মাঠের মাঝখানে সবুজ ঘাস চিবুতে থাকা ঐ যে লাল রঙের গরুটা দেখছেন, ও রাঙ্গা । আমার অতি আদর-যত্নে বড় হয়ে ওঠা রাঙ্গা । আর ঐ যে রাঙ্গার চারপাশে হামাগুড়ি দিতে থাকা ছোট্ট ছেলেটাকে দেখছেন, ও হচ্ছে মনসুর । আমার একমাত্র সন্তান । বাপ আমার স্বাভাবিকভাবে হাটতে পারে না, পায়ে কোন বল নেই । ডাক্তার দেখিয়েছি বার কয়েক, কিন্তু কোন লাভ হয়নি তাতে ।
রাঙ্গার যখন জন্ম হয়, ওর গায়ের অদ্ভুত লাল রঙ দেখে ওর এই নাম রেখেছিলাম আমি । তখন আরেকটা নিয়তও করেছিলাম, এই রাঙ্গাকে বড় করে কোন এক কোরবানীর ঈদে কোরবানী দেব । এভাবে ঘটা করে নিয়তের কারন, প্রতিবছর কোরবানীর সামর্থ আমার নেই । গ্রামের বাজারে সবজি বিক্রি করি আমি, আর রাঙ্গার মায়ের দুধ বেচে কিছু টাকা আয় হয় । ওই দিয়ে কি আর বছর বছর কোরবানী দেয়া যায় !
দেখতে দেখতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে । এই রাঙ্গা আর মনসুরকে এখন আর আলাদা চোখে দেখতে পারি না আমি । ওরাও অনেকটা সহোদরের মতই মেশে । আসলে মনসুর যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই ওর খেলার একমাত্র সাথী এই রাঙ্গা । রাঙ্গাই যেন ওর শৈশবের সব চাওয়া পুরন করছে । রাঙ্গার সাথে ওর আচরন, কথা বলা, কিংবা ওর প্রতি রাঙ্গার আচরন দেখে আমার প্রায়শই মনে হয়, ওরা দুজন দুজনের সব কিছুই বুঝতে পারে, কোথায় যেন ওদের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগাযোগ আছে ।
রাঙ্গার বয়স এখন তিন বছর । ওর জন্মের সময় করা নিয়তের কথা অগ্রাহ্য করার আর উপায় নেই আমার । সামনেই কোরবানীর ঈদ । এই ঈদেই নিয়ত পুরন করার সিদ্ধান্ত নিলাম । যত দেরী হবে সমস্যা ততই বাড়বে । মনসুরের সংগে রাঙ্গার সম্পর্ক গভীরতর হবে । মনসুরের বয়স এখন মাত্র সাত, আশা করা যায় ওকে এখন ভোলানোটা অত কঠিন হবে না ।
যথারীতি ঈদের দিনটা চলেই এল । মনসুরকে আগ থেকে কিছু জানাইনি আমরা । ঈদের নামাজ পড়ে এসে দেখি মনসুর তখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছে । আমি ওর ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলাম, যাতে কোন আওয়াজ না যায় । এরপর দড়ি ধরে রাঙ্গাকে নিয়ে চললাম মাঠের দিকে । রাঙ্গার চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না কোনভাবেই, আমার বুকে পাথর চাপা দেয় যেন কেউ ।
জবাইয়ের বেশ কিছুক্ষন পর শান্ত হয় রাঙ্গার দেহ । আমি পাথর হয়ে বসে থাকি আরও কিছু সময় । তারপর চামড়া আর মাংস ছাড়াবার কাজে লেগে পড়ি ।
মনসুরের ঘুম ভেঙ্গে যায় হঠাত । বাপ আমার ঘুম থেকে উঠেই জিজ্ঞেস করে, “রাঙ্গা কই?” ওর মায়ের মিথ্যে কথায় ওর মন ভরে না । ও পাগলের মত হামাগুড়ি দেয় উঠোনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত । পাকের ঘরে পাতিলের ভেতর বেশ কিছুটা কাচা মাংস দেখে ওর মনের সব জানা হয়ে যায় । ও কোন কথা আর বলে না, ঘরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ে ।
সব কাজ শেষ হতে হতে আমার দুপুর হয়ে যায় । এর মধ্য ওর মা ওকে বেশ কবার উঠাবার চেষ্টা করে গেছে, বাপ আমার ওঠেনি । আমি গিয়ে ওকে ডাকি, ঝাঁকি দেই, কিন্তু ও ওঠেনা । চোখ খোলে না, মুখ নাড়ায় না, শুধু শ্বাসটা নিচ্ছে । আমার বুকটা ছ্যাত করে ওঠে । ভেতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে, কাজটা ঠিক হয়নি,......ঠিক হয়নি ।
এইভাবে সেইদিন রাত গেল, তারপরের দিন পুরোটা গেল, বাপ আমার উঠলো না । ওদিকে গায়েও প্রচন্ড জ্বর । রাতে ডাক্তার ডেকে আনলাম । উনি স্যালাইন দিতে গিয়েও জ্বরের কারনে দিলেন না ।
উপায়ান্তর না দেখে পরের দিন দুপুরে আমার মাকে আনতে গেলাম । মা এতদিন বোনের বাড়িতে ছিলেন বোন অসুস্থ বলে । আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । এসেই মা ঢুকলেন মনসুরের ঘরে । মনসুরের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন, “নাতিরে, তুই এইহানে এমুন করতাছোস, আর ঐহানে বেহেশ্তে বইয়া রাঙ্গা কি মজাটাইনা করতাসে । আরে তোর বাপে তো রাঙ্গারে আল্লাহর কাছে দিছে যাতে হেইহানে রাঙ্গা বেহেশ্তে আরো মৌজে থাকতে পারে । আমরা যখন মইরা বেহেশ্তে যামু, রাঙ্গারে ঐখানে আবার দেহুমরে নাতি । যদি কোরবানী না দিত, তাইলে তো ওয় বেহেশ্তে যাইতো না, তহন কেমনে দেখতি তারে । ” দুইদিনে এই প্রথম মনসুর চোখ মেলে চাইলো । “দাদীগো, তুমি হাছা কইতাসো ?” “হাছা না কি মিছা ? এহন ওঠ, ভাত খাইয়া ল দুইটা ।“ “এহন না দাদী, কালকা সকালে খামু, এহনে মেলা ঘুম ধরছে ।“ মনসুর হাসিমুখে ঘুমিয়ে পড়ে । আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচি । মা কি সুন্দরভাবেই না বুঝ দিল, মনসুরও সব বুঝলো ।
পরদিন সকালে বাপ আমার রাঙ্গার কাছে বেহেশ্তেই চলে গেল !
১৪ জানুয়ারী - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪