আজ দিনটা বড্ড অন্যরকম, আকাশে ঝলমলে রোদ্দুর মিষ্টি হাসি যেন খেলে যেন যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে-এরকম দিন জীবনে বোধহয় বারে বারে আসেও না। আজ যে গানের ফাইনাল রাউন্ড অডিশান, সেই কবে যে গানের হাতেখড়ি তা এখন তমালিকার আর মনে নেই। ওস্তাদ দাদুর পাশে বসে সেই সারেগামাপা….র সুর তুলেছে সেই ছোট্টবেলায়, তারপর থেকেই গানই যেন ওর প্রাণ হয়ে ওঠেছে, লাল-নীল-সবুজ স্বপ্নের মতো সে বিভোর হয়ে থেকেছে গানে…গান যেন হয়ে ওঠে শ্বাস প্রশ্বাস, এমনকি বলা চলে প্রাণের চেয়েও আপন। আর হবেই না বা কেন…কী বা ছিল তাঁর জীবনে সুখ সাচ্ছন্দ সেসব তো কল্পনাতীত অভাবের সংসারে কোনোরকমে দিনাতিপাত করেছে বাবার যেটুকু আয় ছিল তাতে গানের মতো অত সৌখিন সুর তোলা হয়তো হত না কিন্তু দাদুর স্নেহে তো মিলেছে সুরের ঝংকার তাঁর গলা ভাল বলে তো বিনে পয়সায় দাদু তুলে দিয়েছিল গান… দাদু মানে গানের বড় ওস্তাদ শিরাজ শাহ্ দশ গাঁয়ে তাঁর নাম ডাক সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি যার কাছে শিষ্যরা ভিড় লাগাতেই থাকে শুধুমাত্র তারঁ কন্ঠের যাদুর ছোঁয়ায় এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই অডিশনের ডাক এসে যায়…
তমালিকা কর্মকার, আছেন….
গানটা ক্ল্যাসিকাল হলেও গেয়ে মনটা খুত খুত করে বোধহয় আর একটু ভাল হতে পারতো, কারন এসব গান যতই গলা ছেড়ে গাওয়া যাক না কেন তা কখন হৃদয় চিড়ে যায় না কিন্তু ভাটিয়ালি হোক আর লোকসংগীত কিংবা বাউল যে গান মাটি মানুষ ও প্রাণের কথা বলে তা যেন হৃদয়কে স্পর্শ করে তাতে আর কি…বর্ত ওযখন গাইছিল জাজেসরা বিভোর হয়ে শুনছিল, মন্ত্রম্গুদ্ধতার মতো…তবুও ডিসট্রিক চাম্পিয়ন বলে কথা, পারবে কী চাম্পিয়ন হতে ....এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাসটা জেলা পার হয়ে উপজেলা এসে পৌঁচ্ছে তা বুঝতে পারিনি তমালিকা, এখন বাস থেকে নেমে ভ্যানে যেতে হবে সাগরদাঁড়ি...তারপর খানিকটা কাঁচারাস্তা, মেঠোপথ....পৌঁছে যাবে ফুলকলি গ্রাম....নামটা যেমন মিষ্টি তেমন গ্রামটাও আর গ্রামের মানুষরাও সহজ-সরল কেমন নিবিড় সম্পর্কে বোনা...সারি সারি সবুজ গাছের মেলা, জমি জুড়ে হলুদ সর্রষে ক্ষেত...পাকাধান মাঠ জুড়ে খেলা করে...ঠিক এমন সময় মাথার পেছনে শক্ত ডালের আঘাত লাগে-মাথাটা বনবন করে ঘোরে ওঠে, হঠাৎ সবকিছু অন্ধকার হয়ে ওঠে চোখের সামনে....
যখন জ্ঞান ফিরে আসে তমালিকার তখন দেখে একটা ভয়ংকর বদ্ধ ঘরে বন্দী সে, আলো-বাতাসের কোন চিহ্ণ মাত্র নেই, সমস্ত শরীরটা যেন ব্যথায় জ্বালা করছে, কতদিন পার হয়ে গেছে কিছুই বুঝে ওঠতে পারছেনা, সবকিছু ঝাপসা হয়ে ওঠে চোখের কোণে, কী যেন হয়েছিল তার সাথে, হ্যাঁ মনে পরেছে, মনে পরেছে-অডিশান শেষ করে বাড়ি ফিরছিল সে,তারপর কী হল….
ওহো আজ কী বার, অডিশানের রেজাল্ট কী আজ তবে বার হল, যেতে হবে- খোঁজ নিতে হবে, কিন্তু কীভাবে যাবে ওর হাত-পা যে শক্ত করে বাঁধা দড়ি দিয়ে…এসব কিছু ভাবতে গিয়ে মাথাটা আগোছালো হয়ে যায়, তবে কী তাঁর ধারনাটা সত্যি কেউ তাকে কিডন্যাপ করে আটকে রেখেছে এই অন্ধকার ঘরে…
অনেকক্ষণ এভাবে কেটে যায় এখন দিন না রাত কিছুই বোঝা যাচ্ছে না..কারা তাকে এনেছে, কেন …কী চায়…তবে কী ওই ছেলেগুলোই…সন্দেহ দানা বাঁধে মনের ভেতর…
ভোরের আযান ভেসে খুব ক্ষীণ সুরে, এই সময়টা একটু শীতল হয় প্রকৃতি..সারাদিনের ক্লান্তি ভেঙ্গে নতুন সজীব এক সূর্য ওঠে আকাশে,লালচে আভা মনকে বিশুদ্ধ করে তোলে শুরু হয় নতুন দিন…চোখ বন্ধ করে এসবই ভাবে তমালিকা…খুব ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে, পুকুর ধারে ছিল শিউলি গাছ..শরতের শুরুতে গাছটিতে ঝাকে ঝাকে ধরত দুধসাদা শিউলি ফুল। আর ভোরবেলা গুটি গুটি পায়ে ঔ ফুল তোলা ছিল নেশার মত, এজন্য বাবার বকুনি কম খেতে হয়নি…হঠাৎ করে বাড়ির কথা মনে পড়ে যাওয়ায় চোখের কোণে পানির ফোটা চিকচিক করে ওঠে, পেটের মধ্যে রাজ্যের ক্ষুধা ছটফট করে, পিপাসায় গলাটা যেন ধরে আসে, এমন সময় নাকে খিচুড়ি আর মাছভাজার ঘ্রাণ ভেসে আসে…
আচমকা ক্যাচ ক্যাচ শব্দে খুলেযায় দরজাটা…হঠাৎ করে অনেক আলোর সম্মুখীন হয় সে, ইচ্ছে করে এক ছুটে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে ওড়ে যায় নীলাকাশে, তা আর হয়না…সেই পেঁচামুখো ছেলাটা চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে তার সামনে এসে দাঁড়ায় আলোকে দূরে ঠেলে, সাথে কিছু উটকো বন্ধু…এই ছেলেটা তো তার পথ আটকে দাঁড়াত গানের ক্লাসে যাওয়ার সময় মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে…!
তাহলে কী অচিরেই তমার সব স্বপ্ন ধূলিসাত হয়ে যাবে, চোরাবালির মত হারিয়ে যাবে সময়ের অচীন গহ্বরে, কেউ কী পাশে দাঁড়াবেনা ভয়ংকর এ দুঃসময় থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবেনা…সুখস্বপ্নে ভেসে যাবেনা মেঘবালিকার মতো…গানের কলি কী আর কন্ঠে ঝরবে না মুক্তদানার মতো গাইবেনা গলা ছেড়ে সারেগামাপা…..
সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে করতে ভয়ে চোখ বুজে ফেলে তমালিকা, কিন্তু পেঁচামুখো ছেলাটা মনুষ্যত্বের মাথা খেয়ে ঠিকই বুক ফুলিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় হাতির মতো, এক হাতে চুলের গোছা ধরে বলে, কীহল রাজরানী- মত কী হল, আমার প্রস্তাবে তাহলে আপনি কী রাজি না অন্য পথ দেখতে হবে আমাকে..
একবার সবকিছু খুব ভাল করে ভেবে নেই তমালিকা, বাবার শুকনো মুখটা খুব বেশি মনে পরে যায়..ছোট্টবোনটা কেবলমাত্র প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দিল, আর ভাইটা এখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি আজ যদি তমালিকা পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে পারত তাহলে খুব বেশি কলেজে পা রাখত, কিন্তু অভাবের সংসারে তা আর সম্ভব হয়নি বাবার অসুখ মা কোনরকমে ধান ভেনে চাতালে কাজ করে ভাই-বোনদের মুখের আহার যোগার করত সে যে কী কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করত তা আর মুখ ফুটে বলার অবকাশ নেই, তবুও এত কিছুর পরে তানপুরা আর গলাসাধাটা ছেড়ে দিতে পারিনি…অভাবের সংসারে গানটাও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতনা যদিনা গানের ওস্তাদ গরীবের মেয়ে বলে তাকে বিনা বেতনে গান শিখিয়েছে… নিজের মেয়ের মত গলা তুলেছে… স্বপ্ন দেখিয়েছে গানকে নিয়ে সে থেকেই গান হয়ে ওঠেছে প্রাণ, হৃদয়ের আবেগ মেশানো কথা দিয়ে গান তুলেছে তমালিকা, সে স্বপ্ন-আবেগ-ভালোবাসা কী মাঠে মারা যাবে...
এমনটা ভেবেই বুকের ভেতরটা ছ্যাত্ করে ওঠে কিন্তু অগ্যাতা কী করবে বুঝে ওঠতে পারেনা তাই ঔছেলেটার কথাই সায় দিতে হয় সমাজ সংসার লোকলজ্জার ভয়ে না বলার ক্ষমতা ওর এখন আর নেই …এই মুখ নিয়ে তো আর ফিরে যাওয়া যাবেনা…অগত্যা ওদের কথা শুনতে হবে নিজের অনিচ্ছায় ও গোমূর্খটাকে বিয়ে করতে হবে…নিজ স্বপ্নের বলি দিতে হবে আর কী…
--কী হল নবাবজাদী এত কীভাব? আমারে বিয়ে করতে তুমি রাজি কিনা কও… আমি কী বর হিসেবে খারাপ…সম্মানের সাথে নিয়ে এসছি...গায়ে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি… আসলে তোমার ঐ মধুর গলা…কোকীলকন্ঠ আমাকে উদাস করে তুলেছে…আমাকে অশান্ত করে তুলেছে…তাইতো তোমাকে একেবারে তুলে নিয়ে এলাম… সহজে যদি তুমি সায় দিতা তবে এতটা কষ্ট করতে হতনা…
হঠাত চোখ তুলে তাকায় তমালিকা…গলাটা তেষ্টায় ভিজে ওঠে …চিৎকার করে কেঁদে ওঠতে চায় মনটা….ঝাপসা হয়ে ওঠে ভেজা চোখ…কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে চারপাশ…
০৫ আগষ্ট - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
২৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪