অবসরহীন সময়ের শহর আর 'এক অর্ধপ্রাণের গল্প'

শিক্ষা / শিক্ষক (নভেম্বর ২০১৫)

তুহেল আহমেদ
দৃশ্যপট 1:-
পৃথিবীর ব্যস্ততম একটি শহর , ম্যানহাটন ।যার প্রতিটি মানুষ জীবনের মোহে ছুটে চলেছে , অবসরহীন সময়ের পৃথিবীর দিকে । এর প্রায় প্রতিটি স্ট্রিট , প্রতিটি পয়েন্ট , প্রতিটি স্কয়ার , সবকিছুই ভীষণ রকমের সচল । এক জীবন্ত টনের্ডো ধেয়ে আসছে যেন পিছু !
এরকমই একটি ব্যস্ত পয়েন্ট হলো 14 স্ট্রিট × 3rd এভিনিউ , ইস্ট ভিলেজের । চিরন্তন পাশ কাটিয়ে চলা এই ব্যস্ততম শহরের ব্যস্ততম প্রাণী গুলোর চোখের অগোচরেই পড়ে থাকে শত 'অর্ধপ্রাণ' । 'হোমলেস' নামটি ছাড়া এই সভ্যতায় ওদের আর কোন পরিচয় আছে বলে মনে হয় না ।
এমনই এক 'হোমলেস' , দেহের দিক দিয়ে বিশালাকার কিন্তু দাঁড়াতে পারে না ঠিক মত সোজা হয়ে । প্রতিবন্ধীই বলা চলে এই 'অর্ধপ্রাণ'টাকে । রেইস বলে , আফ্রিকান হতে পারে কিংবা জ্যামাইকান ।
বসে থাকে ও একটি এটিএম বুথের সামনে , এই পয়েন্টেই ।

দৃশ্যপট 2:-
ওই অর্ধপ্রাণের সাথে আমার পরিচয়ের সূত্র হলো , আমার কাজের জায়গা , একটি রেস্টোরেন্ট , ওখানেই । ও রোজ সন্ধ্যায় সারাদিনে পাওয়া চেঞ্জ গুলো নিয়ে আসতো নোট করতে , আমাদের এখানে ।
একদিন ও কিছু অর্ডার করছিল , ঐ সময় একটি কম বয়সী যুবক ছেলে এসে ফ্রি'তে খাবার চাইলো ।তো স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের ম্যানেজার ওকে 'নো' বলে দিলেন । আর তখনই এই অর্ধপ্রাণটাই , মাত্র আসা ছেলেটাকে ডেকে খাবার দিতে বলে নিজেই পে করে !
একজন প্রতিবন্ধী নিজের ভিক্ষার টাকা দিয়ে একজন সুস্থ মানুষকে খাওয়ালো !

দৃশ্যপট 3 :-
এর বেশ কয়েকদিন পরের কথা ।
প্রতিদিনকার মত বিকেল 6টার দিকে আমি আমার লাঞ্চে বসি , একদম সামনের দরজার কাছের টেবিলে ।
সেদিন হঠাৎ করে ঐ অর্ধপ্রাণটা এসে বসে পড়লো আমার পাশে । সারাদিনের পাওয়া কয়েনগুলো গুনছিল ।
' আজ এত তাড়াতাড়ি ?'- আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
' বিজনেস স্লো , তাই আজকে একটু আগেই ফিরছি ।'- ও জবাব দিলো ।
আমি ওকে আমার খাবার থেকে কিছু অফার করলে ও না নিয়ে চলে গেল কাউন্টারে , নিজেই কিনে নিয়ে আসলো কিছু একটা , বসলো এসে আমার পাশেই ।
' তুমি কি ইন্ডিয়ান ? '
'না , বাংলাদেশী ।'- আমি জবাবে মৃদু হাসলাম ।
' ওও , বাংলাদেশী ! আমি ছিলাম কয়েকদিন তোমাদের ওখানে। '
' ওউ ! রিয়েলী ! '- আমার সত্যি অবাক লাগছিল ।অবিশ্বাস করছিলাম না যদিও ওকে । তবু খটকা লাগছিল যে , হয়তো বেটা ভাব জমাতে ভাও মারছে । বাংলাদেশ ছোট্ট একটা দেশ । সেখানে এরকম একটা হোমলেসের যাওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না ।
'হ্যাঁ , আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম 2002 এর দিকে কারাতের একটা প্রোগ্রামে । 4-5 দিন থাকা হয়েছিল । এশিয়ার আরো কয়েকটা দেশ ঘুরা হয়েছিল সেবার । '
আমি বিস্ময়ের ঘোরে চলে যাচ্ছিলাম ।
' তাহলে এখন এই অবস্থা কেন ?'- মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা । অখেয়ালে ।
' আর বলছো ! '- একটা দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ করে ছেড়ে ও আবার বলা শুরু করলো ,
' একসময় আমার সময় অনেক ভালো ছিল । গার্লফ্রেন্ডের উপর গার্লফ্রেন্ডে সময় যেত । প্রায় প্রতিটি রাতই কাটতো বারে , রেইস লাগানোতে । এরকম চলতে চলতে একসময় আউট অভ কান্ট্রোল হয়ে যাই । আস্তে আস্তে সব শেষ । তারপর থেকে এই অবস্থা । এখন এমনই চলে , চলছে । থাকা হয় ব্রুকলিনে , একটি পার্কিং প্লেসের বেজমন্টে । বেঁচে থাকার কথা ছিল না তো আমার ! সৃষ্টিকর্তাকে ডাকি নি কখনো ঠিক , আজ তিনিই আমাকে বাঁচিয়ে নিচ্ছেন ।'- দীর্ঘ একটি কথা বলে আবারও আরো একটি র্দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও । অসহায় , হতাশা মাখা দীর্ঘশ্বাস , ভেজে উঠছিল বারে বারে ওর চোখের কোণা , পাপড়ি গুলো ।
আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না ! কথা ঘুরাতে প্রশ্ন করলাম ,
' তুমি কোথা থেকে ?'
' হাওয়াই দ্বীপের । 5 বছর বয়সে এসেছিলাম এখানে সাগর হয়ে ।বেলেগ্লেড আর মায়ামীতেই আমার বেশী সময় কাটে ,আর পরের দিকে এসে পড়েছিলাম নিউ জার্সির আটলান্টাতে । ওটাই হলো রেইসের স্বর্গ রাজ্য ।নিউ ইয়র্কে আসার বেশীদিন হয়নি । তবে আমার বাবা-মায়ের সাথে ছিলাম না কখনোই । অ্যামেরিকায় আসার কিছুদিনের ভিতরেই আমি ওদেরকে হারিয়ে ফেলি ! হয়তো ওরা কোথাও চলে গেছে ! বা ইমিগ্রেশন পুলিশ ধরেছে । বা হয়তো অন্য কিছু । তখন আবার কৃষ্ণাঙ্গদের অনেক সমস্যা চলছিল কিনা !'- ওর চেহারা বলছিল , ও হারিয়ে গেছে কোন এক দূরে , কিছু পেছনে ফেলে আসা জানা সময়ে , স্মৃতি হয়ে যাওয়া মুহূর্তে, স্বপ্নীলে--।

'হুম ! তোমার সাথে আজ অনেক কথা হলো , ভালো লাগলো। আমার ব্রেক অলরেডি শেষ , এখন যেতে হবে আমাকে ।'- আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম ।
' ঠিক আছে তাহলে , ভালো থেকো ।'
'ও , হ্যাঁ । কথা তো হলো ,কিন্তু তোমার নামটাই তো জানা হলো না ! তোমার নাম ?'
'আব্দুর রাহমান।'
ওর কথা শুনে আমার চোখ যেন উল্টে গেলো যেন ! আবার মাথায় আসছিল , আমি বাংলাদেশী শুনে ও ফাইজলামি করে রসাতে চাইছে !
'হুম ! তোমার সাথে আজ অনেক কথা হলো , ভালো লাগলো। আমার ব্রেক অলরেডি শেষ , এখন যেতে হবে আমাকে ।'- আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম ।
' ঠিক আছে তাহলে , ভালো থেকো ।'
'ও , হ্যাঁ । কথা তো হলো ,কিন্তু তোমার নামটাই তো জানা হলো না ! তোমার নাম ?'
'আব্দুর রাহমান।'
ওর কথা শুনে আমার চোখ যেন উল্টে গেলো যেন ! আবার মাথায় আসছিল , আমি বাংলাদেশী শুনে ও ফাইজলামি করে রসাতে চাইছে !
'এহ ! সিরিয়াসলি, নাম কি তোমার ?'
' সত্যি । আমার নাম আব্দুর রাহমান ।'
'তুমি মুসলিম ?'- অবাক হওয়ার হয়তো কথা ছিল না , তবু আমি অবাক না হয়ে পারলাম না ।
আবার হলাম ।
'হ্যাঁ তো। তবে এখন মসজিদে যাওয়া হয়ই না বলতে গেলে ।ঐ ফ্রাইডে যাই আরকি ।তবে , গেল রোজায় রেখেছিলাম কয়েকটা।শরীর শয় না এখন কিছু আর ! '
'ও ! ' আমি একটা শকের মত ফিল করছিলাম !
' আমি আহমেদ ।'- বলে মৃদু হেসে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমার হাতটা ।
'তুমিও মুসলিম । হুম , আমার দেখা বাংলাদেশীর প্রায় সবাই ই মুসলিম ।'
পেছনে ম্যানেজারের ডাক আসলো ।
'আবার দেখা হবে'- বলে ওকে বিদায় দিয়ে আমার কাজে ফিরতে ভিতরের দিকে পা ফেরালাম । ধীর পায়ে । থেমে যাওয়া আঁখিতে দু'বার পেছন ফিরে তাকালামও । 'অর্ধপ্রাণ'টা বাহিরের দরজার দিকে এগুচ্ছে ।
আমার মনে হচ্ছিল হঠাৎ করেই আমার চারপাশের বাতাসগুলো গুমোট ভাব ধরে নিয়েছে !

শেষপট :-
একটা জীবনের চলা আর থেমে থাকাটা আমার চোখে ভাসছে যেন ! ভেসে উঠছে 'থেমে থাকা'টার এই পার আর ঐ পার । জলে ভরে ওঠা চোখ থেকে ঝরছে , পৃথিবীর অবসরহীন সময়ের শহরের প্রতি ভালোবাসা বা ঘৃণা । একসময় কেউ একজন এই শহরের বাসিন্দা ছিল , আজ এই শহর সেই তাকে ভূলে গিয়েছে , ভূলে গিয়েছে কেউ একজন সব হারিয়ে গিয়েও সব পেয়ে ছিল , আবার সব হারিয়েছে । তবু , ছিল তো এই শহরের ! আজ তার শহর তাকে অপরিচিতের দৃষ্টিতে দৃষ্টি ছুঁড়ে ! শহরের বাসিন্দারা ! ওরা তো পূর্ণপ্রাণ , আর ও ! ও তো এই শহরের এক অগোচরের নেশার ঘোরে পড়ে থাকা এক বাস্তু শরীর , এক 'অর্ধপ্রাণ' --
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।
এশরার লতিফ ভালো লাগলো পৃথিবীর পাঠশালার এই গল্পটি. অনেক শুভেচ্ছা.
আপনার প্রতিও অনেক বেশী শুভেচ্ছা ভাইয়া :)
রেজওয়ানা আলী তনিমা সুলিখিত। শুভেচ্ছা রইলো।
পড়েছেন দেখে ভালো লাগলো :)
এস আই গগণ গোছান লেখা, ভাল লাগলো। শুভ কামনা, পাতায় আমন্ত্রণ রইলো।
পড়েছেন দেখে ভালো লাগলো ।

৩০ মে - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী