হালকা হালকা রোদ ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ।
.
শীতের তীব্রতায় প্রকৃতি জবুথুবু।
.
পৌষের উত্তাপহীন দিনগুলো এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে।
.
এখন অনেক রাত। ঘড়ির কাটায় প্রায় দেড়টা পেরিয়ে গেছে।
.
ঢাকা শহরের মানুষগুলো যে প্রতিনিয়ত নিজেকে সামনে এগিয়ে নেয়ার নিরলস প্রচেষ্টায় ব্যস্ত, তা ব্যস্ত রাস্তার ব্যস্ত যন্ত্রমানবগুলো দেখলে বোঝা যায়।
.
বেলকুনির গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে জনাব শাহারিয়ার ইসলাম দিপ। সোডিয়াম বাতির নিভু নিভু আলো, শহরটাকে করে তুলেছে আরও রমণীয়। যতটুকু দেখা যায় তাতে সে একদৃষ্টে বাইরের প্রকৃতির অপরুপ দৃশ্য দেখছে।
.
অভ্যাসবশত মাঝেমধ্যে পুরো ব্যালকুনিতে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে। পাশের রুম থেকে ভেসে আসা চিৎকারের শব্দে হঠাৎ থমকে যায়।
.
"আমাকে যেতে দাও, আমি আমার স্বপ্নের কাছে যাবো! তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও!"
.
চিৎকার শুনে বুকটা হাহাকার করে ওঠে। বিশাল ব্যালকুনির একপ্রান্তে একটা সোফায় বসে। এলোমেলো ভাবনায় ডুবে যায় দিপ।
.
আজ থেকে ২৫বছর আগের পুরো বিষয়টি আরো একবার মনে করার চেষ্টা করে।
.
সেবার দিপ এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে ও মেঝো, বাবা নেই। অনেক কষ্ট করে ওর মা ওদের তিন ভাইকে লালনপালন করেন, পড়াশুনা করান।
.
একবার ওদের পাশের গ্রামের এক স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যায় দিপ। সেখানেই হঠাৎ চোখ পড়ে যায় মঞ্চে দাঁড়ানো এক প্রতিযোগিনীর দিকে।
.
মেয়েটি একটি গান গাইলো। কেন যেন মেয়েটির কন্ঠ দিপের অসম্ভব ভাল লাগে, ওই কন্ঠে গাওয়া গানটি ওর প্রত্যেকটি স্নায়ুকোষকে আলোড়িত করে।
.
পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে মেয়েটির পিছু করে দিপ। এক বন্ধুর কাছে মেয়েটির ব্যাপারে সব জানতে পারে।
.
মেয়েটির নাম নিপা। এই গ্রামের নামকরা পঞ্চায়েত বাড়ির মেয়ে। তিন বোন আর এক ভাইয়ের সব থেকে ছোট ও। অষ্টম শ্রেনীতে পড়ুয়া এই মেয়েটির গানের গলার মতই ছিলো সুদর্শনা। গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা কিন্তু অসাধারন এক অদ্ভুত মনহরনকারী নেশা ঐ চেহারায়।
.
সবকিছু জেনে বেশ ভালোই লাগে মেয়েটিকে। দিপ জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়েটিকেই পছন্দ করে।
.
দিপ আর দেরি না করে ওর মা'কে ব্যপারটা জানায়। সব ঠিকঠাক, নিপার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠায় দিপের পরিবার।
.
ওই সময়টাতে বাল্যবিবাহের বহুল প্রচলন থাকায় নিপার পরিবার থেকে আর অমত করেনা। ভালো বংশীয় ছেলে হওয়ায় নিপার বাবা ওকে দিপের হাতে তুলে দেয়।
.
দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় দশবছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু দিপ আর নিপার কোল আলো করে কোন সন্তান আসেনি। সবার ধারনা নিপা সন্তান নিতে অক্ষম। তবুও নিপা বিশ্বাস করে, একদিন না একদিন ওদের দুজনের স্বপ্ন পুরন হবে।
.
কিছুদিন পর সবাইকে চমকে দিয়ে নিপা জানায় ও সন্তান সম্ভবা। খবরটা শুনে দিপ ভীষন খুশি। দিপ আর নিপার স্বপ্ন যেন এবার পুরন হওয়ার পালা। সবকিছু ভালোই চলছিলো। কিন্তু হঠাৎ ঘটে যায় দুর্ঘটনা।
.
একদিন রাতে খুব পেটে ব্যথা হয় নিপার, সেই সাথে রক্তক্ষরন। গর্ভাবস্থার ৭মাসের মাথায় এমন অবস্থা খুব বিপদজনক। সঙ্গে সঙ্গে নিপাকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রাম থেকে প্রায় ১০-১২কিলোমিটার দুরে এক হাসপাতালে।
.
ডাক্তার জানায় "বাচ্চা বাঁচাতে হলে এখনই সিজারিয়ান করতে হবে।"
.
রাত প্রায় আড়াইটার দিকে নিপা একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় আর সেই সাথে ডাক্তার জানান "নিপা দ্বিতীয়বার সন্তান প্রসব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন।"
.
মন খারাপ হয়ে যায় দিপের তবুও এই একটি সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরে সারাজীবন পার করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা।
.
যেহেতু ছেলেকে ঘিরে তারা স্বপ্ন বোনা শুরু করে, সেহেতু ছেলের নাম রাখে স্বপ্ন। স্বপ্ন জন্মের পরপরই স্বল্প আয়ের সংসারের খরচের পরিমাণটা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। শুরু হয়ে যায় সংসারের অনটন।
.
সাংসারিক স্বাচ্ছন্দ্য আর জীবিকা নির্বাহের জন্য দিপ পাড়ি জমায় ঢাকায়। আর নিপা তার ছোট্ট স্বপ্নকে নিয়ে পড়ে রয় গ্রামে।
.
দিপ ঢাকা এসেই একটা দোকানে মোটামুটি ভালো বেতনে চাকরি পায়। প্রথম মাসের বেতন পেয়েই কিছু টাকা সহ একটা চিঠি ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয় নিপাকে।
.
তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো চিঠি বা টেলিগ্রাম। মোবাইলের মত দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না বলে নিপা ওই ব্যাপারে অবগত ছিলো।
.
দিপের বড় ভাই, জনাব আকরাম বাজারে গিয়ে জানতে পারেন দিপ টাকা পাঠিয়েছে। পিয়নের কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে, পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করে নেন আর চিঠিটা ফেলে দেন রাস্তায়।
.
অন্যদিকে অভাব অনটনের কষাঘাতে, খেয়ে না খেয়ে জর্জরিত নিপার জীবন চলতে থাকে। ক্ষুধার জ্বালায় কাতর স্বপ্নকে কোনভাবে এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে আনা ভাতের মাড় খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে।
.
স্বপ্ন শুধু লবন দিয়ে ভাতের মাড় খেতে চায়না তাই নিপা বাজার থেকে আখের গুঁড় আনবে বলে ঠিক করে। একদিন বিকেলে নিপার ভাসুর, জনাব আকরাম বাজারে যাচ্ছেন দেখে নিপা তাকে বাজার থেকে আখের গুঁড় আনতে বলে।
.
সন্ধ্যার দিকে জনাব আকরাম পাশের বাড়ির জলিলের সাথে নিজের বাড়িতে যাওয়ার পথে, নিপাকে বাহির থেকে ডেকে বলে... "আজকে বাজারে আখের গুঁড় ওঠে নাই। পরে পাইলে নিয়া আসুমনে।"
.
নিপা কিছু বলে না, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ও বুঝতে পারে জনাব আকরাম মিথ্যা বলছিলো। ওর ধারনা যে পুরোপুরি সত্যি সেটা পরদিন জলিলের মায়ের কথায় প্রমান হয়। তিনি বললেন...
.
"আকরামের কাছে নাকি তোমার অনেক টাকা ধার পইরা গেছে তাই সে কাল আখের গুঁড় আনে নাই। জলিল আমারে সব কইছে। কাল জলিল যদি আবার বাজারে যায় তয় আমি আখের গুঁড় আইনা দিমুনে।"
.
এদিকে না খেয়ে থেকে দিন দিন নিপা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। সাথে স্বপ্নও অসুস্থ হয়ে যায়। টাকার অভাবে স্বপ্নকে ভালো ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যেতে পারেনা নিপা।
.
ছয়মাস পেরুতেই দিপ কিছুদিনের ছুটিতে গ্রামে ফেরে। নিপা আর স্বপ্নের এমন করুন অবস্থা দেখে দিপ হতভম্ব হয়ে পড়ে। দিপ জানায় সে প্রতি মাসেই নিপা আর স্বপ্নের খরচের টাকা পাঠায়।
.
"এখন এগুলো ভাবার সময় না, পরে ভাবলেও চলবে। সকাল হলেই আগে স্বপ্নকে নিয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।"....নিপা বলে।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিপা হাতমুখ ধুয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখে স্বপ্ন বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে। দৌড়ে এসে স্বপ্নকে কোলে নিতেই নিপা আঁতকে ওঠে।
.
দিপকে জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে নিপা।
.
→দেখোতো আমার স্বপ্নের কি হয়েছে? পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে এভাবে বিছানায় শক্ত হয়ে পড়ে আছে কেন? একটুও নড়ছে না!
.
দিপ স্বপ্নের শরীরটা ধরেই বুঝতে পারে তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। তাদের আদরের ছোট্ট সন্তানটা তাদেরকে ছেড়ে অনেক দুরে চলে গেছে।
.
দিপ স্বপ্নের নিথর দেহটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। দু'চোখ বেয়ে ঝর্ণার মত অনবরত অশ্রু বইতে লাগলো। নিপা আবারো উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে...
.
→এই কিছু বলছো না কেন? বলো না, কি হইছে আমার স্বপ্নের?
.
এবার দিপ বাচ্চাদের মতো কেঁদে বললো...
.
→বউ, আমাদের স্বপ্ন আমাদের ছেড়ে অনেক দুরে চলে গেছে। চলে গেছে না ফেরার দেশে, আর কখনো ফিরবে না আমাদের স্বপ্ন।
.
কথাটা শুনেই নিপা চিৎকার করে স্বপ্নের শরীরটাকে জোরে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। দিপ কাঁদতে কাঁদতে নিপার বুক থেকে স্বপ্নের দেহটা নিয়ে একটা সাদা কাপড় বিছিয়ে তার উপর উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুইয়ে দেয়।
.
আশেপাশের সবাইকে ডাকা হয়। অনেকে মিলে নিপাকে ধরাধরি করে সেখান থেকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়।
.
এদিকে দিপ তার আদরে সন্তানের লাশের কাছে বসে বুক চাপড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে...
.
→একটা মাত্র সুযোগ দিলিনা তোর এই অধম বাবাকে? একটা দিন দিলিনা তোকে ভালো ডাক্তার দেখানোর, একটু ভালো চিকিৎসা করানোর? আমি তোর বাবা হবার যোগ্য ছিলাম নারে! ক্ষমা করিস আমাকে, তোকে আমি বাঁচাতে পারলাম না।
.
স্বপ্নের দেহটাকে গোসল করিয়ে একটি খাটের উপর শুইয়ে রেখেছে। ওর সারা শরীর সাদা কাফন দিয়ে জড়ানো, শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। এই মুহুর্তে স্বপ্নের মুখটা দেখলে যে কেউই বলবে... ও এখন শান্তির ঘুমে নীরবে ঘুমিয়ে পড়েছে।
.
ইতোমধ্যে নিপার জ্ঞান ফিরেছে। নিপা ধীর পায়ে সন্তানের লাশের মাথার পাশে বসে নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে পুরো মুখটা মুছে, কপালে আলতোভাবে একটা চুমু খেলো।
.
অপলক দৃষ্টিতে স্বপ্নের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষন। এভাবে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিপার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
.
কিছুক্ষন পর লাশ কবরস্থানে নেওয়ার জন্য সবকিছু তৈরী। লাশের খাটিয়াল কাঁধে উঠাতেই নিপা লাশের উপর ঝাপিয়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।
.
"তোমরা ওকে নিবানা, আমার স্বপ্নকে নিবানা তোমরা। ও ঘুমাচ্ছে, ওকে ঘুমাতে দাও। নইলে আমাকেও নিয়ে যাও ওর সাথে, আমি যাবো। ছেড়ে দাও, আমি আমার স্বপ্নের কাছে যাবো।"
.
কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়লো নিপা। জ্ঞান ফেরার পর থেকে সবসময় এভাবেই চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
.
পুরনো সেই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে দিপের। বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখটা মুখে নেয়, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মিনিট কয়েকের মধ্যে নিজেকে সামলে নেয় দিপ। শান্ত ও ধীর ভঙ্গিতে সোফা থেকে আবারো উঠে দাঁড়ায়।
.
রাত বাড়ছে, রাত বাড়ার সাথে সাথে অন্ধকারটা গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। নির্ঘুম চোখে রাতের প্রহর কেটে যায়। নিঃসঙ্গ একাকী সময়ের সাথে কষ্টের নীল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে দিপ।
.
আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দিপ।
.
"বাবারে, কোথায় যেনো শুনেছি, মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে তোকে খোঁজার চেষ্টা করছি। কিন্তু তুই কোথায়? তোকে তো খুঁজে পাইনা হাজারো তারার ভীড়ে!"
.
কথাটা বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ওঠে দিপ। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে। তবে কি এই রাতের পর সকাল ফিরবে না? এই অন্ধকারঘন রাত কি কখনো আলোর ছোঁয়া দেবে না? সুখ নামের সেই বস্তুটি কি ওর জীবনে মরিচিকার মতোই থাকবে?
.
১৩ এপ্রিল - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪