শরত

ত্যাগ (মার্চ ২০১৬)

কায়সার মোহাম্মদ ইসলাম
  • ৫৭
শহরের মূলধারার রাস্তাটা হঠাৎ করেই পাহাড়ি রাস্তাটা বেয়ে উঠে গেছে অনেকদূর। গাড় সবুজ রঙের “সিএনজি”টা অনেক চেষ্টা করেও যখন পাহাড়ে উঠতে ব্যর্থ হল, নিনাকে তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই সিএনজি থেকে নেমে যেতে হল। অঙ্কশাস্ত্রের ছাত্রি মনে মনে বলল- ৪৫ডিগ্রী খাড়া এঙ্গেলে কি রাস্তা বানানো উচিৎ?
কামরুলের আত্মাটা যেন আজ সারা পাহাড় জুড়ে ভাসছে- যেখানে ইচ্ছে সেখানে ঘুড়ির মতন উড়ছে। নিনা যে পাহাড় বেয়ে টুকটুক করে উঠছে সেটা সে টের পেয়েছে তাৎক্ষণিক ভাবেই। নিনাকে আজ গেইটের বেল চাপতে হলনা সে স্রেফ বাতাসের মতই উড়ে এসে জুড়েছে কামরুলের রুমে! দক্ষিনের জানালায় বাতাস বয়ে যাচ্ছে- পেয়ারা, বেলুম্বু, জল্পাই গাছের বৃষ্টি ভেজা সবুজ পাতাগুলো ঠাণ্ডা বাতাসে ঝিরঝির করে কাঁপছে আর উঁচু নারিকেল গাছগুলো ঝরো বাতাসের দোলায় একবার হেলে পড়ছে আবার সোজা হয়ে উঠছে- এভাবেই চলছে, ব্যাপারটা দেখতে নিনার বেশ ভালই লাগছে- মাথার ভেতরে একরকম আনন্দধারা বয়ে চলছে----
অনেক্ষন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর কামরুল যখন নিনার কোমল হাতে হাত রাখল, এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো এটা আসলেই নিনা ততোক্ষণে আফসানার হালকা অবয়বটাও বিলিন হয়ে গেল নিনার মুখশ্রী থেকে। এটা কামরুলের বিশেষ ধরনের কোন অসুস্থতা নয় বরং একধরনের গুন বটেই, নিনা ভাবতে থাকে। কামরুলের অতিপ্রাকৃত ব্যাপার স্যাপারগুলি বুঝে ওঠার পরেই নিনা কামরুলকে ভালোবাসার সারা দিয়েছে। কিন্তু এটাকে কি সোজাসুজি ভালোবাসা বলা যাবে? বরঞ্চ বলা যেতে পারে দুজন মানুষের একজন আরেকজনকে চেনার একটা প্রক্রিয়া। কামরুল অনেকদিন ধরে দাবি করে আসছে সে নিনাকে জন্মের পূর্ব থেকেই চেনে, প্রথম প্রথম ব্যাপারটা এতটাই উদ্ভট মনে হতো যে নিনা তখন কামরুলকে স্রেফ উম্মাদ বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলো কিন্তু ধীরে ধীরে নিনা বুঝতে পেরেছে তারা আসলেই কোন না কোন ভাবে আগে থেকেই সম্পর্কযুক্ত।
বছর খানিক আগের কথা, নিনার একুশ তম জন্মদিনে কামরুল “সুমন চট্টোপাধ্যায়ের” জাতিস্মর এ্যালবামটা উপহার দিয়েছিলো এর আগে পর্যন্ত নিনা কখনো শুনেনি পূর্ণজন্মের কথা। সময় পেলেই নিনা গুনগুন করে গাইতে থাকে- “অমরত্তের প্রত্যাশা নেই------------“।
পুরো বাড়িতে আজ আয়োজন চলছে। কামরুলের দূরের একজন আত্মীয় তার পরিবার পরিজন নিয়ে পাহাড়ি বাড়িটিতে নিমন্ত্রিত হয়েছেন। তারা এসেছেন সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে। কামরুলের বাবার মুখের হাসি আর থামেনা, কামরুলের বোনরাও এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
জনাব সোবহান সাহেব বহু বছর যাবত বিলেতে বসবাস করছেন, লন্ডনে তার প্রতিষ্ঠিত আইন-ব্যবসা। তার স্ত্রী ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে পারেন, প্রথম দর্শনেই ভদ্র মহিলাকে নিনার অসাধারণই মনে হয়েছে। সম্ভবত কালো চুলের ইউরোপিয়ানদের বাঙ্গালিদের একটু বেশী পছন্দ। নিনাও তার ব্যাতিক্রম নয় তবে নিনার মূল আকর্ষণটা ভদ্র মহিলার পিয়ানো বাদনের প্রতি, অসাধারন “শোপ্যাঁ” বাজাতে পারেন তিনি। নিনা আগ বাড়িয়ে ভদ্রমহিলাকে প্রশ্ন করে তিনি কি “ব্যাতোভ্যানের” মুনলাইট-সোনাটা বাজাতে অভ্যাস্ত কিনা-? ভদ্রমহিলা এমন ভাবে হাত চালালেন মনে হল, পিয়ানো বাজানোটা ছেলের হাতের মোয়াই-
বাড়ির সবাই লাঞ্চ-পার্টিতে যোগ দিলেও নিনা আর কামরুল ছিল অনুপস্থিত, তারা দুজন বেডরুমেই দুপুরের খাবারের পর্বটা শুরু করেছে মাত্র।
নিনা- কি অসাধারণ পিয়ানো বাজাতে পারেন লুসিয়াশ(মিসেস সোবহান), আর তার নামটাও পুরোপুরি সার্থক- নামের মতই মিষ্টি তার চেহারা, পিয়ানো বাজানো সবকিছু-(নিনা বরাবরই অন্যের রুপে মুগ্ধ একজন মানুষ- মানুষটা যতো দারিদ্রই হোক অথবা গুণহীনই হোক সে তার একটা গুন খুঁজে বসবেই)
কামরুল- শোপ্যাঁর কয়েকটা “নক্টার্ন”(নিশিথের স্বপ্নিল সঙ্গীত), ওয়াল্জ অথবা মুনলাইট-সোনাটা বাজানোটা অধিকাংশ সংস্কৃতিমনা ইউরোপিয়ানদের জন্য সাধারণ ব্যাপারই বটে।
নিনা- কিন্তু আমি ওসব ইউরোপ-টিউরোপ বুঝিনা, এই মুহূর্তে আমার কাছে লুসিয়াশই পৃথিবীর সেরা পিয়ানোবাদক--- বলতে বলতে হুট করে “জর্জ-উইনস্টনের” ক্যাসেটটা ছেড়ে দেয়; “অটম(শরৎ)”- এই পিসটাকে বলা যেতে পারে কামরুল আর নিনার অন্তরের কুঠির, যেখানে তারা বারবার ফিরে আসে শঙ্খচিলের মতন।
পড়ার টেবিলে নিনার দেয়া জন্মদিনের কার্ডে বড় বড় করে লেখা- “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে------“। বাড়ীর সবাই কোন না কোন সময় সেটা পড়ে দেখেছে আনমনেই আর ভাবতে থাকে নিনা নিশ্চয় একজন জীবনানন্দের ভক্ত! কামরুলদের গ্রামের বাড়ির যে মেয়েটা পাহাড়ি বাড়িটিতে ছোটোখাটো কাজ করে থাকে- সে একদিন নিনাকে আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে বসে ভাবী আপনি কি জীবনানন্দের “ হায় চিল” কবিতাটি পড়েছেন। ভাবী সম্বোধনটা শুনে নিনার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আসে, তারপর কি মনে করে হাসতে থাকে; কামরুল কখনো নিনাকে এভাবে হাসতে দেখেনি- সেও হাসতে থাকে-----।
অটমের সুরে সুরে পুরো ঘরের রঙ পাল্টাতে শুরু করেছে মাত্র, নিনা মনের অজান্তেই কামরুলের পাশেই শুয়ে পড়ে- অথচ কামরুলের বেডরুমের দরজা তখনো খোলা, অতিথি শিশুরা বেশ কয়েকবার ঢুঁ মেড়েছে তাদের রুমে এরিমধ্যে-। কিন্তু তারা সে ব্যাপারে অনুভূতিহীন, সুরের মূর্ছনা আকাশ ছুঁয়েছে মাত্র- এভাবে ধীরে ধীরে রাত নেমে আসে; কামরুল স্বপ্ন দেখছে সে নির্বিঘ্নে উড়ছে আকাশে- যতো ইচ্ছে ততো উঁচুতে, সে উড়ছে- এমনকি পনেরো তলা দালান ঘেঁষে সে উড়তে উড়তে সেটার চূড়া ছুঁয়ে শূন্যে ভাসছে আর সেখান থেকে পুরো শহরের কাণ্ডকীর্তি দেখছে নির্দ্বিধায়; নিনা স্বপ্ন দেখছে সে পাতালপুরীতে সাঁতরিয়ে বেড়াচ্ছে, এভাবে ভোরের আযানের সাথে সাথে তাদের ঘুম ভাঙ্গে- নিনার গায়ের কালো জামাটি নীল হয়ে ওঠে!
কামরুল- চোখ রাঙ্গিয়ে বলে ওঠে- এটাতো আসলেই নীল!
নিনা- আসলে রাতের বেলায় গাড় নীলকে অনেক সময় কালই মনে হয়।
তারা আর কিছু বল্লনা। বাগান থেকে কিছু গোলাপ তুলে কামরুল নিনার চুলে গেঁথে দেয় আর বলল- আমরা আজ অসাধারণ একটা নদীর প্রান্ত দেখবো-
নিনা- সাঁই দিয়ে বলল- স্বপ্নে দ্যাখা নদীর প্রান্ত!
কামরুল- আ্যাকজেক্টলি!
(ভোর ছটায় পুরো বাড়িটিকেই নিনার ভূতুরে বাড়িই মনে হচ্ছে, শুধু বাগানের নানারকমের উঁচুনিচু গাছগুলোর পাতা ঝির ঝির করে কাঁপছে উইনস্টনের সুরের মূর্ছনায়- তারা কি আগাম কিছুর সংকেত দিচ্ছে এই জুটির জন্য- পুরো বাড়ির মানুষরা তখনো ঘুমের ঘোড়ে- স্বপ্নে মগ্ন যে যার মতো- তাই বাড়ির গেইটের ছোটো দরজাটা হা হয়ে রইলো কেও না ওঠা পর্যন্ত!


দুই

ঘোর লাগানো ঘুমের পরেই কামরুল নিনাকে নিয়েই রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো। দুজনের অনুরক্ত হাত দুটি যেন আর ছাড়ে না।
রিক্সা চলছে ঝড়ের গতিতে, টুংটাং বেল বাজিয়ে, নিনার মিহি গলার মিষ্টি হাসি রাস্তার দুধারের মানুষদেরও আকর্ষণ করছে এই সোনালু ফুলের শহরে ।
নরম রোদ্দুরের পর হঠাৎ বৃষ্টি, নিনা বললো-হুড তুলো, কামরুল হুড তুলল;
নিনা-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
কামরুল- অসাধারণ এক নদি, যেটির প্রান্ত অবশেষে সাগরে মিশে গেছে!!
নিনা- নদীর নাম কি?
কামরুল- সাবটেরেনিয়ান রিভার!
নিনা- মানে কি?
অতলস্পর্শই বলতে বলতেই, রিক্সাটি নিম্নমুখি দীর্ঘ-ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে হাওয়ার গতিতে নিচে নামতে শুরু করেছে- নিনা ব্যাপারটা আঁচ করলো অনেক দেড়িতে, ততক্ষনে তারা প্রায় সমুদ্রের সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে; ওভারব্রিজটা যে নীল সমুদ্রের অনেক নিচে নেমে গেছে- সেটা দেখেই নিনা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে আনমনে, এটাই একমাত্র উপায়- সে ভাবলো আলোর-গতিতে! অথচ তখনো অটমের ঘোর লাগা সুর তার কানে বেজেই চলছে-
কামরুল, চলন্ত রিক্সার বামদিক ঘেঁষা ব্রিজের-রেলিং ধরে দ্রুত-যানটির গতি কমাতে চাইলো- মাত্র, পারল না;
রিকশাওয়ালা ব্রেক কষার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই রিক্সা আর থামেনা----------
কামরুল অবাক হয়ে দেখছে আর ভাবছে, যে নদি দেখানোর জন্য নিনাকে সে আজ এখানে নিয়ে এসেছে সেটি আসলেই সাগরে মিশে গেছে!
কি কঠিন ব্যাপার ২০৫০ সনের বাস্তবতা যেন পঁয়ত্রিশ বছর আগেই ঘটতে চলছে। কি ভয়ানক পানিতে ডুবে মরা- এতদিন সেতো শুধু শুনেছে বা দেখেছে টেলিভিশনের পর্দায় আর এখন সেটা সত্যি হতে চলছে;
কামরুল, শেষবারের মতো পানিতে দৃশ্যমান রেলিং ধরে রিক্সাটা থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু না বরং তারা তিনজন সজোরে চিৎকার দিচ্ছে অনন্যপায় হয়ে; তাদের আত্ম-চিৎকারে হাঙ্গরের আক্রমনের বিলম্ব ঘটছে মাত্র!
ঘট্- একটা হাঙর গিলে ফেললো কামরুলের ঘাড় থেকে মাথা,- নিনা দৃশ্যটা দেখে চিৎকার দেয়ার আগেই সেও নিস্তব্ধ হয়ে গেলো আরেকটা গাড় রঙের হাঙরের বিশাল চোয়ালে তার পা থেকে কোমর পর্যন্ত গ্রাস হতে দেখে।
সমুদ্রের নীল পানি অনেকদিন পর আবার লাল হোল। রিকশাওয়ালা রিক্সার হুড সমেত ভাঙ্গা অংশটা নিয়েই সমুদ্রে ভাসছে। আশ্চর্য তাকে কোনো হাঙর আক্রমন করতে আসলো না!
সে বেঁচে যাবে, এটাই নিয়তি।
কারণ সে হৃদয়ের কবি।
সে তার কাহিনি মানুষকে শোনাবে!
(ওদিকে অটমের সুরে সুরে সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল পানি ঝিরঝির করে কাঁপছে বাতাসের সাথে তালেতাল মিলেয়ে- আহ সমুদ্রের তলানিটা কতই না স্বচ্ছ আর জীবন্ত, প্রানের মেলায় বাড়ন্ত- কেউ যেন বলছে অটমের সুরে সুরে------- )
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাঃ ফখরুল আলম ভাল লাগল। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ ভাল লিখেছেন । প্রাপ্যটা রেখে গেলাম ।
ফয়েজ উল্লাহ রবি বেশ ভাল শুভেচ্ছা জানবেন, ভোট!!

০২ জানুয়ারী - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪