নিরালায়

প্রেম (ফেব্রুয়ারী ২০১৭)

শিল্পী জলী
  • 0
  • ৪৪
রঞ্জনা সবে পনেরতে পা দিয়েছে। চঞ্চলা হরিণীর মত সকাল-সন্ধ্যা ছুটে বেড়াতো আমাদের বাড়ীর আশপাশ দিয়ে। আমাকে দেখলেই কেমন থেমে যেত তার ছুটোছুটি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতো মাথা গুজে নীচের দিকে তাকিয়ে, আর পা দিয়ে মাটি ঘষতো । কোন প্রশ্ন করলে কেমন ঠোঁট কেঁপে উঠতো তার। গলা দিয়ে কোন সাড়াশব্দ বেরুতো না। আর কাছে যেতেই ছুটে পালাতো।
এক সন্ধ্যায় নির্জনে পেয়ে ধরে ফেলি তাকে। অমনি লুটিয়ে পড়ে সে আমার বাহুতে। প্রাণহীন একটি শরীর, নিজের ইচ্ছে বলে যেন কিছু নেই। অসাড়। কেমন থড়থড় করে কাঁপছিল। চোখ দু’টি বন্ধ । মনে হয় বেহুশ অবস্হা। তাকে ছুঁতেই কেমন বিদ্যুৎ খেলে যায় আমার শরীরে। শিহরণ জাগে প্রতিটি কোষের কোণে। অচেনা এক ঝড় বয়ে যায় দেহে। কি অপূর্ব সুন্দর তার মুখটি । নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না আমি । ঠোঁটটি নেমে আসে তার ঠোঁটে। না কোন বাঁধা দেয় না সে। বাঁধা দেবার কোন ক্ষমতাই হয়ত তখন আর তার নেই। অবাধ্য হতে থাকি আমি। সময় বয়ে যায়। ভালোলাগায় ঢুবে যেতে থাকি আরও গভীরে। আরও নিবিড় হয়ে। সে যেন এক অনন্ত কালের যাত্রা। জীবনে প্রথম একটি নারী দেহকে ছুঁয়ে দেখা। একেবারে বেসামাল অবস্হা । কোন দিকে খেয়াল নেই। তার শরীরটি আরও মিশে যেতে থাকে আমার শরীরের সাথে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আমার, অন্ততকালের সে আলিঙ্গন। অসীম নির্ভরতায় সে তখন আমার বুকে ।
বাবা বাসিত ! টিচার এসেছে, পড়তে আস-- মা ডেকে ওঠেন।
মায়ের ডাকে সন্বিৎ ফিরে পাই। রঞ্জনা তখনও লুটিয়ে আছে আমার বাহুতে সম্পূর্ণ ওজন সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে। অচেতন অবস্হা। ললাটে কয়েকগোছা চুল লেপটে আছে তার । চোখের পাতা দুটি কেমন ভেজা ভেজা। মন চায় না ছেড়ে যেতে। মনে হয় অনন্তকাল ধরে রাখি।
মা আবার ডাকেন—বাসিত!
যদি আবার চলে আসেন। ঝটপট তাকে দেয়ালের পাশে শুইয়ে দিয়ে ঢুকে যাই ঘরে। বুকের মধ্যে কেমন ধুক ধুক করছে তখনও। মনে হচ্ছে, কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে। বাথরুমে ঢুকে দ্রুত চোখেমুখে পানির ছিটা দেই। এসে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসি। মন আর বসে না পড়াতে। ঘন্টা দেড়েক পর ফিরে গিয়ে দেখি সে আর নেই। কখন হয়ত উঠে চলে গিয়েছে। কতই বা বয়স তখন আমার—হয়ত সাড়ে পনের।

একাদশ শ্রেনীতে ভর্তির আয়োজন চলছে।
পড়ালেখায় বেশ ভালো আমি। আমাদের আর্থিক অবস্হা ভালো। দেখতে একহারা লম্বা আমি, মাথা ভর্তি ঘন, কাল, সিল্কি চুল। চেহারা একেবারে পশ্চিমা হিরোদের মত। নীল রঙা চোখ। মায়ের অগাধ আদরে ডুবে থাকি আমি। কাজের মধ্যে কাজ শুধু নিয়মিত পড়ালেখা করা। ওতেই মা খুশী। কিছু না চাইতেই মোবাইল, বাইক, এবং ব্রান্ডের পোষাকে ভরে থাকে আমার ওয়ারড্রব। বন্ধুমহলেও সবাই বিশেষ কদর করে চলে। কেউ কেউ আবার ঈর্ষার চোখে তাকায়। মেয়েদের মন পেতে বন্ধুরা যেখানে নানা বাহানা খোঁজে, নানা কাঠখড় পোড়ায় আমার সেখানে কোন বেগই পেতে হয় না। মেয়েরাই বরং আমাকে কেমন চোখে চোখে রাখে। পাড়া-মহল্লা, স্কুল-কলেজ, বা মার্কেটে চলার পথে অনুভূব করি, তরুণীদের উৎসুক নয়নে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা । সে এক অন্যরকম অনুভূতি। যেন না চাইতেই বর্ষণ। তবে সামনা সামনি মেয়েদের আগ্রহ বুঝেও না বোঝার ভান করি আমি। ওতে লোক জানাজানির সম্ভাবনা বেশী।
আজকাল বাসাতেও চিঠি আসতে শুরু করেছে। অচেনা মেয়েদের সব চিঠি। কিছু চিঠি পড়ি, কিছু আবার পড়ি না। তবে ভালো লেগে গেলে দু’একটির উওরও দেই। সে কত রকম প্রতিশ্রুতি, ভবিষ্যত নিয়ে কত স্বপ্নের কথা। কিছুই সিরিয়াসলি নেই না আমি। একটিই কথা আমার—জীবন যখন যেমন তেমনই বাঁচো। একটিই জীবন, জীবনকে উপভোগ করো।
একবার একটি চিঠি পেয়েছিলাম। মেয়েটি লিখেছে, আমি নাকি তার প্রথম প্রেম। এ জীবনে আর সে আমায় ভুলবে না। লন্ডনে যাচ্ছে পরিবারের সাথে। অবশ্যই ফিরে আসবে-- সময় হলে ।
বন্ধুদের দেখাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে তারা। সবাই মিলে উওর দেই সে চিঠির। কথা রাখবো, তার জন্যে সাত জনম অপেক্ষায় থাকবো। সেও আমার প্রথম প্রেম।
মেয়েটিও উওর পাঠায় হাজারও প্রতিশ্রুতি দিয়ে, দশ পৃষ্ঠার। লিখেছে, ঘর বাঁধলে সে আমারই সাথে ঘর বাঁধবে, ফিরে আসবে, আজীবন থাকবে পাশে, আরও কত কি।
ঐ চিঠি পড়ে আমরা বন্ধুরা একে অন্যের উপর হেসে হেসে গড়িয়ে পড়ি। মেয়েটির নাম তিস্তা। একটু লাজুক স্বভাবের। সে স্কুলে যাবার পথে মাঝে মাঝে দেখতাম তাকে। অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকতো, কোন কথা বলতো না। যেন শুধু চোখে দেখেই প্রাণ ভরিয়ে নেবে।
রঞ্জনা ঐ দিনের পর প্রথম দু’দিন ঘর থেকে আর বের হয়নি। ভেবেছিলাম হয়তবা তার বাসা জেনে গিয়েছে। জানালো, জানেনি। সুযোগ পেলেই সে এখন যখন তখন বাসায় আসে। আমিও জড়িয়ে ধরি তাকে।কোন বাঁধা দেয় না। আগের চেয়ে অনেক সহজতা এসেছে তার মাঝে। এটাওটা নিয়ে আসে আমার জন্যে। সারাক্ষণ ঘিরে থাকতে চায় । দ্রুত বড় হচ্ছে সে।
আমার পড়া লেখার চাপ বাড়ছে। তত সময় আর নেই নষ্ট করার, রঞ্জনাকে বোঝাই। অবুঝ হতে চাইলে কথা বন্ধ করে দেই। তারপরও মাঝে মাঝেই রঞ্জনা বিয়ে করতে চাপ দেয়।
বোঝাই-- এখনই কেন ? আমিতো হারিয়ে যাচ্ছি না…. সময় আসুক…সব হবে। সে শান্ত হয়।
কেন যে মেয়েরা কাউকে ভালো লাগলেই বিয়ে করতে চায়, বুঝি না ! যেখানে প্রতিস্ঠিতই হয়নি সেখানে বিয়ের প্রশ্ন আসে কি করে? মনে হয়, মেয়েরা কি হাল্কা-- একটু আগ্রহ দেখালেই কেমন গলে যায়।
বন্ধুরা যেখানে বলে তারা মেয়ে পটাতে পারছে না আমি সেখানে বাহানা করে তাদেরকে দূরে রাখি। তবে সবাইকে না। যাদেরকে ভালো লাগে তাদেরকে আশা দিয়ে হাতে রাখি যেন আবার একেবারেই চলে না যায়। পড়ালেখায়ও তেমন কোন ক্ষতি হয় না আমার। কারণ কারও ব্যাপারেই সিরিয়াস নই আমি । যে যতটুকু কাছে আসে ঠিক ততটুকুই কাছে টানি তাকে। তাদের বলারও কোন পথ থাকে না যে আমি কাউকে বাধ্য করেছি।
এর মধ্যেই কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। রঞ্জনারা চলে গিয়েছে অন্য শহরে। তার বাবার বদলীর চাকরি ছিল। যাবার আগে ফোন করে অনেক কেঁদেছে। বলেছি, এখনতো পড়ালেখার সময়। পরীক্ষা সামনে, ভাগ্যে থাকলে অবশ্যই হবে।
বেগ পেতে হয়েছে তাকে শান্ত করতে। বিশ্ববিদ্যালয়েও উৎসুক মেয়েদের অভাব নেই। তবে কারও ব্যাপারেই আমি এখনও সিরিয়াস নই। এই চব্বিশ বছরের জীবনে কত মেয়ে যে জীবন দিতে চেয়েছে তারও কোন হিসেব রাখিনি? তবে, মাঝে মাঝে কাউকে একটু বেশীই কাছে টেনেছি । আমার শান্ত এবং নীরব ভাব দেখে অনেক মেয়েই কেন যেন ভেবেছে আমি তার জন্যে আজীবন অপেক্ষা করবো। কেন যে এত অবুঝ !
একটি মেয়েকে একটু আধটু দেখা আর তার সাথে ঘর বাঁধা দু’টো কি কখনও এক কথা হলো? আমারতো হিসেবই থাকে না কাকে, কখন, কোন কথা দিয়েছি ! এমনকি অনেকের নামও মনে রাখি না, অথচ...।
পড়া শেষে চাকরি পেতেই বিয়ে হয়ে যায় আমার। বাধ্য হয়েই করতে হয়। বউয়ের একটিই কথা, হয় বিয়ে করতে হবে নয় মরে যাবে সে। প্রথম প্রথম সম্পর্কটি আর দশটা সম্পর্কের মত হালকাভাবেই নিয়েছিলাম। কিন্তু বিষয়টি সিরিয়াস হয়ে যাওয়ায় বিয়ে না করে আর উপায় থাকে না। দু’পক্ষেরই অভিভাবকরা চেপে ধরেছিলেন। আর না করিনি।
সেদিন তিস্তার সাথে আবার যোগাযোগ। ফেসবুক ঘেঁটে খুঁজে বের করেছে। বার বার জানতে চায় তাকে এখনও মনে আছে কিনা? আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি মনে আছে কিনা? আসলেই ভালোবেসেছিলাম কিনা? তার উৎসাহ দেখে অবাক হই । কেমন আগ্রহ জাগে তাকে আরও একটু জানার। কখনও সামনা সামনি কথা হয়নি। সে যেমন আমার পরিবারের কথা জানে না আমিও তার পরিবারের কথা জানি না। বলি, দেখা হলে সামনা সামনি সব কথা হবে! তারপরও সে বার বার জিজ্ঞেস করে তাকে সত্যিই ভালোবাসতাম কিনা ? মনে নেই তখন কি লিখেছিলাম তাকে, চিঠিতে। বলি, কেন চিঠিতেইতো সব লিখা আছে—বিশ্বাস নেই ? আবার কেন জিজ্ঞেস করছো ?
দেখা হয় তিস্তার সাথে টিএসসিতে। প্রথমবার। সামনাসামনি। বান্ধবীকে সাথে নিয়ে এসেছিল । দেখে মনে হলো যেন কতদিনের চেনা। বান্ধবীকে আগেই সব বলে রেখেছে। জানায় এখন তার পড়ালেখা শেষ, বিয়ের সময়। তাই আমার সাথে যোগাযোগ হতেই বাংলাদেশে এসেছে। পরিবার ছেলে দেখতে চাইছে, আর সে আমার কথা বলেছে।
বলা হয় না আমি তার জন্যে অপেক্ষায় নেই। কোনদিনই অপেক্ষা করিনি। সে আমার কল্পনা নয়। আমার জীবনে তার কোন গুরুত্ব নেই, শুধুই একটি নাম। জানাতে পারি না আমার ঘর আছে, সন্তান আছে, চিঠির কথাগুলো কোন সিরিয়াস প্রতিশ্রুতি ছিল না-- শুধুই কথার কথা। কেমন ভয় ভয় করতে থাকে আমার, বাহানা করে চলে আসি বাসায়।
ভাবছিলাম, ফেসবুকে আবার হয়ত যোগাযোগ করবে সে। তখনই বুঝিয়ে বলবো তাকে আমার পরিবারের কথা, ছোটবেলার ছেলেমানুষীর কথা।
সে আর যোগাযোগ করেনি।
সেদিন নিউমার্কেটে রুমকির সাথে দেখা, তিস্তার বান্ধবী। জানায়, তিস্তার পরিবার যখন প্লান করছিল তার কাজিনের বন্ধুকে দিয়ে আমাদের বাসায় প্রস্তাব পাঠাতে তখনই তারা জানতে পারে,আগেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে ।
সব জেনে তিস্তা শুধু বলেছিল, ‘দুণিয়াতে এত মানুষ থাকতে যে কোনদিন ভালোবাসেনি তাকেই কেন ভালোবাসলাম ? এমন যেন আর কারও না হয় !‘ কিছু না বলেই লন্ডনে ফিরে যায় তিস্তা।
একটি ছেলে ও একটি মেয়ের গর্বিত পিতা আমি। ওদেরকে চোখে চোখে রাখি যেন কখনও ধরা না খায়।




আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম ।পাতায় আমন্ত্রন রইল।
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭
মনোয়ার মোকাররম সুন্দর গল্প ... চাওয়া -পাওয়ার অসম সমীকরণ ... শুভ কামনা ...
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ১১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪