বয়সও হইছে আবার শরীরেও কুলায় না৷ শুনেছি, ঈদে দিবে জনে পঞ্চাশ টাকা করে৷
– কয়টা দোকানে কাজ করেন? কী কী ফরমায়েশ খাটতে হয় আপনাকে এসব দোকানে?
– পাঁচটা দোকানে৷ দু চার বালতি পানি এনে দেই, দোকানের ভিতর-বাইরে ঝাড়ু দেই, দোকানীদের চা এনে দেই- এইগুলোই তো করি দাদুভাই৷
– সেই হিসেবে তো সব মিলে আড়াইশো টাকা পাবেন আজ রাতে৷ এতে কি কালকের ঈদের বাজার হবে? বাড়িতে দুটো নাতিন, দাদী৷ কাপড়-চোপড় কিছুই কিনবেন না?
– না, দাদু ভাই। আমার আবার নতুন পুরাতনে ভেদাভেদ কী!বয়স হইছে তো অনেক৷ দিনকে দিন নতুন নতুন জগত দেখি চোখের সামনে। ওসবেই মনের সাধ মিটায়ে যায়৷ আর নতুন জামার কথা বললে গতবার তৈবর মেম্বার একটা লুঙ্গি দিয়েছিল ওটাই ধুয়ে ইস্ত্রি করতে দিয়েছি৷ আর পাঞ্জাবীও একটা আছে ইস্ত্রি করা- ঐ দিয়ে চলে যাবে৷ আপনার দাদী আজ কয়েকজন গার্হস্থ্যের বাড়িতে গেছে, যদি কোন যাকাতের কাপড় পাওয়া যায় তার জন্য৷ বোধকরি ও পাবেই, প্রত্যেকবারই তো পায়।
– আর নাতিন দুটোর জন্য?
– গতবারের মাছের জলা পাহারা দেয়ার কিছু টাকা বাকী পড়েছিল বাবলু সওদাগরের কাছে৷ দুদিন আগে দিয়েছে, ঐ দিয়ে নাতিদুটোর ঈদের কাপড় হয়ে গেছে।
– তাহলে আড়াইশো টাকায় কী কিনবেন?
স্মিত হাসি হেসে বলে, দুকেজি চাউল, সামান্য কিছু ডাল, এক কেজি সেমাই, পোয়া খানেক চিনি৷ আমি মনে মনে বুঝে গেলাম যেগুলো উনি কিনবেন সেগুলোও হবে বাজারের উচ্ছিষ্ট খাবারের প্রায় কাছাকাছি গোছেরই কোন খাবার৷ তার মেয়াদোত্তীর্ণ গন্ধ অনেক মোটা-টাকা রোজগারকারী ভিক্ষুকের নাকেও এসে লাগলে সে আর খাবে না৷
– আপনার ছেলে তো ভালোই আয় রোজগার করে শুনেছি৷ এই ঈদেও ও আপনাকে কিছুই দিবেনা?
আবারো হাসি দিয়ে খুব ফুর্তি ফুর্তি চেহারা নিয়ে বলে,
– দাদুভাই, ও নিজেও তো আমার মতই কামলা মানুষই। আয় হয়তো করেই। কিন্তু ওরা নাকি যা কামাই করে, তাতে তো ওদেরই নাকি আকাল ফুরায় না৷ আমায় আর কী দিবে? আল্লাই আমারে প্রতিদিন যা দেয় তাতে আমার জোর শুকরিয়া, নইলে ওদের দুটো ছেলে কি আমি চালাইতে পারতাম?
– আগে তো দেখতাম ক্ষেত-খামার থেকে গোটা আট-দশেক কচুশাঁকের আটি বাজারে আনতেন বিক্রি করার জন্য৷ এখন আর করেন না?
– না দাদুভাই, দিন এখন বদলাইছে কত! এখন সবারই শুধু অভাব আর অভাব৷ যাদের টাকা পয়সা বেশী তাদের আরো বেশী অভাব! তা না হলে আগে কচুশাঁকের জঙ্গলে বা ক্ষেতে গরীব মানুষ ছাড়া অন্য কেউই উঁকিই মারত না৷ আর এখন সেখানে গার্হস্থ্য কী, আর গরীব কী, সবারই বউ-ঝি এসে শাক তোলার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে! আমাদেরও আর কপালে তাই ওসব জোটেনা এখন! তবে দাদুভাই, গরীব মানুষ্রে আল্লাই থামায়ে রাখেনা, এক জায়গায় না জায়গায় ঠিকই পেটে দেয়ার জন্য দু মুঠো অন্ন ঠিকই জুটায়ে দেয়!
আমি চা স্টলের ঢালুতে দূরে পুকুরের কালো জলে তাকিয়ে তার সাথে দবির দা কে মেলায়। দবির দা যেন ঐ জলের মতন নিরব, ঢেউহীন আর নির্বাক। এতটা সময় ধরে তার এত অভাবী জীবনের গল্প আমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শুনলাম কিন্তু সে একবারের জন্যও লজ্জিত বা সংকোচিত হয়নি সেই অভাবের কথা শোনাতে গিয়ে!একবারের জন্যও মুখ ফুটিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বলেওনি – দাদুভাই, আমাকে দেয়ার মত কিছু টাকা হবে? এর কিছুই সে চাইনি, বলেনি, অঙ্গভঙ্গিতে বুঝাতেও চায়নি। যেন জীবন তাকে কিছুই না দিলেও তার আর জীবনের কাছে চাওয়ার কিছুই নেই। আমি আবার তার স্যান্ডোগেঞ্জিটার দূরবীন দিয়ে তার হৃদয়টাকে দেখার চেষ্টা করি, কিন্তু সেখানে দবির দা কুলুপ এটে দিয়েছেন। তাতে আমার প্রবেশের ক্ষমতা শূন্য! হঠাৎ চেতনায় ফিরি আমি, পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দুশো টাকা ভাঁজ করি আমার হাতের মুঠোয়। দবির দা তখনো রাস্তার দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে। দেখার মত করে তার নিত্যদিনের নতুন নতুন করে বদলে যাওয়া জগতকে দেখছে। আমি ডাকলাম, দবির দা, কী ভাবছেন?
- হুম, না না দাদুভাই তেমন কিছু না তো!
আমার হাতের মুঠিটা তার হাতের মধ্যে গুঁজে দেই। সে শুধু বলে, কী দাদু?
- কিছুনা, কয়েকটা টাকা। ভালো কিছু খাবার কিনবেন। আমি ঈদের দিন সকালে ঈদের মাঠ থেকে ফিরে আপনাদের ঘরে গিয়ে একসাথে খাব।
দেখি দবির দা অনেক নিচু হয়ে টাকাটাকে দেখেই যাচ্ছে, কিছুই বলছে না। আবার ডাকলাম, দবির দা! দবির দা মুখ তুললেন। কিন্তু যে অপূর্ব দৃশ্য আমি দেখলাম তা দেখে বসে থাকার মত শক্তি আমার ছিলনা বিধায় উঠতে উঠতে বললাম, ঠিক ঠিক খেতে আসব কিন্তু দবির দা! দবির দার ঠোট তিরতির করে কাঁপছে তখনো। দাঁত দিয়ে আলতো কামড়ে ধরে সেই কাঁপুনি সে আটকাতে চাচ্ছে মুহুর্মুহু। কিন্তু আরেকটা জিনিস সে কীভাবে আটকাবে? কোনভাবেই যে সে তা পারবেনা! ফিরে ফিরে আসতে তাই তো ভাবছিলাম, নির্বাক, নিঃশব্দ চোখের জলের সমার্থক শব্দ আর কী কী হতে পারে? যেটি আর দবির দা আটকাতে পারল না!