দিন যায়, দিন আসে। তেমনি স্বাধীনতা ঘুরেফিরে বারবার আসে।
স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনে শুধু তাৎপর্য নয়, তার ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গেলে ভাবনার শেষ নেই। এ দিনটি শুধু ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ নয়,নবতর অঙ্গীকারের চেতনাবাহীও।উন্নিশো একাওরের ছাব্বিশে মার্চে ঘোষিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা,শুরু হয়েছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালিদের ইতিহাসের এক মাইলফলক এই দিনটি। পাকিস্তানী শত্রু বাহিনীরা যেভাবে আমাদের অধিকার কেরে নিতে চেয়েছিল দীর্ঘ তেইশটি বছর ধরে তা স্বাধীনতার সূর্যদিনে উপনীত হয়েছিল এই দিনে।
আমরা ভুলে যায়নি বায়ান্ন-এর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্ন-র সাধারণ নির্বাচন, আমরা আজো ভুলতে চাই না বাশটি-র শিক্ষা আন্দোলন,
আমরা ভুলতে চাই না শিষটি-র ছয় দফা আন্দোলন, উন্নসওরের-এর গণঅভ্যন্তথান অগনিত আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে স্বপ্নকে বুকে নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল সওরের নির্বাচন আর একাওরের রক্তাক্ত মার্চের অসহযোগ আন্দোল পেরিয়ে ছাব্বিশে মার্চেই সেই স্বপ্ন পরিণতি করেছিল মহান স্বাধীনতার রূপ।
স্বাধীনতার জলদমন্ত্র ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেদিন অধিকারহারা নিপীড়িত মানুষের শোষণমুক্তির স্বপ্নসাধ অর্জন করেছিল এক নতুন দিক-নির্দেশনা।সে দিনটি ছিল আমাদের আত্মপরিচয়ের গৌরব উজ্জ্বল। "ত্যাগে ও বেদনায় মহীহান।"
এক গৌরবময় সংগ্রামের ধারায় নিপীড়িত বঞ্চিত সাধারণ মানুষের শোষণ মুক্তির স্বপ্ন স্বাদ এই দিনে অর্জন করেছিল নতুন দিক-নির্দেশনা। তা ভাস্বর হয়ে আছে দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের সুমহান ঐতিহ্য হয়ে।
প্রতি বছর যখন স্বাধীনতা আসে তখন আমাদের নানান প্রশ্ন বোধের চিহ্নের মুখোমুখি হতে হয়।
কর্তব্যের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়- স্বাধীনতার স্বপ্ন সাধ আমরা কতটুকুই-বা বাস্তবায়ন করেছি? বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের কতটুকুই-বা সম্মান অর্জন করেছি আমরা?
এই দিনে সকল দেশপ্রিয় বাঙালি জাতিদের জন্য আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্ম-সমালোচনা করার দিন।হিসাব মেলাবার দিন। তার হিসাব মেলাতে গিয়ে যে কারণে আমাদের নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়,
স্বাধীনতার অর্থ হলো- উন্নতির শ্বাস-প্রশ্বাস। আলোক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জেগে উঠে না, তেমনি স্রোত ব্যতীত নদী টেকে না, তাই আমিও একথা বলব, স্বাধীনতা ব্যতীত আমাদের জাতি ও বাঁচতে পারবে না। সুখ-দুঃখের প্রতিশ্রুতিবাহী দিনটি এখনো জাতিকে আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে উপনীত করেনি। যে স্বাধীনতা তিরিশ লক্ষ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এসেছিল, যে স্বাধীনতা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এসেছিল,
যে স্বাধীনতা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এসেছে।
আজ শুধুই প্রশ্ন জেগে উঠে ভাবুক হৃদয়ে-
সাধারণ মানুষের জীবনে কতটুকু অর্থবহ হয়ে উঠেছে আমাদের স্বাধীনতা?
আমরা কেন ঘোচাতে পারছি না দারিদ্রপীড়িত অগণিত মানুষের দুঃখ-যাতনা, হতাশা-ব্যর্থতা?
কেন আজ স্বাধীনতার সুফল গুলো একে একে চলে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী ও গণচক্রের হাতে? এই আকাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক জাতীয় জীবনে চালিকাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে না কেন?
এসব প্রশ্ন আমাদের বিব্রত করে দেয়, বেদনা আর হতাশায় মন আচ্ছন্ন হয়ে উঠে। প্রকৃত অর্থ আমরা জানি, স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব, সেই জন্যে স্বাধীন দেশের মানুষ দায়িত্ববান হওয়া উচিত। নয় তো কি,
'স্বাধীনতাই তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গৌরব।' স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব। তাই স্বাধীন দেশের নাগরিক দায়িত্ববান হবেন। একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বাধীন মানুষেরা বসবাসের ইচ্ছা করবে।
যদি প্রশ্ন করা হয় স্বাধীনতা কার?
আমি বলব, স্বাধীনতা তাদের জন্য, যাঁরা "স্বাধীনতার জন্য" নিজের জীবনের মায়া 'ত্যাগ' করে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। যাঁরা বুলেটের আঘাত বুকে নিয়ে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাজপথে নেমেছিলেন। যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বিশ্ব মানচিত্রে অর্জিত লাল আর সবুজ পতাকার দেশ সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সেই সব দেশপ্রেমিকদের উদ্দেশ্য ছিল -'আমরা রক্ত দিয়ে এ দেশকে মুক্ত করেছি। আমরা বাংলার মাটিতে যতদিন বাঁচি আর না বাঁচি তবুও অন্ততঃ একদিন বাংলার মানুষ সুখি হবে।' কিন্তু, 'আমরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম?' 'আমরা রাজনীতি স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, তা পেয়েছি ,যদি বাংলার মানুষ সুখী না হয় তাহলে স্বাধীনতা বৃথাই থেকে যাবে।' আজ কথাটা সত্য প্রমাণ হলো। তা না হলে আজ এতো বছর অতিবাহিত হল আমরা কি পেরেছি তাঁদের সেই উজ্জ্বল স্বপ্নগুলো পূরণ করতে? এত কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমরা কতটুকুই বা দৃঢ় প্রত্যয়ী?
প্রশ্নই থেকে যায়। আজ এই স্বাধীন দেশে কেউ খেতে পায়, কেউ পায় না। কেউ বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হয় আর কেউবা মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু খুঁজে পায় না এই বিশাল মাতৃভূমিতে। আমাদের জাতিটা বড়ই অদ্ভুত! বড়ো বিচিত্র আমাদের এই দেশ! এ দেশে কারো জন্ম হয় সোনার চামছ মুখে নিয়ে, কারো জন্ম হয় দুখের পাথর বুকে বেঁধে। বিচিত্র দেশের বিচিত্র মানুষের জীবন চরণ! তাহলে স্বাধীনতা কি একেই বলব যে স্বাধীনতায় কেউ ধনী,কেউ গরিব চিহ্নিত হয়, যে স্বাধীন দেশে কেউ অভুক্ত থাকে তিনবেলা আহারের অভাবে, আর কেউ উদ্বৃত্ত খাবার নষ্ট করে ছুঁড়ে ফেলে ডাস্টবিনের চারপাশে? আর সে সব খাবার পায় কুকুর আর পশুপাখিরা। তাহলে বলা যায়-আমাদের স্বাধীন দেশে কুকুর ও পশুপাখিরা ক্ষুধা নিবারণে সফল কিন্তু আমাদের স্বাধীন দেশে সব কিছুরই বড় অভাব।
অথচ, আমাদের স্বপ্ন-আশা ও লক্ষ ছিল দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের।শিক্ষা-সংস্কৃতি,গণতান্ত্রিক চেতনা এবং সম্পদে সমৃদ্ধি অর্জনের; স্বাধীন ও স্বর্নিভর জাতীয় অগ্রগতি সাধনের। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা তার আদর্শ থেকে দুরে চলে এসেছি। স্বাধীনতার পর থেকে অনেকবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে, রাষ্ট্রনায়কের পরিবর্তন হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু, এবং স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া সহ অনেক অগ্রনায়ককে হত্যা করা হয়েছে, স্বাধীনতার চেতনাকে পরিবর্তন ও ইতিহাসকে বিকৃত করার অপচেষ্টা চলেছে।সামরিক স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে সংবিধানের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম জবরদস্তি। অন্যদিকে সমাজজীবনের দারিদ্রতা ঘোচেনি বরং সমাজে লুটেরা ধনিকের সংখ্যা বেড়েছে। কৃষকেরা ভূমিহীন হয়ে পড়ছে দ্রুত। শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। শিক্ষিতরা কাজ পাচ্ছে না। দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। জনসংখ্যা এমন হু হু করে বেড়ে চলেছে যে মাটি সে চাপ সইতে পারছে না। মূল্যবোধ মুখ থুবড়ে পড়ছে। প্রতিদিন বাড়ছে-চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, খুন,দর্শন, ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, ছিনতাই, ডাকাতি,নারি নির্যাতন সহ আরো কত কিছু । আজ আমাদের স্বাধীনতা ঘুরপাক খায় জীবনানেন্দর এই কবিতার লাইনে •••
'অদ্ভুত আধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ/ যারা অন্ধ সব চেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা/ যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া/ যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি/ এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়/ মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা/ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।'
অন্যায় লোভ, আত্মসর্বস্ব মানসিকতা, জুলুম ও অস্ত্রবাজির প্রবণতা সমাজকে করে তুলছে অস্থির ও নৈরাশ্যময়। আইন নিজের মতো চলতে পারছে না। সব মিলিয়ে আমরা পর্যুদস্ত আশাভঙ্গের বেদনায়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যে আজ চাই নতুন চেতনা ,চাই নতুন আত্ম-উপলব্ধি, চাই নতুন অঙ্গীকার। ক্ষুধা থেকে, দারিদ্র থেকে, অশিক্ষা থেকে, অবক্ষয় ও সন্ত্রাস থেকে দেশকে উদ্ধার করতে না পারলে , শ্রম ও মেধা কাজে লাগিয়ে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে না পারলে স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে না।স্বাধীনতার মূল্য রক্ত দিয়েই প্রমাণ হয়। স্বাধীনতাকামী সংগ্রামীদের দেহ থেকে যখন রক্ত ঝরতে শুরু করবে,একমাত্র তখন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হব।
আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে স্বাধীনতার চেতনাকে সুফলপ্রসূ করে তোলার দায়ভার আমাদেরই।
তখন স্বাধীনতার বিবর্ণ পতাকা হয়ে ওঠবে আরো সুন্দর।