বৈরিতা ও বন্ধুতা

বৈরিতা (জুন ২০১৫)

পারভেজ রাকসান্দ কামাল
  • ৪১
পল্টু ও রঞ্জু দুই বন্ধু। এক সাথে গ্রামের স্কুলে পড়ে। নিজেদের মধ্যে খুব ভাব। যাকে বলে একেবারে গলায় গলায় বন্ধুত্ব। স্কুলের শিক্ষকরা পর্যন্ত তাদের বন্ধুত্ব দেখে মানিকজোড় নাম দিয়েছে। যথাসময়ে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে এখন তাঁরা কলেজের বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে। তাদের এলাকায় ভাল কলেজ বলতে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি কলেজ। কিন্তু সেটি তাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। তাই পড়াশুনা চালাতে হলে হোস্টেলে সীট নিতে হবে। না হলে বাড়ি থেকে কলেজে আসতে হলে পড়াশুনার বারোটা বাজবে সেই সাথে টাকা-পয়সার শ্রাদ্ধ হবে। তাই খুব ভেবে চিন্তে পল্টু ও রঞ্জুর পরিবার হোস্টেলে থেকে তাদের পড়াশুনা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত না হয় হলো কিন্তু সীট তাঁরা পাবে কিভাবে ভেবে পায় না। এমনিতেই হোস্টেলে সীটের বড় অভাব। তারপর আছে বোঝার উপর শাঁকের আটির মত রাজনৈতিক পরিচয় দেবার সক্ষমতা। সেটাতো দুই বন্ধুর কারোরই তো নেই। এসব চিন্তা-ভাবনা করে পল্টু-রঞ্জুর মন বেজায় খারাপ। কিন্তু হাল ছেড়ে দেবার পাত্র তো পল্টু না। সে রঞ্জুকে বলল, ‘শোন, হোস্টেলে সীট পাবার জন্য যদি একটু আধটু রাজনীতি করতে হয় তো করলাম।’ রঞ্জুও বেশ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
পারিবারিক নীতি আর আদর্শের উপর ভিত্তি করে আর বড় ভাইদের মন ভুলানো কথায় মুগ্ধ হয়ে তাঁরা দু’জন দুইটি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িয়ে পড়ল। প্রায় সাথে সাথেই দুই দলের দুই বড় ভাইদের আঙ্গুলের ইশারায় তাঁরা দুইটি আলাদা হোস্টেলে সীটও পেল। এখন আর তাঁদের দেখে কে। এবার তাঁরা নিজেদের পড়াশুনা শেষ করতে পারবে। পল্টু আর রঞ্জু মন দিয়ে পড়াশুনা আর দলের কাজ করতে লাগল।
দিন যায়-মাস যায় পড়াশুনা আর দলের কাজ করতে করতে দু’জনেরই সময় কেটে যায়। এখন আর তেমন দেখাও হয় না তাঁদের। পল্টু শুনেছে রঞ্জু নাকি তাঁর ক্লাশের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটির নাম ঝর্না। যেমন সুন্দর দেখেতে তেমনি ঝর্নার মতই চঞ্চলা হরিনি। লোক মুখে শুনে একটু মন খারাপ হলেও পল্টু ব্যপারটিকে খুব একটা পাত্তা দিল না। পল্টু মনে মনে ভাবে রঞ্জুটা যেন কেমন হয়ে গেছে মোবাইলে একটা কলও দেয়না, একটু যোগাযোগও করেনা। এমনকি ক্লাশেও খুব একটা দেখা বা কথা হয় না তাঁদের। ‘এত বড় একটা খবর নিজে তাঁকে দিতে পারত না রঞ্জু’, পল্টু মনে মনে ভাবতে থাকে। সে যাই হোক রঞ্জু এবং তাঁর প্রেমিকা ভাল থাকলেই সে খুশি। যেচে পড়ে সে আর দেখা করতে চায় না রঞ্জু আর ঝর্নার সাথে।
এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ কি একটা বিষয় নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে বেশ ঝামেলা হ্ল। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মাঝে একটা ছোটখাট মারামারিও হয়ে গেল কলেজে। রঞ্জু বা পল্টু ব্যপারটি খুব একটা বুঝতে পারল না। বড় ভাইদের জিজ্ঞাসা করে তাঁরা জানতে পারল কলেজে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলে আসলে টিকে থাকা মুশকিল। তাই মাঝে মাঝে নিজেদের ক্ষমতা দেখাবার দরকার পড়ে। তাছাড়া দল চালাতে গেলে দরকার হয় অনেক টাকা। সেজন্য কলেজের উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার নিজেদের নামে নিতে হয়। আর তারজন্যই দরকার হয় এই সব মারামারির। এদিকে পল্টুকে তাঁর দলের সহকর্মিরা মাঝে মাঝে টিটকারি মারে রঞ্জু আর ঝর্নার নামে। রঞ্জু যদি পল্টুর এত ভাল বন্ধুই হয় তাহলে পল্টুর সাথে যোগাযোগ করেনা কেন। আবার অন্যদিকে রঞ্জুও চিন্তা করে পল্টু তো নিজে এসে একদিন তাঁদের কে শুভেচ্ছা জানাতে পারত। কিন্তু সে তো তা করেনি। রঞ্জু শুনেছে পল্টু নাকি ঝর্না আর তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে হাসাহাসি করে। এসব শুনে রঞ্জুর ঘৃনায় মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবে পল্টু তো এরকম ছিল না।
এরমধ্যে পল্টু ও রঞ্জুর উপর কড়া নির্দেশ আসে উপরমহল থেকে যে, এক গ্রুপের সদস্যরা যেন অন্য গ্রুপের ছেলেদের সাথে যেন ঘনিষ্ঠভাবে না মেশে। তাঁদের মাথায় সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়া হ্ল, ‘অন্য গ্রুপের ছেলেরা তাঁদের গ্রুপ কে ধ্বংস করবার পাঁয়তারা করছে।’ এভাবে রঞ্জু বা পল্টুর মত অনেকের মনে বিরোধী গ্রুপ সম্পর্কে হিংসা-বিদ্বেসের বীজ বুনে দিল তাঁদের দলের বড় বড় নেতারা। এখনতো রাস্তায় দেখা হলেও কেউ কারোর সাথে কথাও বলে না। এক গ্রুপের ছেলেরা অন্য গ্রুপের ছেলেদের রাস্তায় একা পেলে বেধড়ক পিটুনি দেয়। এভাবেই চলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা।
এভাবে দেখতে দেখতে একটি বছর পার হয়ে যায়। নতুন বছরের শুরুতে কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে। দুই দলের শীর্ষ নেতারা তাই উঠে পড়ে লেগেছে, নিজেদের কব্জায় রেখে নবীন বরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। এতে করে নতুন মুখ দলে পাওয়া যাবে আর কিছু টাকা পয়সা ইনকাম হবে দলের ছেলেদের। রঞ্জু-পল্টু তাঁদের নিজ নিজ দলের বেশ হত্তা কত্তা হয়ে উঠেছে। তাই তাঁদের উপর দ্বায়িত্ব পড়েছে নবীন বরণ অনুষ্ঠান কব্জা করার। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হল রঞ্জুর দল। অনুষ্ঠানের জন্য রিহার্সাল বেশ জমে উঠেছে। ঝর্নাও এবার অনুষ্ঠানে একটি গানে অংশ নেবে। তাই রিহার্সাল করছে জোরে শোরে। প্রায় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর। যদিও রঞ্জু বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে।
এরকম একদিন সন্ধ্যার একটু পরে রিহার্সাল থেকে ফেরবার পথে পল্টু দেখে কতগুলো ছেলে ঝর্নাকে অপমান করছে। সন্ধের আবছা আলোয় ছেলেগুলো খুব একটা চিনতে পারলনা সে, তবে খেয়াল করে দেখল যে তাঁর বন্ধু রঞ্জু প্রাণপনে ঝর্নাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। ধস্তা ধস্তি আর ঝর্নার আর্ত্মচিৎকার কে অগ্রাহ্য করে পল্টু উল্টো দিকের পথ ধরতে যাবে এমন সময় ঝর্না দৌড়ে তাঁর সামনে চলে আসল। ঝর্না পল্টুর হাত ধরে বলতে লাগল, ‘আমার জন্য না হোক ভাইয়া আপনার বন্ধুকে বাঁচান।’ হঠাৎ করেই পল্টুর তাঁর নিজের ছোট বোনের মুখখানা মনে পড়তে লাগল। আর কয়েকদিন পরেই তো তাঁর ছোট বোন এস এস সি পরীক্ষা দেবে। সেও তো ঝর্নার মত কোনো না কোনো কলেজে পড়তে যাবে। তারও কি এই দশা হবে? এইসব ভাবতে ভাবতে সে ঝর্নার ধাক্কা খেয়ে সম্বিত ফিরে পেল। তীর বেগে এগিয়ে গেল জটলার দিকে। গিয়ে যা দেখল তা দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। পল্টু জটলার ভেতরে তাঁর নিজের ও রঞ্জুর দলের প্রধান নেতাদের দেখতে পেল। আরও দেখল যে, তাঁরা সবাই রঞ্জুকে ধরে মারছে। আর রঞ্জু ঝর্নাকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘ঝর্না, তুমি পালাও।’ রঞ্জুর নাক মুখ দিয়ে তখন রক্ত বের হচ্ছিল। পল্টুর মাথায় রক্ত উঠে গেল। কয়দিন আগে দলের নেতারা তাঁকে আত্মরক্ষার জন্য একটি চা-পাতি দিয়েছিল। কোমরে গুজে রাখা চাপাতি টি বের করে মারামারি করতে লাগল পল্টু। অন্যদিকে রঞ্জুও সুযোগ পেয়ে ঝর্নার সম্মান বাঁচাতে সমানে মারপিট করতে লাগল। কয়েকজন নপুংসক যৌন সন্ত্রাসি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে রঞ্জু আর পল্টুর মারের আঘাতে।
এরই মধ্যে বাংলা সিনেমার মত পুলিশ এসে হাজির। সাথে সাথে রঞ্জু আর পল্টু কে গ্রেফতার করল। ওদিকে ঝর্না নিজের সম্ভ্রম বাচিয়ে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পড়ছে ঝর্নাধারা। পুলিশ ভ্যানে উঠতে উঠতে পল্টু একবার ঝর্নার দিকে আর একবার রঞ্জুর দিকে তাকাল। তারপর দুই দলের প্রধান নেতাদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগল, ‘শালা, কুত্তার বাচ্চা। নিজের বোনের অপমান করতে তোদের লজ্জা হয় না? আমাদের দুই বন্ধুর মধ্যে অদৃশ্য দেয়াল আর বৈরিতা সৃষ্টি করেছিস তোরা। একবার ছাড়া পাইলে তোদের কল্লা আমি নামায়ে দেব শালা-কুলাঙ্গার।’
একদিন হাত ধরাধরি করে দুই বন্ধু এসেছিল কলেজ ক্যাম্পাসে আর আজ হ্যান্ডকাফ পড়া অবস্থায় একে অপরের হাত ধরে উঠতে লাগল পুলিশ ভ্যানে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, মুখে কিছু বলল না। আর ওদিকে ঝর্না ছুটল উকিলের কাছে নিজের পরম আপনজনদের পুলিশের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক বেশ ভালো লাগলো পড়ে । ভোট রইলো । রইলো শুভেচ্ছাও ।
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক ভাই, ধন্যবাদ আমাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য।
তাপস চট্টোপাধ্যায় khub bhalo laglo. amar patay amantron.
তাপস চট্টোপাধ্যায় ভাই, অনেক ধন্যবাদ।
হুমায়ূন কবির অনেক সুন্দর হয়েছে, ভোট থাকল আর আমার গল্পে আমন্ত্রন।
ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। অবশ্যই আপনার গল্পটি পড়ব...
Fahmida Bari Bipu ভাল লাগল। শুভকামনা সাথে ভোট রইল।
ফাহমিদা বারী আপু অনেক ধন্যবাদ। আমার জন্য দোয়া করবেন। ভাল থাকবেন।
আল মুনাফ রাজু ভালো লাগলো লেখাটা, ভোট রইলো .
ধন্যবাদ আল মুনাফ রাজু ভাই...ভাল থাকবেন।
শামীম খান ভাল লিখেছেন । শুভ কামনা রইল , ভোট ও ।
ধন্যবাদ শামীম খান ভাই...ভাল থাকবেন...
আবুযর গিফারী ভালো লিখেছেন। ভোট থাকলো।
ধন্যবাদ আবুযর গিফারী ভাই...এটা আমাদের সমাজের চালচিত্র...ভাল থাকবেন।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।
ধন্যবাদ...আপনাকে...লেখা পড়ার ইচ্ছা রইল।

১৩ এপ্রিল - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪