১
মানুষের সহ্যশক্তি আর কত থাকে! কখন থেকে বসে আছি, বাঁশের সেই লোহা-সদৃশ শক্ত ছিপটা নিয়ে। না, কাউকে পেঁদানোর জন্য না। আমাদের গ্রামের ছোট নদীর বড় কিনারে- “ছিপের বড়শি নিয়ে বসে আছি”! সেই সক্কাল বেলা থেকে বসে আছি, এখন অব্ধি একটা মাছও ধরতে পারলাম না। নির্ঘাত সেই শকুনির জন্য! “শকুনি” কে…? “শকুনি, মণ্ডল বাড়ির স্বপন কাকুর মেয়ে” নাম ঊর্মিলা, ছোট বেলা থেকে দু’জন এক সাথে বড় হয়েছি। আজকে একটু কলহ হয়েছে ঊর্মির সাথে। হবে না, কত বার বলেছি- আমি তোর তিন বছরের বড়, দাদা ডাকবি। সে বলে কিনা পারবো না! সোজা নাম ধরে ডেকে সকালে মস্তক খানা ঘুরিয়েছে। সে কী আবদার- এই “রমাকান্ত” কদম রঙ্গন একখানি পেড়ে দে না। সকাল-সকাল কে গাছে উঠতে চাইবে? সোজা পারবো না বলে দিলাম। অতঃপর সে কী কামড়…! উফ্ঃ এখন পর্যন্ত সে ব্যথা বাঁ-হাতের কনুই পাশে টনটন করছে। আমিও আর দেরি না করে হাতের কাছে পড়ে থাকা শুকনো লাটি খানা দিয়ে এক ঘা লাগিয়েছি।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে আমার। ঊর্মির সাথে এরূপ ব্যবহার প্রয়োগ করা উচিৎ হয়নি। জানি এতক্ষণে বিচার চলে গেছে বাড়িতে। আজ শ্রদ্ধেয় বাবার কাছে পিটুনি অনিবার্য! তবু বাড়ি তো ফিরতে হবে, সন্ধ্যা গড়িয়ে এসেছে। কিছু মাছ ধরতে পারলে ভালো হত, এর আগে তো আর বড়শি নিয়ে মাছ ধরিনি। তাই অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। কত বার বড়শি টান পড়েছে, কিন্তু মাছ মহাশয় বড় চালাক, ধরা দেয় না।
বাড়ি ফিরতে শুরু হল প্রথমে বকানো, তারপর পেঁদানো। জানতাম, বাবা আমায় না মেরে ছাড়বেন না। পরে অবশ্য জানতে পারলাম ঊর্মির জন্য পিটেনি, পিটেছে মাস্টার মশাই বিচার দিয়েছে বলে। আজকে পাঠশালা যাওয়া হয়নি। মেজাজ খানা গরম দেখিয়ে অন্নপ্রাশন করে সেই রাত্রি গভীর নিদ্রাবেশ হয়েছে। পরেরদিন ঊর্মির সাথে দেখা করে মাফ চাইবো, তবে সে আগে থেকে আমার সহিত ক্ষমা প্রার্থনা করল! আমিও অবশ্য মুহূর্তে মাফ চেয়ে নিয়েছি। পাঠশালা শেষে মন্ডল বাড়ি গিয়ে ঊর্মির সাথে বর-বউ পুতুল খেলা খেলেছি, এতো আমাদের নিত্যদিনের কাজ। সেই দিবা আমি আর ঊর্মি বহু ঘুরেছি, খেলেছি, কদম ফুলের আবাদার মিটিয়েছি ঊর্মিলার। “রমাদা আমি যাই, বেশ বেলা হয়েছে”। আহ্ ঊর্মির মুখে রমাদা ডাক খানা আমি আবার শুনলাম, প্রায় বহু দিন পর। “যাবি, তবে যা।” ঊর্মি মৃদু পায় আস্তে-আস্তে প্রস্থান করছে। “ঊর্মি শোন!” কিছু বলবে রমাদা? “না..., থাক আরেকদিন বলবো।”
সেই দিন ঊর্মি চলে গেল। সে হয়ত বুঝে আমার বলবার কী আছে! কিন্তু...।
২
প্রায় কিছুদিন এভাবে আমাদের কৈশর কাটিয়ে যৌবন যাপিত হল। এখন বুঝতে শিখেছি। ঊর্মির সাথে আলাপন এখন খুব কম বললেই চলে। দীর্ঘ কয়েক বৎসর ধরে আমার না বলা ক্ষুরধার কথাটি বলতে চেয়েছি! “বলতে চেয়েছি- তোকে খুব ভালোবাসি ঊর্মি”। আগে ঊর্মিলা এসবে শ্রেয় দিলেও এখন অনেকটা পালটে গেছে। আগের মত আর মিলমিশ থাকতে চাই না। একসাথে বাড়ির উঠোনে পুতুল খেলার সব স্মৃতি গুলোই মরিচা ধরেছে হয়ত। এখনো অবশ্য রমাদা বলে সম্ভোধন করে। তবে সেটা “দা” পর্যন্ত! এর বেশি কিছু আর ভাবে না উর্মিলা, আমি সেটা বেশ ভালো বুঝি। তবে ইদানীং ঊর্মির মুখে রমাদা ডাক শুনতেও ভালো লাগে না! “দা” বর্জন করে রমাকান্ত ডাকলেই বোধহয় আমোদ পেতাম।
বাড়ি থেকে বাবার কড়া আদেশ, আগামিকাল শহরে যেতে হবে। একমাত্র কাকা শহর থেকে পত্র পাঠিয়েছে। লেখাপড়া বেশিদূর হয়নি, তাই এখন আমার ঘরে বসে থেকে কাজ নেই। দুইটা পয়সা-কড়ি পুঁজি করলে সংসারে কিঞ্চিৎ হাত বাটানো হবে। বাবাও এই বৃদ্ধ বয়সে কেরানির চাকরি করে আর কত...। পরিস্থিতি ভালো ঠেকে না দেখে আমিও শহরে অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে পরেরদিন রওনা দিলাম। তবে শহরে আসার আগে ঊর্মির সাথে একবার দেখা করেছিলাম। কত হাজার ভাব-ভঙ্গি করলাম, তবু সে যেন বুঝেও কিছু বুঝলো না। কিছু একটার ভয় তাকে বেশ কিছুদিন ধরে পেয়ে বসেছে। “কী সে ভয়?” জানার অনন্ত বাসনা আমার। কিন্তু সে কিছু বলে না। শহরে যাওয়ার আগে শেষ বেলায় তার টানা-টানা দু’টি চোখের দিকে এক পলক তাকালাম। আগে থেকে বেশ সুন্দর হয়েছে ঊর্মি! রূপে ভরপুর এক রাধিকা মূর্তি যেন। কিন্তু আমার লোভ-বাসনা সব যেন অন্তরঙ্গের, তার সেই অপরূপে আমার যেন সামান্য টুকু কামনা নেই। এখন মাঝে মাঝে থমকে যায় ঊর্মিলার এরকম আচরণে, কিছু একটা সে আমার থেকে গোপন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ দুই মাস আগেও যেন দিনে একবার আমায় না দেখে থাকতে পারতো না। আমিও আর বিশেষ কোন জোর দেয়নি। মনের গহীন থেকে অস্ফুট ভাবে গর্জে উঠা সেই কথাটি, এই ক্ষণস্থায়ী বিদায়বেলায় ও বলতে পারিনি। “বলতে পারিনি- ঊর্মি ‘রে তোকে খুব ভালোবাসি”।
৩
শীতের বেলা, সূর্যটা উঠেছে কিনা বুঝা মুস্কিল। বেলা সাড়ে-এগারোটা বাজে এখনো রবি মামা আকাশের মেঘের ফাঁক থেকে একটু-আধটু উঁকি মারছে, পুরোপুরিভাবে এখনো সজাগ হয়নি। মা-বাবা, স্বজনদের ছেড়ে দুটো পয়সার জন্য এই শহরে আসা। সকালবেলা গ্রামে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়েছি। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর এসে পৌঁছালাম। উর্মিলার সাথে শেষ আলাপের মুহূর্ত টুকু বেশ মনে পড়ছে। মেয়েটা সত্যি অল্পদিনে এতটা পালটে যাবে, আমার কল্পনার বাইরে ছিল। তবু নিয়তি কি মানুষে খণ্ডাতে পারে? যা হবার তা হবেই। এসব ভাবতে ভাবতে কাকার বাসায় এসে পৌঁছলাম। পরিবার সমেত তারা এখানে “শহরে” আছে। কাকাত ভাই কাঞ্চন এসে বুক মিলিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে। বয়সে আমার এক বছরের ছোট হলেও আমরা বন্ধুর মত বড় হয়েছি শৈশবে। তাই একটু বন্ধুভাব বলা যায়। কাকার আদেশ মত সেদিন ঘরে ছিলাম। পরেরদিন কাকা একটা কাজ যোগাড় করে দিল। কাজটা কিসের, কাকা নিজেও জানে না! মাসে চারশো টাকা বেতন। কাজে যোগ দিতেই একজন সহকর্মী কাজ বুঝিয়ে দিল। সকালে অফিসের কর্মীদের চা বানিয়ে দেয়া, ফাইল পত্র এই টেবিল থেকে ঐ টেবিল, ঐ টেবিল থেকে এই টেবিল নিয়ে আসা-যাওয়া করা, এই আমার কাজ।
এভাবে আমার দিন কাটছে তো কাটছে। অফিসে কাজ সেরে কাকার বাসায় এসে এখানেও আমাকে ঘরের কাজ করতে হয়। এমনি এমনি তো বসে বসে খাওয়াবে না। আমাকে কিছু না বললেও কাকিমার চিৎকার চেঁচামেচি রাতবিরেত শুনতে পাই- “কাকার সাথে সে কী ঝগড়া”। কাকা-কাকিমা সারাদিন বাইরে থাকে। দুই জনেই কিসের চাকরি করেন জানি না। বিকেলে যাও একটু সময় পাই কাঞ্চনটাও ঘরে থাকে না। খুব ব্যস্ত মানুষ তারা। এই বিকেলে সঙ্গী হিসেবে ঊর্মিলার সব স্মৃতি! আর রবি-ঠাকুর এর একটি কাব্যগ্রন্থ- “সোনার তরী”।
আজ রবি-ঠাকুরের একটি কবিতা বেশ বারবার করে পড়ছি, সব পুরনো স্মৃতি যেন আবার নতুন করে আস্কারা পাচ্ছে!
“আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি।
………”।
৪
দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে গেল। ইতিমধ্যে গ্রাম থেকে ঊর্মিলার একখানা পত্র এসেছে। অফিসের কাজ, বাড়ির কাজ শেষ করে বিকেল বেলায় পত্রখানা নিয়ে বসলাম। পত্রটির প্রতিটা ভাঁজ ধীরেধীরে খুলছি আর ভাবছি- ঊর্মিলা কী লিখতে পারে। ঘরের আঙিনার পাশে বাতাবি লেবুর গাছে দু’টি চড়ুইপাখি বেশ কলকলিয়ে যাচ্ছে, তাদের এই কলকলানি শুনতে যেন মনটাও উৎসুক হয়ে আছে। অবশেষে পত্রখানা খুললাম—
প্রিয় রমাদা,
কেমন আছ? আশা করি ভালোই আছ। নতুন পরিবেশে গেছ, আমাদের মত গ্রামের মেয়েদের আর কী খবর রাখবে। তবে বিশ্বাস করো রমাদা তোমায় এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি। যাক সেসব কথা। যে কারনে পত্র লিখলাম- আসছে পৌষ মাসে আমার বিয়ে! কী চমকে উঠলে?। আমি জানি তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি রমাদা, বিশ্বাস করো। তুমি চলে গেলে, কিন্তু তুমি যাওয়ার পর থেকে একেকটি রাতের জ্যোৎস্না মাখা প্লাবন যেন আমার একাকীত্ব বিরহ পবন হয়ে উঠেছে। ভাবছো এসব কেন বলছি? ভাববার কিছু নেই। এসব কথা আজ শুধু মূল্যহীন মুদ্রার মত। তবু নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আচ্ছা রমাদা তোমার কী অমল কাকার ছেলে মোহনকে মনে আছে? ঐ যে ছোটবেলায় পাঠশালাতে তুমি যাকে মেরেছিলে! আমার কিন্তু আজো মনে আছে। আমার মাথায় গুটি-ঘাত করেছিল মোহন, রক্ত ঝরছে তো ঝরছে। তারপর তুমি মোহনকে কী মারটাই না মারলে। কিন্তু আজ দেখ- সেই মোহনের সাথে আমার বিয়ে। রমাদা আমি বাবাকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি- যে আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু তুমি তো জানো- “জাতি” এই জাতি ভেদাভেদ টুকু বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমাদের মাঝে। রমাদা তুমি কেন একটি বার বললে না- “ঊর্মি তোকে খুব ভালোবাসি!” তারপর দু’জন দূর বহুদূর পালিয়ে যেতাম। তাহলে আজকের এই বাধার মুখোমুখি হতে হত না। তুমি বলে দাও রমাদা আমি এখন কী করব? আমিও তো তোমায় অনেক…; জানো রমাদা মাঝেমাঝে ভাবি ভালোই করেছ, না হয় আবার কোন মোড়ে ঘুরে যেত দিক। যাই হোক এটা আমার লেখা তোমার কাছে প্রথম পত্র, হয়ত শেষ…! তুমি কিন্তু বিয়েতে চলে আসবে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়। আর পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও, ক্ষমা করে দিও বলছি কারণ আমার বিয়ের কথা আগে থেকে জানতাম। কিন্তু কোন এক অজানা ভয়ে তোমাকে বলতে সাহস পায়নি। পারলে একটা পত্র দিও।
ইতি,
তোমার ঊর্মি।
৫
রমাদা…; আরে ও রমাদা! “কে? ও কাঞ্চন। কখন এলে?” সেই কখন থেকে ডাকছি কোথায় হারিয়ে গেছিলে বলো তো? “না কোথায় আর হারাবো, এই যে সামনে পাখি দু’টো কলরব তুলছে তা দেখছিলাম।” ঠিক আছে আর দেখতে হবে না, মাথা কি গেছে? নাকি…। এখানে এই সন্ধ্যাবেলায় পাখি কই পেলে? তবু বলছি তোমার পাখি দেখা হয়ে গেলে ঘরে এসো বাবা ডাকছে। “ঠিক আছে তুই যা, আমি আসছি।”
সত্যিই তো সন্ধ্যা হয়ে গেল। চোখ দুটোও লাল হয়ে আছে, হয়ত আমি কেঁদেছি। কিন্তু আমি কী ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? না; আখি-মেলে কেউ নিদ্রা যাপিত করে। ডান হাতে এখনো ঊর্মির লেখা পত্রখানা আছে। জানি এই পত্র আমার ঊর্মি কখনও চোখেরজল ঝরানো ছাড়া লিখতে পারবে না। এতো পাষাণ সে নয়। “জাতি” আমরা না হয় বংশীয় ভাবে নিচু জাতি, তাই বলে ভালোবাসার অধিকার নেই।
কী করব ভাবতে-ভাবতে বাইরে থেকে ঘরে এসে ঢুকলাম। ঢুকতেই কাকা বলতে লাগলো- বাড়ি থেকে পত্র এসেছে। মা-বাবা নাকি খুব কাঁদছিল। আমায় যেতে বলেছে, কাঁদবে না কেন? কতদিন বাইরে আছি একটু দেখতে ইচ্ছে তো করবেই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার কষ্টটা বুঝবার মত কেউ রইল না। তবু কাকুকে বললাম— “ঠিক আছে যাব”।
সেই রাত্রি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আর নিদ্রার আগমন হল না। ঘরের ছাদের উপর উঠে আসলাম। বাহ্! চাঁদ খানা আজ মুচকি হাসছে, যেন আমার ঊর্মিলা আমার দিকে বাঁকানো ঠোটে ইশারা করছে…। সমাজের গহীন ভাবনায়, মনুষ্যের প্রবল আইন-কানুনে যেন বাধা পড়ে আছি। কী মনোরম সুদিন গুলোই না ছিল আমার। তবে আজকে হঠাৎ বিরহ মালা গলাই ধারণ করেছি মনে হচ্ছে। দিবাতে কত সুন্দর ছোঁয়ার বাইরের দূরের ঐ নভোঃ টকটকে লাল রবির কিরণতরঙ্গে যেন নীল রঙ বিমোহিত! শুধু এই অন্ধকার- রাত্রিতে কালো হয়ে আছে। আচ্ছা রাত্রি তো অসমাপ্তিজ্ঞাপক নয়, ফিরে ফিরে আসে দিবা। তবে আমার ও কি পুনরায় ফিরে আসবে সেই সব দিন গুলি!? জানি এই সব ভাবনা মাত্র, সমাজের বেড়াজালে আটকানো সেই জাতিভেদ কখনো শুধরাবে না। আজকের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু ঊর্মিলাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে! ইচ্ছে করে বলি— “সত্যি কি তুমি আমায় প্রেম দিয়েছিলে? নাকি জ্বলন্ত-অনল-বিরহে ঠেলে দিলে”।
৬
সপ্তাহ খানেক পর গ্রামে চলে এলাম। কয়েক মাসের ব্যবধান, মনে হচ্ছে যেন এক যুগ বাদে ফিরলাম। মা-বাবা স্বজন সবাই ভালোই আছে। আমিও তাদের “কেমন আছিস বাবা” প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ বললাম- বেশ আছি। তবে কত যে যন্ত্রণা উইপোকার মত বাসা বেঁধেছে কাউকে বুঝতে দেয়নি। ঊর্মিটা কীরকম আছে কে জানে! আমার আসার খবর এতক্ষণে সে পেয়ে গেছে। কেননা আসার সময় রাস্তায় স্বপন কাকার সাথে দেখা হয়েছিল। তবে ঊর্মি এখনো আসছে না কেন? হয়ত বিব্রত, সংকোচ বা ভয়। জানি এ আর তেমন কিছু নই। এসেই কানে খবর আসলো আজকে ঊর্মির গাঁয়ে হলুদ! বড্ড হাসি পাচ্ছে, বেদনার হাসি? নাকি...।
কয়েক বছর আগের দিন গুলি বেশ মনে পড়ছে- সেই রমাকান্ত ডাক, কদম ফুল পেড়ে দেওয়ার আবদার, চড়ুইভাতি, বর-বউ খেলাটা খুব বেশিই...। চণ্ডিদাস হতে মনটা বেশ উৎসুক হয়ে আছে। বাকি একরাত্রি শুধু, কালকে ঊর্মির বিয়ে, অথচ এখনো তার সাথে আমার দেখা হয়নি। বড়শিটা নিয়ে আবার সেই ছোট নদীটির কিনারে গিয়ে বসলাম! মাছ ধরতে? নাকি দুঃখ বিলাতে, জানি না। আজও আর মাছ ধরা হল না। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে, তবে আজকে বাড়ি যেতে আর ভয় লাগছে না, বাবার পিটুনিও আর পড়বে না। শুধু একটি বিচ্ছেদ রজনীর জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। এই রাত্রি যদি অফুরন্ত হত! তা তো হবার নয়। প্রকৃতি জুড়ে নিঃশব্দতার বিলাপ, প্রকৃতি সারা আস্তে আস্তে নিশিতে নিদ্রারত হচ্ছে। শুধু আমার নেত্র হতে উধাও- নিদ্রা নামক আজকের জীর্ণ বস্তুটি।
৭
রাত প্রায় অনেক হল, বিছানার এপাশ-ওপাশ করছি, ঘুম কিছুতেই আসছে না। আহ্! চিনচিনে ব্যথা লাগছে বুকের মধ্যাংশে। এই রাত যদি শেষ না হত। এই একরাত্রি যদি যুগ-যুগান্তর বেঁচে থাকত। রাত বেশি হয়নি, বড়জোর নয়টা! তবু চারিদিক নিস্তব্ধ। জানালা খুলে দিলাম- শীতের কনকনে হাওয়া আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জুড়ে হালকা শীতের উপস্থিতি বেশ টের পাওয়ার মত। সব লোম খাড়া হয়ে গেল মুহূর্তে। টেবিলের উপর থেকে ডায়েরী-কলম, আর আলনা থেকে চাদর খানা নিয়ে- চাদর গাঁয়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শীতের হাওয়াটা মোটামুটি গাঁয়ে লাগার মত। এই ধরনের বিরহ মাখা রাত গুলো নাকি বেশ কবিতা লেখার মৌসুম হয়ে থাকে। হাঁটতে-হাঁটতে একবার ভাবলাম মন্ডল বাড়ির দিকে যাওয়া যাক। ঊর্মির সাথে এখনো দেখা হয়নি। ঘরের দুয়ারে কুকুর দু’খানা লেজ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু ভয় হলেও বুকে সাহস নিয়ে ঊর্মির কামড়াই কড়া নাড়ালাম। “একি রমাদা তুমি”? হ্যা ঊর্মি আমি। তুই এত পাষাণ হয়ে গেলি কী করে রে? একটি বার আমার খোঁজ খবর নিলি না। “রমাদা তুমি বুঝতে পারছো না, কাল আমার বিয়ে। ঘর থেকে বেরুতে দিলে তো…! তুমি এখন যাও রমাদা। লোক জনের কানে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।” হোক, আমি পরোয়া করি না। এই একরাত্রি নাহয় কলঙ্কিনী হয়ে যাবে! “তুমি বুঝতে পারছো না রমাদা, বোঝা তো আমার বয়ে বেড়াতে হবে!” বাহ্! বাহ্ঃ বাহ্ঃ কী সুন্দর করে বলে দিলি ‘রে তুই ঊর্মি। বোঝা; আমার ভালোবাসা তোর এখন বোঝা মনে হয়। “রমাদা বড্ড দেরি হয়ে গেল, আমাকে ক্ষমা করে দিও! তুমি খুব ভালো থেকো। এখন যাও দয়া করে।” যাবো, তবে আমার একটা শেষ আবদার রাখবি বল? “কী”। আমার সাথে নদীর পাড়ে যাবি!? “এখন এই রাতে?” হ্যা এই ক্ষণে! “না; পারব না। একটু বুঝার চেষ্টা ক’র, কাল আমার বিয়ে...।” ঠিক আছে, যাচ্ছি, তুই সুখে থাকিস, গেলাম...।
পথে উদাসীনতা হয়ে বেশ লাগছে আমার। ভাবতে অবাক লাগছে- আমার ঊর্মি কী রকম পালটে গেছে। সত্যি… খুব পালটে গেছে। রাত বার’টা হবে হয়ত এখন। সময়টা স্বল্পস্থায়ী হয়ে যাচ্ছে ধীরেধীরে। প্রিয় নদীটির দিকে চলতে লাগলাম, এই ক্ষণে শান্তি নিকেতন জায়গা শুধু সেই জায়গা খানি। চন্দ্রিমা নিঝুম রাত চলতে ভালোই লাগছে। ওইতো দেখা যাচ্ছে দূরে—
“অন্ধকারে কেমন মিতালী
মৃত্তিকা আর গগনে,
পৃথক শুধু আমি
এই নিশিতে, এই ক্ষণে।”
নদীটির ধারে বসে আছি এখন। আমার স্বপ্নের স্থান, ছোটবেলায় বেশ সময় পার করেছি বড়শি নিয়ে। এখন হাতে বড়শি না থাকলেও অক্ষত ডায়েরী আর কলম খানা আছে। চাঁদ নেমে এলো নদীর জলে, ঐ কলঙ্কিনী চাঁদ ও আজ আমাকে দেখে হাসছে। এই চাঁদ তো বিধাতার সৃষ্টি, ছাড়বো না! আজ সব কিছু নিয়ে লিখবো। ঐ চাঁদকেও ছাড়বো না।
“চাঁদ—
তুই স্বাধীন; মূলকথা!
কলঙ্কিনী বলে তোর যত ব্যথা।
তবু তুই মুক্ত; দেবতার গগন নীড়ে,
জ্যোৎস্না নামের হাজারো প্রহরী' ভীরে।
কলঙ্কিনী সদৃশ তোর পূর্ণ দাগ
তবু কেন সদা থাকিস নির্বাক?
সহস্র প্রাণের কেন তুই এত প্রিয়?
এতো দেবতার দান; তাইতো তুই পূজনীয়।”