কাঁচের বৈয়ামটা হাতে নিয়ে বিল্ডিংটার দ্বিতীয় তলায় প্রশস্ত বারান্দায় বসে আছি। রাত কত হবে বুঝতে পারছি না। হাতে কোন ঘড়ি নেই, সেটা কোন সমস্যা না। বুক পকেটে থাকা সেল ফোনটা বের করলেই জানা যাবে ক’টা বাজে। ইচ্ছে করছে না দেখার, অবশ্য কোন প্রয়োজনও নেই।
বেশ কটা নারকেল গাছ কেটে না ফেলে ঝুল বারান্দায় ফাঁকা রাখা হয়েছে সেগুলোর জন্য। গাছ গুলো বাঁচলো আর বাড়লো কিছুটা সবুজ। ছাদের যে অংশটা ফুড়ে গাছগুলো উঠে এসেছে তার চারদিকে বৃত্তাকারে বেদী বানানো হয়েছে। চারদিকে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল গাছের টব। আর্কিটেক যে প্রকৃতির কথাও মাথায় রেখেছেন দিব্যি বুঝা যায়।
বেদীতে বসে থেকে সামনের সরু গলিটার দিকে তাকিয়ে আছি। ছোট ছোট লাল-হলুদ রংয়ের গাড়ীগুলো আসছে যাচ্ছে...। এ ক’দিনে সেটা ধাতস্থ হয়ে গেছে। চারদিকে কত আনন্দ কোলাহল! আমার সময়গুলো শুধু নিঃসঙ্গতায় কাটে। বিকালের পুরোটা সময় কেটেছে বিল্ডিংটা ঘুরে। বড় একটা জায়গা জুড়ে দাড়িয়ে আছে এটা। এখনও পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি, কাজ চলছে। আমি যেখানটায় বসে আছি তার উল্টোদিকে মানে দক্ষিনে যে ঢালু সিড়ির মতো পথটা নেমে গেছে তার পাশেই সুন্দর একটা কক্ষ সাজানো। সারি সারি গাড়ি, ঘোড়া যেন যাত্রী তোলার অপেক্ষায়। পুরোটা বিকেল জায়গাটা শিশুদের হর্ষ আনন্দে কাটে। কেউ ঘোড়ায় উঠেছে তো মন পড়ে আছে লাল টুকটুকে গাড়িটার দিকে, তবুও ঘোড়াটা ছাড়তে আপত্তি। আমি অবাক চোখে তা দেখি, যেন এক দল অপ্সরা মাটির পৃথিবীতে এসে খেলছে।
জায়গাটা এখন নিরিবিলি এবং একটা ঘোর লাগা আলো-আধারীতে ছেয়ে আছে। পাশেই একজোড়া ছেলেমেয়ে বসে আছে, গল্প করছে- অনাগত ভবিষ্যৎ গড়ার গল্প। হাজারটা খুনসুটি, মান অভিমান... আমার ফোন ধরলে না কেন? এ জাতীয় না বললেই নয় ধরণের গল্প। ওরা এতটাই মগ্ন আশে পাশে যে কেউ আছে তার খেয়াল নেই, অথবা এমনও হতে পারে, “আমার দুনিয়া শুধু আমারই, থাকুক আশেপাশে হাজার জন”। ঠিক যেন আমার বর্তমান সময়টার মতো।
আমি কি অপেক্ষা করছি না প্রতীক্ষা? অপেক্ষার তো শেষ আছে, প্রাপ্তীর সম্ভাবনা আছে। আর প্রতীক্ষার আছে শুধু আশা। যা অবস্যম্ভাবী তার জন্য অন্তত প্রতীক্ষা করা যায় না। আমি অপেক্ষায়ই আছি কখন আমার ডাক আসবে।
আচ্ছা চৈতি ভাবীর যদি মেয়ে হয় তোমার পরিবার কি তা ভাল ভাবে নিবে?
সমুদ্র এটা কোন কথা হলো? ছেলে, না মেয়ে হবে এটা জানাতো এখন কোন ব্যাপার না। প্রযুক্তির কল্যাণে অনাগত সন্তানের থ্রি ডাইমেনসনাল ছবিও দেখা যায়। এটা তুমিও জানো।
হ্যা, তা তো জানিই, তারপরেও....
তুমিতো আস্ত একটা গাধা দেখছি।
সব মেয়েদের কাছেই তার প্রেমিকরা গাধা হয়ে থাকে।
না সে রকম না তুমি আসলেই একটা গাধা। আমাদের পরিবারে যদি এমন কোন চাহিদা থাকতো তাহলেতো অনেক আগেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারতাম।
হ্যা তা পারতে অবশ্য।
তাহলে...
না মানে তোমাদের একটা আশা আছে না!
না মিস্টার এমন কোন আশা নেই। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক, সুস্থ্য সুন্দরভাবে পৃথিবীতে আসুক এটাই চাওয়া সবার। বুঝলে হাদারাম....
অযাচিত ভাবেই ওদের কথগুলো আমার ভেতরে প্রবেশ করে। অথবা আমিই কান খাঁড়া করে ওদের কথা শুনি। মেয়েটা অনেক ভাল চিন্তা করতে পারে, গুছিয়ে কথা বলতেও জানে বটে।
চল চৈতি খেয়ে আসি, পরে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে রাতে না খেয়ে কাটাতে হবে। ক্যান্টিন আরো ঘন্টাখানেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
বল কি! কটা বাজে এখন।
ম্যাডাম এখন সাড়ে এগারটা।
হ্যা, চল খেয়ে আসি। খালি পেটে তোমার বোকামী ভরা কথা শুনতে শুনতে মেজাজ বিগড়ে যাবে।
ওরা আমার সামনে দিয়ে হাত ধরাধরি করে হেটে চলে যায়। এখন নিশ্চিত হলাম সময় রাত সাড়ে এগারটা। আচ্ছা আমারওতো খাওয়া হয়নি, হ্যা দুপুরেওতো কিছু খাইনি। তবু খাবার পাবার তাড়না নেই কেন? ক্যান্টিনতো শুনলাম বন্ধ হয়ে গেছে। যাব নাকি সেই রেস্টুরেন্টে চারটা খেয়ে আসতে। আরে ধ্যাৎ কী ভাবছি আমি। এখন যদি খেতে যাই ওরা ভেবে বসতে পারে মেয়েটার জন্যই গিয়েছি।
একটা আযানের ধ্বনি কানে আসে। ধর্ম আমাদের জীবনটা জুড়েই বিদ্যমান। জন্ম থেকেই সেটার শুরু যদিও তাতে নবজাতকের কোন হাত নেই। নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় মুসলিম কেউ ছেলে সন্তানের বাবা হয়েছেন।
মনের ভেতর চলতে থাকা অস্থিরতাটা বেড়ে যায়। কিছু ভাল্লাগে না। সময় যেন আমার কাছে স্থবির হয়ে আছে। খুব বেশি ধর্ম পালন যাকে বলে পুরোপুরি ধর্মান্ধ তা নই আবার অধর্মও হয়ে ওঠে না। রতœা যখন জানবে, দেখবে, কী হবে তখন? ভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকেই রতœার সাথে ঘনিষ্ঠতা। পারিবারিক অনুশাসন আর নৈতিকতার বেড়াজালে কখনো ছুয়ে দেখিনি তাকে। লেখাপড়া শেষ করে একটা কর্পোরেট অফিসে চাকুরী পাবার পর আমাদের বিয়ে হয়। আমার জন্য ভালবাসার কমতি দেখিনি কখনো তার মাঝে। নিজের সত্তার চেয়েও বেশি ভালবাসে আমাকে। আমিও ভালবাসি তাকে। তবু এমন হলো কেন?
মাস চারেক আগে যখন সবাই জানল রত্না মা হতে যাচ্ছে, তার প্রতি কদর আর যত্ন ঈর্ষনীয় পর্যায়ে উন্নীত হল। একটু একটু করে সময় হেটে যায় আর রত্নার লাবন্যতা আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। নিয়মিত চেকআপের জন্য নিয়ে আসি আদ্দীন হাসপাতালে। ডাক্তার লাবন্য কান্তি ধর রত্নাকে দেখে আমাকে ডেকে নিলেন তার চেম্বারে। আমি যাওয়ার সাথে সাথে একটা এলবাম বের করে দেখতে দিলেন। ওটা খুলে আমি যতই পৃষ্ঠা উল্টাই ততই আমার নিঃশ্বাস গাঢ় হতে থাকে। অজানা একটা আশংকা আমাকে গিলে খায়। দুরু দুরু বুকে আমি জানতে চাই, “আমার সন্তান বেঁচে আছেতো!” লাবন্য জানালেন বেঁচে আছে এবং ভাল আছে। কতকটা আশ্বস্ত হই, আবার একটা চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তাহলে উনি আমাকে এই এলবাম দেখতে দিলেন কেন?
মনে জাগা প্রশ্নটা যেন লাবন্য কান্তিকেও ছুঁয়ে যায়। উনি বলতে শুরু করেন, ”পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তাদের অনুপাতে হিসাব করলে এমন ঘটনা খুবই কম, ধরে নিতে পারেন কয়েক কোটিতে একটা এমন ঘটনা ঘটে থাকে”। তার কথায় আমার নিঃশ্বাস থেমে আসে, অজানা আশংকায় তবুও আরো শোনার অপেক্ষায় থাকি। ”একটা সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতেই হবে। আমরা শুধু পসিবলিটিই জানাতে পারি সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে।” এ কথা বলে আরো একটা জার্নাল বের করে আমার সামনে রাখলেন। আমি সেটার পাতা উল্টে স্থবির হয়ে যাই, কম্পমান হাতে জার্নালটা ধরে থাকি। লাবন্য আমাকে স্থির হবার সময় দিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে যান।
নতুন মাতৃত্বের আনন্দে বিভোর রত্না আজ সাতদিন ধরে হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। দুটো মাথা, চারটা হাত, দুটো পা নিয়ে পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় আমার সন্তানটির কথা তাকে জানাতে পারিনি। ভাবতেও পারছিনা পৃথিবীজুড়ে এমন জোরা লাগানো জীবিত ১২টি সন্তানের ভবিষ্যত কি হতে পারে, যার কোন চিকিৎসা আজো আবিস্কৃত হয়নি। অবচেতন মনে কাঁচের জারটা নিয়ে ঘুরছি শুধু.......
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৩৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪