আমার বাবা ।। আধুলি ও গৃহযুদ্ধ

আমার বাবা (জুন ২০১৫)

শাহ আজিজ
  • ৫৫
আমরা ভিতরের বড় ঘরের এককোণে রান্নাঘর লাগোয়া একটি বড় টেবিলে খাবার খাই।আব্বা পাশেই আমাদের শোবার ঘরে ছোট্ট একটি টেবিলে হাই ব্যাক চেয়ারে একা বসে খান । কেন তিনি একা খান আমার বোধগম্য নয়। আমরা বড় মাছ বিশেষত ভেটকি মাছ নিয়মিত খাই । এটার দর্শনীয় মাথাটি আব্বা খেয়ে থাকেন এবং আমরা কখনই তা চেখে দেখার সুযোগ পাইনি। মাছের কাটা আমার জন্য অভিশাপ। এক দুবার ফুটেছে বলে আমি ইলিশ, কৈ কে জমের মত ভয় করি। কাটাহীন বড় মাছ আমার প্রিয় । মাকে একদিন খেতে খেতে আস্তে করে জিজ্ঞাসা করলাম আব্বার মত ওভাবে মাছের মাথা কবে খেতে পারব। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন বড় হয়ে যখন কামাই করবি তখন খাস। শীতের দিনে ভোরে আমি ও ছোটটি বিহারিদের দোকান থেকে পায়া আর তন্দুরি এনে সবাই মিলে খেতাম। খাদ্য খাবারে বাবার জুড়ি ছিল না। কিন্তু তিনি আমাদের বঞ্চিত করেছিলেন মারবেল,সিগারেট প্যাকেটের খেলা,লাটিম ইত্যাদি হতে । বার কয়েক হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তার হাতের সুদৃশ্য লাঠির বাড়ি খেয়েছি। আমরা পোশাক আশাকও খুব সাধারন পরতাম এবং বেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ কঠিন জীবন যাপন করতাম। স্কুলের ঐ সময়টুকু আর বাবা যেই গ্রামের বাড়িতে যেতেন তিনদিনের জন্য আমরা গনতন্ত্র ফিরে পেতাম । ঐ কদিন আমাদের বড় ভাইটি গ্রামের জমিদারি ছেড়ে শহরে আসতেন । বড়ছেলে ও বাপের মধ্যে দেখা প্রায় হত না। বাহকেরা তাদের বার্তা আদানপ্রদান করত। ঐ সময়ে তিনি খুব স্টাইলিসট যুবক ছিলেন এবং দামি জামা জুতো পরতেন।
আব্বা কেন জানি আমায় নিয়ে বাজার করা শুরু করলেন । বাপ বেটা ও একজন দুর্বল কুলি ,কারন ও তার চেয়ে দ্বিগুণ সাইজের ঝুড়ি টুপ করে মাথায় তুলে ফেলত। হটাৎ আমায় বাসা থেকে মা ও বড় ভাই নির্দেশ দিলেন বাজারে গিয়ে আব্বা যেন মিষ্টির দোকানে বসে মিষ্টি না খান। আমার এত সাহস হয়নি যে আব্বার কথা বাড়িতে বলব। প্রতিবার বাজারে গেলে বাজার সেরে সম্ভ্রান্ত মিষ্টির দোকান নিরাপদ ঘোষের দোকানে বসে মিষ্টি , দই ইত্যাদি খাওয়া নিয়মিত ব্যাপার ছিল। আমার বেশি ভাল লাগত ফুলকপি ও বাদাম ভরা শিঙ্গাড়া । নিমকির সাথে রসগোল্লা । আমরা বাসার জন্য মিষ্টি ও দই নিতে ভুলতাম না। বেশ কিছুকাল খেয়াল করছি তিনি নিরাপদ ঘোষের দোকানের সামনে এসে গতি স্লথ করে ভিতরের ভিড় দেখে আচ করতেন কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে , তা আর করছেন না । বেশ বিস্মিত আমি কারন আমার শিঙ্গাড়া বাদ যাচ্ছে ।
দিন দুয়েক বাদে হটাৎ একদিন বাজারের মুখে গজিয়ে ওঠা বিশাল খাবারের দোকানে ঢুকে পড়লেন , হতবাক আমি।এখানে রিকশাচালকের সাথে বাজারের কুলি মজুররা বসে চা নাস্তা ভাত খায়। বাইরে জিলিপি ভাজছে , ভিতরে শো কেসে মিষ্টি আছে। ওরা হাজি সাহেবকে ঢুকতে দেখে খুব দ্রুত খাবার খাচ্ছিল এমন দুজনকে অন্য টেবিলে সরিয়ে দিল। আব্বা মৃদু আপত্তি করলেও তারা জাহাপনা স্টাইলে আব্বাকে বসাল। তিনি রসমালাইয়ের গুনাগুন জিজ্ঞাসা করে দু বাটি দিতে বললেন। দই আব্বা একাই খেলেন। দই খেতে খেতে তিনি আমার হাতের উপর হাত রাখলেন। আমি চমকে উঠলাম এবং বিব্রত হচ্ছিলাম। কারন তার সাথে আমার এযাবত বাতচিত কবার হয়েছে গুনে বলা যাবে। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললেন এই যে আজ মিষ্টি খেলাম এটা তোর মাকে কখনই বলবিনা। আমি আব্বার বাল্যখিল্যতায় বেশ ঘাবড়ে গেলাম । আমি ভেবে পাচ্ছিনা এতে বলা না বলার কি আছে।
তিনি আমায় আরো রসমালাই সাধলেন কিন্তু আমার ছোট পেটটি এক বাটিতেই ভরে গেছে।আমরা এবার হেটে কাছেই আমাদের দোকানে চলে এলাম। এখানে কিছুক্ষন বসে ঢাউস দুটো থলে দোকানের লোকেরা রিকশায় তুলে দিল। রিকশাভাড়া কুড়ি পয়সা কিন্তু তিনি আমায় একটি আধুলি দিলেন। আমি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম এই ভেবে যে তিনি ভুল করছেন। তিনি হেসে বললেন চার আনা তোর । রিকশাওয়ালাকে পাচ পয়সা বেশি দিতে হবে কারন সে ওই থলে দুটো দোতালায় তুলে দেবে।
রাস্তায় কি খুশী লাগছে যে এই প্রথম আব্বা আমার হাতে চার আনা তুলে দিলেন। চারদিনের বাদাম কেনার ব্যাপারটা হয়ে গেল। আচ্ছা আব্বা হটাত আজ পয়সা দিলেন, চিন্তিত আমি। বাসার কাছে এসে মনে হল মিষ্টি খাওয়ার ঘটনাটি চেপে যাওয়ার জন্য আব্বা আমার মুখ বন্ধ করে দিলেন।
****************
দুপুরে আব্বা এবং মায়ের মধ্যে একপশলা ঝগড়া ঝাটি হল। একসময় মাকে একলা পেয়ে আব্বা তার চুলের ঝুটি ধরলেন এবং মা চেচামেচি শুরু করলেন । ভাবী নাউজুবিল্লাহ বলতেবলতে আব্বার পায়ে পড়লেন। কাজের স্থায়ী মহিলাটির চেষ্টায় পাক-ভারত যুদ্ধ বন্ধ হল। সারাটি বাড়ি নীরব এবং থমথম করছে। এমনিতেই আব্বা বাড়িতে থাকলে কেউ জোরে কথা বলেনা বা হৈ হট্টগোল করেনা। আমার ক্ষিধে পেয়েছে তাই টেবিলে একাকি বসে খেয়ে নিলাম। মা সাধারনত আমাদের প্লেটে ভাত বেড়ে দেন কিন্তু মা এখন কোথায় তাও বলতে পারছি না। আব্বাকে কেউ খেতে দিলনা আজ কারন মা ছাড়া তার খাবার কেউ দেয়না বা রান্নাও করেনা। বাবা অন্য কার রান্না পছন্দ করেননা। আজ স্বভাববশত হাক পাড়লেন না ‘কই আমার খাবার কোথায়’। খেয়াল করলাম তিনি বাইরে যাবার কাপড় পরছেন। অবাক আমি ভীষণ। আমার ডাক পড়ল গম্ভীর গলায়। ‘শুধু জামা গায় দে, হাফ প্যান্টেই চলবে। ‘
আমরা সোসাইটি সিনেমার বিপরীতে বিহারিদের নাম করা হোটেলটিতে চলে এলাম। যাওয়ার দৃশ্যটি দোতালার রেলিঙের ফাক দিয়ে সবাই দেখতে লাগলো। আমরা ভিতরের শেষ রুমটিতে এক টেবিলে দুজন বসলাম। তিনি বিরিয়ানির অর্ডার দিলেন। বেয়ারাকে আমি মানা করলাম আমার খাবার না দিতে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন কেন , হাফ প্লেট খা ! আমি মাথা নাড়লাম। বললাম আমি দুপুরের ভাত খেয়ে নিয়েছি।।
তো, তাহলে শুধু কাবাব খা !
না ।
তাহলে ফিরনি খা ! মনে মনে ভাবলাম এটা খাওয়া যায়। মাথা নেড়ে হ্যা সুচক সায় দিলাম।
কিযে ভুল করেছি দুপুরে খেয়ে নিয়ে , আজ মিস হয়ে গেল মজাদার বিরিয়ানি ! ধুস শালা! আচ্ছা ওরা আরেকটু আগে ঝগড়াটা করলেতো আজ এই মুখে লালা ঝরানো বিরিয়ানি মিস হতো না।
খাবার আসতে সময় নিচ্ছে আর আমি মাথা নিচু করে টেবিলের ময়লা খুঁটছি নখ দিয়ে।
হটাত আব্বা আমায় ডাক দিলেন , আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম।
তিনি বললেন প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে , আমি বিব্রত আশপাশের লোকদের নিয়ে , কিন্তু তারা কেউ এদিকে নজর দিচ্ছেন না আর আব্বাও বেশ নিচু স্বরে বয়ান করছিলেন।
‘ দ্যাখ তোর মা কি করেছে ! তিনি তার পাঞ্জাবীর হাতা টেনে গোটালেন’।
হ্যা তাইতো আব্বার হাতে গভীর ক্ষত ! রক্ত গড়িয়ে পড়ে শুকিয়ে আছে।
তিনি এবার বা হাত দিয়ে আমার হাত টেনে তা তার ক্ষতস্থানের উপর রাখলেন।
আমি এতটাই বিব্রত ও ভীত হচ্ছিলাম বোঝাতে পারব না।
তার চোখে পানি ! পৃথিবীর এই কঠিন মানুষটির চোখে পানি। তার দুচোখে একধরনের আকুতি যেন আমি কিছু বলি। কিন্তু আমাদের পারিবারিক কাঠামো এমন নয় বা এই ঘটনা কখনই ঘটেনি , বাবা ও ছেলেদের মধ্যে তেমন কথা বা অনুভুতির ভাগাভাগি নেই। কঠিন শৃঙ্খলার মধ্যে মানুষ হতে গিয়ে আব্বার জন্য আজ অনুভুতির প্রকাশ হচ্ছে না বা কিভাবে করতে হয় তাও জানা নেই ।
‘তোর মা আমায় এভাবে খামচালো ??
আমি সাহস ফিরে পেলাম এবং আড় চোখে তার ক্ষতস্থান দেখলাম। তিনি চাইছিলেন তাই আমার হাতটি তার হাতের উপর রাখলাম ।
এবার আমি মাথা ঘুরিয়ে একটিমাত্র খোলা জানালা দিয়ে ঈষৎ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
জনক ও জননীর মধ্যকার সম্পর্ক সন্মন্ধে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা আমায় ভিন রকমের ভাবালুতায় আচ্ছন্ন করে ফেলল।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাম্মদ আবুল হোসেন ভাল লিখেছেন। শুভ কামনা রইল।

০৮ মে - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৮১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪