সেপটেম্বর ১৩,১৯৮২ । আমরা তিনজন চারুকলার ছাত্র প্রথমবারের মত চীনা সরকারী বৃত্তি নিয়ে বেইজিং পৌঁছলাম । ছোট দোতালা পুরানো একটি দালানে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এর যাবতীয় কাজ হয় । যাত্রী এই এক প্লেন কাজেই খুব দ্রুত আমরা বাইরে এসে টেলিফোন আলাপ ও হেল্প ডেস্ক থেকে ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতে সমর্পিত হয়ে একটি কালো রঙের রাশিয়ার তৈরি গাড়িতে চলতে শুরু করলাম। ঈষৎ গরম এবং অচেনা শুকনো আবহাওয়ায় বড্ড অস্বস্তিতে ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সটিটিউটের দিকে চলছি । ভাষার কারনে ড্রাইভারের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ। আমাদের দুদিকে প্রচুর গাছের সারি মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। আমাদের আগে পিছে কোন গাড়ী টাড়ি নেই। রাস্তায় সাইকেল চালককে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম। খুব কর্কশ চেহারা, মাথায় নীল টুপি, গায়ে নীল পোশাক , খুব নোংরা । একইভাবে এক তরুণী সাইকেল চালাচ্ছে । তার চেরি ফুলের মত গালের চারদিক আশাহত অপরিচ্ছন্ন । তার লালচে চুল জানান দিল চায়না রিকন্সট্র্যাক্ট পত্রিকায় যাদের ছবি ছাপা হয় তার সাথে এদের কোন মিলঝুল নেই। দূর থেকে দালান কোঠা দেখে বুঝলাম আমরা শহরের কাছে। প্রশস্ত রাস্তা , ভিড় নেই, দুধারে পুরাতন দ্বিতল ও নতুন ৬ থেকে ১৪ তালা পর্যন্ত বাড়িঘর। এখানে সাইকেলের জন্য দুধারে আলাদা রাস্তা ।রাস্তায় ইলেকট্রিক চালিত বাস দেখে ভাল লাগলো । মস্কোর বাসের কথা শুনেছি তা দেখলাম বেইজিঙে । হংকঙে তিন দিন আটকে থাকার পর তার জৌলুশপূর্ণ জীবন দেখে বেইজিংকে এতিম এতিম লাগছে। আবারো ধেনো জমি দেখা গেলে বুঝলাম আমরা শহর পার হয়ে আরেকটি শহরতলীর প্রান্তে। আমি সাইদ বেবুল এযাবত কেউ কারও সাথে কথা বলিনি বোধ করি আশাপ্রদ বিদেশের কাম্য চিত্রের সাথে মিলঝুল হচ্ছিল না বলে। আমি অবশ্য যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়ে এসেছিলাম এবং তা পরিচিতজনদেরও বলেছিলাম। একটা কমিউনিস্ট দেশকে গাঁটের পয়সা খরচ করে দেখতে পাবো না কখনই – এরকম ইচ্ছায় আমি হাল তুলেছিলাম শক্ত হাতে। আসার আগে কেউ কেউ বলেছিল জেলখানায় যাচ্ছ, কিন্তু আমরা কেউই চীন সম্পর্কে জানিনা। চীনের প্রোপাগান্ডা পত্রিকাগুলোর চমৎকার সুদর্শন চাষি ও বালিকার কোন সন্ধান না পেয়ে আমি হতাশ হচ্ছিলাম। একটা বিশাল পিঙ্ক রঙের দালানের সামনের গেটে আমরা দাঁড়ালাম । এগিয়ে আসা নোংরা সবুজ মাও কোটের থুরথুরে বুড়োকে ড্রাইভার অজানা ভাষায় কিছু বলল। বুড়ো প্রথমে উকি দিয়ে তিন আদমকে দেখে নিয়ে হাত তুলতেই বিশাল গেটের একটি ঘড়ঘড় করে একদিকে খুলে গেল। বেশ চমৎকৃত ব্যাপার । আমাদের পিছনেই রাস্তার অপর পাশে এরকম একটি ভবনের সামনে সাদা রঙের মাও জে তুং এর একহাত ওঠানো ভাস্কর্য। গাড়ি ভিতরে ঢুকতে যে সময় তার কয়েক সেকেন্ড ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলাম এবং বললাম আছি যখন তখন দেখতে পাবো অহরহ । বিস্ময়ে অভিভুত হবার বিষয় বৃক্ষের সমাহারে । এত গাছ যে মনটাকে চাঙ্গা করে তুলল এই প্রথম। গাছের ফাকা দিয়ে ব্রিটিশ আমলের তৈরি দালান উকিঝুকি মারছে। দারুন ব্যাপার। দূর থেকে ওপরে টালি দেওয়া ইংলিশ কায়দার পুরনো দালান । ডানে গ্যালারিবিহিন একটা স্টেডিয়াম রেখে আমরা বায়ে ঢুকলাম । ডান হাতে দুটো টেনিস কোর্ট উচু করে ঘেরা। আবার ডানে ঘুরে বাস্কেট খেলার বিশাল চত্বরের পাশে পার্ক বেঞ্চে বসে সাদা এক যুবক বিড়ি ফুকছিল । তাকে ড্রাইভার সেই চাং চুং শব্দে কিছু বললে সেও চাংচুং এ উত্তর দিল । আমাদের টোটাল কনসেন্ট্রেশন এখন যা ঘটছে তার দিকে। সাহস বাড়িয়ে দিল যুবক যে, না আমরাও পারব ওর মত কথা বলতে । আমরা বুঝতে পারছি এই যে সারি দেওয়া দালান এগুলো ডরমিটরি । সিমেন্ট বাধান অসংখ্য বাস্কেট মাঠে সাদা এবং কালো সব রঙের ছেলেরা খেলছে ফুটবল । বায়ে ঘুরে আখরোট গাছের পাশ দিয়ে আমরা যে ভবনটির সামনে দাঁড়ালাম তার দরজার ওপর ইংরেজিতে লিউ লৌ লেখা , পাশে ৬ লেখাটাও আছে । এই লিউ লৌ শব্দটি সাদা যুবক ড্রাইভারকে বলেছিল । খাটো , চওড়া এক বয়স্ক লোক কোন হাঁকডাক ছাড়াই বেরিয়ে এল ভিতর থেকে, মৃদু হাসি তার মুখে । ড্রাইভার কথা না বলে দরজা খুলে ধরতেই আমরা বুঝলাম আমাদের ইস্পিত জায়গায় এসে পড়েছি । বুড়ো আমাদের নি হাও বলে মালপত্র হাতে তুলে দরজার কাছে অপেক্ষমান আর সাইদ ড্রাইভারের সাথে ইশারায় দাম নিয়ে আলাপ করছে। ওর হাতে একটা ছাপানো ফর্দ যাতে কোথা থেকে কোথায় কত ভাড়া তা লেখা। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় ঠিক মাঝ বরাবর বারান্দা দিয়ে এগুলাম দারোয়ান আমাদের হাউ মাউ করে কিছু বলল আর আমরা বিজ্ঞের মত মাথা দুলিয়ে তা বুঝলাম। দুদিকে রুম , শাহনেওয়াজ হলের মত নয়। পাশাপাশি দুটি রুম খুলে দিল আমাদের। বেবুল আর আমি একটায় আর সাইদ পাশেরটায় । বিছানা হাসপাতালের খাটের মত লোহার তবে তাতে বিছানো নতুন চাদর আর পাট ভাঙা বালিশের কভার ওপরে ছোট তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো। একটা কাঠের ওয়ারড্রব আর টেবিল চেয়ার তো আছেই। ফ্লোরে রাখা দুটি জিনিসের প্রতি আগ্রহ জন্মাল । এর একটা ঢাউস সাইজের নতুন ঝকঝকে ফ্লাস্ক আর দ্বিতীয়টির কাজ কি তা নিয়ে আমি এবং বেবুল নীরব গবেষণা করতে লাগলাম । হটাত বেবুল সেই বড় গামলা যাতে আমাদের হলে ভাত দেওয়া হত তা নিয়ে দৌড়ে পাশে সাইদের রুমে গেল বোঝার জন্য। ওরা দুজন খানিক বাদে আবার একযোগে হুড়মুড় করে আমার রুমে এসে সব কিছু হাতে ছুয়ে বলল নাহ শুধু আমাকে একা নয় তোদেরও দেখছি সব নতুন দিয়েছে । কিন্তু গামলার কাজটা কি ? আমরা সবাই বললাম আছি যখন তখন গামলা রহস্য জানা যাবে । সাইদ বলল যাই বিশ্রাম করি , যা ধকল গেছে তিন তিনটা দিন। বেবুলও গেল সাইদের সাথে। কেডস খুলে জানালার পাশে দাঁড়ালাম । বাইরের দৃশ্য মনোরম । রাস্তার দুদিকে সারি দিয়ে ঠিক কত হাজার বার্চ ট্রি আছে তা জানিনে তবে কয়েক কোটি ঝিঁঝিঁ পোকার ঐকতান কান খারাপ করে দিচ্ছে। সিগারেট ধরালাম একটা । রাস্তার ওপাশে বেড়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেল । কজন মানুষের চলাচল দেখতে পেলাম তবে পাদুখানা দেখা যায় শুধু । ডাবল জানালা। একটা নেটের একটা গ্লাসের । নেট খুলে উকি দিলাম আকাশ দেখব বলে, দেখলাম নীল আকাশ , মেঘমুক্ত। সিগারেটে লম্বা টান মেরে ধুঁয়া বাইরে ছুড়ে দিলাম। হটাৎ, হ্যা হটাৎই মনে এলো আমি এখন বিদেশ বিভুইয়ে । শিহরণ জাগল মনে ! আমি এখন এক ভিন্ন জাতি ও সমাজে । ইচ্ছে হলেই বাসে করে মাকে দেখতে যাওয়া যাবেনা খুলনাতে । ইচ্ছে হলেই বাগদত্তা বান্ধবীকে দেখা যাবেনা, খুব অসহায় মনে হল নিজেকে । এতগুলো দিন কাটবে কিভাবে ? ঝরঝর করে কেদে ফেললাম । কান্নার গমক এত বেশি যে দৌড়ে বিছানার বালিশে উপুড় হয়ে মুখ চেপে ধরলাম। আমার এত জোরে চিৎকার করে কান্না আসছে যে আমি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়েছি । অঝোরে কেদে বালিশ ভেজালাম, রুদ্ধ ধরা গলায় মাথা উঠিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললাম “মা আমি আবার কবে তোমায় দেখব” ? পৃথিবীর তাবৎ দুঃখমালা আমার বালিশে এসে ঠাই নিল । জীবনের সবচে অসহায় সময় আমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেধে ফেলল ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
নাসরিন , নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হচ্ছে ফন্ট দেখতে। সেপ্টেম্বর শব্দ ছাড়া আমি তেমন কিছু ভুল বানান পাচ্ছিনা। ফন্ট ছোট , চশমাও বেশ পাওয়ারফুল । যদিও আমি অন্য ব্লগে এই চশমায় ভালো দেখতে পাই। যাহোক ভালো থেকো কনকনে ঠাণ্ডায় ।।
ফয়সল সৈয়দ
চমৎকার বর্ণনা। শেষের প্যারায় হঠাৎ মায়ের জন্য আকুতিটা কোন দৃশ্য থেকে হলে ভাল হত।বানান ভুল দিয়ে গল্প শুরু যা আমাদের কাম্য নয়।সেপ্টেম্বর। দুধারে ইলেক চিহ্ন ব্যবহার করা উচিত ছিল। দু'ধারে।
ভাল লাগা কয়েকটি লাইন উল্লেখ করলাম। ভালাবাসা দিলাম।
রাস্তায় সাইকেল চালককে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম/তার চেরি ফুলের মত গালের চারদিক আশাহত অপরিচ্ছন্ন।
অভ্র দিয়ে লিখি আমি ও। বানান ভুল আমার হয়। বানানের ব্যাপারে আমরা যারা লেখালেখি করি আমাদের সর্তক থাকা উচিত।পাঠক যেন ভুল বানান শিখতে না পারে আমাদের গাফলতির জন্য।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।