নিলয় মায়ের ছেলে। বড় বেশী আদরের, বড় বেশী নেওটা । মা যেমন তাকে আগলে রাখেন, সেও তেমনি মায়ের কাছ ছাড়া হয় না।
মা ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘আহা ! আমার ছেলের চুলের ছিড়ি দেখ, যেন কাকের বাসা!’
ছেলে গাল ফুলিয়ে বলে, ‘হায় হায় কী বললে তুমি? তুমি জান না মা! আজকাল যে এটিই ফ্যাশান ?’
মা হেসে বলেন, ‘আমার সোনারচাঁদ ছেলের অতো ফ্যাশান লাগবে নাগো অত ফ্যাশান লাগবে না । তাহলে যে মেয়ের দল ভিড় জমাবে আমার রাজকুমারের পিছে। ভুলিয়ে নিয়ে যাবে ঐ দূর পরীর দেশে। তখন তাকে আমি কোথায় পাবো?’
বলতে বলতে মায়ের চোখ জলে ভিজে ওঠে, গলা ধরে যায়। তাই দেখে ছেলে মায়ের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কোল ঘেঁষে বসে। মা তখন পরম আদরে ছেলের মাথায় তেল লাগিয়ে দেন। চলতে থাকে তাদের খুনশুটি।
মায়ের যেমন ছেলেকে ছাড়া একটি ক্ষণও কাটে না, ছেলেরও তেমনি। মায়ের শাড়ি আইরণ করা থেকে শুরু করে অসুখবিসুখের যাবতীয় সেবা সেই করে। বাবা থাকেন দেশের বাইরে। তিন সন্তানের মধ্যে নিলয়ই বড়।
দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। নিলয়ও তেইশ বছরে পা রাখে। সে বাংলাদেশের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অতি ভদ্র স্বভাবের নিলয়ের পরিপাটি থাকতেই বেশী পছন্দ। পড়ালেখার খাতিরে আজকাল সে হলে থাকে। সপ্তাহ শেষে বাড়ি গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসে। টুকিটাকি সব কাজ করে দেয় যেন তার কোন অসুবিধা না হয়। মুগ্ধ চোখে মা ছেলেকে দেখেন। গর্বে তাঁর বুক ফুলে ওঠে। ভাবেন, এইতো সেদিনের ছেলে অথচ সব দিকেই কত নজর তার।
নেহা নিলয়ের সহপাঠী, স্বভাবে চঞ্চল। ভেবে কথা বলে না সে। হৈ চৈ করে, অকারনে হাসে, হেলেদ্যুলে চলে... কিছুকেই পরোয়া করে না যেন । যেমনি খেয়ালী তেমনি মেয়েলী স্বভাবও কম। টম বয়ের মত। তার ব্যবহার মিষ্টি। চলে ভিন্ন ছকে নিজের খুশীতে । কেউ ভাবে দেমাগি, কেউ বলে সুন্দরী , কেউ ভাবে সহজসরল, কেউ বা ডেঞ্জারাস বলে এড়িয়ে যায়। সে সাইকেল রেস করে।
দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলে আসে। সব বিভাগ গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। জয়-পরাজয়ের সাথে বিভাগের সুনাম জড়িত। রীতিমত হৈচৈ ব্যাপার। চারিদিকে চরম উওেজনা। নির্ধারিত হয় সাইকেল রেসে নেহা পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে অংশ নেবে।
সহপাঠীদের মধ্যে একমাএ নিলয়েরই সাইকেল রয়েছে। সকালে বিকেলে নিয়মিত অনুশীলন চলবে তারই সাইকেলে। অতি উৎসাহী সহপাঠী বন্ধুরা সাইকেলটির বাড়তি যন্ত্রপাতি খুলে ওজন কমিয়ে ফেলে যেন রেসের সময় সাইকেলটি হাওয়ার বেগে ছোটে। শুরু হয় কড়া অনুশীলন যেন জিততেই হবে তাদের !
নিলয় অনুশীলনরত নেহার বেপরোওয়া আচরণ চোখে অবাক হয়। নেহাও নিলয়ের কেয়ারিং আচরণ অবলোকন করে। দেখতে দেখতে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সহজতা আসে। আজকাল নিলয় ক্লাস শেষে নেহার বইপএ গুছিয়ে দেয়, এটাওটা খাবার নিয়ে আসে। নেহা তৎক্ষণাৎ খাবার মুখে দিয়ে গপ্ গপ্ করে খেয়ে ফেলে। ট্রাউজারে হাত মুছতে যেতেই নিলয় ঝটপট পকেট থেকে নিজের পরিপাটি রুমালটি বাড়িয়ে দেয়। মিষ্টি হেসে নেহা রুমালে হাত মুছে নেয়।
কেঁটে যায় বছর। অনার্স শেষ হতেই নেহার বিয়ের প্রস্তাব আসে। মায়ের অসুস্হতার কথা বলে জরুরী তলব পাঠিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ীতে। এক সহপাঠীর কাছে খবরটি শুণে নিলয় উদাস হয়ে যায়। বুঝে পায় না কী করবে সে?
নেহার সাথে চলতে চলতে এক ধরনের অভ্যস্হতা এসে গিয়েছে তার। তবে মা কষ্ট পাবেন সেই ভয়ে কোনদিন সে নেহাকে নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখেনি। সব সময় শুধু বন্ধুত্বই বজায় রেখেছে। অথচ আজ কি হলো ? এমনতো কখনও হয়নি আগে ? নেহার বিয়ের কথা শুণতেই তার মন হঠাৎ উতলা হয়ে উঠলো কেন ? তাকে হারাবার কথা ভাবতেই তার বুকের মধ্যে মোচড় দিতে থাকে। ভেবে পায় না কি করবে সে ? ছুটে যায় মায়ের কাছে।
দিনভর হাজার চেষ্টা করেও মাকে কিছুই বলতে পারে না সে। অস্হিরভাবে ঘরময় পায়চারি করে । খাওয়ায় রুচি নেই । ক্ষণে ক্ষণে বাথরুমে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে থাকে। চোখেমুখে পানি ছিটায়। রাতে অন্ধকার নামতেই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে । বলে ‘মাগো ! আমার সোনামা! তুমি কি জানো আমি যে নেহাকে ভালোবাসি ? ওর যে বিয়ে হয়ে যাবে, মা ! বাঁচবো কী করে ?’
কথাগুলো শুণতেই মায়ের হাতপা ঠান্ডা হয়ে যায়। দম আঁটকে আসে। অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেন না তিনি। অতঃপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, ‘তুমি কাউকে ভালোবাসো না সোনা ! বাসতে পারো না—তুমি যে আমার ছেলে। ঐ মেয়েই তোমায় ভালোবাসে। সেই তোমার এই সর্বনাশ করেছে।’ তারা মা-ছেলে দুজনে মিলে রাতভর কাঁদতে থাকে। এক সময় রাত পেরিয়ে ভোর হয়। সে রাতে তাদের আর কিছু খাওয়া হয় না।
নেহা বিয়ে না করেই ফিরে এসেছে। পরীক্ষা না দিয়ে বিয়েতে সে মত দেয়নি। ফাইন্যাল পরীক্ষা হতেই নিলয়ের বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান নেহাদের বাসায়। সহপাঠীর সাথে বিয়ে অপছন্দ থাকলেও ছেলেদের আগ্রহ দেখে বিয়েতে মত দেয় নেহার পরিবার। ভাবে এমন কেয়ারিং ছেলে হয়ত তারা পাবে না।
নিলয়ের বাবাকে কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে বিদেশে। তড়িঘড়ি করে বিয়ে হয়ে যায় তাদের। ছেলের মুখ চেয়ে বিয়েতে মত দিলেও নিলয়ের মা সামলে উঠতে পারেন না। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। এখনও যে তার ছেলের বিয়ের বয়স হয়নি। বাবা ছুটে যান তাঁকে শান্ত করতে। মায়ের এত কষ্ট দেখে নিলয়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় তার। বিয়ে বাড়িতে হৈ চৈ এর পরিবর্তে বিরাজ করে মৃতবাড়ির থমথমে ভাব। সেই সাথে মায়ের ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে ওঠা কাঁন্নার শব্দ যেন বয়ে আনে অশনি সংকেত, খান খান করে ভেঙে দেয় চারিদিকের নিস্তদ্ধতা।
বিয়ের পরের দিন ব্রেকফ্যাষ্ট খেতে বসে নেহা বুঝে উঠতে পারে না বাসায় আসলে কী হয়েছে ? সবাই কেমন যেন আড়ালে আড়ালে সরিয়ে রাখে তাকে। কেউ কেউ আবার গরম চোখে তাকায়। কেউ বা ঠেস দিয়ে এটাওটা বলে। নিলয়ও বিয়ের পর থেকে দূরে দূরেই থাকছে। কিছু সময় যেতেই বেখেয়ালি নেহাও বুঝে যায় সে আসাতেই বাড়ির এই পরিবেশ। ব্যথিত হয় সে। কিছুই আর ভালো লাগে না। তবুও আশা ছাড়ে না সে। ভাবে সময়ের সাথে সাথে সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। খাওয়া আর হয় না তার। ধুমায়িত চায়ের কাপটি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।
নিলয়ের মা টেবিলে খেতে আসেননি । শোকে একেবারে বিছানা পড়ে গিয়েছেন । নেহা চা নিয়ে যায় তাঁকে দিতে। তিনি চোখ বন্ধ রাখেন। ‘মা চা নিন’ বলতেই রেগে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। এটা ওটা ভাঙতে ছোটেন। নিজেকে মেরে ফেলতে চান। ভয়ে নেহার হাত থেকে কাপ পরে যায় মেঝেতে। ছেলেমেয়ে দৌঁড়ে ছুটে আসে । অবস্হা দেখে নিলয় বলে ওঠে, ‘আমি ওকে কখনও ভালোবাসিনি মা ! সে আমার সহপাঠী ছাড়া আর কিছুই নয়।’
নেহা একেবারে নীরব হয়ে যায় । ভেবে পায় না নিলয় কেন মায়ের অমতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল ? দায়তো ছিল না কোন!
বাবা বিদেশে যেতেই মা তার দিন দিন আরও বেসামাল হয়ে পরেন। মাকে খুশী করতে তখন নেহাকে মারধোর করা শুরু করে সে। কিন্তু অবস্হার উন্নতি হয় না। একদিন সকালে মা কান্না করতে করতে আত্মহত্যা করতে ছোটেন । ছেলেমেয়ে সবাই ছোটে তাঁকে বাঁচাতে। নেহা দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। লোক মুখে নেহা শোণে নিলয়কে দিব্যি দেয়া হয়েছে তার সাথে যেন সে আর কোন যোগাযোগ না রাখে। নিলয়ও মাকে ছুঁয়ে শপথ করেছে, ‘না ! কোন যোগাযোগ রাখবে না সে । কোনদিনই না l’ ওয়াদা ভাঙেনি সে। নেহাও আর খোঁজ নেয়নি কোন, ফিরেও আসেনি। ভেবেছে , ‘বউ গেলে বউ পাবে সে , মাকেতো পাবে না—কি হবে খোঁজ নিয়ে ?’
বছর খানেক আলাদা থাকার পর ডিভোর্স হয়ে যায় তাদের।
বিশ বছর পার হয়ে গিয়েছে। তাদের মাঝে আর কোন যোগাযোগ নেই।
ফেব্রুয়ারীর এক সকালে ফেসবুকে একটি মেসেজ আসে।
নিলয় লিখেছে, ‘ এই তের তারিখে মা মারা গিয়েছেন—কোন অভিযোগ থাকলে তাঁকে ক্ষমা করো, তুমি! পারবে তো ?’
মেসেজ পড়ে অনেকক্ষণ স্হির হয়ে বসে থাকে নেহা।
অতঃপর লিখে, ‘তোমায় খুব বেশী ভালোবাসতেন তিনি—বাবাকে দেখো।’
চোখ থেকে টপ্ টপ্ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে নেহার। হাতের পেছনে ঘষে চোখ মুছে নেয় সে । উঠে দাঁড়ায় পানি খেতে।
০৭ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
১১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪