অযাচিত

রমণী (ফেব্রুয়ারী ২০১৮)

reza karim
  • ৪৮
তখনো ফজরের আযান পড়েনি। ফুরফুরে বাতাসে রিক্সা চালিয়ে বাসায় ফিরছিল মকবুল। সারা দেহে ক্লান্তির ছাপ। তবে মুখে ‘ও সখিনা ’ টাইপের কোন গান গুনগুন করে গাইছে। হঠাৎ একটা কান্নার শব্দ শুনে এদিক ওদিক তাকালো সে। জায়গাটা একটু অন্ধকার। এখানের সোডিয়াম বাতিটা কোন কারণে নষ্ট হয়ে আছে। একটি শিশুর কান্না। কান্নাটা ভেসে আসছে রাস্তার ওপাশের বড় ডাস্টবিনটা থেকে। মকবুল রিক্সা থামিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো শিশুটির দিকে। আজই বোধয় এর জন্ম হয়েছে। হতভম্ব মকবুল বুঝতে পারছে না কি করবে। তার মনে পড়লো সখিনার কথা। সখিনা একটি সন্তানের আশায় একেবারেই ভেঙে পড়েছে। বিয়ের দশটি বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ তারা কোন সন্তানের মুখ দেখতে পারেনি। সখিনার ফুটফুটে চাঁদের মতো একটি সন্তানের কতই না আশা ছিল। আর মকবুলের নিজেরই বা ছিল না নাকি। সেও তো নানা কল্পনার রঙ এঁকেছিল হৃদয়ে তার সন্তানকে নিয়ে।

বিয়ের কদিন পরেই তারা সন্তান নিয়ে আলাপ করছিলো। আমরার পোলা মাইয়ার কী নাম রাখবা গো সখিনা? হাসতে হাসতে প্রশ্ন করছিল মকবুল। ছেলে হইলে নাম আমি রাখমু আর মেয়ে হইলে তুমি রাখবা। লাজুক ভাবে উত্তর দেয় সখিনা। আইচ্ছা এইডাতো বুঝলাম। আয়ো আমরা নামগুলা আগেভাগেই রাইখ্যা থই বলেই মকবুল একটি খিলি পান মুখে ঠেলে দেয়। সখিনা বলে, তোমারে না কইছি অত পান খাইবা না। আইজ সারা দিনে কয়ডা খাইলা? মকবুল এই কথার উত্তর দেয় না। সে বলে, আহা পানের আলাপ বাদ দিয়া পুলা মাইয়ার নামের কথা কও। মাইয়া অইলে নাম রাখমু বকুল। আহা ফুলের নামে নাম। আমার মাইয়া ফুলের মতো সুবাস ছড়াইবো। কী নাম পছন্দ অইছে তোমার? সখিনা কোন উত্তর দেয় না। সে আনমনে কী যেন ভাবছিলো। হয়তবা তার ছেলের নাম কী রাখবে তাই।

ডাস্টবিনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মকবুলের চোখ ভিজে ওঠে। সে তার গামছা দিয়ে অনাবৃত শিশুটিকে পেঁচিয়ে বুকে চেপে ধরলো। শিশুর কান্নার আওয়াজ থেমে গেলো। মনে হলো এরকম একটা বিদগ্ধ হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার জন্য শিশুটি তৃষ্ণার্ত ছিলো। মকবুলের চোখ এখন শুধু ভিজেই ওঠেনি তার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়লো। আনন্দের অশ্রু।

কী না করেছে মকবুল একটা সন্তানের জন্য। কত ডাক্তার আর কবিরাজের কাছে গেছে। সখিনা, মকবুল কারো কোন সমস্যা নেই তবে কেন তাদের কোল জুড়ে একটি সন্তান আসবে না। মসজিদের ইমাম সাহেব মকবুলকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলেন, ধৈর্য ধরুন ভাই। আল্লাহ আপনাদের পরিক্ষা করছেন। নামায পড়ে আল্লাহকে ডাকুন। আল্লাহর কাছে চান। তিনি তার বান্দাদের নিরাশ করেন না।

মকবুলের মনে হলো আল্লাহ এইবার শুনেছেন তার দোয়া। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে কতই না কান্নাকাটি করেছে। কত রাত তারা নফল নামাজে কাটিয়েছে। আল্লাহর কাছে একটি সন্তান চেয়ে কত রাত বিনিদ্র যাপন করেছে। রিক্সার টুং টাং শব্দ শুনেই বেরিয়ে আসে সখিনা। সখিনা কিছু বলার আগেই মকবুল বলে ওঠে, সখিনারে! শেষ লাগাত আল্লাহ আমরার দিকে মুখ তুইল্যা চাইছে। সখিনা কিছু বলে না। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মকবুলের আঁকড়ে ধরা শিশুটির দিকে। রাস্তায় পাইছি। ডাষ্টবিনে পইড়া আছিলো। পোলা। তোমার আশা পূরণ অইছে। অহন একটা নাম ঠিক কর দেহি।

সখিনা তবু কিছু বলে না। তার চেহারা কেমন যেন ফুঁসে ওঠেছে। মনে মনে ভাবে- কেমন মা-বাপ। জন্ম দিছে অহন পাপ মুছনের লাইগ্যা ডাস্টবিনে ফালাইয়্যা গেছে। পালনের যহন ইচ্ছাই নাই তহন জন্ম দেয় কিল লাইগ্যা। হায়রে নিয়তি - কেউ চায় পায় না। আর কেউ পায় কিন্তু চায় না। সখিনা কোলে নিতে চায় না। মকবুল একরকম জোর করেই সখিনার কোলে তুলে দেয়। যাও সখিনা এরে গরম কাপড় জরাইয়া দাও। মকবুল রিক্সা নিয়ে তালা মেরে রাখে। এর মধ্যে ফজরের আযান ভেসে আসে অসংখ্য মসজিদ থেকে। সখিনা নড়ে না। শিশুটিকে কোলে নিয়ে প্রতিক্ষা করে হয়তো অন্য কোন ভোরের আশায়।

সখিনা তার ছেলের নাম রাখে বুলবুল। অনেক ভেবে চিন্তে সে এ নাম রাখে। পাখির নামে নাম। যেদিন সে এ নাম খুঁজে পেলো সেদিন মকবুল বললো, হুনছেন বুলবুলের বাপ। আমার ছেলের নাম রাখছি বুলবুল। পক্ষীর নামে নাম। সুন্দর অইছে না? মকবুল হাসে। খুব সুন্দর অইছে। আমি বুলবুলের বাপ আর তুমি বুলবুলের মা।

সখিনা এখন যেন একটু পাল্টে গেছে। আগের মতো আর মন খারাপ করে বসে থাকে না। সারাক্ষণ বুলবুলকে নিয়েই আছে। বুলবুলকে সাজাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে। কখনো বুলবুলকে সাথে একমনে কথা বলছে। কখনো বা ছড়া কাটছে।
“বুলবুল আমার বুলবুল
গাঙ্গের পাড়ে কাশফুল
গাইয়্যা বেড়ায় গান
বুলবুল আমার জান।”

এভাবে দিন যায়। বুলবুল বড় হতে থাকে। এক পা দুইপা করে হাঁটতে শেখে। দৌড়াতেও শেখে। স্কুলে ভর্তি হয় বুলবুল। কয়েকটা ক্লাস ডিঙিয়েও যায় সে। বুলবুলকে নিয়ে মকবুল আর সখিনার সুখের সংসার এখন। সন্তান না পাওয়ার বেদনা এখন তাদের আর পোড়ায় না। হয়তো আর কোনো সন্তানের আশাও করে না তারা। বেমালুম ভুলে গেছে তাদের দুঃখের সেই দিনগুলো। এমন মূহুর্তেই তাদেরকে অবাক করে দিয়ে সখিনার কোল জুড়ে এলো এক সন্তান। ছেলে। যার জন্য একসময় সখিনার চিন্তার অন্ত ছিল না। সারাদিন বসে বসে নাম খুঁজতো। চোখের দুই কুল বর্ষার জলের মতো ফেঁপে থাকতো দিন রাত। আর এখন? কিছুই চিন্তা করতে পারে না সখিনা। মকবুল ভাবে অন্য কথা। একটি মেয়ে হলেই তো আরো ভালো ছিলো। বকুল নামটি রাখতে পারতো সে। ড্রেনের ওপাশের বকুল গাছটির দিকে তাকিয়ে দেখে সব বকুল ঝরে পড়েছে মাটিতে।

বুলবুল জানে না যে এরা তার আসল মা-বাবা নয়। মকবুল সখিনাও কখনো বলেনি। আর এতটুকু ছেলে কী-ই-বা বোঝে? তবে বুলবুল বেশ বুঝতে পারে মা এখন আর তাকে আগের মতো আদর করেন না। তার চেয়ে ঐ ছোট বাবুটাকেই বেশি আদর করেন। তবু সে নানা প্রশ্ন করে মাকে বিরক্ত করবেই। মা, ও এতো ছোট কেন? ও কি আমার মতো বড় হবে? সখিনা আগের মতো প্রশ্নের উত্তর দেয় না। শিশুটিকে বুকে টেনে নিয়ে দুধ খাওয়াতে থাকে।বিরক্ত হয়ে বলে, যাতো এখান থেকে । বিরক্ত করিস না।

বুলবুল হাল ছাড়ে না। সে আবার প্রশ্ন করে। মা, ও কি আমার ভাই? সখিনা এ প্রশ্নের ও কোন উত্তর দেয় না। বুলবুল আবার প্রশ্ন করে। মা কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়ে কেন? সখিনা বেশ বিরক্ত হয়ে বলে, জানিনা। বুলবুল হেসে ফেলে। মা জানে না। মা জানে না। আমি বলছি। কারণ হলো কোকিলেরা বাসা তৈরি করতে জানে না। তাই কাকের বাসায় ডিম পাড়ে। যেন কাক তা দিয়ে বাচ্চা ফুটাতে পাড়ে। কিন্তু জানো মা কাকগুলো খুবই নিষ্ঠুর। কোকিলের বাচ্চাগুলোকে ঠোকরিয়ে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়। বাচ্চাগুলো খুব কষ্ট পায় তাই না মা?

সখিনা কোন কথা বলতে পারে না। তার বুকে বইতে থাকে সিডরের তান্ডব। তার চোখের কোনায় গলে যাওয়া মোমের মতো জমাট বাঁধে অশ্রুদানা। আলো আঁধারীর রাজপথে ভেসে ওঠে ডাস্টবিনে কান্নারত একটি শিশুর বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কারিমুল ইসলাম খুব সংক্ষেপে সুন্দর চিত্রবর্ণনা। ভাল লেগেছে বাস্তব জীবনের এই নিষ্ঠুরতার কাহিনী
ভালো লাগেনি ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
বালোক মুসাফির এক জন আদর্শ গল্পকারের গল্পের অবয়ব। দারুন লাগল শুভ কামনা রইল আগামীর।
ভালো লাগেনি ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
সাদিক ইসলাম মাতা পিতাহীন বুলবুলের জীবন অঙ্কন চমৎকার। ভালো লাগলো। আমার পাতায় আমন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
ম নি র মো হা ম্ম দ “বুলবুল আমার বুলবুল গাঙ্গের পাড়ে কাশফুল গাইয়্যা বেড়ায় গান। আসবেন আমার কবিতার পাতায়, আমতন্ত্রণ।
ভালো লাগেনি ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
সুমন আফ্রী ভালো লাগলো। শুভকামনা কবির প্রতি... আমার পাতায় আমন্ত্রণ
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮
মোঃ নুরেআলম সিদ্দিকী চমৎকার একটি গল্প, পড়ে বেশ ভালো লেগেছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে, মকবুল তার সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে পালক সন্তান লালন করেছেন। যখন তার আপন সন্তান জন্ম নেয়, তখন পালক সন্তানের প্রতি আদর কমে যায়। আর তখনই পালক সন্তান বুঝতে পারে উনারা আমার আপন মা বাবা নয়, কিন্তু শেষে মকবুলের স্ত্রীর দু'চোখে জল এইটুকু বুঝে উঠতে পারলাম না!! শুভকামনা রইল....
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

১৪ নভেম্বর - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪