আমাদের বিছানাটা পাতিয়ে দিয়ে মা সবাইকে বললেন-, ‘এয়- তোরা চুপচাপ ঘুমাস্ যেন । রাত্রে যদি- কালকের মতো চিতকার চেঁচামেচি শুনেতে পেয়েছি তবে, রক্ষে নেই আর । কথাটা মনে রাখিস্ তোরা ’! সবাই মিলে এক সাথে ঘুমিয়ে পড় লক্ষ্মী ছেলে হয়ে ।
আমরা সবাই মিলে একই সাথে বলে দিলাম , “ঠিক আছে । আমরা আজকে কোনো কথা বলবো না । তোমাদের লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবো” ।
এই শুনে, মা চলে গেলেন । মা, যেতে না যেতেই, আবার গল্প চালু ।
রামা বলল; “ দেখিস্ সব্বাই, আমিই আগে উঠবো ঘুম থেকে, আর গোটা দশেক তো সবচেয়ে বড় বড় আম কুঁড়িয়ে আনবো । আর স্কুলে তাপসের সাথে ক্লাসে বসে বসেই খাব্বো ”!
সুজয় বলল; -তুই “ হাত্তি পাবি’ , আমার বালিশের পাশে দেখ , টিং টিং- ঘড়ি । তুই ওঠার আগেই দেখবি-, গাছের নীচে একটা পাতাও পাব্বি না । আমি স-ব সাফ্ফাই করে দেবো ”।
এই না শুনে রাজু লালসাতে বলে উঠল-; “ সুজয়-দা , সুজয় দা, তুমি যখন যাবে, আমাকে ডাকবে গো । আমিও যাবো, সাথে । অনেক দিন থেকে না- আমের একটা মুখও দেখিনি । যখনই যাই তখন আমের ছোটো ছোটো চানাই পাই । আজ তোমাকে ছাড়ছি না আমি । (-স্বজোরে বলে ওঠে,)বলো, বলো-, নিয়ে যাবে তো আমাকে । –কি গো সুজয় দা , হ্যাঁ বলো-, হ্যাঁ বলো”!
ঠিক ওদের পাশেই, মানে দেওয়ালের দিকে আমি মুখ করেই, নিস্তব্দে ঘুমোচ্ছিলাম । বন্ধুদের জোরালো চিতকার চেঁচামেচি শুনে, খুব -ধীর কণ্ঠস্বরে, কিন্তু-, গম্ভীর স্বরে, ওদেরকে শাসিয়ে দিলাম এই বলে যে ; “ কি করছিস্ তোরা, এত চিতকার, বাপ্-রে ! পাশে মা ঘুমাচ্ছে যে- । এত্ত করেই মা তোদের শাসিয়ে গেল, তবুও তোদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে অবাক হচ্ছি । আমাকে দেখেও তোদের শিক্ষা হয়নি । আমি কেমন কাল মার খেয়েছিলাম । এক্ষুনি চুপ কর , নয়তো মা উঠে এলে- কিংবা এই ব্যপারে যদি আমার নাম উঠে আসে তবে তোদের সাথে ‘কাট্টি’ করে দেবো । ‘ঘুমা’ তাড়াতাড়ি ”! এমনি করতে করতে রাত্তির তখন এগারো’টা- বেজে গেল । সবাই ঘুমিয়ে পড়ল । আর আমিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম ।
রাত্রি তখন দুটো । টিং- টিং- টিং- । ফের , টিং টিং টিং- ।
ওহ্ ! আর পারা গেল না । এই বোকাটে সুজয়কে নিয়ে, আর পারা গেল না । বোকা কোথাকার । গাধা কোথাকার । উঠবে ভোরের বেলায়, আর বেটা এর্লামের সময় দিয়ে রেখেছে রাত দু’টোতে । ওহ্ !ধেত্-তারিকি !
আমি উঠে, এর্লামটা বন্ধ করেই, সবার দিকে একটু এদিক-ওদিক দেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম । কারণ , সাত’টাতে স্কুল আছে আমার । তাই, আমাকেও উঠতে হবে তাড়াতাড়ি । কিন্তু-, কোনো মতেই আর চোখের দু’পাতা এক হল না । কেন জানি না, মনের মাঝে নানান রকম ভাবনা, ঘুরপাক খেতে লাগল । ভাবতে লাগলাম- ; আমি যদি ‘ছোটা ভীম’ হতাম । তাহলে সব দুষমন কে ‘ঢুসুম’-‘ঢুসুম’ করে মেরে উড়িয়ে দিতাম । তখন স্কুলের সবাই হত -আমার দোস্ত । মণ্টু, বল্টু, গিলটু, এমনকি চিণ্টুও । আমাকে অবাক হয়ে দেখতো সবাই । কেউ কেউ সুটিং করতে আসতো, আবার, আমায়-, দেশ থেকে, বিদেশ থেকে-, কতই না নামি দামি লোক । হঠাত মন থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, ‘না, না, আমি ছোটা ভীম হবো না, আমি-ই ‘সকা-লাকা বোম বোম’ হবো, । মন যা চাইবে আমি , তাই আঁকবো, তাই- লিখবো । আমি তাই লিখবো, আর -তাই আঁকবো । লিখবো পিঠে-, আসবে সোজা, ঢুকবে পেটে । আঁকবো মিঠে, আসবে সোজা আর সোজা ঢুকবে পেটে । নানান রকম শিশু মনের কথা ভাবতে ভাবতে, আমার কখন যে ঘুমটা -এল টেরই পেলাম না ।
পরেদিন সকাল বেলা , একটু দেরি করেই আমার ঘুম ভাঙ্গার পর উঠেই দেখি , পাশে কেউই নেই । আমি সোজা, মুখ-টুখ না ধুয়ে, দিলাম ছুট, আম বাগানে । যেতে যেতে ভাবলাম-, “আজকে, -আর আমার ভাগ্যে জুটবে না । এই- রামা, রাজু কি আর রাখবে আমার জন্যে ! সব কুড়িয়ে নেবে” । হাঁপাতে হাঁপাতে পৌচ্ছে গিয়ে, যখন দেখি-, তিন জন বন্ধুর সাথে আরোও গোটা দশেক ছেলে-মেয়ে একটাই আম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে । আমাকে দেখেই-, সুজয় দৌড়ে এল, এবং বলে উঠল-; “ নেপুদা, নেপুদা, তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষন ! গিয়েছিলে বা কোথায় ? ক’টা পেলে আজ ! জানো নেপুদা , আজ আমরা কেউই পায়নি, একটাও । এমনকি আমের একটা ছোটো দানাও মেলেনি । চলো , চলো , খেয়ে দেয়ে স্কুলে যাই ।
আমি বেটা সুজয়ের বক্তব্য গুলো শোনার পর , কিছুই উত্তর না দিয়ে, সোজা আর বাকি দুজনকে স্বজরে ডাক দিলাম । তারা হাজির হল । এবং হাজির হবার পর, চোখ দুটো লাল করে, তিন জনকে বলতে লাগলাম ; “ তোরা আমাকে আজ ডাকিস্ নি কেন ! তোদের তো আমি, রোজই ডেকে দি ভোর বেলা । খুব ভালো বন্ধুও মানি তোদের কে । একটা কিছু জিনিস আনলে, আমি না খেয়ে আগে তোদের কেই দি । দেখলি তো ! আজ , এত তাড়াতাড়ি উঠার পরও তোরা একটাও আম পাসনি । আর পাবিও না, কারন, তোরা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিস্ । তাই, আজ থেকে তোদের সাথে ‘কাট্টি, কাট্টি, কাট্টি’ । তোরা আমার কেউ নস্ । আর আমিও । কোথাটা মনে রাখিস তোরা । ” এই বলে আমি খুব রাগতে রাগতে ফিরে এলাম ঘরেতে । তারাও ফিরে এল-, আমারই পাছে পাছে ।
তখন, সকাল সাড়ে সাতটা । আমাদের পার্শ্ববর্তী স্কুলে আমরা সবাই তখন উপস্থিত । প্রথম ক্লাস বাংলার পরে, সবাই স্কুলের ইংরেজি পড়া পড়ছি । প্রতিদিন দিদিমনির নিয়ম অনুযায়ি, ইংরেজির হস্তাক্ষর খাতা টেবিলের উপর জমা দিতে হয় । আমিও দিয়েছি । কিন্তু, রামা, রাজু এবং সুজয় দেয়নি । কারন , তারা ইংরেজিতে একেবারে গাধা । এমন কি, তারা ভালো ভাবে লিখতেও পারে না । উলোট-পালোট এবং যত্নহীন ভাবে লেখে । তাই, ওদের মধ্যে রাজু ইংরেজির খাতা নিয়ে হাজির হয়েছে । তখনও দিদিমনির ক্লাসে ঢুকতে, আরোও পাঁচ-পাঁচটি মিনিট বাকি ছিল । আমি প্রথম না বলার মানসিকতায় ছিলাম, কিন্তু আমি আর অতশত না ভেবে, খাতাটা ছিনিয়ে নিয়ে এক মিনিটের মধ্যে লিখে দিয়ে , নিজের লাম লিখে, জমা দিতে বলে দিলাম, এবং সুজয় ও রামাকেও খাতা আনতে বললাম । ওরা নিয়ে আসার আগেই দিদিমনি ক্লাসেতে ঢুকে যায় । কিন্তু, সেই দিনটি কোনো একটা ব্যস্ততার কারনেই দিদিমনি আর খাতা দেখেননি । খানিক বাদেই যে পড়াটাই ছিল , সেই পড়াটাকে রিভিজন্ করতে বলে দিলেন । তাই, ওদের, কোনো একটা অসুবিধে হয়নি । কিন্তু-, পরের ক্লাসটা ছিল ইতিহাসের, আবার -ওই দিদিমনির-ই । দিদিমনি এলেন এবং নতুন একটি অধ্যায় পড়াতে চালু করেদিলেন । এদিকে-, রামা অর্থাত দীপক অহরহ তাপসের সাথে কথা বলা চালু করে দেয় । দিদিমনি শুনার পর আগে ওদেরই নামটাই উঠে আসে । দিদিমনি ডাক দেয় । ওরা উঠে আসে দুইজনাই ।
(স্ব-জোরে, দুজনকেই, বেতের আঘাত করে। ) কথা বলছিলে কেন ? আমি এদিকে কি পড়ালাম, শুনেছো ! কিসের কথা এত ? বলো ! না হলে-
আতঙ্কেতে তাপস বলে উঠে; “ দিদিমনি- দীপকদা’ই কথা বলছিল আমার সাথে । আমি কোনো কথা বলি নি ” ।
“ মিথ্যে কথা দিদিমনি, এ ও আমার সাথে খুব কথা বলছিল ” । রামা স্ব-জোরে বলে উঠল দিদিমনিকে ।
“ কিসের কথা ”?- দিদিমনি আবার প্রশ্ন করল তাদের ।
ওই সময় ক্লাসের এক সহপাঠি, দাঁড়িয়ে বলতে লাগে;- “ দিদিমনি ওরা ‘আম’ নিয়ে এসেছে ” । ওদের দুইজনারই ব্যগের মধ্যে আছে । আমাকে দিয়েছিল । কিন্তু, আমি মানা করে দি । আমি নি নি” । -এই বলেই ওদের দুইজনার ব্যগ দিদিমনির কাছে দিয়ে এল ।
তারপর আর কি , পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট, ক্লাসের বাইরে দুইজনাই দুইজনার কান ধরে হাঁটুগেড়ে বসে রইল । আমি তো খুব আনন্দ উপভোগ নিচ্ছিলাম । কারন সকালের ওই ব্যপারেতে আমি রেগেই ছিলাম ওদের উপরে । আমি মনে মনে শুধু একটা কথাই বলছিলাম ওদেরকেই-, “ না ডাকলে ক্যাঁচকলা , আর স্কুলেতে কালমলা ” ।