এক ফাগুনের অপরাহ্নে।

ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৬)

সালমা সেঁতারা
  • 0
মেরির সুদৃঢ় আদর্শিক জীবনের চরম পরাজয় যেন ঘটে গিয়েছিলো সেদিন। প্রবাদ ছিলো দিবাস্বপ্ন, কিন্তু আজ যেন মেরির মনে হতে লাগলো সেদিনের ঘটনাটায় দিবাস্বপ্নই বাস্তবে রূপ নিয়েছিলো। ধারণা আর বিশ্বাসের এতোটা বাইরে থেকেও কি কুৎসিতভাবে পরিণতি পেয়ে গেল সন্তানের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আশা আর নিরাশার দোদুল্যমানতায় সে দৃশ্য আজ প্রায় সংসারের কড়িকাঠ ভেঙে অপসৃয়মান।

আজ আবার সেই পনেরো ফাগুন। ঋতুরাজ প্রকৃতিকে একেবারে ফুলে ফুলে ফুল্লরা করে খেলছে বৃন্দাবনি খেলা। মাতাল দক্ষিণায় ফুলকুমারিরা ঘোমটা খুলি খুলি করছে।

মরিয়ম বেগম ওরফে মেরি। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বাবা শিক্ষকতা করতেন। মধ্যযুগের দায়িত্ববতী নারীর কোলে জন্ম তার। যাঁরা একখানা মোটামুটি সচ্ছল সংসার, কর্মজীবী স্বামী, আত্মীয়স্বজন ঘেরা সংসারকে পৃথিবীর স্বর্গ বলেই বিশ্বাস করতেন। এমন পরিবারের চিন্তাচেতনা শিক্ষাদীক্ষার মানসিকতায় গড়া মেরির জীবনও কেটে যাচ্ছে এভাবেই। এইসব নারীর কাছে বিজ্ঞানের তথ্য প্রযুক্তি অত্যাধুনিকতাই স্বয়ং হার মেনেছে। কেড়ে নিতে পারেনি øেহ প্রেম দাম্পত্যের মতো আবেগ কে।

সেই মেরির পঞ্চাশ বছরের সংসারের অভিজ্ঞতা কী তাহলে অন্তসার শূন্য ? মেরির সততা, আদর্শ, অঙ্গীকার সব ? সবটুকুই এক অপরাহ্নেই বিসর্জিত হয়েছিলো ? মেরি ভাবছে; একসময় শৈশব থেকে যৌবনঅব্দি গড়া, দৃঢ়বদ্ধ অপত্য ভেঙ্গে কতোটা অকাতরে চলে যেতে পারে সন্তানরা, মানবজন্মকে স্বার্থক করার জন্য।

স্বপ্না, স্বপ্নার বাবা চাকুরীজীবী সাধারণ ছা-পোষা মানুষ। রাগি তবে সাহসি নয়। স্ত্রী মেরির সামনে কোনরকম ডিসিশন্ নিতে সবসময় সব গুলিয়ে ফেলেন, অবশেষে হাল ছেড়ে দেন, তারপর স্ত্রী মেরিকেই সামাল দিতে হয় পরিস্থিতি নিরুপায় হয়ে। সেদিন সেই অবসরেই অঘটন ঘটন পটিয়সি সময় টেনে দিয়েছিলো স্বপ্নার জীবনের বাবার বাড়ীর যবনিকা। একেক সময় এসব ভেবে মেরির খুব হাঁসি পায়। কী আশ্চর্য ! স্রষ্টার সৃজন ইশারা ! আমরা বাবা মা সমাজ মিলে সত্যিই কিছুটা অন্যায়, হয়তোবা অনধিকার চর্চাও করে বিধাতার হাত পাকড়ে ধরে নিয়তিকে বদলাতে চাই, কিন্তু নিয়তি যে মায়াবন বিহারিনী সোনার হরিণ !!

ভাবতে চাই না, জীবনের পর্যায়গুলো ঠিক সময় মতোই এসে নোঙ্গর ফেলতে চায় জন্ম নদীর ঘাটে ঘাটে। সময়ের কাছে অসহায় জীবন তখনি মনে হয় গেয়ে ওঠে “মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে/আমি আর বইতে পারছি না।”

উনিশ বছর আগের ১৫ ফাগুন আর আজকের ফাগুন; কত বড় তফাত !! আজ প্রায় দু-দশক পর মেরির সামনে সেই সে ফাগুন যথানিয়মে এসে, মেরিকে ভারাক্রান্ত করে তুললো। যে দিন প্রেমের টানে বাবার ঘরটা ছেড়েছিলো স্বপ্না। মেরির স্বামী পুত্র কন্যা স্ত্রী রেখে অবসর নিয়েছেন দশ বৎসর আগেই, শুধু চাকুরী নয় পার্থীব জীবন থেকেও। স্বপ্নাকে নিয়েই মেরির একাকি জীবন চলছে সুখে দুখে।

অনেক চেষ্টা করেও আর টিকলো না স্বপ্নার প্রেমের সংসার। তবে ফিরে এসে প্রাইমারি স্কুলে একটা চাকুরি পেয়েছিলো। সেটুকুই জীবনের পাথেয়। নিলম আর প্রিয়ম দুটি কন্যাও এসেছে পৃথিবীতে যথারীতি সৃষ্টির অনিবার্য নিয়মে। নানুর কিংকর্তব্যবিমূঢ় যাপনে একাকি চলছে জীবন যুদ্ধ, দুিট ফুল নিলম, প্রিয়মকে নিয়ে।
আজকাল এত বিজ্ঞানের আবিস্কৃত সামগ্রি ল্যাপটপ কম্পিউটারে কত্ত বিনোদন অপশন, ট্যাব, মোবাইলে পুরো পৃথিবী, তবু যেন মেরি আর স্বপ্না কী ভীষণ একা ! বিজ্ঞান কী আর মানবিক আবেগ দিতে পারে ? এসব নানাবিধ কথা মেরি আজকের ফাগুনের অপরাহ্নে ভাবছে বসে আর আপন মনে বিড়বিড় করছে নিজের সাথে। সেদিন কোন মিডিয়াতে যেন ঘর ভাঙার জরিপের কথা শুনলো মেরি। ২০১৫ এর জরিপে দেখা গেছে শুধু রাজধানীতেই বাইশ হাজার সংসার ভেঙে গেছে। কেন ? কেন চারিদিকে এতো অকল্যাণের হৈচৈ শুরু হয়ে গেল ? কন্যাদের শিক্ষিত স্বাবলম্বি করতে গিয়েই কী তবে “ইগো’’ সমস্যা পাহাড় সমান হয়ে গেল ? যার জন্য পুরোনো প্রাচীরের মতো দুপদাপ দুপদাপ ভেঙে পড়ছে। সংসার ?
স্বপ্না ঃ মা, মা, ওমা ? বলতে বলতে বারান্দায় এসে দেখে মা চুপচাপ বসে আছে। মাকে আনমনা দেখে স্বপ্না বললো-
ঃ মা ? কী এত ভাবছো তুমি ? আমি জানি তুমি কি ভাবছো। আমি ছাড়া তোমার তো আর কোন অশান্তি নেই বলো ? কিন্তু তুমি একা ভেবে কী করবে বলোতো ? শোন মা, প্রতিটা যুগেরই তো একেকটা ক্রাইসিস থাকে মা। মেরি বললেন খানিকটা দৃঢ় করেই
ঃ স্বপ্না, সে ক্রাইসিস কী তাহলে যুগকে, যুগের সন্তানদের ধ্বংস করে দেবে ? এই ভাংচুর এর খেলায় ? তোমাদের “ইগো’’ তোমাদের প্রেমহীনতার এই অসম চাওয়া যে সৃষ্টিকেই অর্থহীন করে দেবে ! সৃষ্টির বৈশিষ্ট øেহপ্রেম সহিষ্ণুতা সম্পর্ক সম্মান হারিয়ে পরবর্তী যুগ কী উপকরণে তৈরি হবে ? বাবা মায়ের সেপারেশন দেখে দেখে একটা হার্টলেস প্রজন্ম তৈরি হতে যাচ্ছে ? মায়ের কথা শুনে স্বপ্নার পায়ের নীচের মাটি কেঁপে উঠছে যেন। সে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে গেল। মেরি এ পর্যন্ত বলে সহসাই যেন চিৎকার করে বলে উঠলো-
ঃ তাহলে কন্যারা কী হারিয়ে ফেলেছে তাদের বধু প্রেমিকা স্ত্রী সহধর্মিনীর সেই শান্তশ্রীরুপ ? এতসব বিসর্জন দিয়ে রয়ে গেল শুধু রমনী !! যা ধর্ষিতা নামেই অভীহিত হতে পারে ?

স্বপ্না ভাষা হারিয়ে ফেলেছে মায়ের আধুনিক সংসারের বিড়ম্বিত ব্যখ্যা শুনে। সে ধীরে ধীরে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। নীলম প্রিয়ম ফেসবুক আর মোবাইলে বসে যুগের সদব্যবহার করছে। মেরি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। আজ প্রৌঢ় ফাগুনে এসে নিজের দিকে চোখ ফিরিয়ে তার তিরিশ বছরের অতিতকে দেখার চেষ্টা করলো। মেরি মায়ের কাছে শুনেছিলো, স্বামী স্ত্রীর গভীর প্রেম থেকে যে সন্তান জন্ম নেয়, সে সন্তান সৎ ন্যায়নীষ্ঠ সত্যবাদী মানবতার গুনে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠে। এবার মেরির দাম্পত্য স্মৃতিচারণে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাঁসির ঝিলিক মেরিকে লাজ রাঙা করে দিল। চটজলদি ঘরে আয়নার সামনে গিয়ে ভালবাসার স্মৃতি রক্তিম মুখখানা দেখে নিতেই পেছন থেকে স্বপ্না ডাকলো-



ঃ মা ? - মেরি তাড়াতাড়ি শাড়ীর আঁচলে অনুরাগের রং মুছে জবাব দিলেন- কিরে মা ?
ঃ মা, তুমি কী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে ?

ঃ না, না, কাদবো কেন ? ঘাম মুছ্ছিলাম। স্বপ্না জানে মায়ের ওটুকু ছলনা। স্বপ্নার জীবনের বেদনার্ত খত, মায়ের হƒদয়ে কতোটা পচন ধরিয়েছে। মা ১৯ শতকের শেষ দশকের নারী। তার ভিতরের অবশেষ উষ্ণতাটুকু এখনও এই পরিবার সমাজ সংসারের উপর শান্তির বারি হয়ে ঝরছে স্বপ্নাদের কিছু ভাবিয়ে তোলার জন্য। স্বপ্না মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ, আমাদের মায়েদের চোখের ঐটুকু শান্তিবারি যেন শেষ কোরনা, তাহলে যে আমাদের ভিতর থেকে সবটুকু অনুভব হারিয়ে যাবে !!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ আমাদের চলমান পচনশীল, অসহিষ্ণু সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে যে সত্যটুকু আপনি গল্পের ছলে উচ্চারণ করেছেন, সে জন্য আবশ্যই আপনি প্রশংসিত হবেন । অথচ এই অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনেও কবি-সাহিত্যিকদের অবদান কম নয় । তাদের অসতর্ক আদিখ্যেতাও এই পরিণতির জন্য অনেকাংশেই দায়ী । খুব ভাল লাগল আপনার সাহসী উচ্চারণ । ভেট দিয়ে গেলাম ।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
গাজী সালাহ উদ্দিন বেশ লাগলো ,আমার পাতায় আমন্ত্রন রইলো ।
ভালো লাগেনি ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
ফয়েজ উল্লাহ রবি বেশ ভাল লেগেছে, শুভেচ্ছা জানবেন, ভাল থাকা হয় যেন।
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ২০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪