মায়ের মৃত্যু পরোয়ানায় আমার স্বাক্ষর

মা - তুমি কোথায় (মে ২০১৬)

শাহ আজিজ
  • ১৭৩
খুব ছোট থাকতে মায়ের ডানদিকে শুতাম আমি । ঐ সময় আমার বা পা খানি তার পেটের উপর উঠিয়ে ঘুমোতাম । ক্লাশ এইট অবধি মায়ের সাথে ঘুমিয়েছি । এরপর নির্বাসনের জীবন । দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হল আমায় রাজনৈতিক ডামাডোলের প্রতিহিংসামুলক কাজে জড়ানোর কারনে । তারপর ঢাকা । ছুটিতে বাড়ী যেতাম । মা সর্বাত্মক চেষ্টায় থাকতেন সেইসব মাছ খাওয়াতে যা ঢাকাতে খেতে পাইনা । বড় একান্নবর্তী সংসারে তার মনের দুঃখ,এটা সেটা, অমুক তমুক ,গ্রামের বাড়ির কথা ,ধান পান এসব নিরিবিলিতে শোনার কেঁউ নেই । সবাই ব্যাস্ত । আমি পুরো ছুটিটাই বাড়িতে কাটাই আর মা একেবারে শেষের দিকের রুমটিতে বসে আমায় শোনাতেন তার কথা । আমি যেন তাঁকে রেখে ভেগে না যাই তার জন্য পাঁচটি করে সিগারেট ঘুষ দিতেন আমায় । চানাচুর মুড়ি পেয়াজ কাচা মরিচ মাখা তো বিকালের অতি আবশ্যিক মেনু । আমি বিছানায় শুয়ে জানালায় পা উঠিয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছি আর মা পায়ের কাছে খাটের কিনারায় বসে একনাগাড়ে বলে চলেছেন তার নালিশ বড় দুজনের বিরুদ্ধে । বাবার কঠোর নিয়ন্ত্রণের সংসার ,সম্পদ এখন পড়েছে লর্ড বড় পুত্রের হাতে । বাবা হীন সংসার কেমন হয় তা বুঝিনি দূরে থাকার কারনে । এক সময়ে খেই হারিয়ে কল্পনার জালে ভেসে বেড়াচ্ছি , মা বলে চলেছেন , আমি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছি । তবুও হুম হাম শব্দ করে মাকে বুঝ দিচ্ছি যে আমি সিরিয়াসলি শুনছিতো । আমিই একমাত্র পুত্র যাকে মা সিগারেট কিনে দিতেন বোধকরি দূরে থাকার কারনে , বাড়িতে থাকলে যেন তার কাছাকাছি থাকি, যেন তার রান্না করা ভেটকি মাছটা আরেক টুকরো বেশী খাই ,মোচা দিয়ে চিংড়ি ভুনা , আর নারকেলের দুধ দিয়ে গলদা চিংড়ি যেন সেধে সেধে খেতে চাই, রসওয়ালাকে আদেশ থাকতো রস চাই পায়েস হবে । চাউলের গুড়ো দিয়ে পিঠে হবে , রাত জেগে মা চিতই পিঠে বানিয়ে খেজুর রস আর নারকেল মিশিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে ভোরে প্লেট ভরে তুলতুলে নরম পিঠা নিয়ে বিছানার পাশে দাড়িয়ে বলতেন বাবা ওঠ , খেয়ে নে।
প্রবাসে যাবার আগে বুঝিনি মাতৃ বিচ্ছেদের যন্ত্রনা । বেইজিং এ ডরমিটরি তে উঠে একটু গুছিয়ে নিয়ে শিশুর মতো চিৎকার করে কেঁদেছিলাম একাকী, মায়ের মুখখানি মনে করে, বালিশ চাপা দিয়ে। বছর তিনেক বাদে চলে এলাম ছুটিতে ।
এক হাড়ি ভেঙ্গে বহু হাড়ি হয়ে গেছে । মা তখন ভাসমান নিজের সম্পদের উপরে । আগেই চিঠিতে বলে দিয়েছিলাম মা যেন একটি ভাড়াটে উঠিয়ে সেখানে একা থাকেন । এবার এসে গোটা বাড়ির ভাড়া, ও তো আইনত তারই দালিলিক সম্পত্তি, মার হাতে তুলে দিলাম আর সব ভাড়াটেকে বলে দিলাম । মা খুব খুশী তার নিজের একাকী সংসারে নাতি,পোতা,পুতনীর ভিড়ে ।
প্রবাস ছেড়ে একসময় থিতু হলাম নিজ বাড়িতে নতুন ভবনে। দু দুবার ব্রেন স্ট্রোক করেও দেয়াল ধরে সার্বক্ষণিক লোকের হাতে ভর দিয়ে এ বিল্ডিং থেকে ওটায় , তার পরেরটায় ঘুরে বেরাতেন । নিষিদ্ধ জিনিষ গোপনে খেতেন । তৃতীয় স্ট্রোকে বেহাল দশা । ঠাই হল বড় পুত্রের বাড়িতে । বাকহীন , নড়চড়হীন মা ছয় মাসেই কঙ্কাল হয়ে গেলেন । বয়েস হয়েছে আর ব্রেন সার্জারি প্রায় অসম্ভব তার এই সঙ্কটকুল সময়ে ।
পারিবারিক বন্ধু ডাক্তার এলেন । তিনি গোড়া থেকেই চিকিৎসা করছেন । আমরা তিন ভাই বসে , সাথে একমাত্র বোন । ছোট ভাইটি বিদেশে ,দশ বছর একনাগাড়ে মাকে দেখেনি বৈধ কাগজের অভাবে। ডাক্তার বললেন আমি তাঁকে ইঞ্জেকশন দেবো ব্রেন ব্লকেজ ইজি করার জন্য । বিপদ হচ্ছে তার আগের তিনটি ডাইলুটেড এরিয়া । ছোট ছোট ভাসমান কনা যদি বেঁধে যায় তাহলে কোন আশা নেই । কঙ্কালসার নির্জীব জীবন, কণ্ঠ নালি শুকিয়ে বন্ধ খাওয়া দাওয়া , বেড সোল এ পোকার উপস্থিতি , বড় কষ্টকর জীবন । ছোটটিকে ওখানে বসেই কল দিয়ে চূড়ান্ত জানতে চাওয়া হল । না , তারও আপত্তি নেই এই চিকিৎসায় । যদি মা ভালো হয়ে আরও কিছুদিন থাকেন আমাদের মধ্যে । ডাক্তার আমাদের আরও ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন আর ফোনে জানাতে বললেন ।
তিনি লন্ডনে এফ আর সি এস করার সময় তার মায়ের হটাত মৃত্যু হয় । এসে মাকে পাননি কিন্তু আর বাইরে না গিয়ে খুলনাতেই মায়ের নামে ক্লিনিক খুলে আরও কিছু ডাক্তার নিয়ে শুরু করলেন মানব সেবা । একান্ত গরীব রোগীদের বিনা পয়সায় হাসপাতালে রাখতেন ।
আমরা একটা সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছি ।তারপরও দরজায় দাঁড়ানো একমাত্র বোনের দিকে তাকালাম তিনি সায় দিলেন এবং বললেন সবকিছু খোদার ইচ্ছা ।
আমরা এবং আমি জননী জন্মদাত্রী দুগ্ধদায়িনী গরীয়সী দেবীর অলিখিত মৃত্যু পরোয়ানায় সাক্ষর দিয়ে দিলাম । ডাক্তার টেলিফোনে তার এ্যাম্বুলেন্স খবর করলেন । মা হাসপাতালে গেলেন । তার চিকিৎসা ভালো ভাবেই শুরু হল । আট ঘণ্টার মধ্যেই তার পূর্ব চেহারা ফিরে এলো দুই স্যালাইনের গুনে । কিছু শব্দ উচ্চারন করতে শুরু করেছেন । তার হাত পায়ের অনড় ভাবটা দূর হচ্ছে । ক্ষীন কণ্ঠে বললেন বাসায় যাবো । আমি একটা ফিফটি ফিফটি অবস্থার মধ্যে সময় কাটাচ্ছি । আত্মীয় স্বজনে ভর্তি রুম থেকে আমি বিদায় নিলাম । রাত গেল ভালো ভাবে । সুপ খেয়েছেন । তার চেহারা দেখে মনেই হচ্ছিলনা গত ছয় মাস তিনি কংকালসার ছিলেন । পরদিন সকাল ১১টায় সেই দুসংবাদ পেয়ে ছুটলাম । ডাক্তার যা বলেছিলেন তাই হল , তার ব্লকেজে দানা আটকে আবার তিনি হিক্কা তুলতে লাগলেন । ডাক্তাররা আবারো ইঞ্জেকশন লাগালেন কিন্তু না , আমাদের সব আশা ছেড়ে তিনি নেতিয়ে পড়লেন, মুখে ফেনা , নাকে অক্সিজেন । রাত ১১টায় চলে এলাম বাসায় । বড় দুজন রইল । আমার রাত জাগা নিষিদ্ধ শারীরিক সমস্যার কারনে । ওদের বলে এলাম কিছু হয়ে গেলে ফোন করতে । সকাল ছয়টায় ফোন এলো- চলে আসো, মা নেই। আঠারটি ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে মা হেরে গেলেন। তার শরীর তখনও গরম । ৩৩ টি বছর একাকীত্বের অসহনীয় জীবন যাপনের পর মা বাবার কাছে চলে গেলেন ।
এই ২০১৪ তে মার বয়স ১০০ হতো । নিজেই কবরে নেমে মার শরীর আঁকড়ে ধরে শুইয়ে দিয়েছি বাবার পাশে একই কবরে । তার মাথার বাধন আলগা করে উঠে এলাম ।
কৃষ্ণচূড়ার লাল টকটকে বৈশাখে মা চলে গেলেন দূর আকাশে । কান্নার মধ্যে এই সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে যে তিনি ৮৬ টি মাঘ আর ৮৫ টি শ্রাবণ পেয়েছিলেন জীবনে । প্রথম জীবনে একাকী সংসার পেতেছেন কলকাতায়, প্রথম সন্তান , নগরের জীবন আর নানা গল্প বলতেন আমায়, সেই ১৯৩২ সালের কথা । কলকাতায় গিয়ে ৮২ সালে পার্ক ষ্ট্রীটে তাদের ভাড়াটে ঘর খুজে পাইনি , ওটা কবে ভেঙ্গে নতুন দালান চড়েছে । মায়ের বিয়ের বেনারসি শাড়িটি আমার কাছে, বাবা ওটা ৮ রুপি দিয়ে কিনেছিলেন । তার হাতে সেলাই করা নকশী কাঁথাটি দেওয়ালে বাধিয়ে রেখেছি ।
আমি ডায়রিতে লিখেছিলাম “ঈশ্বর পৃথিবী থেকে আরেকটি মাকে হরন করলেন”।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাঃ ফখরুল আলম অনেক ভাল লেগেছে। ভোট দিলাম।
নাস‌রিন নাহার চৌধুরী মাকে নিয়ে এভাবে লিখতে হয়না...চোখের পানি আটকাতে পারলাম না।

০৮ মে - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৮১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী