একটি ব্রীজ । ঠায় দাঁড়িয়ে । নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পানি । কালো কালো পানি । প্রথম সন্ধ্যার আঁধারে পানিকে কালোই মনে হচ্ছে । বর্ষার পাহাড়ি ঢল নামায় নদীতে স্রোতও বেড়েছে কয়েক গুণ, প্রতি বর্ষাতেই হয় এমন । একটু পর পর চোখে পড়ে সেখানে জীবন প্রদীপের আলো বয়ে নিয়ে যাওয়া নিশ্চুপ নৌকা । কখনো আবার দ্রুতগতি ইঞ্জিনের, দ্রুত চলে যায় ব্রীজ কাটিয়ে । এসব খুব স্বাভাবিক দৃশ্য প্রতি সন্ধ্যার জন্যই । তবে আজ কেন জানি একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে, কেমন জানি খুব কাছের কিছু!
সর্বহারাদের দলের কেউ যেমন অমাবস্যায় একটি জোনাক পোকাকেও পৃথিবীর পরম বন্ধু ভাবে, তেমনি ।
তবে আজ কি আমি সর্বহারার দলে ভিড়ে গেলাম? আমি?
হ্যাঁ, আমি । আমি অভ্র । দাঁড়িয়ে আছি এই ব্রীজটির উপর । ঠায় দাঁড়িয়ে, ব্রীজের মত । ব্রীজের রেলিং ধরে থাকা সোডিয়াম বাতির একটিও জ্বলছে না । হয়তো জ্বলতো কোন এক কালে । আজ সব ভাঙাচোরা । ঠিক আমার মত ।
ব্রীজ হয়ে চলেছে শত গাড়ি । একের পর এক । খুব তাড়াহুড়ো সবার । কেউ থামছে না, কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, ব্রীজের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে, বসে আছে একটি ছেলে, পাশে রাখা খোলা এক প্যাকেট গোল্ড লিফ সিগারেট । কমছে যার থেকে একটার পর একটা । ভ্রুক্ষেপ অবশ্য হওয়ার কথাও না, আঁধারে ঢাকা কিনা!
.
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তের বর্ষার কান্নায় এখন আকাশ পরিষ্কার । মুক্ত আকাশ । স্বাধীন আকাশ । হালকা রকম দেখা যাচ্ছে ছোট্ট একটি বাঁকা চাঁদ । দু একদিনের ভিতরেই অমাবস্যা নামবে । আজও হয়তো নামতো, বৃষ্টির জলে মুছে ফেলে দিয়েছে সকল অমাবস্যা ।
আমার অমাবস্যা কি মুছবে? বৃষ্টির জলে?
নাহ! আমার গোল্ড লিফই ভালো । অপেক্ষা শুধু, কখন পাশের প্যাকেটটি শেষ হবে ।
'প্যাকেটটি' শেষ হবে!
প্যাকেট শেষ হওয়ার কথা থেকে মনে পড়ে যায় ছয় বছর আগের অনেক গুলো রাতের কথা! যখন রোজ রাতেই আমার কাটতো বাসার ছাদে বসে বসে আর ভোরে সেখানে মিলতো গুনে গুনে বিশটি জ্বলে যাওয়া সিগারেটের অবশেষের টুকরো । একবার তো বাড়িওয়ালা বাসায় অভিযোগ দিয়ে দিয়েছিলো, সেই থেকে আর জমা না রেখে ফেলে দিতাম বাসার পাশ হয়ে বয়ে যাওয়া ছড়ায় ।
তবে সিগারেটের সংখ্যা কি কমেছিল কখনো?
হ্যাঁ । যখন ভিক্টোরিয়ার হলে ছিলাম । তখন তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম । বন্ধুদের সাথে ফ্ল্যাটে ওঠার পর অবশ্য এসেছিল, তাও কাজ থেকে ফিরে অ্যাসাইনমেন্ট করার সময় হালকা রকম মার্লবরোর লালটা । এই আরকি । তবে যে আবার বেড়ে গেলো! কবে?
যখন ওরা আমায় মেলবোর্নে বদলি করলো, তখন খুব টানছিল । আমি অনেক বেশিই অনুভব করছিলাম যেন মার্লবরো বা গোল্ড লিফের অনুপস্থিতি । তখন থেকেই হয়তো । সে সময় অবশ্য নিতে পারিনি, খুব কড়া আইন ছিল ওখানটায় । এয়ারপোর্টের সেই ২৭ ঘন্টা আর পরের আরো ৪৯ দিন!
আহা! আমার সেই দিনগুলি! সে সময় সূর্য দেখতে পেতাম কয়েকদিন পর পর । যেদিন কোর্টে হাজিরা থাকতো সাথে সানডের চার্চ প্রোগ্রামে, শুধু সেই সব দিন । আর রাত! রাতের ক্ষুধায় আমার স্যুপ খাওয়া । হ্যাঁ, 'খুররাম ভাই' ।
হঠাৎ করে পাকিস্তানী ঐ ভাইটার কথা খুব মনে পড়ছে, যে স্ত্রী খুনের দায়ে আটকা ছিল! সে নিজের কার্ড দিয়ে আমার জন্য স্যুপ নিয়ে আসতো রোজ । আমার ক্রেডিট কার্ড, ডেভিট কার্ড , ক্যাশ, সব ওরা বাজেয়াপ্ত করে ফেলেছিল কিনা!
সে সময় আমার পৃথিবীটা হঠাৎই খুব ছোট হয়ে যায়, সেখানে এসে বসেছিল সে ভাইটি ।
কে সে? আমার রক্তের কেউ? অথচ খুব কাছের কারো মত আগলে রেখেছিল আমাকে, ঐ চাইনিজের বিদ্রুপে বা ব্রাজিলিয়ান ছেলেটার সাথে রান্না ঘরে সমস্যা হওয়ার সময় । সবার ছোঁয়া থেকে উপরে রেখেছিল সে দিনগুলোতে । একেবারে বাবার মত ।
বাবা! হ্যাঁ বাবা । 'বাবা' শব্দের চরিত্র গুলো এমনই হয় হয়তো সবসময় ।
আমি এবারে ফিরে আসার পর যতবারই সমস্যা শুরু হয়েছে ততবারই বাবা ছিলেন আমার সামনে । শুধু বলতে থেকেছেন,
'যা হবার হয়েছে রে বাপ, সব ভুলে যা । পৃথিবী এমনই । সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখ ।'
বড় ভাইয়ের নষ্ট হওয়া একটি টাকারও আঁচ 'আমি' পর্যন্ত আসতে দেননি । সব উনি নিজেই নিয়ে নিতেন উনার উপর দিয়ে । কিন্তু আমি? আমি কি বুঝি না?
আমার বড় ভাই উনার জীবনের এই সল্প সময়ের মাঝে যা কিছুই করেছেন তার সবটাই ছেড়ে দিয়েছেন আমরা বাকি ভাইদের জন্য ।
এমনকি যে আজকের সন্ধ্যার টি-স্টলের চা বা পাশের এই কমতে থাকা গোল্ড লিফের প্যাকেট । সব কিছুই উনার থেকে, উনার ঝরা রক্তের ফোঁটার অংশ এগুলো । যেটার শুরু হয়েছিল আমি যখন বছর আটের, সেই তখন থেকেই আমাদের বাবা হয়ে ছিলেন তিনি । আমার স্কুল, আমার কলেজ, আমার প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি, প্রথম মোবাইল পাওয়া বা প্রথমবারের গিটার কেনা! পরের গিটার গুলো অবশ্য আমার নিজের উপার্জনের ছিল ।
নিজের উপার্জনের! আমার নিজের বলে কিছু ছিল নাকি কখনো? আমার অস্তিত্ব অবদি সব, সবই আমার বড় ভাই ।
বিশ বছর আগেকার সেই ঈদের কথাই ধরি, আমার জন্য জিন্সের প্যান্ট নিয়ে এসেছিলেন উনি, আমার জীবনের প্রথম জিন্সের প্যান্ট । ছোট চাচার জিন্স পছন্দ ছিলনা বলে কখনো জিন্স আনা হতো না বাড়িতে । কিন্তু উনি ছোট চাচাকে লুকিয়েই আমার জন্য এনেছিলেন ওটা, শুধুমাত্র একবার আমি আবদার করেছিলাম বলে! আমি তখন বছর চারের ছিলাম, উনার বয়েস কত হবে? ক্লাস টেনে ছিলেন হিসেব বলে । তাহলে সেই সময়ের সে বয়েসে টাকা পেয়েছিলেন কোথায়?
উনার বিয়েতে আসার জন্য এমিরেটসের টিকেট বুক করেছিলেন লন্ডন থেকেই, জরুরি ভাবে । আমার, মেজো ভাইয়ের, উনার ফ্লাইট মিলিয়ে মিলিয়ে একই দিনে দেশে পৌঁছা, কনে দেখা, বিয়ে ।
আর এবারের আসার পর? প্রথমদিকে বেঁচে গিয়েছিলাম যে, সে সময় বাবা-মা সহ উনারা সবাই ওমরাহে ছিলেন । দেশে ফেরার পর আমি সামনে যেতে পারি নি উনার । প্রথম প্রথম উনি তেমন কিছু বলেনও নি ঠিক । তবে ধীরে ধীরে উনার ভিতরের না বলা কথা গুলো বের হয়ে আসতে থাকে ।
আমি মুখ দিয়ে কিছু বলতাম না ।
কি আর বলবো? এই যে, আমি আজন্ম অশুভ! শূন্য!
বলার মত কোন শব্দ খুঁজে পেতাম না । শুধু রাতের বিছানায় ঘুম হতো না ভিজে ওঠা বালিশে । আমার মত আরেকজন ছিলেন যার চোখেরও জল শুকাতো না খুব একটা ।
আমার মায়ের । হ্যাঁ । আমার মা ।
'মা' হীন পৃথিবীতে আমার শ্বসন তন্ত্র কাজ করবে? এই ভাবনাটা প্রায়ই ভেসে উঠতো অখেয়ালের দেয়ালে, যেটা ভয়ে পরিনত হয়েছিল মাস তিনেক আগের মায়ের মেডিক্যাল রিপোর্ট শুনার পর । হঠাৎই ডাক্তার বলে, মায়ের ইন্ট্রাএপিথেলিয়াল স্কোয়ামাস হাই স্টেজের শেষ সীমায়! যেটার জন্য নাকি জরুরী ভিত্তিতে অপারেশন না করা হলে ক্যান্সারের স্তরে চলে যেতে পারে যেকোন সময় । ইউটেরাস অপারেশন!
বৃহৎ মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের বড় বউ ছিলেন মা, যে বাড়িতে মাসে ২০ থেকে ২৫ লিটার তেলের রান্না হতো । সেই বাড়িতে ডান বায়ে এত তাকানোর অবসর থাকতো না । কয়েক বছর আগে যদিও পৃথক হয়ে গিয়েছে তবু দীর্ঘদিনের অসতর্কতায় কখন যে ব্যাপারটা এত খারাপের দিকে চলে গিয়েছিল, উনি নিজেও বলতে পারেন নি!
আর এখন! এই অবস্থার মাঝে আবার অপারেশন! কিভাবে সম্ভব? এতগুলো টাকার ব্যাপার!
শেষমেশ সব কেটেছিল অবশ্য ভালো মত । আমার ভয়ও কেটেছিল । তবে এখন পর্যন্ত যেটা চলে, বাবা মায়ের ওষুধ আসে না ঠিক মত, ফার্মেসী বা বাজারের মুদি দোকানে বিশাল অঙ্কের বাকির খাতা ভারী হচ্ছে দিনকে দিন!
বড় ভাইয়ের লন্ডন থেকে ফেরার পর প্রথম দিকে সব ঠিক ছিল কিন্তু, সব চলছিল সুন্দর ভাবে । ছিল না অশান্তির ছিটেফোঁটাও ।
তারপর মেঘহীন আকাশের জোৎস্নার বিদ্রোহে আমাদের পরিবারের উপর নেমে আসে অমাবস্যার কালো ছায়া । হঠাৎ করে আমার ঠিক পরের ছোটটা রাজনৈতিক মামলায় চলে যায় জেলে । সেই থেকে শুরু, তারপর আমি ভর্তি জটিলতায় আটকে যাই ভিক্টোরিয়ায়, শেষে ক্রিমিনাল কেস! মেজোর চাকরি হারানো দুবাইতে, বড় ভাইয়ের সর্বশেষ ফিক্সড ডিপজিটটাও ভেঙে ফেলা আর সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে সব কিছুর শেষ হতে থাকা । অতঃপর আমার দেশে চলে আসা ।
এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না ।
তাহলে? কেন হলো এরকম?
ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমার পৃথিবীর সব, পাশে রাখা গোল্ড লিফের প্যাকেটটিও ।
চাঁদটা আর দেখা যাচ্ছে না । মেঘে ঢাকা অমাবস্যায় ছেয়ে গেছে সব । বর্ষার ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে, দক্ষিণ থেকে উত্তরে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ।
.
অবশেষে, শেষতম সিগারেট । আমি বসে আছি রেলিংয়ের উপর, এখনো । এভাবেই বসে বসে কেটেছে কত শত জোৎস্নার সন্ধ্যা বন্ধুদের সাথে । আজ বছর চার পর এভাবেই বসে আমি, আমি অভ্র ।
আমার রেটিনা কর্ণিয়ার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে পরাজয় বরণ করে করে গড়িয়ে আসে বের হয়ে কয়েক ফোঁটা অ্যাকুয়াস হিউমাস । হঠাৎ করেই চোখে ভেসে ওঠে মায়ের অশ্রুময় চোখের দৃশ্য ।
শেষতম সিগারেটের অবশেষটি ধীরে ধীরে গিয়ে বর্ষার পাহাড়ী ঢলের সাথে মিশে যায় করতোয়ার স্রোতে । আঁধার ঘেরা কালো জলে কিছু একটা পড়ার শব্দ হয় । বয়ে যাওয়া কয়েক জীবন প্রদীপের আলো থেকে কেউ হয়তো উঁকি দেয় । ব্রীজ হয়ে যাওয়া গাড়ি গুলোর তখনো কোন ভ্রুক্ষেপ থাকে না । আকাশ বার কয়েক জ্বলে জ্বলে উঠছিল ঠিক সে মুহূর্তে ।
তারপর? তারপরের আর কিছুই জানা নেই আমার....