২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দুপুর আড়াইটার সময় সাতক্ষীরা বাস স্টেশনে নেমে আবাসিক হোটেল খুঁজতে লাগলাম। এ এলাকায় প্রথম এসেছি। সবই অপরিচিত। সাতক্ষীরা শহর সম্বন্ধে কোন ধারনা নেই। এক রিক্সাওয়ালাকে ডাক দিয়ে আবাসিক হোটেল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই বলল, কোন হোটেলে যাবেন?
তার প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। সাতক্ষীরার কোনো হোটেলের নাম জানা তো দুরের কথা, সাতক্ষীরায় হোটেল আছে কিনা সেটাই আমার জানা নেই। আমি সাতক্ষীরায় নতুন এসেছি এ কথাটি রিক্সাওয়ালাকে বুঝতে না দিয়ে বললাম, যে কোন একটা হোটেল হলেই হলো।
রিক্সাওয়ালা বলল, ওঠেন।
রিক্সায় উঠে বসলাম। আমি নতুন এসেছি এটা রিক্সাওয়ালাকে না বললে কি হবে, রিক্সাওয়ালা ঠিকই আমার নতুনত্ব টের পেয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে একটা হোটেলের কাছে এসে থামল। বাস যেখানে থেমেছিল সেখান থেকে খুব দুরে নয়, মাত্র তিন চার মিনিটের রাস্তা। সেই তিন চার মিনিটকে চৌদ্দ মিনিট বানিয়ে কয়েক গলি ঘুরে আমাকে নিয়ে এসেছে। বিষয়টি তখন টের না পেলেও পরদিন ঠিকই টের পেয়েছিলাম। পেয়েও লাভ নেই, ততক্ষণে একরাত পার হয়ে গেছে। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই দশ টাকা চেয়ে বসল, দশ টাকা ভাড়ার ব্যাপারে হু হা কিছু বললাম না, পকেট থেকে তার চাহিদা মত নোট একটা বের করে দিয়ে দিলাম।
নিচ তলায় দোকানপাট উপর তলায় হোটেল। দোতালায় গিয়ে হোটেলের ম্যানেজারের কাছে সিঙ্গেল রুম চাইতেই দখিনমুখি জানালাওয়ালা একটি রুম দিয়ে দিল। হোটেল বয় এসে বিছানা পত্র ঠিক করে দিয়ে গেল। হোটেলের বয়স খুব বেশিদিন নয়। বিল্ডিংসহ চেয়ার, টেবিল, বিছানাপত্র সবই নতুন নতুন মনে হলো। রুমের চুনের গন্ধ এখনও যায়নি। গোসলখানায় গিয়ে গোসল করে ফ্রেস হয়ে নিলাম। জামা কাপড় পরে বাইরে এসে হোটেলের ম্যানেজারের টেবিলে গেলাম। গিয়ে দেখি ম্যানেজার নেই। ম্যানেজারের চেয়ারে মোটাসোটা গোফওয়ালা গলায় স্বর্নের চেইন পরিহিত পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ বছর বয়স্ক স্মার্ট এবং মাস্তান মাস্তান ভাবের এক ভদ্রলোক বসে আছে। কাছে গিয়ে ভদ্রলোককে বললাম, ভাই ম্যানেজার সাব গেলেন কই?
ভদ্রলোক বলল, কেন, তাকে কি দরকার?
বললাম, তার প্রয়োজন কি আপনি পুরণ করতে পারবেন?
ভদ্রলোক বলল, ম্যানেজারকে কাজে পাঠিয়েছি, আমি এই হোটেলের মালিক। আপনার যদি কিছু প্রয়োজন হয় আমাকে বলতে পারেন।
তিনি হোটেলের মালিক এবং এই মুহুর্তে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছে এ কথা শুনে অন্য কোন কথা না বলে সরাসরি বললাম, এখানে খাওয়ার ভাল হোটেল কোথায় আছে?
আমার কথা শুনে ভদ্রলোক চোখ দু’টা কপালে তুলে আমার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি এর আগে কখনও সাতক্ষীরা আসেননি?
বললাম, না।
আমি নতুন এসেছি বলার সাথে সাথে ভদ্রলোকের চোখ মুখ স্বাভাবিক হলো, নরম সুরে বলল, আশেপাশে যে কোন হোটেলে খেতে পারেন। আর যদি একটু কষ্ট করে দুরে যান, তাহলে ঘরোয়া পরিবেশে ভাল খেতে পারবেন।
আমি বললাম, কোথায়?
বাজারের কাছাকাছি যেতে হবে, হেঁটে ১৫/২০ মিনিট লাগবে, যদি রিক্সায় যান তাহলে তিন টাকা ভাড়া নিবে।
বললাম, হোটেলের নাম কি?
বলল, হোটেলের নাম নেই, তবে রিক্সাওয়ালাকে বললেই হবে ভাবীর হোটেলে যাবো। যে কোন রিক্সাওয়ালা আপনাকে পৌছে দিবে।
ভাবীর হোটেলের নাম শুনে কিছুটা বিব্রত বোধ করলাম। বাংলাদেশ ভারতের অনেক জায়গায় ঘুরেছি, এরকম নামে তো কোন দিন হোটেল পাইনি! তার মুখে ভাবীর হোটেলের নাম শুনে ইতস্তত করতে লাগলাম। ভদ্রলোক আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, মহিলার স্বামী হোটেল চালাতো, স্বামী হঠাৎ অসুস্থ্য হয়ে মারা গেলে ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে সংসার চালাতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে নিজেই এখন হোটেল চালায়। ওখানে গেলেই বুঝতে পারবেন। খুব সুন্দর পরিবেশ। বাড়ির মত রান্না। খেলে তৃপ্তি পাবেন।
ভাবীর হোটেলের প্রশংসা, পরিবেশ, রান্না এবং তৃপ্তির কথা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। হাজার হলেও আবাসিক হোটেলের মালিক, কোন মালিকের কেমন চরিত্র বোঝা মুশকিল। অতিরিক্ত রোজগার করার জন্য আমাকে খারাপ কোন পরিবেশে পাঠাতে চাচ্ছে কিনা? মনের ভিতর সন্দেহ হলেও মুখে কিছুই বললাম না। ভাবীর হোটেল দেখার কৌতুহলও সংবরন করতে পারছি না। দোতালার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। রাস্তায় গিয়ে দেখি আধা বয়সি একজন রিক্সাওয়ালা রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে বললাম, ভাবীর হোটেল যাবেন?
বলল, উঠেন ।
-- ভাড়া কত?
-- চার টাকা।
বললাম, ভাড়া তিন টাকা, একটাকা বেশি চাচ্ছেন কেন?
রিক্সাওয়ালা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আঙ্কেল, এই বাজারে তিন টাকায় পোষায় না, এইজন্য এক টাকা বেশি চেয়েছি।
বললাম, তিন টাকায় যাবেন না?
রিক্সাওয়ালা ঘাড় কাত করে বলল, উঠেন।
রিক্সায় উঠে ভবীর হোটেল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, ভাবীর হোটেলের রান্না কেমন?
বলল, অনেক হোটেলের চেয়ে ভাল। মহিলা নিজেই রান্না করে। দুপুরে তো প্রচুর ভির থাকে।
ভাবীর হোটেল নামে যে হোটেল আছে এটা রিক্সাওয়ালার কাছে জেনে একটু নিশ্চিত হলাম। বুঝতে পেলাম আসলেই এটা খাবার হোটেল খারাপ কোন জায়গা নয়।
কিছুক্ষণ পরেই টিন সেট বিল্ডিংয়ের সামনে এনে রিক্সাওয়ালা বলল, আঙ্কেল নামেন, এটাই ভাবীর হোটেল।
আধপাকা বিল্ডিংটি রাস্তা থেকে একটু নিচে। রিক্সাওয়ালার ভাড়া দিয়ে রাস্তা থেকে নিচে নেমে এলাম। হোটেলের সামনে কচুপাতা রঙয়ের শাড়ী পরে একজন মধ্য বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে চেয়ার টেবিল সাজানো। শুধু একজন লোক ভাত খাচ্ছে। আর কোন কাস্টমার নেই।
ঘরের উপরে নিচে তাকিয়ে কোথাও কোন হোটেলের সাইন বোর্ড চোখে পড়ল না। ঘরের দুই পাশে পরিত্যাক্ত ফাঁকা জায়গা। আশে পাশে কোন ঘরবাড়ি নেই। এটা যে হোটেল দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সামনে দাঁড়ানো মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি ভাবীর হোটেল?
আমার কথা শুনে মহিলা আশ্চার্য হয়ে বলল, হ্যাঁ, কেন?
বললাম, আমি ভাত খেতে এসেছি।
ভাত খেতে এসেছি শুনে মাহিলা সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষায় বলল, কুথা থেকে এসেছেন?
বললাম, ঢাকা থেকে এসেছি।
-- এখানে কে পাটিয়েছে?
-- বাস স্টেশনের কাছে যে থাকার হোটেল আছে সেই মালিক পাঠিয়েছে। হোটেলের মালিক পাঠিয়েছে শুনে মহিলা চোখেমুখে স্বাভাবিক ভাব এনে বলল, ও বুঝতে পেরেছি, হোটেল থেকে পাঠিয়েছে। এখন তো সব শেষ হয়ে গেছে। কি দিয়ে খাবেন? কিছু তো নেই।
-- কিছুই নেই?
-- ভাত আছে, তরকারী নেই।
-- ডালও নেই।
-- শুধু ডাল দিয়ে খাবেন?
-- তরকারী না থাকলে কি আর করবো, আপাতত ডাল দিয়েই দু’টো ভাত খেয়ে যাই।
মহিলা যেমনি দাঁড়ানো ছিল তেমনি দাঁড়িয়েই বলল, কাতল মাছের ঠুটামুটা আর কুমড়োর তরকারী আছে, এ ছাড়া আর কোন তরকারী নেই। মাছের ঠুটামুটা খেতি পারবেন তো?
বললাম, মাছ না থাকলেও সমস্যা নেই, কুমড়োর তরকারী দিলেই হবে।
শুধু কুমড়োর তরকারী দিলেই হবে এমন কথা শুনে মহিলা বলল, ভিতরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে বসেন, আমি ভাত দিতে বলছি।
ভিতরে গিয়ে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে একটি টেবিলে বসলাম। তের চৌদ্দ বছর বয়সী একটি ছেলেকে ভাত দিতে বলল। ছেলেটি ভাত দিয়ে গেলে মহিলা নিজেই এক বাটি তরকারী নিয়ে এলো। কাতলা মাছের আধা ভাঙা ঠোটার সাথে ঝোলসহ কয়েক পিস কুমড়ো নিয়ে এসেছে। তরকারীতে অতিরিক্ত কোন তেল বা হলুদ নেই। তরকারীর চেহেরা তেমন আকর্ষনীয় নয়। তরকারীর রঙ দেখে খুব একটা রুচি হচ্ছে না। তবে খেতে বসেছি যখন না খেয়ে উঠতেও পারছি না। ইতস্তত করতে করতে প্রথমেই একটু ঝোল পাতে ঢেলে ভাত দিয়ে মেখে অল্প করে মুখে দিলাম। খেয়ে দেখি অসম্ভব স্বাদ। ক্ষুধাও প্রচুর লেগেছে। ঝোলের সাথে কুমড়ো দিয়ে গো গ্রাসে খেত লাগলাম। কুমড়োও স্বাদ হয়েছে। দু’প্লেট ভাত খেয়ে পেট ভরল না। আরো এক প্লেট ভাত খেলাম। তিন প্লেট খেয়ে পেট ভরলেও মুখের তৃপ্তি যেন মিটছে না। আরো এক প্লেট ভাত চেয়ে বসলাম। ভাত চাইতেই মহিলা বলল, ভাত দিতে পারবো, তরকারী তো আর নেই।
তার কথা শুনে খাওয়ার অতৃপ্তিভাব যেন আরো বেড়ে গেল। মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ঝোল তরকারী কিছুই নেই?
বলল, আপনাকে যা দিয়েছি হাঁড়ি চেছেমুছেই দিয়েছি। আর কিছুই নেই।
বাধ্য হয়েই খাওয়া বন্ধ করে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। কুমড়োর স্বাদ পুরোপুরি পেয়েও যেন পেলাম না।
বিল দিতে গিয়ে অবাক হলাম। যে তুলনায় তরকারীর স্বাদ হয়েছে সেই তুলনায় বিল খুব বেশি নয়। তিন প্লেট ভাত দুই প্লেট কুমড়োর তরকারী আরো অতিরিক্ত ঝোল, সেই হিসাবে বিল মাত্র আঠারো টাকা। এত কম টাকা বিল দিয়ে মনে হলো শুধু খেয়েই নয় বিল দিয়েও মহা তৃপ্তি পেলাম। ভাত খেয়ে শহরে চলে গেলাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত শহর ঘুরে রাতে আবার সেই হোটেলে এসে খেলাম। রাতে মাছের তরকারী না খেয়ে মুরগীর মাংস খেলাম। মুরগীর মাংসও খুব ভাল লাগল।
পরদিন সকালে শহরে ঘুরতে গিয়ে বড়সড় একটি হোটেলে গিয়ে নাস্তা করলাম এবং দুপুরে অন্য একটি হোটেলে ভাত খেলাম। কিন্তু ভাবীর হোটেলের মত এত স্বাদ পেলাম না। ভাবীর হোটেলের খাবারের স্বাদের কারণে অন্য হোটেলের খাবার মুখে ধরতেছে না।
রাতে আবার ভাবীর হোটেলে খেলাম, ছোট চেলা মাছের সাথে চিকন চিকন বেগুন দিয়ে সুখনা সুখনা চটচটি। এত স্বাদ হয়েছে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। অনেক ছোট মাছের তরকারী খেয়েছি কিন্তু ভাবীর হোটেলের মত এত মুখোরোচক স্বাদ কখনও পাইনি। দুই প্লেট তরকারী আর তিন প্লেট ভাত মুহুর্তেই সাবাড় করে দিলাম। তারপরেও যেন তৃপ্তি মিটতে চায় না। আরো খেতে মন চায়। চতুর্থ প্লেট ভাত নিয়ে দুই লোকমা খেয়ে তৃতীয় লোকমা মুখে দিতেই দুই চাপার দাঁতের চিপায় পড়ে কি যেন ক্যার ব্যার করে গুড়া হয়ে গেল। বেসিনে গিয়ে খাবার মুখ থেকে উগরাতেই দেখি ছোট শামুক গুড়া হয়েছে। ওয়াক করে বমি করে দিলাম। শুমুক মুখে পড়ায় খাওয়া তো দুরের কথা মুখের রুচি এমনিতেই মরে গেল। ভরা পেটে মুখের অতৃপ্তি নিয়ে ওয়াক করতে করতে চলে এলাম।
এর পরে অনেক জায়গায় গিয়েছি, অনেক হোটেলে খেয়েছি কিন্তু সেই ভাবীর হোটেলের ছোট মাছের তরকারীর স্বাদ আর কোথাও পাইনি। শামুক দাঁতের তলে পরে গুঁড়–া হলেও ছোট মাছের স্বাদ ভুলতে পারিনি, এখনও মনে হলে মনে হয় সেই মাছের তরকারীর স্বাদ যেন মুখে লেগেই আছে।