সবাই সরে গেলে একজন যুবক আস্তে করে আমায় বলল ‘দিদির আপন লোকেরাই তার শত্রু হয়ে গিয়েছিল । বি এ পাশ দিদি সভা –সমিতি , ইউনিয়ন , কম্যুনিস্ট পার্টিতে জড়িত বলেই তার আর ঠাই হয়নি এদেশে। জীবনের নিরাপত্তা যদি নাই থাকে তো কি লাভ এদেশে থেকে। শেষমেশ দেশত্যাগ , পেছনে মা , বাবা, ভাইদের রেখে। এখন বারাসাতে , ওখানেই বিয়ে ‘থা , বাচ্চারা বড় হয়ে কলেজ করছে’। আমি স্থাণু হয়ে তাকিয়ে রইলাম নদীর পাড়ে । একটা অসহায় বেদনা জেগে উঠলো বুকের মধ্যে।
*************
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস। আশরাফ ভাইয়ের সাথে আমি একটা লঞ্চ ভর্তি কম্বল, শুকনো খাবার, ঔষধ নিয়ে চালনা পৌঁছলাম ।সেই পুরাতন লালচে দালান যা আমরা মংলা হয়ে রামপাল যাওয়ার সময় দেখতাম সেখানেই লঞ্চ নোঙ্গর করল। আমাদের ঠাই হল অদুরেই নদীর কাছে ফাকা জায়গায় একটি টিনের ঘরে। বাজারের দোকান ঘর এটি । এখন ফাকা। পাশের ঘরগুলো লুট হয়েছে এপ্রিল মাসেই যখন পাক হানাদাররা খুলনা পৌঁছল আর হিন্দু অধ্যুষিত এই এলাকার হিন্দুরা নৌকায় পাড়ি জমাল ভারতের উদ্দেশ্যে।ঘরটায় একখানি তক্তপোষ মাদুর পাতা তাতে। নিচে মাটি , চাটাই দিয়ে ঘরখানি ঘেরা। ঘরের কোনে কিছু দড়ি, বাশ, টিনের পাত্র, দড়িতে কাপড় ঝোলানো । আমরা ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেডক্রসের পক্ষ থেকে দুজন এসেছি এই এলাকায় রিলিফ দিতে।
এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের পূর্ব ধারনা নেই। শুধু জানি আমাদের ইতালীয় কর্মীরা রিফিউজি লিস্ট ধরে এখানকার জনসংখ্যা এবং ভোটার লিস্ট অনুযায়ী মালামাল দিয়েছে। এটাই প্রথম চালান। ক্রমে আরও আসবে । আমরা গম,কম্বল ,সয়া পাউডার, ওষুধ , পানি শোধনের ট্যাবলেট এনেছি। খুলনা শহরে ২০ ডিসেম্বর ৭১ থেকে আমরা তরুন স্কাউটরা ট্রানজিট ক্যাম্পের জন্য তাৎক্ষনিক জিনিসপত্র বিলি করেছি।
চুপচাপ বসে আছি।
একজন যুবক থাকেন এখানে, অজিত , রাতের খাবার নিয়ে এলে আশরাফ ভাই আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলেন। আলু ভর্তা , ডাল ব্যাস ।
আমি টয়লেট যেতে চাইলে হ্যারিকেনের আলোয় নদীর পাড়ে চার বাঁশের উপর চট ঘেরা টাট্টিতে বসে গেলাম নদীর ওপর। রাতের ঠাণ্ডায় মাত্র একটি পাতলা লেপের নিচে দুজনের পৌষ মাস সর্বনাশ ডেকে আনল। আশরাফ ভাই বললেন আমরাই কয়েক হাজার কম্বল এনেছি কিন্তু তা ব্যাবহার করলে অনেক হিন্দুই তা নিতে চাইবেনা। সকালে তীব্র সূর্যের আলোয় ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে রইলাম। রোদটা বেশ উত্তাপ দিচ্ছিল তাতে রাতে শীতল হয়ে যাওয়া শরীর গরম করতে লাগলাম।
সকাল দশটায় রুটি আর আলুভাজি এলো ।
আমরা অপেক্ষা করছি স্থানীয় প্রশাসনের। আমাদের ভাঙ্গাচোরা টিনের ঘর থেকে নদী অবধি এমনকি বায়ের বাজারের খালি জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক মানুষ বসা। এদের দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল তারা ভারত ফেরত শরণার্থী । রাতেই খবর রটেছে রিলিফ এসেছে। একটা বিষয় মনোযোগ আকর্ষণ করল যে অজিত ঘরের কোনে টিনের জ্যারিকেন যা আসলে তেল রাখা ও প্যাকিং করে তা থেকে ঘরে আসা লোকেদের ছোট বোতলে পানি ঢেলে দিচ্ছে। একজন ছোট গ্লাসে খেল এক চুমুকে। কেরোসিনের গন্ধ নেই , পেট্রোল নয় তাহলে কি? আবার লোকটা খেল দেখে ভাবলাম পেট্রোল কেরোসিনতো খায় না। অজিত বাইরে গেলেই আশরাফ ভাই আমায় বললেন কি হচ্ছে জানো? মাথা ঝাকিয়ে ইশারা করলাম কি? মদ, বাংলা মদ ! কি সর্বনাশ সারারাত আমরা মদের দোকানে ঘুমিয়েছি?
একজন যুবতী এসে ছালাম দিলেন ও আমাদের খোজ খবর নিলেন নাস্তা খেয়েছি কিনা। বললেন গ্রাম এলাকা আটা চালু নয় , সবাই ভাত খায় । সরকারী এক বাড়ির বউদির কাছ থেকে ওখানে বসেই রুটি বানিয়ে ভাজি করে তারপর চালের সন্ধানে বেরিয়েছি। কেউই চাল দিতে চায়না বা নেই একমুঠো চাল ঘরে। একবাড়ীতে আপনাদের কথা শুনে একবেলার জন্য দুমুঠো চাল দিল। রান্না করব আরেক বাসায়। জ্বালানীর অভাব, কারো কাছে কাঠ নেই । সবাই আগাছা ডালপালা , ঘরবাড়ি লুট হবার পর ভাঙ্গাচোরা যা পড়ে আছে তা জ্বালিয়েই ছাতু গুলিয়ে খাচ্ছি ।দেশত্যাগী শরণার্থীদের দুরবস্থা কি ভয়াবহ তা এদের রিলিফ কাজে জড়িত না হলে বুঝতাম না।
মীরা দিদি যিনি এতক্ষন বলছিলেন মানুষের দুরাবস্থার কথা তিনি আচলে বাধা দুমুঠো চাল একটা কুলো নিয়ে বসে গেলেন বাছতে। আমি ভালই ছিলাম এজন্য যে আমি ক্যাম্পগুলোর ফিল্ড হাসপাতাল কর্মী হয়েছিলাম আর একবেলা বাচ্চাদের স্কুল চালাতাম ফলে হাসপাতালে খাবারের অভাব হয়নি । জ্বালানীর অভাবে ওখানেও একই অবস্থা । প্রথমে গন খিচুড়ি হত। চালের অভাব দেখা দিলে খিচুড়ি বন্ধ। দিল ছাতু। পানিতে গোলাও আর খাও । বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য আমাদের অসহায় ৮০-৯০ লাখ লোক কি ত্যাগ স্বীকার করেছে বলে বোঝানো যাবেনা। চুকনগর গনহত্যার আগেই আমরা পায়ে হেটে বর্ডার পেরিয়েছি। আমাদের আশপাশের অনেক গ্রামের পুরো পরিবার মেশিনগানের গুলিতে মারা গেছে । কেউই চিতা জ্বালানোর জন্য ছিলনা। কথায় ছেদ কাটল স্থানীয় চেয়ারম্যান এসে গেলে । এরা পাকিস্তান পর্বের চেয়ারম্যান । কেউ না বললে আমি চেয়ারম্যানকে একজন ভিক্ষুক বলে মনে করতাম।
আমরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে ওই লালদালান যেটি ডাকবাংলো সেখানে চলে এলাম। যাবতীয় মালামাল রাতভর স্থানীয় কর্মীরা ভিতরের রুমগুলিতে নিরাপদ করেছে কারন ফিরতি রিফিউজিরা ক্ষুধার্ত , শীতে অসহায় তাই লুটপাট শুরু হলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবেনা।
আমি বয়েসে এবং আকারে ছোট তাই কেউ পাত্তা দিচ্ছেনা, দিচ্ছে আশরাফ ভাইকে।বাইরের লোকেদের দুর্ভোগ এড়াতে আমরা টেবিল চেয়ার নিয়ে জানালা দুটিতে বসে গেলাম । আশরাফ ভাই লোকদের পরিচয় নিশ্চিত করছেন , তাকে পেছনে দাড়িয়ে চেয়ারম্যান সহায়তা দিচ্ছেন। আমি হাতের টিপ সই রেখে দিলেই স্বেচ্ছাসেবীরা পরিবার প্রতি গম সয়া ট্যাবলেট ইত্যাদি তুলে দিচ্ছে। লোকগুলো যেন জানালা ভেঙ্গে ফেলছে , উঠে দাড়িয়ে দরজায় গেলাম এবং পুরো কম্যান্ড শুরু করলাম। লাইন দিন না হয় বিতরন বন্ধ । এবার ওদের খেয়াল হল এই বাচ্চা ছেলেটি তো বেশ অর্ডার টর্ডার করতে পারে। আসলেও খুলনা জিলা স্কুলে হাজার দশেক রিফিউজি আসছে প্রতিদিন তো বিতরনের সময় তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলে আমরা বাচ্চা ছেলেরা ডামি রাইফেল নিয়ে পাহারা শুরু করতেই সব ভদ্র হয়ে গেল। ওখান থেকেই এগুলো শেখা। একজন অতি বৃদ্ধ ভিতরে এসে আমার হাত দুটো ধরে বললেন বাবা , আমরা কবে ভাত খেতে পারব ? আমি মায়াভরা কণ্ঠে বললাম দু তিন দিনের মধ্যেই আসছে। আমি জেনেভা রেডক্রসের এই কাজে যোগ না দিলে কখনই এত কাছ থেকে কি দুঃখ ভরা ,পাথর হয়ে যাওয়া মুখগুলো দেখতে পেতাম না । কতদিন এরা চুল সাবান দিয়ে ধোয়নি , কাপড় পরিস্কার করেনি। খুলনাতে আমরা জীবনে প্রথম দেখা লম্বা সাবান বার পেলাম যা ওদের বিলি করেছি।
বিকেলে আমরা খেতে বসেছি। যারা এসেছিল তাদের সবাই রিলিফ নিয়ে চলে গেছে। তারপরও কেউ আসলে তাকে যেন ফেরান না হয়। মীরা দিদি আমাদের পাশে বসেই আবারো রান্নার জন্য ধর্না , মাছের আয়োজন করা , মুরগি আনতে না পারার দুঃখ একদমে বলে যাচ্ছিলেন। তিনি আমায় বললেন আমিত ভাবিইনি তুমি ভাই এসব কাজ করতে অভ্যস্ত।
মীরা ‘দি বলে চলেছেন আজ কম্বলে ওরা ঘুমাবে কিন্তু মাথার ওপর ছাউনি নেই। খড় কুটো দিয়ে কোন রকম বানিয়ে গত তিন চারদিন চলছে। ধান চাষ হয়নি তাই চাল নেই আর ধান চাষ করবেটা কে ? কেউই ছিলনা। আশরাফ ভাই বললেন চিন্তা করোনা মীরা , আমরা এসে গেছি আরও আসছে এবং সব সমস্যা মিটবে । চাল টিন সব ইন্ডিয়া থেকে এসে গেছে । যোগাযোগ ব্যাবস্থা এতই খারাপ যে এটা পৌছাতেও সময় নেবে। মীরা ‘দি বলল আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক , আমাদের আত্মত্যাগ যেন বিলীন না হয়ে যায়।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় এসব কথা শুনে।
ডাকবাংলোর দুজন কর্মচারী ফেরত এসেছে। থানায় দুএকজন পুলিশ এসেছে তবে ঊর্ধ্বতন কেউই এখনও আসেন নি। সরকারী অফিসের শিক্ষা অফিসার পরিবার ছাড়াই এসেছেন। সবাই খাওয়ার সংকটে যোগ দিচ্ছেন এসেই। ডাকবাংলোর ওই দুই ছোকরা বলল আপনারা হিন্দুদের হাতে খাচ্ছেন ----, আশরাফ ভাই বললেন তো কি হয়েছে ? না মানে ---, ওসব মানে ফানে ভুলে যাও ।
রাতে কম্বল নামিয়ে মোটা বিছানা এবং কম্বল গোল করে বালিশ বানিয়ে শুলাম।
পরদিন ভোরেই আমরা শুরু করলাম । একটা চায়ের দোকান পর্যন্ত নেই, রেস্টুরেন্ট ছিল –নেই । যারা ব্যাবসা করত তারা এখনও আসেনি । তারা সবাই ওপারে বাড়ি ভাড়া করে ছিল। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওরা দেরি করছে। চা খাবে পয়সা কোথায়? মিয়া ভাত খাওয়ার চাল নেই আবার চা, হুহ !
এইসব ডায়ালগের মধ্যে অপেক্ষমান লোকেদের লাইন দিতে বললাম । তারা ভোররাতে এসে বসে আছে। দুজন কাল রাতে এসে কাছের একটা গোয়াল ঘরে সারারাত চাদর মুড়িয়ে বসে ঢুলেছে । সকাল ১১ টায় মানুষে মানুষে ছেয়ে গেল। খুব ব্যাস্ত । আমার হাত টনটন করছে লিখতে লিখতে । আজ স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যা বেশি। খুব ব্যাস্ত দিন পার করলাম তবে খুলনাতে বিলির শারীরিক কাজ ইত্যাদি আরও কঠিন ছিল। পরদিন আমরা শুরুতেই চারজন যারা আমাদের কাজ খেয়াল করেছে তাদের একসময় টেবিল ছেড়ে দিলাম। দেখলাম ওরা কিভাবে কাজ করে। আমরা হাটতে বেরুলাম । চারিদিক ফাকা মানে ঘর বাড়ি নেই কোন। ফসলের জমি খালি । রাতে খাবার খেলাম ক্লিনিকের ডাক্তারের বাসায়। তারা সবাই পালিয়েছিলেন কেননা চালনা হিন্দু প্রধান এলাকা। ডাক্তার বলে চালডাল ম্যানেজ হয়েছে সাথে মুরগীও । রাতের খাবার বেশ ভিন্ন স্বাদ। রাতে আমরা ওনার কোয়ার্টারেই ঘুমালাম ডাকবাংলা ছেড়ে । ভোরে দ্রুত রেডি হয়ে লঞ্চ ঘাট । লঞ্চ এসে গেছে পেছন থেকে হাপাতে হাপাতে মীরা ‘দি । আমার সাথে বিদায় নিলেন না? কেদে ফেললেন এবং বললেন আপনারা যেন জীবনভর মানুষের কল্যানে থাকেন , কিছুই করতে পারিনি আপনাদের জন্য, দুটো ভাল খাওয়াতে পারিনি, দেশের জন্য সব কিছুর সাথে সৌজন্যতাও ত্যাগ করেছি , মাফ করে দেবেন ভুল চুক হলে। আমি স্তম্ভিত হয়ে একজন মানবীর দিকে নির্বাক তাকিয়ে। লঞ্চ চলতে শুরু করলে প্রথম নজর গেল ঐতিহাসিক রাত কাটানো বাংলা মদের ঘরখানার দিকে , একা একা হাসলাম।
************
৯৫ সালের পর থেকে কলকাতা যাওয়া আসার সময় বারাসাত এলে মীরা ‘দির কথা মনে পড়ে । এইখানে কোথাও কোন বাড়িতে দিদি থাকেন । আমাদের খাবারের সন্ধানে যে মীরা ‘দি নাজেহাল সেই মীরা দিদিরই নিজের দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তা নেই । যারা দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছে , জীবন দিয়েছে, ইজ্জত হারিয়েছে , ঘর বাড়ি , গরু ছাগল, হাস – মুরগি মায় কি পুকুরের মাছগুলো পর্যন্ত খুইয়েছে সেই তাদের একজন মীরা ‘দি দ্বিতীয় এবং শেষবারের মত আবারো ত্যাগ করলেন সব কিছু , চিরতরে ।
ভাল থাকুন মীরা ‘দি ।