মাত্র কিছু দিন আগে এই বাড়িতে একটি মেয়ে ফ্যানের সাথে নিজের ওড়না গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
ফিলিপাইনের একটি মুসলিম অবিবাহিতা কাজের মেয়ে সেজুতি। এ বছরের মে মাসের শেষের দিকে দেশে ফিরে ছুটি কাটিয়ে আসার কথা ছিলো।
বাবা-মা সেজুতির জন্য নির্বাচিত পাত্র দেখে বিয়ের কথাবার্তা ফাঁকা করে রেখেছিলেন মেয়ে দেশে ফিরে আসলেই ধুমধামের সঙ্গে বিয়েটা হবে।
কিন্তু নিয়তির নির্দেশ ছিল অন্যরকম!
এই বাড়ির মনিব বুড়ো ছিলেন শয়তান!
গভীর এক রাত্রির আঁধারে সেজুতির যৌবন-সুধা পান করার জন্যে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বুড়ো কে বাঁধা দিলে বুকের উপর প্রচন্ড লাথি ঘুষি খেয়ে নিজের প্রাণ হারাতে হয়।
ঘটনাটা এই গভীর রাত্রির আঁধারে বুড়োর নিজ পরিবার ছাড়া অন্য কারো নজরে পরেনি। তারা তাদের নিজেদের মানসম্মান হারানোর ভয়ে
দেখে ও না দেখার ভান করে নিরব হয়ে বসে থাকেন।
যদিও বাহিরে আশেপাশের দুই একজন ঘটনাটা বুঝতে পারেন কিন্তু মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সেই জন্যে এই মৃত্যুর জন্য বাড়তি কোনো ঝামেলা জড়িয়ে পড়েনি।
তবে এই বাড়ির আরেকজন কাজের মেয়ে সাদিয়ার চোখে ঘটনাটা নিরবে সাক্ষী হয়ে আছেন।
তারা সাদিয়াকেও হত্যার ভয় দেখিয়ে নানানভাবে হুমকি চমকি দিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন।
বিশাল এই বাড়ির উওর দিকে রান্না ঘরের পাশে একটি রুম। যে রুমটিতে সেজুতি থাকত।এই রুমটিতে এখন সাদিয়াকেও থাকতে হবে।
ভাবতেই ভয়ে আতংকে গা শিহরণ জেগে উঠল।
একবার চোখ মেলে তাকিয়ে রুমের চারিপাশে দেখে নিল সাদিয়া। সেজুতির রেখে যাওয়া জিনিস- পত্র কাপড়-চোপড় যেভাবে ছিলেন ঠিক আগের মতোই যেখানে -সেখানে পড়ে রয়েছে। শুধু বিছানাটা শূন্য।
এই রুম এই বিছানাতে সাদিয়া এখন থাকতে ভয় পায়। সারা রাত আলো না জ্বালিয়ে তার ঘুম আসে না।
তার পরেও আজ রাতে প্রায় শেষের দিকে সেই ঘটনাটা সাদিয়ার ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মাঝে ভেসে উঠলো।সে দেখতে পেলো-
সেজুতির প্রাণহীন দেহটা সিলিং ফ্যানের সাথে নিথর হয়ে ঝুলিয়ে রয়েছে। ঝুলন্ত অবস্থায় থাকা সেজুতির মৃত লাশটি যেন সাদিয়াকে বিড় বিড় করে কথা বলছে-
'তুইও বাঁচতে পারবি না সাদিয়া!•••
ওরা তোকেও বাঁচতে দেবে না। পালিয়ে যা•••!
এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নটা দেখার পর সাদিয়া ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ল।
ঠিক সেই সময়ে বুড়ো শয়তানের ছোট ছেলে নরপশুটার ঘুম ভেঙেছে বলে সাদিয়াকে প্রচন্ড মারধর করে।
তার পর থেকে সাদিয়া সতর্ক হয়ে থাকে সর্বদা।
আজ রাতেও বুড়ো জানোয়ারটা সাদিয়ার যৌবন লুটে নেওয়ার জন্য ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
কিন্তু সাদিয়া ঐ রকম ডাচের মেয়ে না যে পয়সার বিনিময়ে নিজের ইজ্জত বিক্রি করে দেবে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তবু ও দেহে হাত ছোঁয়াতে দেননি।
এমন অসহায় নির্যাতন দীর্ঘদিন যাবত ধরে
সহ্য করে আসছে।
সাদিয়ারা ছিলেন চার ভাই,দুই বোন,ভাই বোনের মধ্যে ও পাঁচ নাম্বার। বাবা ছিলেন গ্রামের একজন আদর্শবান ব্যক্তি। যেমন উনি সরল ছিলেন তেমনিই সরল ছিলো তার হৃদয়। পেশায় যদিও তিনি ছিলেন রিক্সা ডাইভার কিন্তু তার মনটা ছিলো উদার।তিনি মানুষের দুঃখকে অন্তর দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন।
বেশ সুখেই কাটছিল সাদিয়াদের সুখী পরিবার।
কিন্তু সুখ মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী হয় না।
একদিন ঝড় তুফানের দিনে এলাকার দু জন মেম্বারের অনুরোধে তাদের কি যেন জরুরি কাজে থানায় যাওয়ার উদ্বেগ হয়। সেখান থেকে এই প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রিক্সা চালানোর আসার পথে হঠাৎ সাদিয়া বাবা হার্ট ষ্টোক করে মারা যান। তখন সারা গ্রাম জুড়ে নেমে আসে মৃত্যু সুখের ছায়া। সেদিন সাদিয়া বাবার মৃত লাশ দেখার জন্য সারা গ্রামের মানুষ ছুটে আসেন।
তখন সাদিয়ার ছিল কিশোরী বয়স।
এই ক্ষুদ্র জীবনে যেটুকু সময় বাবাকে পেয়েছিল সেটাই তার সব চেয়ে বড় স্মৃতি। প্রিয় বাবার আদর কুড়ানো মুখ,শাসন, স্নেহ, মমতা,সব কিছু যেন আজ স্মৃতির ফ্রেমে বাঁধা। তখন হয়ত, বাস্তবতার নিষ্ঠুর নীরবতা মেনে নেওয়ার মতো বয়স ওর
ছিল না। তবে বেশ সাদিয়ার স্পষ্ট মনে আছে ওর বাবা মারা যাওয়ার কিছু দিন পরই বড় ভাই,মেজো ভাইয়েরা নিজেদের স্বার্থের জন্যে বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার থেকে আলেদা হয়ে যান। একজন হলেন শহর বাসি; মেজো ভাই হলেন প্রবাসী। তারা এতো টাকা রোজগার করে ও ছোট ভাই বোন আর মায়ের প্রতি লক্ষ রাখেন নি। সেই সময় ছোট ভাইটি মায়ের বুকের দুধ পান করে।
সাদিয়া নিয়তির এই করুন পরিণতি কিছু বুঝতে পারল না। সেখানে পরাগের এসব ঘটনা বোঝা কল্পনা অতীত ব্যাপার মাত্র। আর মধ্য বয়সী বিধবা মা হয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের নিয়ে এতো চিন্তার মধ্যে ও তিনি চেহারায় এতোটুকু ছাপ ছিল না। এক দিকে স্বামী হারা, অন্য দিকে ওই ছোট ছেলে মেয়েদের কীভাবে মানুষ করবেন সে চিন্তায় তার দিন কাটতো।
সাদিয়া যখন ধীরে ধীরে একটু বড় হয়ে ওঠে তখন মায়ের শেষ বয়সের এই কষ্ট গুলো সহ্য করতে পারতো না। তখন সে বৃদ্ধ মাকে পরিশ্রম করতে বাঁধা দিলেন। সে তখন নিজের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে জীবনকে আত্মবলিদান দিয়ে বিভিন্ন বড়ো লোকদের বাসায় কাজ করে যেতটুকু অর্থ পায় মায়ের জন্য, ছোট ভাই বোনের খরচ বহন করে যায়।
কিন্তু মেয়ের এই কষ্ট দেখে মায়ের মন ও বাঁধা মানলেন না। উনি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে
বললেন,
মা, তুই এবার বিয়ে কর।
-কিন্তু আমি যদি তোমাদের ছেড়ে দূরে চলে যাই,
তোমরা চলবে কী করে মা।
-ও সব এখন আর তোকে ভাবতে হবে না।
আমাদের তো আল্লা আছেন। তিনি নিশ্চয় আমাদের কিছু না কিছু একটা উপায় বের করে দেবেন।
মায়ের কথা শুনে সাদিয়া বিয়েতে মত দিলেন।
সাদিয়ার সাথে যে ছেলের বিয়ের কথাবার্তা ফাঁকা হয়। বর ছিলেন তাদেরই আত্মীয়। সম্পর্কে ও সাদিয়ার খালাতো ভাই হন।
এক সপ্তাহের ভেতরেই বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হয়।
সাদিয়া ভেবেছিল স্বামীর সংসারে গিয়ে সুখী হবে।
কিন্তু হায়! 'অবাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়!'
তার ফলাফল আরো ভয়ানক হয়ে উঠলো।
স্বামী নামের বস্তু সে শুধু নামে মাত্র,কাজে নেই।
একদিন রোজগারের পথে বের হলে পাঁচদিন ঘরে বসে খায়।
শেষ পর্যন্ত এখন আবার স্বামীর সংসারের হাল সে নিজেকেই গুচিয়ে নিতে হয়।
এখন সে আবার আগের মতোই বিভিন্ন বাসায় কাজ করতে শুরু করে। যতটুকু পারেন মায়ের জন্য ও কিছু কিছু দিতে চেষ্টা চালিয়ে যান।
এভাবেই তার দিন কাটে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর।
অবশেষে সাদিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টায়। এভাবেই কী দিন চলে?
এরই নাম কি জীবন?
তাই বাধ্য হয়ে ভাবলো, নিজের সংসার, আর বৃদ্ধ মা, ছোট ভাই-বোনদের জীবন বাঁচাতে হলে আমাকে বেশি বেশি টাকা রোজগারের জন্য,জীবন বেঁচে থাকার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি দিতে হবে।
এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই ।
তাই সাদিয়া আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে আর মেজো ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা পয়সা ধার নিয়ে আরব আমিরাতে চলে আসেন।
কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়, পাঠক মহাশয়, অনেকে হয়ত এটা একটি কাল্পনিক কাহিনী মনে করেছেন?
কল্পনা নয়, বাস্তব!
সাদিয়া প্রবাসে আসার পর, কাজের নামে এখানে এই অন্যায় হত্যাচারের কথা পরিবারের সবাইকে কষ্ট পাবে বলে কাউকে কিছু বলেনি।
অনেক নির্যাতনের পর মাস শেষে যে টাকা বেতন পায় প্রথমে তিন চার মাসের আয় স্বামীর কাছেই জমা রাখতো। আর কিছু টাকা মায়ের খরচের জন্য ও আলেদা ভাবে পাঠিয়ে দিতো।
কিন্তু পাষাণ স্বামী এতো টাকা পাওয়ার পর ও তার মন ভরে না। মাস শেষ হতে-না-হতেই শুধু টাকা চাই টাকা! কিন্তু ও কি সাদিয়ার কষ্টের কথা একবার জানতে চেয়েছে?
শুধু তাই নয়, সাদিয়া বিশ্বাস করে তাকে টাকা দেয়। আর পাষাণ স্বামী নিজে কোনো কাজ না করে সাদিয়ার দেওয়া অনেক কষ্টের টাকা গুলো
ঘুরে ঘুরে বসে বসে মজা করে উড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
তার কিছু দিন পরই সাদিয়ার কানে একটা দুঃসংবাদ আসে। জানতে পারলো-
তার এই চরিত্রহীন বিবেকহীন পাষাণ স্বামী
সাদিয়ার অজান্তে একটা বয়স্ক মহিলাকে তিন বাচ্চা সহ গোপনে বিয়ে করে সংসার করছে।
এই খবরটা সাদিয়ার কানে আসার পর তার মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়! এলোমেলো হয়ে গেলো সাদিয়ার জীবন!
গভীর রাত্রে আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রুভেজা চোখে একটা অভিমানের নালিশ ছুঁড়ে দিল-
আমার এই জীবনটা যেন খেলা না, অর্থহীন!
তা না হলে এই জীবনটা কেন এমন হলো?
কেন আমি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে
বার বার ব্যর্থ হই?
বিধাতা কি আমার কপালে এক ফোঁটা ও সুখ রাখেনি?
একটা রাস্তার কুকুর তারও তো নিজস্ব পৃথিবীতে মাথা গুজাঁর ঠাঁই হয়। কিন্তু আমি পৃথিবীর বুকে এসে কী পেয়েছি?
এই সব ভেবে ভেবে কত অচেনা রাত পার হয়ে যায় সাদিয়ার।
এখন যে টাকা মাইনে পায় মায়ের একাউন্টেই জমা রাখে।
এই তো মাত্র কিছু দিন আগে আরেকটি দুঃসংবাদ এসেছে। ফোনে মা জানিয়েছে উনার শরীরের পেশারের ছাপটা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
যে কোনো মুহূর্তে উনি মৃত্যু ডেকে নিয়ে যাবে পরপারে।
খবরটা জানার পর সাদিয়ার বুক মায়ের জন্য কেঁদে ওঠে! শুধু ভাবে কখন দেশে ফিরে যাবে?
সাদিয়া মনে মনে ভাবে এমন দুঃখের দিনে যদি মা পাশে থাকত পরম মমতার চাহনিতে তাকে বুকে জড়িয়ে নিতো। তখন মায়ের আদর-মমতা মাখা ভালোবাসার পরশে হয়ত তার পাহাড় সমান দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যেতো।
আজ সাদিয়া শুধু তাই ভাবে-ভুল করে দেশ ছেড়ে জীবনের কিছু কিছু চাওয়া পাওয়া হয়ত পূর্ণ হয়েছে। যতটুকু পেয়েছি তার চাইতে জীবনের অনেকখানি সুখ কেড়ে বেশি।
কে-ন-ই-বা প্রয়োজন ছিল এই অনর্থক অর্থহীন জীবনের! শুধু অর্থই কি পারে জীবনের সব কিছুর সমাধান দিতে?
মানুষের জীবনে এই বনবাসের সাজা বড়ই কষ্টের!
বড়ই দুঃখের! বড়ই নিঃসঙ্গের!
২৫ অক্টোবর - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
২৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪