যাত্রী

গভীরতা (সেপ্টেম্বর ২০১৫)

মেহেদী হাসান অপু
  • ৪৮
নৈহাটি স্টেশনে অনেকক্ষণ ধরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে আছি।স্টেশনটা বেশ নির্জন।এই নির্জনতাই এখন আমার কাছে প্রিয়।মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত কোলাহোল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য কোন ভুবনে আছি।কয়েকদিন ধরে কোন জায়গায় স্থির হতে পারছি না।এখানে-সেখানে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে।বারবার থাকবার জায়গা বদল করতে হচ্ছে।গত সপ্তাহে নোয়াখালি ছিলাম।সেখান থেকে বরিশাল,পিরোজপুর হয়ে আজ সকালেই এখানে এসেছি।কিন্তু জরুরী কাজে আজকেই ঢাকা যেতে হচ্ছে।জীবনের সকল তৃষ্ণা শেষ হতে চলেছে।আমি আজ আর কারও মনে নেই।আছি শুধু ঘৃণায়।
হঠাৎ আমার পাশে একটি ছায়া এসে দাঁড়াল।আমি চমকে উঠলাম।এ তো সেই ছায়া।একদিন যার পিছে পিছে আমি পাগলের মতো ছুটেছি।আমার স্মৃতিতে সেই ছায়া আজও কত পরিচিত হয়ে আছে।আমি তো সেই কবে তার স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলেছি।তবে সেই স্মৃতি হারিয়ে যায়নি?নাকি আমি সেই স্মৃতি হারিয়ে যেতে দেইনি।
কী ভাবছি এসব?আমার তো এখন এসব ভাবার কথা নয়।তাহলে এই ছায়া কার?কোথা থেকে এলো।কোথাও হয়ত ভুল হচ্ছে।আমি ভুল করছি।এ ছায়া আমার পরিচিত হতে পারে না।অনেকক্ষণ হলো সেই ছায়া আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।বিষ্ময় ধরে রাখতে পারলাম না।একবার চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম।সেই মুখ,সেই দুটি চোখ,সেই হাসি।একদিন প্রথম দেখাতেই যাকে আপন করে চেয়েছিলাম।সেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে।অবাক হলাম না।বিধাতার হাতে গড়া নিয়তিতে কত বিষ্ময় তো জন্ম নেয়।আমি নিয়তি মানি না।তাই এই দেখা আমার কাছে বিষ্ময় নয়।এই দেখাটা আমার পাওনা ছিলো।
সে আমার পাশে এসে বসল।কত সহজ,অথচ কত দূর্লভ।কত কাছে,অথচ চিরবিচ্ছেদ।কত দামী,অথচ সবচেয়ে অবহেলার বস্তু।আমি অভিমানে অন্যদিকে চেয়ে রইলাম।
সে নীরবতা ভেঙে বলল, “আমাদের আবার দেখা হলো।তুমি বলেছিলে আমার এই মুখ আর কখনও দেখতে চাওনা।ঘৃণা করে হলেও আরও একবার দেখতে হলো”।
“এতদিন যে তোমাকে আবার দেখার জন্য পাগল হইনি এটা মনে করছ না কেন?যে হারিয়ে যাবে তাকে ঘৃণা করেই হারাতে দিতে হয়।তাতে সারাজীবন মনে রাখা যায়”,আমি তার কথার জবাব দিলাম।
সে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।তুমি আমাকে ভালোবাসনি,ঘৃণাও করনি।আমি তোমার সাধনার ধন ছিলাম,কিন্তু তুমি তা সঞ্চয় করনি।আমি তোমার জীবনে পরাধীন রাজ্য হয়ে ছিলাম,কিন্তু সুযোগ পেয়েও তুমি তা জয় করনি”।
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছি মিথ্যা নয়।আমি তোমাকে ঘৃণা করি এ কথাও মিথ্যা নয়।কিন্তু তোমার-আমার মিলন নিয়তিতে লেখা নেই যেদিন এই সত্য জানতে পেরেছি সেদিন থেকে তোমাকে কেন ঈশ্বরকেও আর সহ্য হয়নি।-আমি আবারও তার কথার জবাব দিলাম।
সে বলল, “আজ এতদিন পর আমাদের দেখা হলো।আমরা কি আগের মতো শুধুই ঝগড়াই করব?আমাদের দেহের মিল না হোক।মনের মিলও কি কখনও হবে না?”
আমি বললাম, “সে তোমার ইচ্ছে।কাঠকে পুড়িয়ে কয়লা করতে পারো।কয়লা পুড়িয়ে হীরেও করতে পারো।পারো,আরও অনেক কিছু করতে পারো”।
সে বিষ্মিত হয়ে বলল, “বলে যাও।যত কথা আছে বলে যাও।আমি শুধু শুনে যাই”।
আমি বললাম, “বাদ দাও ওসব।তোমাকে কথা শোনাব বলে আজ এতদিন পর তোমার দেখা পাইনি।আমার ভালোবাসা যে সত্য ছিলো সেই কথাটি জগতে আবারও প্রমাণ হলো।
“হাসালে।যে তার ভালোবাসাকে বালুর চরে বেঁধে ধূলির ঝড়ে ভেঙে ফেলে।যে তার ভালোবাসাকে ফুলের কলিতে ছায়া দিয়ে আগুনের তাপে পুড়িয়ে ফেলে।সেই ভালোবাসাকে তুমি সত্য বলে দাবী করছ?লজ্জা করে না!আমি তার কথায় মুগ্ধ হলাম।
সে আমাকে জীবনের সূচনায় হারয়ে দিয়েছে।জীবনের উপসংহারেও আজ সে আমাকে হারিয়ে দিতে চায়।সে আমাকে নিঃস্ব করেছে।কিন্তু ভরিয়ে দিয়েছে জীবনের শুন্য খাতার প্রতিটি পাতা।সে আমাকে ভাসিয়ে দিয়েছে।কিন্তু মিলনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ গড়ে আমার জন্য সে রেখে দিয়েছে চিরকালের আশ্রয়।প্রথমবার ভালোবেসে সে আমাকে শুন্য করেছে।আজ আবারও ভালোবেসে সে আমাকে মহাশূন্যে রেখে গেল। যে ভার নিয়ে জীবনের এতগুলো দিন পার করে দিলাম আজ সে ভার অসহ্য মনে হচ্ছে।মনের অজান্তে আমি তার হাত দুটি চেপে ধরলাম।সে বাধা দিলো না।আবার হাত দুটি ধরেও রাখতে দিলো না।
সে বলল, “তুমি একটু অপেক্ষা কর।আমি এখনই আসছি”।
যাকে চিরতরে বিদায় দিয়েছি আমি এখনও তার জন্য অপেক্ষা করব,এ কেমন খেলা তার।আমি যত তার প্রতি দুর্বল হই সে ততই আমাকে অবহেলা করে।একদিন চলে গিয়ে সেই অবহেলার শোধ নিয়েছি।আমি তাকে হারিয়েছি সত্যি।কিন্তু আমাকেও সে পায়নি।ঝড় সমুদ্র থেকে ছুটে আসে পৃথিবীর স্থলভাগ আঘাত করার জন্য।সেও বারবার আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে আঘাত করে চলে যায়।
আমি তার অপেক্ষায় না থেকে ট্রেনে উঠে বসলাম।ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।অনেকটা ভারমুক্ত হলাম।তার সাথে আর দেখা না হওয়াটাই ভালো।জানালার বাইরে তাকালাম।মানুষের জীবনের সরল ছবি দেখতে পেলাম।ট্রেনের গতি খুব সহজেই সেগুলো চোখ থেকে সরিয়ে দিচ্ছিল।কিন্তু যে ছবি আমি চিরদিন স্মৃতির মঝে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি জানি মৃত্যুই একদিন তা হারিয়ে দিতে পারে।
আবার সেই কন্ঠ কানে ভেসে এলো, “এটাই আমার সিট,তাই না?”
উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকালাম।সে আমাকে না চেনার ভাব করে বলল, “আমি বসলাম,তুমি যাও”।
তার সাথে থাকা পুরুষটি আমার দিকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে তাকে নিয়ে বলল, “আমি পাশের কামরায় আছি”।
সে আমার পাশে বসল।আমরা যেন দুজন-দুজনাকে আবার কাছে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হলাম।তবে সেই পাওয়ার অনুভূতি আমি না বুঝতে দিলাম তাকে,সে না বুঝতে দিলো আমাকে।তার শরীর আমাকে স্পর্শ করল।সে জানে তার স্পর্শে আমি পাগল হই।আজও সে আমাকে পাগল করতে চায়।
সে বলল, “আবারও পালাতে চেয়েছিলে?কিন্তু জান তো,নিয়তি তার অধিকার একবিন্দুও ছাড়ে না”।
আমি তাকে বললাম, “এখানে কেন এসেছিলে?”
সে বলল, “একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলাম।কিন্তু হঠাৎ করে ওর ছুটি বাতিল করায় ফিরে যেতে হচ্ছে”।
সে তার শরীর দিয়ে আমাকে কাছে টানল।আমি জানি সে অধিকার প্রথম দিন থেকেই আমার ছিলো।আজও সে অধিকার নষ্ট হয়নি।আমি তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম।সে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল।আমি সেখান থেকে উঠে পাশের কামরায় গেলাম।
আমি আসলে পাশের কামরায় তার স্বামীর সন্ধানে গেলাম।দেখলাম তিনি ঘুমাচ্ছেন।নিজের স্ত্রীকে আরেকজন পুরুষের পাশে বসিয়ে এসে তার এই প্রশান্ত ভাব দেখে রাগে আমার শরীর কেঁপে উঠল।
তাকে জাগিয়ে বললাম, “শুনুন,আপনি আপনার স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসুন।আমি এই সিটে বসছি”।
মহুয়ার আচরণ আমাকে কখনও শান্তি দেয়নি।সে যতটা প্রশ্রয় দেয় তারও বেশি সংকট তৈরি করতে পারে।যে অতীত আমি পার করে এসেছি তা আমার কাছে অনেক মূল্যবান।সেই স্মৃতি নিয়েই আমি চিরকাল ছুটে বেড়াতে চাই।আমি চাই না আবারও মহুয়ার মায়ার জালে ভুল করে জড়াতে।
মহুয়ার বিচলিত ভাব দেখে তার স্বামী বলল, “অনেকক্ষণ হলো দেখছি তুমি ছটফট করছ।শরীর খারাপ করেছে নাকি?”
“ভাবছি একটা কথা তোমাকে বলা দরকার”।–মহুয়া উত্তর দিলো।
তার স্বামী বলল, “ কী কথা?”
মহুয়া বলল, “আমার পাশে যে লোকটি বসেছিলো সে আমার পুরাতন বন্ধু”।
তার স্বামী বলল, “তাই বুঝি?”
মহুয়া বলল, “শুধু বন্ধু নয়,সে আমাকে ভালোবাসত”।
তার স্বামী বলল, “এখনও ভালোবাসে?”
মহুয়া বলল, “জানি না”।
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম”।
তার স্বামী বলল, “তাকে ভুলতে পারছ না”।
মহুয়া বলল, “ না”।তার স্বামী বলল, “পাশের কামরায় আছে।দেখা করে আসতে পারো”।
মহুয়া বলল, “তার প্রয়োজন নেই”।
ট্রেন ইতিমধ্যে একটি স্টেশনে বিরতি দিয়েছে।অনেকক্ষণ হলো মহুয়া চোখ বন্ধ করে আছে।মহুয়ার মনের অবস্থা বোঝা বেশ কঠিন।সে যতটা অমায়িক,ততটাই অভিমানী।সে যতটা চঞ্চল,ততটাই শান্ত।সে যতটা বিশ্বাসী,ততটাই বিশ্বাস ভঙ্গকারী।
হঠাৎ মহুয়াদের সিটের পাশে পুলিশের একটি দল এসে বলল, “আপনাদের টিকিট দেখি”।
টিকিট ভালো করে চেক করে পুলিশের অফিসার বলল, “আমাদের ঢাকা থেকে ইনফর্ম করা হয়েছে যে,এই কামরায় একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী আছে।গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে এই সিটেই তার থাকার কথা।আপনাদের পরিচয় জানতে পারি?”
মহুয়ার স্বামী মহুয়ার চোখের দিকে তাকাল।ভয়ে জড়োসড়ো মহুয়া তার স্বামীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।মহুয়ার স্বামী পুলিশকে তার পরিচয় দিয়ে বলল, “আমি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার”।
পুলিশের অফিসার বলল, “দুঃখিত স্যার,কিন্তু আমাদেরকে নিশ্চিত করেই বলা হয়েছে সন্ত্রাসী এই সিটেই আছে”।
মহুয়ার স্বামী বলল, “আমার মনে হয় ভুল ইনফর্ম করা হয়েছে।এমনও হতে পারে সন্ত্রাসী আপনাদের অবস্থান জেনে ফেলেছে।অথবা সে অন্য কোন কামরায় আছে।ভালো করে চেকিং করুন।পরের ট্রেনেও থাকতে পার”।
ট্রেন পরবর্তী স্টেশনে এসে থামল।পুলিশের দল চলে গেলে মহুয়া অনেকটা দৌঁড়ে পাশের কামরায় ছুটে গেল।কিন্তু সেখানে সেই পরিচিত মুখটিকে দেখতে পেল না।পাশে বসা লোকটিকে বলল, “আপনার পাশে যিনি বসেছিলেন,তিনি কোথায়?”
লোকটি বলল, “উনি তো এই মাত্র ট্রেন থেকে নেমে গেলেন”।
মহুয়া দৌঁড়ে ট্রেনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল।এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে তাকে খোঁজার চেষ্টা করল।কিন্তু খুঁজে পেলো না।দূরে অনন্ত আকাশের বুকে জমে থাকা খন্ড খন্ড কালো মেঘগুলো তার চলার পথের সাথী হতে চায়।মহুয়ার দুচোখের কোণ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।ট্রেন আবার চলতে শুরু করে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রেজওয়ানা আলী তনিমা সুন্দর লিখেছেন।শুভকামনা।
মিলন বনিক বাহ! খুব সুন্দর গল্প....কথার গাঁথুনি চমত্কার...
Syed Injamul Huq golpo ta pore mone holo like na dile ami aporadh korbo.
ভালো লাগেনি ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

২৬ আগষ্ট - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী