সিঙ্গারা

ক্ষুধা (সেপ্টেম্বর ২০১১)

সূর্য
  • ১৫০
  • 0
ডানপিটে হিসেবে সুমনের একটা পরিচয় আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে, সবে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে। বাবা পাট কলের তাঁতী। মাথার ঘাম গায়ে জড়িয়ে যা উপার্জন করেন, তাতে টেনেটুনে দু'বেলার আহারের বন্দোবস্ত হয়। ঘরভাড়া আর বাকি খরচের বেয়ারা ঘোড়াটাকে বাগে আনতে মা নঁকশী কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত থাকেন। দু'জনের জীবন নিংড়ানো আয়ে সংসার খরচ এবং সন্তানদের পড়ার খরচ চলে। তাতে সহপাঠীদের সাথে তাল মিলিয়ে চলবার মতো পোষাক-পরিচ্ছদ আর বাড়তি দু-চার টাকা হাত খরচের সুরাহা হয় না।

এইতো সেদিন ওর ক্লাশের সবচেয়ে কম মেধার ছাত্রটাও কি সুন্দর সপ্রিং এবং গিয়ার ওয়ালা লাল টুকটুকে একটা বাই সাইকেল নিয়ে এসেছে। মাথায় সুন্দর একটা ক্যাপ পড়ে যখন স্কুল ছুটির পর সাইকেল চালিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, সুমন সাইকেলটার পিছনের ক্যারিয়ার ধরে দৌড়ে অনেকটা পথ চলে গিয়েছিল। ভেবেছিল তাকে বলবে যেন একটু সাইকেলে চড়তে দেয়। ওর ভাবনাটা আলো দেখার আগে আতুর ঘরেই মরে যায়। যদি আবার আগের মত বলে ফেলে, "তাঁতীর পোলা! আবার ঘোড়ায় চড়ার শখ"।

১৪ বছরের দূরন্ত কৈশরেও ওর কোন বন্ধু নেই। থাকবেই বা কি করে, বন্ধুত্বের জম্পেশ আড্ডায় বাগড়া দেয়ার ক্ষমতাতো তার নেই। দু'দিন বন্ধুর ঘাড়ে খরচের জোয়াল দিতে পারলেও তৃতীয়দিন যখন তার পালা আসে, তখন অপমানের জ্বালা নিয়ে মাথাটা নিচু করেই বাড়ী ফিরতে হয়। গরীব হলেও আত্মসম্মান বোধটা প্রবলভাবেই আছে, তাই পারতপক্ষে নিজ থেকে অপমানিত হওয়ার উৎকট বাসনা তার নেই। এত কষ্ট! তার উপর বাবা-মার চাওয়া "ক্লাশে ফার্স্ট হতে হবে।" একি কস্মিনকালেও সম্ভব? যা চাই দেবে না কিন্তু ভালটা চাই ষোলর উপর দু'আনা বেশি।

আগামী কাল ঘুড়ি কাটাকাটির উৎসব হবে। লাল, নীল হাজার রংয়ের ঘুড়ি বাতাসের নাগরদোলায় চড়ে আকাশ জুড়ে মাতাল হবে। এলাকা এবং এলাকার বাইরের কত লোক আসে এই উৎসবে। সুমনেরও ঘুড়ি উড়ানোর ভীষণ সখ। মার কাছে কদিন ধরেই ঘ্যানর ঘ্যানর করেছে একটা নাটাই, সুতো আর ঘুড়ি কেনার আবদার করে। তাতে পাওনার শিকেটা ছিড়েনি। মা খুব নরম ভাষায় কঠিন করে বলে দিয়েছেন। "পেটে যে দানা পড়তাছে সেইটা কেমনে, কোত্থেইকা আইতাছে খবর রাখ? আমি এমন ফালতু খরচের জন্য কিছুই দিতে পারুমনা। আর ঘ্যানর ঘ্যানর না কইরা গিয়া পড়তে বহ"।

একটা কাজ অবশ্য সে গোপনে করে এসেছে। "বাবার সাথে কথা আছে" বলে দারোয়ানের অনুমতি নিয়ে মিলে গিয়েছিল কাঁধে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে। সেখান থেকে সুতলী প্যাঁচানোর ভাঙ্গা ববিনের দুটো সবল চাঁকা ব্যাগে করে নিয়ে এসেছিল। দুটো চাঁকার ফুটোয় বাঁশের চলা গোল করে লাগিয়ে নেয়। চাঁকাগুলোর উপরে ছোট তারকাটায় মুলি বাশের টুকরো লাগিয়ে একটা নাটাই বানিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু মাঞ্জা দেয়া সুতো আর ঘুড়ির টাকা জোগাড় হলেই হয়ে যায়।

রাতে পড়া শেষ করে আবারও মায়ের কাছে বায়না ধরে ক'টা টাকা দেয়ার জন্য। যথারীতি মা'র উত্তর "যা খাইয়া শুইতে যা। সারদিনের কাজের পরে আর ঘ্যানর ঘ্যানর ভাল্লাগেনা।" তুষের আগুন যেমন অন্তরালে জ্বলে, কোন শিখা দেখা যায়না। তেমনই ওর মনের ভেতর না পাওয়ার ক্ষোভ জমে জমে একটা অগি্নগীরির রূপ নিয়েছে। ছোট ছোট না পাওয়ার কষ্ট আর বন্ধুদের সময়পোযোগী অপমান; মায়ের কথার পরে সবই তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না, মুখের উপর বলে বসে "ভাল ভাবে যদি পালতে না পারো জন্ম দিছিলা ক্যান"?

প্রাণপ্রিয় সন্তানের এ ধরণের কথায় মায়ের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সারাদিনের কর্মক্লান্ত মা রাগতঃ স্বরে বলেন, "বান্দির বাচ্চা তগর লাইগা আমার সারাজীবন কামলা খাইটা মরতাছি, আর তুই জিগাস জন্ম দিছি ক্যান? এর উত্তর দেওয়ার লাইগা তরে রক্ত পানি কইরা খাওয়াইতাছি? আগে জানলে তোরে নুন খাওয়াইয়া মাইরা ফালাইতাম। যা হারামজাদা, বাইরহ্ এই বাড়ি থেইকা"।

মায়ের কথাগুলো সুমনের রাগের উনুনে আরো ঘি ঢেলে দেয়। বাস্তবজ্ঞানহীন কিশোর হাফহাতা স্কুলের জামাটা গায়ে জড়িয়ে স্যান্ডেলজোড়া পড়ে এই রাতের বেলায়ই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ হাটতে হাটতে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে। "নাহ্ আর জীবনে বাড়ি ফিরে যাবোনা, মরে গেলেও না"। তখনো অষ্টাদশী নক্ষত্রগুলো রাতের আকাশে রাজত্ব কায়েম করেনি, বাসস্ট্যান্ডটা এখনো লোকারণ্য। মানুষজন আর নানা পদের গাড়ী দেখতে দেখতে ঘন্টা দুয়েক কেটে যায়। মধ্য রাতে লোকজন কমে আসে, দোকান-পাট গুলো বন্ধ হতে থাকে। ওর পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে সেখানে একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়।

নীরবতা চারদিক আচ্ছন্ন করে নিতে থাকে। একটা ভয় আলগোছে ওর মাথার দখল নেয়। রাতে থাকবে কোথায়? খাবে কি? তবুও জেদের পারদ হিমাঙ্কে অগ্রসর হয়না। সামান্য কটা টাকা! দিয়ে দিলেইতো হতো, তাহলেইতো আর সে এমন করে কখনো বলতোনা। আর বলেছেই বা! তাতে মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে? মরে গেলেও বাড়ি ফেরা যাবেনা। হাটে আর চিন্তার সুতো জুড়তে থাকে। রাতের বাতাসও কেমন হিমেল-ঠান্ডা, গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়। সামনে একটা মসজিদ দেখে কিছুটা পুলকিত হয়। যাক্ রাতটা মসজিদের বারান্দায় ঘুমিয়ে নেয়া যাবে। এক হাতে চাপকল চেপে আরেক হাত দিয়ে কলের মুখটা আটকে পানি পান করে নেয়। বারান্দায় আরো কয়েকজন অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। সেও একটা কোনায় গিয়ে নিজেকে ঘুমের কাছে সমর্পন করে। লাল, নীল, সাদা, চাপলাশ হাজার রংয়ের ঘুড়ি ওর মনের আকাশ জুড়ে উড়তে থাকে।

ভোরে আজানের আগেই মসজিদের খাদেম এসে সবাইকে উঠিয়ে দেয়। "এই সবাই ওঠ, আল্লাহ খোদার নাম নাই রাইত অইলে সবগুলা মসজিদে চইলা আহস। যা নামাজের সময় হইয়া গেছে"। সময় আনুমানিক ভোর ৪টা হবে। এত তাড়াতাড়ি সুমন কোন দিনও সময়ের কাছে আত্মসমর্পন করে ঘুম থেকে ওঠেনি। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে পড়ে। সে এখানে কেন বুঝতে খানিকটা সময় লেগে যায়। যখন মনে পড়ে জিদটা আরো বেড়ে যায়। "সারা রাতেও কেউ খোজ নিল না"?

দু'একটা গাড়ির হেলপার এসে গাড়িগুলোকে স্নান করিয়ে দেয়। সুমন এদিক সেদিক হেটে তা দেখে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা খিদের সাথে পাল্লা দিয়ে মূর্তিমান বটবৃক্ষের মতো সময় দাড়িয়ে থাকে। তবুও একসময় সূর্যটা পৃথিবীকে আলোয় ভাসিয়ে পূবদিকে উঁকি দিয়ে লজ্জা ভাঙ্গে। মানুষের কোলাহল বাড়তে থাকে। আর একটা কর্মব্যস্ত দিন শুরু হয়। হিসেবের দৌড়ে পাল্লা দিয়ে পেট মোচড়ানো বাড়তে থাকে। সমস্ত রাগ ভুলে অভিমান দু\'চোখের অশ্রু হয়ে গলে গলে পড়ছে কপোল বেয়ে। সময়ের সিড়ি বেয়ে সূর্যটা আস্তে আস্তে মধ্য আকাশে চলে আসে।

পাঁচফোড়নের মায়াবী গন্ধে ওর জীব লালায়িত হয়। চম্বুক যেমন স্বমহিমায় আকরিক নিজের কাছে টেনে নেয়, তেমনি সে গন্ধটা ওকে জাদুকরী মায়ায় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। হাটতে হাটতে বাসস্ট্যান্ডে "মনা"র হোটেলের সামনে এসে দাড়ায়। দোকানের ঝাপের বাশটা ধরে লোভাতুর দৃষ্টিতে ভিতরের টেবিলে খাওয়ায় ব্যস্ত লোকজনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।

আলু ভাজি শেষ হলে বাবুর্চি সেগুলো নামিয়ে রাখে। উনুনে বড় কড়াইটা চাপিয়ে তাতে তেল ঢালে। ময়দার খামির বেলুনে ডলে ডলে সেগুলোকে অর্ধবৃত্তাকারে কেটে সাজিয়ে রাখে। দুজন সহকমর্ীসহ তিনজন মিলে অর্ধবৃত্ত রুটির ভেতর আলু ভাজি দিয়ে কেমন একটা কারিশমায় সেগুলোকে সিঙ্গারায় রূপ দিয়ে তেলে ছেড়ে দেয়। ঘন্টাখানিক পরে গরম সিঙ্গারা নামিয়ে সাজিয়ে রাখে।

তখনও সুমন ঝাপের বাশটা ধরে তাকিয়ে থাকে সেগুলোর দিকে। তার বাড়ির কথা মনে হয়। মায়ের কথা মনে হয়। মনে পড়ে আজ ঘুড়ি উৎসব। ক্ষুধার নির্লজ্জ আহবানে আবার এক ঝটকায় সব মিলিয়েও যায়। বাবুর্চিটা যেন কি মনে করে ওর হাতে দুটো সিঙ্গারা ধরিয়ে দেয়। মন্ত্রমুগ্ধের মত সে হাত পেতে নেয়ও। হঠাৎ তার মনে পড়ে পৃথিবীতে ক্ষুধার চেয়ে বড় কিছুই নেই। আত্মসম্মান জলাঞ্জলি গিয়ে সে ভিক্ষুকের মত দান গ্রহণ করেছে।

সিঙ্গারা খেতে খেতে বাড়ির পথে হাটা দেয় সুমন। বিষন্ন মনে ভাবতে থাকে, মার কাছে কি বলে ক্ষমা চাইবে। এই খাবারের ব্যবস্থা করতেইতো বাবা-মা দুজনকে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটতে হয়। সিঙ্গারা মুখে দেয়ার সময় অলক্ষে দুফোটা অশ্রু গাল বেয়ে নিরবে ঝরে যায়।

খাদ্য জোগাড়ে উপায়হীন কিশোর হাটার গতি বাড়িয়ে দেয়। পিছনে উড়তে থাকে সুতো কাটা, বন্ধনহীন লাল, নীল, সাদা, চাপলাশ ঘুড়িগুলো।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ শামছুল আরেফিন গল্পের শেষে কিশোরের আত্ম উপোলব্ধি দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে ভাইয়া রমজান মাসে গল্পকবিতার বন্ধু মেলায় আপনি যে থীমটি বললেন তার সাথে তো মিলল না।
ভালো লাগেনি ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১
ম্যারিনা নাসরিন সীমা খুব ভাল লাগলো আপনার গল্প সুন্দর প্রেক্ষাপট ,সাবলীল উপস্থাপনা । অনেক অনেক শুভকামনা ।
ভালো লাগেনি ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১
আসলাম হোসেন এত সুন্দর গল্প.....।
ভালো লাগেনি ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১
ফরহাদ হোসাইন বাস্তব প্রেক্ষাপটে ৫/১০ টাকা দামের সিংঙ্গারা বিনা পয়সার দেবে না, কারণ মানবতা আজ অনুপস্থিত, জীবন সংশ্লিস্ট "ক্ষুদা" নিয়ে গপ্ল, হূদয়ে কৈশর কালের মর্মস্পর্সী স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
ভালো লাগেনি ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সোনিয়া নিশাত আলম শেখার আছে এই গল্প থেকে ..অনন্ত শুভকামনা ...
ভালো লাগেনি ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১১
শাহীন আলম আপনার গল্প পরে সিংগারা খেতে ইচ্ছে করছে. গরিব শিশুদের প্রতি আমাদের দায়য়েত্য টুকু মনে করিয়ে দিলেন. ওদের ও একটা মন থাকে. আমরা মাঝে মাঝে ভুলে যাই.
ভালো লাগেনি ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সূর্য @প্রজ্ঞা মৌসুমী, তোমার কথায় যুক্তি আছে। তবে সুমনের পুরো পরিবার মোটামোটি দু'বেলা খেতে পায়। ঘটনাটা শুধু সুমনকে জড়িয়ে তাই সিঙ্গারা ওকেই খাওয়লাম হা হা হা হা
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সূর্য @সুমননাহার (সুমি), তোমাকে ধন্যবাদ জানাই.......................
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সূর্য @রনীল, হা হা হা এমনটা থেকে বেরোনোর কোন পথ নেই ভাই।
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১
সূর্য @sohel তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।
ভালো লাগেনি ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৩৫ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪