আচ্ছা রিয়াদ, কেমন মেয়ে তোর পছন্দ! আমি মুখ তুলে আহিরের দিকে তাকিয়ে বললাম,হুট করে এই প্রশ্ন?
আহির আমার হাঁটুতে হাত চাপড়ে দিয়ে বলল, তোর কল্পনা আর আর রুচি পরীক্ষা করছি!
আহির আর আমি রাত তিনটার দিকে ডাকসুর সিঁড়িতে বসে আছি,২০০৮ এর দিকের কথা। আহির মনোবিজ্ঞানের ছাত্র,কিন্তু জীবন দর্শন হয়তো অনেক গভীর ছিলো।
আমাদের দুজনেরই রাত জাগার অসুখ আছে ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আঙিনায় আমাদের অনেক স্বপ্নের গল্প আছে,তখন কার চিঠির যুগে,চিঠি কাড়াকাড়ি ঝগড়া আছে। সাতার না জানার কারনে,দুজনের একসাথে ডুবে যাবারও গল্প আছে
আমি আহিরের দিকে তাকিয়ে বললাম, কেমন মেয়ে আবার! এই আমাকে বুঝবে !
আমাকে চিমটি দিয়ে বলল, মামা,তুমি যে টাইপের মেয়ে চাও,তা অর্ডার দিয়ে বানাতে হবে।
জানতে চাইলাম,কেন?!
বলল, আমরা কেউ কাউকে,ঠিক মতো বোঝার চেষ্টা করিনা,একটু বুঝে গেলেই, বাদবাকি টুকু ভান করে চালিয়ে দেই।ভান করতে করতে এক সময় বিশ্বাস করতে শুরু করি,আমি তাকে সত্যিই বুঝি।সব গদগদ টাইপের সম্পর্কের শুরুতে অনেক মোহ থাকে, যেটাকে ভালোবাসা মনে হয় ।
আমি বললাম,তাহলে সমস্যা কি?
বলল,সমস্যা হল, যখন তুই ধরে ফেলবি, যে সত্যিকারের অনুভূতিতে ঘাটতি আছে , তখন সম্পর্কে আর মনযোগী হবি না ।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম,তুই বুঝলি কি করে?তুই তো প্রেম করিস না, এতো অভিজ্ঞতা পেলি কোথায়?
এটুকু ভাবতে সক্রেটিস হতে হয় না , অভিজ্ঞতাও সব ক্ষেত্রে জরুরি না, মুচকি হেসে বলল। ,
জানতে চাইলাম,তোর কেমন মেয়ে পছন্দ? কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
আমার একটা মাঝরাতে গল্প করার তুমি চাই,
সকাল বেলা বাসি মুখের একটা আলসে তুমি চাই,
যার কাছে বলতে পারবো,বাবা,আমার মন ভালো নেই,
বৃষ্টি পাঠাও,
যার আদরে ভরসা পাবো,যার চাঁদরে মুখ লুকাবো,
এমন একটা তুমি চাই,
যাকে পেলে রুপার গল্প আর খুঁজতে হবেনা, উপন্যাসে,
সেই তুমিটার,হাতের তালুতে থাকবে,মায়া মেশানো, ঘাম,
বুকের খাঁজে থাকবে,কষ্ট আড়াল করে,আমাকে ভালবাসার গন্ধ,
যার অভাবে মনে হবে,কি যেন নেই! কি যেন নেই!!!
এমন একটা তুমি চাই !!!
আমি খুব খেয়াল করে শুনছিলাম,আর ভাবছিলাম আমার পছন্দ যদি অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়, তাহলে আহিরে পছন্দ,মঙ্গল গ্রহে এল সি খুলে আমদানি করতে হবে!!! ;)
আমি গলা ফাটিয়ে হেসে দিয়ে বললাম, কাউকে বলেছিস এই কথা?কোন ছেলেকে বলিস না, তোকে ক্যাবলা ভাবুক, পাগল ভাববে,।
আর কিছু কাব্যিক টাইপের বা দলছুট বোকা টাইপের মেয়েরা হয়তো তোর কথায় পটে যাবে,তবে সম্পর্ক না টেঁকার সম্ভবনাই বেশি কারন তোর অভজারভেশন ভালো যার ফলে,বড় দোষগুলো উদার ভাবে মেনে নেয়ার ভান করবি। আর নাক সিটকানো মেয়েগুলো, বরাবরি প্রেমিক হিসেবে উদাসিন ছেলে পছন্দ করে আর চূড়ান্ত সঙ্গি হিসেবে, ভাববে অয়নের ভাইয়ের মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলেদের কে! :(
আহির ফোঁড়ন কেটে বললে, আরি বাব্বাহ, বন্ধু, তুই তো মাস্টার্স পাশ করার আগেই, নারী অধ্যয়নে মাস্টার্স করে ফেলেছিস! :)
আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম, একটু নিচু স্বরে বললাম, জানিসই তো, ডিপার্টমেন্টের সব কটা মেয়ের সাথে আমার খুব খাতির ! :P
এরকম রাতের আড্ডায়,হাসি, তামাশা, কাম, প্রেম বন্ধুত্ব সবই ছিলো, অনেক বছর............।
আহির কে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, দেখেছি ইকোনমিক্সের মিফতার চোখে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার অসংখ্য ছেলে মানুষী হাস্যকর কর্মকাণ্ড করতে। আমাদের অনেক বন্ধু বান্ধব জিগ্যেস করতো, তুই এতো মেয়ে থাকতে এই চাকমার পিছনে লেগে আছিস কেন?
আহির বলতো,
হয়তো আমার সেই তুমিটার সংজ্ঞা বলে,
মিফতাকে চাও .........
খুব করুন মুখে অসহায়ের মতো এই কথাটা বলতো ।
অনেক দিনের দীর্ঘ সংগ্রামের পর, মিফতার সাথে আমি আহিরের শুরুটা দেখেছিলাম। আর শেষটা উড়ো কথায় টের পেয়েছিলাম।
মাস্টার্সে এসে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেঁড়ে দিলাম হঠাৎ করে , অথবা ইচ্ছে করে ।
আমার ভালোবাসাও তীব্র, অভিমানও তীব্র। আমি আর আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি কারো সাথে যোগাযোগও করিনি।
স্বেচ্ছায় ডুব দিয়ে তাজা গল্পগুলো ফিকে স্মৃতি হয়ে গেলো । আর হঠাৎ কিছু উদাসীনতা আপন হয়ে গেলো।
শুনেছি আহির মাস্টার্সের পরই দেশ ছেড়েছে, ব্যাস আর কিছু জানি না । হঠাৎ এই মাসের তিন তারিখ, একটা মেইল এলো,লেখা ছিলো-
বুঝদান(বুঝদার+নাদান),
তোর কবর কবিতা মনে আছে!
যখন যাহারে জড়ায়ে ধরেছি,
সেই চলে গেলো ছাড়ি............
তুই স্বার্থপর, মিফতা স্বার্থপর, তোরা স্বার্থপর।
একটা গণতান্ত্রিক দেশে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটা মেয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে, একটা ২০ বছরের পুরোনো আট নম্বর বাসের নিচে, নিজের ঘিলু বিলিয়ে আসলো, এটা আমি যেমন আমি মানতে পারি না ,
তেমনি কোন ছেলের, মেয়েদের মতো এমন অবাধ্য ফ্যাচফ্যাচে অভিমান থাকবে, এটাও আমি মানতে পারি না ।
আমি তোদের মতো না এটা ভাবতে ভাবতে তোদের মতো হয়ে গেছি।
দেখলে চিনবি না, যাদের একলা লাগার অসুখ হয়, তাদের অচেনা লাগে। সেদিন ক্যাথিরিন কে বলছিলাম, তোর কথা । ও বলেছিলো তোমার বন্ধুটি খুব পাষাণ :D
ক্যাথি কে, আন্দাজ করতো?
যখন মনে হলো কি যেন নেই, কি যেন নেই, দম বন্ধ হয়ে আসছে,
তখন ফ্রেডরিক বারের, ওয়েটার ক্যাথিকে দেখতাম, আমার মধ্যে একটা তুমি খোঁজার চেষ্টা করতো,এক সন্ধ্যায় না এলে, অন্য দিন,
কৈফিয়তের দৃষ্টিতে তাকাতো ।একদিন আমার ভাঙা গ্যারেজে হাজির হয়ে বলল, তুমি কি আফ্রিকান!!
জানিস, অনেক বছর পর প্রান খুলে হাসলাম। তখন মনে পড়লো, তুই বলতি,
ভালবেসে আঁশ মেটে না,
এমন তুমি কবে হবে!............
ক্যাথিও হয়তো এমনটাই ভেবেছিলো :) হয়তো নিজের ভণ্ডামি ঢাকতে অজুহাত দাড় করাচ্ছি, এমনটা ভাবতে পারিস । ঐ যে বললাম চিনবি না !
নিজের মতো বেচে থাকা মানে, প্রিয় মানুষদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা না :)
অস্বীকার করে হৃদয়হীনরা, আর আমাকে তোর চেনার কথা ।
আমি ভালো আছি ! :)
ভালো থাকিস ...........................
মিসির আলম
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আহিরের নাম মিসির আলম । রাতের নিস্তব্ধতায় টের পাই, অনেক কিছুই ভুলে গেছি, প্রচণ্ড ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে আমি জীবন যাপন করছি, আমিও ভালো আছি,
স্বার্থপররা ভালো থাকে,কিন্তু স্মৃতিকাতর স্বার্থপরেরা ,
ধুসর পাণ্ডুলিপিতে ভালো থাকার গল্প লেখে, আহিরের মতো সান্তনা দেয় নিজেকে, এই বেশ ভালো আছি ।অথবা অভ্যাস বসেই ভালো থাকে ।
কারন ভালোবাসা নাকি অন্য কোথাও ,চায়ের কাপে ......... !!!
বুক ভরা বদ্ধ নিকোটিনের উন্মাদনায়,শেষ বিকেলে হয়তো ক্লান্ত লাগে।
সন্ধ্যা এলে, কর্ণফুলীর তীরে বসে, নতুন ব্রীজের ফাঁক গলে,
যে সূর্যটা প্রতিদিন ডুবে যায়, তার সাথে আমার অনেক দিনের সখ্যতা,
অনেক দিনের অভিমান ..............................