রোদেলা দুপুর। বেশ গরম পড়েছে এবার। রোদ্দুর তো না, আগুনের হলকা যেন ....... আগুন...সেই দুপুরের মত। তখন ১৯৭১ সাল। আমার বয়স তখন........ এই বছরেই তো শতবর্ষী বটগাছ হলাম... তাহলে তখন আমার বয়স ছিল ৬০ বছর। কিছু মনে করবেন না। দিন তারিখের হিসেব দিতে আমি বরাবরই একটু কাঁচা ছিলাম। আমি থাকি গ্রামের গেরস্ত বাড়িগুলো থেকে কিছুটা দূরে, মাঠের মাঝে; পাশেই বাঁশ বাগান...এখন অবশ্য নেই ওগুলো, সব সাফ করে রাস্তা করা হয়েছে।
তা যা বলছিলাম '৭১ এর সেই যুদ্ধে আমাদের এই শান্তিপ্রিয় গ্রামেও আগুন লাগিয়েছিল নিষ্ঠুর পাক সেনারা। তখন শুধু আগুনের শিখা আর আকাশ কাঁপানো চিৎকার। কতজন মরেছিল তার কি ইয়ত্তা আছে? তারপর আরেক দিন, ঐ যে রাখাল ছেলেটা, কি যেন নাম.... প্রতিদিনের মত সেদিনও এসে বসল আমার ছায়ায়। হঠাৎ বন্দুকের শব্দ; ছেলেটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কতগুলো পাক সেনা কাছে এসে দেখল; তাদের হাতে বন্দুক, মুখে হাসি। একজন বলে উঠল, "ইয়ে মুক্তি দেখনে মে খুব সুরত থা" বলে বেয়নেট দিয়ে মারল মৃত ছেলেটির মুখের উপর। কি যে ইচ্ছে করছিল আমার! কিন্তু আমিও যে আর দশজনার মত অথর্ব ! মনে অনেক সাহস, মুখে বড় কথা, শুধু কাজটাই যে করতে পারিনা!
কিন্তু বাংলা মায়ের সন্তানেরা হার মানতে জানে না। ক'দিনের মধ্যে আমার ছায়ার তলায় গভীর রাতে গ্রামের ছেলেদের আনাগোনা শুরু হল। আমি সবই শুনতাম.......কত কথা হত! মুক্তিবাহিনী গড়বার কথা, পাক সেনাদের তাড়াবার কথা, নতুন পরিকল্পনার কথা, অস্ত্রের কথা....তবে একটাই মূলকথা দেশ মাকে স্বাধীন করা। স্বাধীনতা। কয়েক সপ্তাহ গড়াল। অতঃপর একদিন ৪ জন পাক সেনা এদিকে আসছিল। আমার তলায় এসে বসে পড়ল ওরা। মনে হয় ওদেরও গা জুড়ানোর প্রয়োজন। ওরাও ত মানুষ...কাজ দেখে ত মনে হত না ওরা মানুষ; মনুষ্যত্বই যে নেই! এটা অবশ্য আমি শিখেছি মাস্টারমশাই এর কাছ থেকে। কি আর বলব? ওরা যে গেল সোমবার মাস্টারমশাইকেই মেরে ফেলল। যা হোক, ওরা যেই বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছে আমার নিচে, আমার ডাল থেকে ৪/৫ জন দামাল ছেলে নির্ভয়ে লাফিয়ে পড়ল ওদের উপর। ওদের হাতে অস্ত্র বলতে শুধু লাঠি কিন্তু বুকে সাহস সাগর সমান। দেখতে দেখতে ওরা ঘায়েল করল তিনজনকে, আরেকজন রাইফেল ফেলে দৌড়িয়েছে। আমি মনে মনে হাসলাম কিন্তু ছেলেরা গম্ভীর.... আসল কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওদের মুখে হাসি নেই। এই ত প্রকৃত বাংলা মায়ের সন্তান। এখন অবশ্য এমনটি নেই। ক্রিকেটের কথাই ধরুন না...ভালো করলে সবাই মাথায় তুলে নাচে আর হারলে অমৃত বচনের অভাব হয় না! যা হোক, তখন শেষ পর্যন্ত সবাই ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আর একচিত্ত। আর ফলও সেরকম। আমরা স্বাধীন হলাম পাক শাসন হতে। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১....এই বাংলার মানচিত্র খুঁজে পেল এক নূতন ঠিকানা: পৃথিবীর বুকে।
দিন বদলেছে...বদলেছে মানুষ আর তাদের চিন্তাভাবনা। এই গ্রামও বদলেছে। এখন মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, আগের স্বয়ংসম্পূর্ণতা তো নেই বরং অন্য দেশের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। এখন আমার পাশেই যেন কি একটা অফিস। বছর খানেক আগে এখানে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রদানের আয়োজন করা হয়েছিল। হঠাৎ একটা সোরগোল; আরে মাস্টারমশাই এর মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটা না! অনেক বয়স হয়েছে...যুদ্ধের সময় ত ২০-২২ এর বেশি ছিল না। নামটা বোধ হয় আনিস। কি যেন বলছে ও...."বেঈমান"..."তুই কত মুক্তিযোদ্ধাকে ধরিয়ে দিয়েছিস আর বলছিস কি না তুই মুক্তিযোদ্ধা!"...."রাজাকার"। আনিস চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। টাকা হাতে সেলাম ঠুকতে ঠুকতে বেরিয়ে এলো একটা লোক। আরে হাশেম না! এই রাজাকারটা তো সেবার পাক সেনাদের তোষামোদ করতে কমতি রাখেনি। স্বজাতির পেছনেও লেলিয়ে দিয়েছিল হায়েনাগুলোকে। আর এখন কিনা নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে! না জানি আরো কত রাজাকার এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পুরস্কৃত মুক্তিযোদ্ধারা কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছে! স্বাধীনতা পেয়েছি, স্ব নির্ভরশীলতা আনতে এখনো অনেক বাকী। যাদের দেশের হাল ধরবার কথা, তারা তো একে অপরের দিকে কাঁদা ছোড়াছুড়িতেই ব্যস্ত। আগের মত একতা কি আর আছে? থাকলেই হতো...কতদিন বা আর বাঁচি...মরবার আগে তো বলতে পারতাম: এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সূর্য
ইতিহাস বিকৃতি এমন পর্যায়ে এসেছে যে এখন সত্যিকার ইতিহাস চলন-বলনঅক্ষম গাছকেই স্বাক্ষী মানতে হবে। লেখাটার গভিরতা যথেষ্ট কিন্তু প্রকাশটা সেভাবে হয়নি। অনেক শুভকামনা রইল।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।