সাল দুই হাজার এক, ডিসেম্বর মাস, দেয়াল ঘড়িটায় কট্ কট্ করে দুইটা বাজে, শব্দ শোনতে শোনতে এমনেই বড় ক্লান্ত তার উপর দুই ডানার ছিলিং ফ্যানটার শব্দে বড় অস্থির আরিফ সাহেব, অনেক বার কেয়ারটেকার কে বলেও লাভ হয়নি। পাশেই ছোট রাস্তা আগে এই রাস্তায় এতো গাড়ী চলা-চল করতো না এখন প্রচুর গাড়ী চলে আর শুধু শুধু ভেঁপু বাজায় বড় বিরক্তির সাথে বসবাস করতেছেন আরিফ সাহেব। বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই এই বয়স থেকে মানুষ ফের বাচ্চা হতে শুরু করে, একে তো আরিফ সাহেব বড় রাগী মানুষ ছোট বেলা থেকেই তার উপর কিছু দিন ধরে হুইল চেয়ারটারও আওয়াজ বেড়ে গেছে, কয়েক বার করে হুইল চেয়ারের জয়েনে জয়েনে তেল দিয়েছে, একদিন ভাল থাকে তো, তার পর আবার আওয়াজ শুরু হয়ে যায়। শব্দ নামক সন্ত্রাসের জ্বালায় জীবন অতিষ্ঠ এক কথায় শব্দ বা আওয়াজ থেকে মুক্তির আশায় আরিফ সাহেব বড় ক্লান্ত।
দরজায় খট্ খট্ শব্দ। কে?
আমি স্যার কেয়ারটেকার মামুন।
আরিফঃ- কি চাই?
মামুনঃ- স্যার আপনার সাথে দেখা করতে এক ভদ্র মহিলা এসেছে।
আরিফঃ- চলে যেতে বল আমি আর কোন ইন্টারভিউ দেব না, মার্চ আর ডিসেম্বর এলে সাংবাদিকরা পাগল হয়ে যায়, সারা বছর আর কোন খবর রাখে না, মামুন উনাকে চলে যেতে বল।
মামুনঃ- স্যার উনি লন্ডন থেকে এসেছে।
আরিফঃ- ওহ! এখন তা হলে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরাও জ্বালাবে।
মামুনঃ- স্যার উনি সাংবাদিক নয়, আপনার পরিচিত বলতেছে, আপনাদের গ্রামের বাড়ীর।
আরিফঃ- মামুন আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নেই, আমি কাউকে কোন সাহায্য করতে পারবোনা, এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা কি আর করতে পারে, তিরিশ বছর ধরে হুইল চেয়ার বসা বৃদ্ধ কিছুই করতে পারবে না, উনাকে চলে যেতে বল। দুঃখিত আমি দেখা করবো না।
নারী কন্ঠে- এখনও আগের মতো রাগ একটুও কমেনি বুঝি?
আরিফঃ- কে আপনি ভিতরে চলে এলেন, চলে যান এখন আমার খাবারের সময় হয়ে গেছে, মামুন খাবারের ব্যবস্থা করো আমি আসতেছি।
আমাকে খেতে বলবেন না? আমারও খুব খিদে পেয়েছে, মামুন সাহেব আমার জন্যও খারাবের ব্যবস্থা করুন।
আরিফঃ- অনুদানের টাকায় আমরা চলি আপনার জন্য খাবার এখানে নেই, বাহিরে হোটেল আছে ওখানে যান, শুনেছি ওখানে নাকি ভাল খাবার পাওয়া যায়।
তো ঠিক আছে আমি আপনাকে খায়াবো চলুন বাহিরের হোটেলে।
আরিফঃ- এক বার বলেছি চলে যান, তার পরও আপনি নির্লজ্জের মতো এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, চলে যান।
চলে যাব কিছুটা সময় চাই আপনার নিকট রাধিকার জন্য।
থমকে গেল আরিফ সাহেব!! কে আপনি?
আপনার কিছুটা সময় দিন সব বলবো।
আরিফঃ- আমি তো এখন খাবার খাব, তার পর দশ মিনিট পাবেন।
ঠিক আছে আমিও খাবার খাব, মামুন সাহেব খাবার এখানে নিয়ে আসুন।
আপনার কি মনে আছে কালিকা পুর?
আরিফঃ- কেন নয়? খুব মনে আছে, সেই দিন গুলো মনে করে করেই তো গত তিরিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছি।
আর আপনার চেয়ারাটা আমার পরিচিত পরিচিত মনে হয়? আপনার গ্রাম কি কালিকা পুর।
কালিকা পুর মনে আছে আর কালিকার পুরের রাধিকাকে ভুলে গেছেন?
আরিফঃ- কালিকা পুর ভুলে যেতে পারি কিন্তু রাধিকাকে ভুলা যাবে না, সে আছে আমার অন্তর জুড়ে।
যাকে অন্তর জুড়ে রেখেছেন, তাকে একটু আগে সামনে আসতে দিচ্ছিলেন না।
আরিফঃ- তুমিই রাধিকা? অনেকটা পরিবর্তন চেনাই যাচ্ছে না।
রাধিকাঃ-এতো দিনে পৃথিবী অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তোমার রাগ এখন আগের মতোই রয়ে গেছে।
একটুও পরিবর্তন হয়নি।
আরিফঃ- কি আর করবো এই রাগ সাথে নিয়েই মরে যেতে হবে মনে হয়, তুমি দেশে কবে আসলে?
রাধিকাঃ- গত সপ্তাহে এলাম, দশ দিন আছি।
আরিফঃ- ছেলে-মেয়েরা আসেনি সাথে, তার কতো বড় হয়েছে, কেমন আছে?
রাধিকাঃ- না ছেলে-মেয়ে কেউ আসবেনা তারা বাংলাদেশকে পছন্দ করে না, লেখা-পড়া শেষ করে ছেলে নিজেদের কোম্পানি চালাইতেছে এই বছর থেকে, আর মেয়ে এখনও লেখা-পড়ায় আছে।
আরিফঃ- আর তোমার স্বামী? সে কি করে?
রাধিকাঃ- উনি গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
আরিফঃ- দুঃখিত আমি, দুঃখিত রাধিকা।
রাধিকাঃ- এইস ওকে।
আরিফঃ- আমি কিন্তু তোমাকে অনেক খোঁজেছি, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তোমার বাড়ীতে গিয়েছিলাম আগস্ট ১৯৭২ কিন্তু তোমাদের ঘরে তালা ঝুলানো ছিল, তখন কেউ তোমাদের কোন খবর দিতে পারেনি, তার পর থেকে আর গ্রামে ফিরে যাইনি। ৮২ সালে জানতে পারি তুমি বেঁচে আছ আর তোমার বিয়ে হয়েছে স্বামীসহ বিদেশে আছ।
রাধিকাঃ- তোমার এই অবস্থা কি করে হলো?
আরিফঃ- দেশ স্বাধীনের দশ দিন আগে একটা অপারেশনের সময় আমার পায়ে এবং কোমরে গুলি লাগে, আমাকে বাঁচাতে একটা পা কেটে ফেলতে হয় আর আমি চির তরে পঙ্গু হয়ে গেলাম। তিন দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে, দেশ স্বাধীন হওয়ায় ভেবেছি স্বাধীন হয়ে গেলাম কিন্তু তার বিনিময়ে হারিয়েছি মা-বাবা, যাদের ৭১ সালে পাক বাহিনী মেরে পেলে, ওদের মৃত দেহ পর্যন্ত পাইনি। হারিয়েছি বড় ভাই যার খবর আজও মিলেনি, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। যাকে এতো ভালবাসতাম তাকেও হারিয়ে ফেলেছি। বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিল না, কি আর করা আল্লাহ এখন বাঁচিয়ে রেখেছেন।
রাধিকাঃ- তোমার না একটা ছোট ভাই ছিল?
আরিফঃ- আছে, এখন মনে হয় ঢাকায় পরিবার নিয়ে আছে।
রাধিকাঃ- তোমার খোঁজ-খবর নেয় না, আর তুমি “পঙ্গু যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় কেন্দ্রে” কেন?
আরিফঃ- ছোট ভাই একবার এসেছিল এখানে, তার বিয়ের দাওয়াত দিতে, যাওয়া হয়নি। এখানে খুব ভাল আছি দুই বেলা খাবার মিলে, ওষুধ মিলে, বিনোদনের জন্য টিভি আছে বই আছে ভালই কেটে যায়।
রাধিকাঃ- তোমার ভাই এটা ঠিক করেনি?
আরিফঃ- কেন? তুমিও তো আমার অপেক্ষা করোনি, একজন পঙ্গুর জন্য কি ভরসায় অপেক্ষা করবে।
রাধিকাঃ- বিশ্বাস করো আমার কিছুই করার ছিল না, দেশ স্বাধীনের পর পরই বাবা আমাদের আত্নীয়ের সাথে আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দেয়, আমি একজন মেয়ে কি করবো, তুমিও স্বাধীনের পর ফিরে আসোনি, বাবা-মাকে কিছুতেই বুঝাতে পারিনি তুমি বেঁচে আছ। সবাই বলা-বলি করছে তুমি বেঁচে নেই কিন্তু আমার মন মেনে নিতে পারে নি।
আরিফঃ- যাক, এখন ঐ সব ভেবে কি আর হবে, তোমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে মনে হয়, একটু পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, সন্ধ্যার পর এখান থেকে গাড়ী পাবে না।
রাধিকাঃ- আমি গাড়ী নিয়ে এসেছি। আর একটা কথা তুমি আমার সাথে লন্ডনে চলো।
এই কথা শোনার পর আরিফ সাহেব খুব রেগে গেলেন।
আরিফঃ- মামুন ম্যাডামকে গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসো, কোথায় মামুন জলদী করো। আর ম্যাডাম আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
রাধিকাঃ- আরে কি বলতেছে তুমি?
আরিফঃ- আপনি আর কখনও এখানে আসবেন না।
এই বলে নিজ রুমে চলে গেলেন আরিফ সাহেব একবারও পিছন ফিরে চায় নি
মামুনঃ- ম্যাডাম চলেন আপনাকে গাড়ী পর্যন্ত পৌছে দেই, স্যারকে কেউ বুঝাতে পারবে না, আজ আর ঘর থেকে বাহির হবে না, দরজা বন্ধ করে রাখবে রাতের খাবারও মনে হয় খাবেনা প্লীজ ম্যাডাম আপনি আসুন।
রাধিকা চোখ মুছতে মুছতে গাড়ীর দিকে চলতে লাগলো.........।