এক জীবনের ব্যর্থ আশা

শ্রমিক (মে ২০১৬)

ইমরানুল হক বেলাল
  • ১০
  • ১২
ঘটনাটা বেশি দিন আগের নয়। কিছু দিন আগে এই কোম্পানিতে
ছাদ ডালাই করতে গিয়ে দিদার নামে একজন শ্রমিক হঠাৎ ওপর থেকে নিমন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে মারা যান।
ঘটনার আকস্মিকতায় রাস্তায় ভিড় জমে ওঠে।
খুব শিগগিরই লাশ যত্ন সহকারে দেশে পাঠানো হয়।
দিদার যে কোম্পানিতে কাজ করত মনিবের কাছে তাঁর ছয় মাসের বেতন পাওনা ছিল। কথা ছিল মে মাসের এক তারিখে দেশে ছুটি কাটিয়ে আসার জন্য সব টাকা পরিশোধ করা হবে।
তার সাথে দুই বছরের কাজের বিনিময়ে দুই মাসের বাড়তি লিফ সেলারি দেওয়া হবে।
আর এখন দেওয়া তো দূরের কথা কপিল সাহেব বলছেন,
দিদারের পরিশ্রমের সব টাকা আগেই দেওয়া হয়েছে।
তাই লাশের সাথে দিদারের পরিবারকে কিছু অর্থ দিয়েছে।
অথচ দিদার ছিল এই কোম্পানির সবচেয়ে পারিশ্রমিক লোক।
কাজের ক্ষেত্রে সে দিন কে রাত রাতকে দিন মনে করতো না।
পাগলের মতো কাজ করতেন। গায়েও ছিল প্রচন্ড জোর। তার কাজের অবদানেই দরিদ্র কপিল জিরো থেকে হিরো বনে যান।
যখন লাশ দেশে বাবা মায়ের কাছে পৌঁছে যায় সারা বাড়ি জুড়ে নেমে আসে কান্নার রোল।
পরের দিন দিদারের লাশ দাপন করা হয়।
দিদারের পরিবারের ছিল চার বোন তিন ভাই।
ভাই বোনের মধ্যে ও ছিল তৃতীয়। এবার দেশে গিয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা ও ছিল দিদারের।
দরিদ্র পরিবারের অভাব অনটন দূর করার জন্যই
ও বাহরাইনের মানামা নামের একটি সিটিতে জীবিকার সূত্রে আসে।
ইচ্ছে ছিল বাবা মায়ের চাহিদা পূর্ণ করবে। নিজ পরিবারকে সুখী করে তুলবে। প্রতিদানে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই হলো তাঁর শেষ ঠিকানা।
দিদারের হঠাৎ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর সব
চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে আবছারুল।
তাঁরা দুজনে ছিল পরস্পরের অন্তরঙ্গ বন্ধু।
শৈশব কিশোর পেরিয়ে স্কুল পাঠ থেকে শুরু করে খাওয়া দাওয়া ঘুম সব কিছুতেই দুজন দুজনের পাশে ছিলেন।
প্রবাস জীবনেও তারা ছিল পরস্পরের সঙ্গী।
যেন এক বৃন্দাবনে দুটি ফল।
মনিবের কাছে দিদারের পাওনা টাকার জন্য অনেক ঝগড়া ঝাটির পরেও কাজ হলো না।
তাই কপিলের প্রতি তাঁরও মন ওঠে গেছে। এখানে ও আর বেশি দিন থাকতে চায় না।
এদিকে আবছারুল ও ছিল একই পথের পথিক।
ওরা ছিল পরিবারে চার ভাই দুই বোন।
ভাই বোনের মধ্যে আবছারুল তৃতীয়। খুব ছেলে বেলায় আবছারুলের বাবা হঠাৎ একদিন হার্ট ষ্টোক করে মারা যান।
এই ক্ষুদ্র জীবনে এতটুকু সময় বাবাকে পেয়েছিল আবছারুল।
সেই স্মৃতি গুলোই ছিল ওর স্মরণীয় মুহূর্ত।
বাবার আদর কুড়ানো মুখ, শাসন,স্নেহ, মমতা, আজ সব কিছু যেন স্মৃতি হয়ে রইল।
বেশ মনে পড়ে বাবা মারা যাওয়ার কিছু দিন পরেই
তাঁর বড় ভাই বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার থেকে আলাদা হয়ে শহরে চলে যান।
তখন সংসারের হাল আবছারুলকেই নিতে হলো।
সেই জন্য পরিবারের অভাব দূর করার জন্য আবছারুল জীবিকার সন্ধানে বাহরাইনে আসেন।
আবছারুলের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে-
স্কুল জীবন শেষ করে যখন ও কর্ম জীবনে ফিরে আসে
তাঁর প্রথম কাজ গুলি ছিল কাগজ টোকানো, মাটি কাটা,
ধান কাটা , ক্ষেত বাছা,এমনকি কুলি দিন মজুর করে ঘরের হাট বাজার চালাত সে। সকাল হতেই ও বেরিয়ে পড়ত মাঠে, ঘাটে, কিংবা জঙ্গলে,ঘরে ফিরে আসত সন্ধ্যা পার করে।
প্রচন্ড ক্লান্তিতে সারা শরীরটা ভেঙে পড়ত তখন। হাট বাজার করে যে টাকা গুলি বাচঁতো বাকি টাকা গুলো মার হাতে দিত সে।
আবছারুলের মা টাকা গুলোকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আলমারি খুলে ভেতর রেখে দিতেন। চোখ নিচু করে সুখ্যাতি করে বলতেন,
সোনা মানিক আমার, কী বলে যে•••আর্শীবাদ করি•••।
মাঝে মাঝে আবছারুল খেয়াল করে দেখতে, কিছু টাকা হাতে নিয়ে মা নিঃশব্দে কাঁদছেন। ঝামার মত সছিদ্র তাঁর নাকের ডগায় ঝুলে রয়েছে এক ফোঁটা ঘোলাটে চোখের জল।
মনে পড়ে আবছারুলের প্রবাসে আসার সময় মা তাকে বুকে জড়িয়ে অশ্রুভেজা চোখে বলছিল, বিদেশ গিয়ে সুন্দর ভাবে চলো বাবা।
কখনও কারো মনে কষ্ট দিও না।
মনে পড়ে ছোট্ট ভাইটি তখন বলেছিল, দাদা, তুমি কি সত্যি সত্যি আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছ? কবে আসবে আবার?
বিদেশ থেকে আমার জন্য একটা ঘড়ি, একটা টুকটুকে লাল জামা আর লুঙ্গি পাঠিয়ে দিয়ো।
এভাবে দীর্ঘ দুটি বছর পার হলো।
ধীরে ধীরে তাঁর ভিসার মেয়াদ ও শেষ হয়ে আসলো।
আবছারুল ভেবেছিল দুই বছরে তাঁর বিদেশে আসাতে পাওনা ধারদের টাকা শোধ করেছ।
এখন আবার নতুন করে ভিসা লাগিয়ে বেশি বেশি টাকা ইনকাম করে নিজ পরিবারকে সুখী করবে।
মায়ের চাওয়া পাওয়া আর ভাই বোনের চাহিদা পূর্ণ করবে।
এ জীবনের দায়িত্ব তার শেষ হয়ে যায়নি। পেছনে পড়ে আছে আরো অনেক গুলো স্বপ্ন। আবছারুলের প্রথম চাওয়া ছিল একটা বাড়ি নির্মাণ করার। তাঁর পর ব্যবসার জন্য কিছু টাকা।
তার পরে নিজ গ্রামে একটা মসজিদ নির্মাণ করা।
কিন্তু দারিদ্রতা আর মানুষের জীবনের চাওয়া পাওয়া চিরকাল অপূর্ণই থেকে যায়।
যেমন ছিল দিদার তেমনই কাজে কর্মে আবছারুল ছিল সবার উপরে। তা দেখে কপিলের হৃদয় ভরে ওঠে। কপিল সাহেব আবছারুলের কাজের যোগ্যতা দেখে তাকে অন্য নজরে দেখত।
বিষয়টি তাঁরই সঙ্গী কয়েকজন শ্রমিক দেখে গাঢ় লাল হয়ে ওঠে।
সব শ্রমিক একত্রিত হয়ে বলাবলি করল,
আবছারুল এখন আমাদের শ্রমিক নেতা হয়ে গেছে।
তার কাজের যোগ্যতা ভালো বলে কপিল সাহেব আমাদের এখন মূল্যায়ণ করে না। ওকে সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে এখান থেকে বের করে দিলে কেমন হয়।
বলা মাত্রেই কাজ। সবাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিল।
অন্য সব শ্রমিকরা দিনের পর দিন কপিলের কাছে তাঁর নামে নালিশ করে- আবছারুল এখন আগের মত কাজ করে না।
সারাক্ষণ দেশে ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
আমাদের কারণে অকারণে গালিগালাজ করেন।
সব কাজে করে শুধু ভুল।
সবাই এক সঙ্গে নালিশ করাতে কপিলের মন উল্টে গেলো।
উনি আবছারুলকে এ কোম্পানিতে আর দেখতে চান না।
অল্প দিনের ভেতরেই পাসপোর্টে লাল কালির আঁচড় মেরে বলল, তোমার ভিসা খালাস•••এবার মুলুক যাও•••।
তখন অসহায় আবছারুলের পাল্টা জবাব দেওয়ার মত ভাষা ওর মুখে ছিল না। দেশে যাওয়ার জন্য কপিল সাহেব তিন দিন আগেই ক্রিকেট রেডি করে রেখেছিল।
সেই দিন এক বুক কষ্ট আর তীব্র অভিমান নিয়ে অশ্রুসজল হয়ে
দেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল।
এখানে শেষ হলো তাঁর বনবাসী জীবনের সমাপ্তি।
যাওয়ার পথে আকাশের দিকে জলরাঙা দৃষ্টিতে তাকিয়ে
বিড়-বিড় বলতে লাগলো-মানুষ কেমন করে এতো নিষ্ঠুর হয়!
কেমন করে একে অপরের এতো বড়ো সর্বনাশ করতে পারে!
কেমন করে একে অপরের একটি ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিতে পারে!
আবছারুল মনে মনে ভাবে, ভুল করে দেশ ছেড়ে জীবনের অনেক গুলো স্বপ্ন হারিয়ে গেল। কিছু স্বপ্ন বাকি ছিল,
কিছু স্বপ্ন পূর্ণ হলো। কিছু স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেল।
যতটুকু পেয়েছি, তার চাইতে জীবনের অনেক গুলি সুখ কেড়ে নিয়েছে।
আসলেই সত্যিই মানুষের জীবনের বনবাসী সাজাটা অনেক কষ্টের!অনেক দুঃখের! অনেক যমযন্ত্রণার!
বনবাসী জীবন কারো কারো জন্যে সোনার হরিণ!
কারো কারো জন্যে বেঁচে থাকা!
কারো জন্য নেমে আসে অকালমৃত্যু! কারো কারো জীবনের সব স্বপ্ন হয়ে যায় বিবর্ণ।
অবশেষে আবছারুল যখন দেশে পৌঁছায়। সবার আগে
তাঁর মা এসে সব যাতনাটা ভুলে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
মায়ের বুকে পরম মমতা পেয়ে আবছারুল ভুলে গেল জীবনের সব দুঃখ।
হয়ত মায়ের আদর মমতা আর ভালোবাসাই
হবে তার জীবনেরনিত্য সঙ্গী।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফেরদৌস আলম darun golpo, onek onek valO laglo laglo vai.
সালমা আক্তার probashe onek dukko bedona peye deshe mayer boke fire ashe smapti, sob miliye asadaron golpo likhechen, pore khub valo laglo. sobo kamna rollo.
ইমরানুল হক বেলাল aponar mulluban motobbo peye valo laglo milon bhai. Ashes kitiggota roilo.
মিলন বনিক সময়ের বাস্তবতায় কাহিনীর ধারাবাহিক বিন্যাস অবশেষে মায়ের কোলে সুন্দর পরিসমাপ্তি...চমৎকার লাগলো...শুভকামনা....
ইমরানুল হক বেলাল amar lekha aponar kache valo legeche jene khusi holam robon bhai. salam of sobeccha niben.
ইমরানুল হক বেলাল donnobad tonima apu. comment korar jonno osonk kitiggota Jamai.....
ইমরানুল হক বেলাল donnobad fokrul bhai. onek kitiggota roilo. amar salam niben.
আহা রুবন লেখনী শৈলি বেশ! বাহুল্য নেই। নতুন গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম এবং ভোট।
রেজওয়ানা আলী তনিমা গল্প ভালো হয়েছে। শুভকামনা।
মোহাঃ ফখরুল আলম ভাল লাগল। ভোট দিলাম।

২৬ অক্টোবর - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী