আজকের দিনটি অন্যান্য আটপৌরে দিনগুলোর মতোই শুরু হয়েছিল ঠিক এইভাবে:
আমি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলাম। তখন মিলি টেবিলে প্রাতরাশ সারছিল।একটু তফাতে বসে আমিও আমারটা সারতে লাগলাম। এক পর্যায়ে সে উঠে গিয়ে ভেতরের ঘরে তৈরী হতে গেল- অফিসে যাবে বলে। এরই ফাঁকে আমার আলাদা মগে চা এনে সামনে রাখল। আবার ফিরে গিয়ে শব্দ ছাড়াই সে শাড়ি পাল্টাল; ব্যাগ নিয়ে হালকা সুগন্ধির রেশ ছড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও আমার মতো করে ওয়ার্ডরোব থেকে শার্ট নিয়ে গায়ে চড়ালাম। টাইয়ের নট ভালো করে বাঁধলাম। ফ্ল্যাটে চাবি ঘুরিয়ে এক সময় আমিও বেরিয়ে গেলাম।
সকালটি ছিল নিখুঁতভাবে অন্যান্য সকালগুলোর মতোই। একঘেয়ে।
দুপুরে অফিসের কাজ শেষ করে লাঞ্চের জন্যে যখন ক্যান্টিনে গেলাম, দেখলাম লাঞ্চ একেবারেই শেষ। কাজ শেষ করতে একটু দেরি হয়েছিল বটে; তাই বলে এত তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ হয়ে যাবে ভাবতেই পারি নি। কী করব, কী করব যখন করছিলাম, পকেট থেকে ফোনটা বের করে সুমনাকে কল দেওয়ার কথা ভাবলাম। লাইন পেতেই জিজ্ঞেস করলাম, আজ আসা যাবে? লাঞ্চ তোমার ওখানে করা যাবে?
সুমনা ওপ্রান্ত থেকে বলল, যাবে।
আমি অফিস থেকে একটা ইমার্জেন্সি লিভ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা নিউভিলা। এক আবাসিক এলাকা। গোটা চৌদ্দটা ফ্ল্যাট নিয়ে জমির উপর আসন গেঁড়েছে। বেশিরভাগ ফ্ল্যাটের ঘরগুলোতে ব্যাচেলর মেয়েরাই থাকে। দারোয়ান আমাকে চেনে। তাই কোন বাধা নেই।
পাঁচ নং ফ্ল্যাটটা সুমনার। সে থাকে থার্ড ফ্লোরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে নাম লেখা বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপলাম। সুমনাই দরজা খুলল। মুখে চিরচেনা নিরুত্তাপ ভাব নিয়ে।
হালকা ছিপছিপে গড়নের মেয়ে। শ্যামবর্ণ, বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ। পরনে ঘামে ভেজা সালোয়ার। চুলগুলো ঘাড়ের উপর ছড়ানো। সে জায়গা করে দিতেই ভেতরে ঢুকলাম।
নির্লিপ্তস্বরে সুমনা জিজ্ঞেস করল, ফ্যান ছাড়ব?
সোফায় বসতে বসতে উত্তর দিলাম, ছাড়।
আজ অনেক গরম পড়েছে। অফিস ছিল না? এ সময়ে কখনো তো আসা হয় না।
ছিল। লিভ নিয়েছি।
কলার উপরে তুলে দিলাম।
সুমনা সেটা দেখল। জিজ্ঞেস করল, মিলি কোথায়?
অফিসে।
সুমনা ভেতরে গিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে লাগল। একটা সময় নিজেই ডাক দিল। এক টেবিলে মুখোমুখি হয়ে দুজনেই লাঞ্চ সারলাম। খাওয়া শেষ হলে সে একটা কাঁচের গ্লাসে করে শরবত নিয়ে এল। তিন চুমুকে পুরোটা গলাধ:করণ করলাম। উঠে দাঁড়িয়ে সুমনার গালে হাত দিলাম। তার ঠোঁটে চুমু খেলাম। সে আরো এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। একটু পরে হাত ধরে টেনে নিয়ে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেল। আমি তার পেছন দিক থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
মিলি আর আমার বিয়েটা হয়েছিল ছয়মাস আগে- মা বাবার জোরাজুরিতে। আমার বিয়ে করবার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ ছিল না। দায়সারাভাবে নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। কৈশোর, যৌবনে নারী, প্রেম এসবে ছিল না কোন উৎসাহ। বন্ধুরা প্রেম করত, আমি উদাসদৃষ্টিতে দেখতাম। পড়াশোনা ছাড়া গতি নেই- এই আপ্তবাক্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মগজে গেঁথেছিল। এরপর চাকরির পেছনে ছোটাছুটি। সেই চাকরি পেতে লাগল তিন বছর। এর মাঝে নারী, প্রেম এসব নিয়ে দু:সাহস দেখাবার শক্তি আমার ছিল না। হঠাৎ করেই এসে পড়ল মিলি। বিয়ের প্রথম রাতেই সে জানিয়ে দিল এ বিয়েতে তার অসম্মতি, নিরাসক্তির কথা। আরো জানাল, তার গোপন প্রেমিকের কথা। তাদের মধ্যে প্রেম চলছিল দু বছর ধরে। এর মধ্যে আমাকে কেবল গ্রহণ করেছে স্রেফ পরিবারের দায়ে। আমি মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু একটা পুরুষ ও একটা নারী দীর্ঘদিন একইসাথে বসবাস করলে যে অমোঘ আকর্ষণ এসে যাবার কথা তা আমার ক্ষেত্রেও এসেছিল। আমরা এক বিছানায় ঘুমাতাম না। তার ফোন আসলে, কাপড় পাল্টাবার প্রয়োজন হলে সে অন্য ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিত। তাকে অনাবৃত দেখি নি কখনো। দেখবার ইচ্ছাও যে কখনো হয় নি তা নয়। সে ইচ্ছের কথা বুঝতে পেরেই হয়তোবা একদিন সরাসরি আমাকে বলল, আমার সাথে ওসব নয়। বুঝেছ? কখনো নয়।
বুঝতাম, অফিসের পর মিলি তার প্রেমিকের সাথে কাটিয়ে আসত কয়েক ঘন্টা। ব্যর্থ আমি নি:সঙ্গ হয়ে বাসায় বসে সেই সময়টায় টিভি দেখতাম। হতোদ্যমভাবে। ডিভোর্স দিব কিনা চিন্তা করতাম প্রায়ই। সামনে শূণ্যতা, পেছনে শূণ্যতা। এমনই শুষ্ক খটখটে জীবনে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় আগমন ঘটল সুমনার।
পরিচয় হয়েছিল অফিসে। তার পাসপোর্ট সংক্রান্ত কী একটা কাজে। ঢাকায় থাকে একা। চাকরি করে সামলায় তার গ্রামের পরিবার। গ্রামে বেড়ে উঠলেও আচারে নেই গ্রাম্যভাব- এক ফোঁটা। কথাবার্তা হত সামান্যই। দরকারি কাজে। উপকার করেছিলাম সেজন্যেই বোধহয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এক দুপুরে। তার বাসায়। লাঞ্চ করবার জন্যে। সেই থেকে কী যে হয়ে গেল; তার ফ্ল্যাট তখন থেকে আমার নিত্য অবসর, আনন্দের জায়গা।
প্রথম প্রথম সে অস্বস্তিতে পড়ত। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছি দুজনের নি:সঙ্গতায় দুজনেই। তাই মিলির সাথে ডিভোর্সের চিন্তাটাও সরিয়ে ফেলেছি ক্রমেই।
ভাবি, বেশ তো আছি।
সে তার মতো।
আমি আমার মতো।
মিলি এসব খুব সম্ভবত জানে না। জানলেও আমার কিছু আসে যায় না। বিয়ের পর নারীসঙ্গের যে অভাব বোধ করতাম তা দূর হয়েছে অনেকখানি। তবে ভালোবাসা- এ ব্যাপারে আমি এখনও সন্দিহান। সুমনার সাথে আমার ভালোবাসার কোন সম্পর্ক নেই। সে কখনোই মন থেকে কোন কিছু খুলে বলে না। দৈহিক আবরণ খুলে ফেললেও মনের আবরণ সে কখনোই আমার সামনে উঠায় না। তার দিক থেকে আন্তরিকতার অভাব ছিল সবসময় বর্তমান। এক ধরণের আবেগশূণ্য সম্ভোগে সে আর আমি যেন নিয়মের চক্রেই আটকে গেছি। স্রেফ নিয়ম রক্ষার্থে, অভ্যাসের বশে পুন:পুন আমরা মিলিত হই। তাতে আমার সমস্যা নেই। সুমনারও না।
সুমনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছি। সে চুপচাপ আমার লোমশ নগ্ন বুকে মুখ গুঁজে একরকম নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে।
সুমনা, তুমি বিয়ে করবে না?
মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই বলল, করব না কেন?
কখন?
সময় হলে। তবে তোমাকে নয়।
গ্রামে ফিরে যাবে?
যেতে পারি। জানি না।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। দেখি মিলি। আমি অবাক হই। সাধারণত সে আমাকে কখনো ফোন করে না। আমিও করি না। প্রয়োজনীয় কিছু হলে, দরকার পড়লে মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দেয়।
আমি ওই অবস্থাতেই ফোন ধরি।
হ্যালো?
তুমি এখন কোথায়?
এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলি, কী দরকার সেটা বল।
বাসায় আসতে পারবে? কিছু জরুরী কথা আছে।
ফোন কেটে যায়। আমি উঠে যাই। বিছানায় সুমনাকে ফেলে। শার্ট গায়ে চড়াই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কলার ঠিক করি। আয়নাতে বিবস্ত্র অবস্থায় সুমনাকে প্রতিফলিত হতে দেখে হঠাৎ ভেতরে এক নির্নিমেষ হাহাকার জেগে উঠে। যেন কিছু একটা নেই। কিছু একটা থেকেও নেই। ঠিকই বুঝি যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না। জীবনের সরল সমীকরণে এ যেন এক ছেদ। কিন্তু এক চরম চক্রে আটকে গেছি। বের হয়ে আসা দুরূহ ব্যাপার।
সুমনাকে তার ঘরে রেখেই বেরিয়ে আসি ফ্ল্যাট থেকে। দরজা বন্ধ করে দিতে বলি। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে এই মেয়েকে। আরো ভালো করে বললে তার নির্জীবতাকে। তার শরীরের খুঁটিনাটি জানি আমি। কিন্তু তার মনের হদিশ বিন্দুমাত্র পাই নি। তার মন, আবেগ বলে কিছু আছে কিনা তা নিয়েও মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে। অনেকবার ভেবেছি, এই মেয়ের সাথে আর একটা দিনও না। কিন্তু অভ্যাসের দাস হয়ে ক্রমাগত পরাজিত হই। আমরা দুজনেই।
ঘড়িতে সময় দেখি। বিকেল পাঁচটা।
এই সময়টায় মিলির সংস্পর্শে কখনো থাকি নি। সে রাত করে বাসায় ফিরে। তার প্রেমিকের গাড়িতে। কখনো এগারটা, কখনো বারটা। এসে অন্য ঘরে বালিশ নিয়ে শুয়ে পড়ে। এই নারী এই সময়ে ডাকছে? তাও আবার আমাকে?
বাসায় পৌঁছে দেখি, ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে মিলি। সায়ান রঙের শাড়িটা কুঁচকোনো। চুলগুলো এলোমেলো। গালে হাত দিয়ে মাথা হেঁট করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
পায়ের শব্দ শুনে মিলি চোখ উপরে উঠায়। দুটো চোখে শূণ্যতা।
একটু বসবে?
আমি তার কথা শুনে সোফায় বসি। অনুমান করি খারাপ কিছু ঘটেছে।
আমি খুবই দু:খিত- থেমে থেমে বলে মিলি- তোমার সাথে বিয়ের পর থেকে খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি। তুমি মানুষটা ভালো বলেই এতদিন সব সহ্য করে রয়েছ। আসলে আমিই ভুল ছিলাম। উচিত ছিল তোমার জায়গাটা একটু বিবেচনা করে দেখা। তা না করে ক্রমাগতই তোমাকে উপেক্ষা করেছি। কয়েকদিন ধরে প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেছে আমার উপর। ভুলগুলো আমি শুধরাতে চাচ্ছি। নতুন করে শুরু করতে চাই সবকিছু। আমাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায়? প্লিজ?
তোমার প্রেমিক -? বিস্মিত আমি জিজ্ঞেস করি।
চলে গেছে। বাষ্পভরাট কন্ঠে মিলি বলে। (খেয়াল করি, আমার অনুমান মিলে গেছে।) শয়তানটা অন্য জায়গায় বিয়ে করে ফেলেছে। যাবার আগে আজ শেষবার আমাকে রেস্টুরেন্টে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করেছে। এতগুলো মানুষের সামনে অপমান করেছে। গালি দিয়েছে।
হু হু করে কেঁদে ফেলে মিলি। খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাই। পুরোনো বন্ধুদের প্রেমিকাদের এভাবে দু একবার কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু নিজের জীবনেই যখন সেটা দেখতে হবে- আশাতীত অবশ্যই।
পারভার্ট!
চমকে উঠি।
পারভার্ট বলেছে আমাকে শয়তানটা।
মিলি এমনভাবে কথাটা বলল তাতে যেন গালটা আমিই খেলাম।
একপর্যায়ে সে উঠে এসে আমার বুকের উপর পড়ে যায়। মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে তাদের সম্পর্কের শেষ কয়েকদিনের টানাপোড়নের কথা, বিশ্বাস, ভালোবাসার অন্তিম পরিণতির কথা। ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে থাকে। লাভার উদগিরণ ঘটতে থাকে। আমি ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিই। মিলি মনের আবরণ আস্তে আস্তে খুলে ফেলছে। আবেগের নগ্নতা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। না! মিলিকে কখনো আমি নগ্ন দেখিনি। দেখেছি সুমনাকে। কিন্তু এখন যে নগ্নতা মিলি দেখাচ্ছে তা যেন আরো উষ্ণ, আরো গভীর উত্তেজনার। এই উষ্ণতা সুমনা থেকে পাই নি। কখনো না। আমার ভেতরে একটা অস্বস্তি জমাট বাঁধতে থাকে। সুমনার ঘরে আয়নার সামনে থাকাকালীন বিমূর্ত হাহাকারটি আবার জেগে উঠে।
মিলিকে কি বলে দিব সুমনার কথা? বলব যে তার এই নগ্নহীন নগ্নতা সুমনার তুলনায় অধিক আকর্ষণীয়, অধিক আনন্দের?
২৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪