পাঞ্জাবী বনাম কুকুর

ডিজিটাল ভালবাসা (নভেম্বর ২০২১)

পারভেজ রাকসান্দ কামাল
  • 0
  • ৪৩
সেদিন ছিল আমার বড়ই আনন্দের দিন। আনন্দের আতিশয্যে আমার চোখে জল চলে আসল। কিন্তু আনন্দের এই রকম আতিশয্য যে হঠাৎ করেই অতি শয্যায় রূপ নেবে তা প্রথমে বুঝতে পারিনি।

ঘটনাটা খুলেই বলি।

আমার স্ত্রী শিলা আমাদের বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে একটি পাঞ্জাবী কিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। উপহার পেয়ে আমি তো মহা খুশি। পাঞ্জাবীটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “পরে দেখতো, কেমন লাগছে?”

আমি বরাবরই একজন ডিউটিফুল ও বিউটিফুল পত্নিনিষ্ঠ ভদ্রলোক। ঘরে এ ব্যপারে খুব একটা সুনাম না থাকলেও, পাড়ায় আমার এই গুণের যথেষ্ঠ সমাদর আছে। আমি গায়ে থাকা স্যান্ডো গেঞ্জির উপর পাঞ্জাবীটা পরতে গেলাম। কিন্তু একি! পাঞ্জাবী তো কোনমতেই ঢুকছে না। বলাবাহুল্য আমিই পাঞ্জাবীর ভিতর ঢুকতে পারছিনা। বহু কষ্টে যদিওবা পাঞ্জাবী শরীরে গলাতে পারলাম, কিন্তু ভুঁড়ির কাছে দিয়ে কোনমতেই আর নীচে নামছে না। শিলা আমার পাঞ্জাবী নিয়ে এরকম কসরত দেখে যারপরনাই বিরক্ত। একটু রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার সাইজ কত ছিল?”
আমি তখন হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম’ “এই তো ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।”

ও আমার এই উত্তর শুনে বলল, “ঢঙ কোরো না তো। পাঞ্জাবীর সাইজ বলো।”

আমি একটু শুকনো মুখে বললাম, “আমি ৪২ সাইজ পরি।”

ও তৎক্ষণাৎ আমার হাত থেকে পাঞ্জাবীটি ছিনিয়ে নিয়ে বলল, “এটাই তো ৪২ সাইজ। তাহলে ফিট করছে না কেন?”

আমি করুণ মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আসলে ৪২ তো বুকের মাপ। পেটের নয়। তোমার ভাল ভাল রান্না খেয়ে আমার ওজন গাণিতিক হারে আর ভুঁড়ি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই দশা।”

এই শুনে শিলা আরও খেপে গেল। বলল, “এই পাঞ্জাবীই তোমাকে পরতে হবে। এতে যদি তোমার ভুঁড়ির জ্যামিতি কমাতে হয়, তবে কমাবে।” সারাজীবন পরীক্ষার মার্কসের ডিজিট থেকে শুরু করে মাসের বেতনের ডিজিট বাড়াতে বাড়াতে আমি ক্লান্ত । এখন নাকি আমাকে উলটো ভুঁড়ির ডিজিট কমানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে।

আমি বললাম, “মুনি ঋষিরা বলে গেছেন, বয়সের সাথে সাথে মানুষের আয়তন বৃদ্ধি পায়। যেহেতু উচ্চতা বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা নেই, সেহেতু জ্যামিতিক নিয়মানুযায়ী পাশে বেড়েই চলেছে। মানে ভুঁড়ির দিকটাতেই। সবই প্রাকৃতিক ব্যাপার। অনেকটা তোমার চুলে দেয়া ঐ হারবাল তেলের মত।” আমার স্ত্রীর প্রাকৃতিক বা হারবাল জিনিষের উপর অগাধ বিশ্বাস। তাই এই চালটা চেলে দিলাম। সংসারজীবন অনেকটা দাবা খেলার মত। একটু বুদ্ধি করে চাল দিতে হয়।

কিন্তু সেই চালে কাজ হলো না। শিলা হুশিয়ারি জারি করে বলল, “আগামী কাল থেকে বাসার সামনের পার্কে বেড়াবে। যাতে তোমার ভুঁড়ি কমে আর পাঞ্জাবীটা গায়ে হয়।” পাঞ্জাবীটা উপহার হিসাবে পেয়ে একটু আগে যতটা আনন্দ হচ্ছিল এখন ততটাই রাগ হচ্ছে।

কী আর করা! ভুঁড়ির ডিজিট কমিয়ে ডিজিটাল ভালবাসার প্রমাণ করতে হবে আমায়।

পরেরদিন থেকে সকালে আমার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে উঠতে হয়। তারপর পার্কের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পাঞ্জাবী পরার কসরত এখন শরীর কসরতে রূপ নেয়। অত কসরত আমার ধাতে সয় না। তাই আমি পার্কের বেঞ্চিতে বসে বসে ঝিমুতে থাকি। এক্ষেত্রে আমার একটা নিজস্ব যুক্তি আছে। আমার যুক্তি হল, গাড়ি পার্কিং এর জায়গায় গাড়িগুলো যদি বিশ্রাম নিতে পারে, তাহলে মানুষের পার্কে বসে আমারও ঝিমানোর অধিকার আছে। অনেকেই পার্কের বেঞ্চের পাশ দিয়ে যাবার সময় আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। তা থাকুক। আমার কিচ্ছু আসে যায় না। এ আমার সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার কেড়ে নেবার অধিকার কারোর নেই।

পার্কে কয়েক সপ্তাহ যাবার পর আমাকে আবার সেই পাঞ্জাবী পরার কসরত করতে হলো। এবারও সেই একই ব্যাপার। কিছুতেই আমি পাঞ্জাবীর ভিতর ঢুকতে পারছিনা। এতেই বোধহয় শিলার সন্দেহ হলো।

একদিন আমি পার্কের বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ আমার কাঁধে কে যেন হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগল। আমি আরও আরামে হাতটিকে জড়িয়ে ধরলাম। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিল। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমার স্ত্রী শিলা। মুখ ঝামটা মেরে বলল, “রোজ পার্কে আসো কি ঘুমানোর জন্য? হ্যাঁ?”

আমি বললাম, “তুমি বলেছ যে, পার্কে বেড়াতে। তাই আমি বাসা থেকে বেরিয়ে বেড়াতে বেড়াতে পার্কে এসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।”

শিলা মুখ ভেংচে বলল, “উঃ বিশ্রাম নিচ্ছি! তা পার্ক কি তোমার বিশ্রাম নেবার জায়গা?”

আমি তখন গাড়িপার্কিং এর যুক্তিটি দিলাম। শিলা এরকম অকাট্য যুক্তি শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ও! বাবা! ভ্যাবাচ্যাকা খাবে না? এ যুক্তি কি যে সে যুক্তি? একেবারে সাংবিধানিক যুক্তি। এর উপর আর কোন যুক্তি চলে না।

এবার সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল, “এই মুহূর্ত থেকে পার্কে দৌড়াবে। যাও দৌড়ও।”

অগত্যা পার্কের বেঞ্চ ছেড়ে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হলো আমার। পাঞ্জাবী পরার জন্য আমার মত বাঙ্গালীর যে কষ্ট করতে হচ্ছে, সেই কষ্ট একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোকেরও করতে হয় না।

আমি অল্প অল্প করে আস্তে আস্তে ছুটছি। আমার পাশে এক ভদ্রলোক তাঁর কুকুর নিয়ে ছুটছেন। কুকুরটি দড়িতে বাঁধা। দড়ির এক প্রান্ত কুকুরের গলায় আর এক প্রান্ত লোকটি হাতে ধরে রেখেছেন। দড়ি বাঁধা কুকুরটি সামনে সামনে ছুটছে আর ভদ্রলোক ছুটছেন কুকুরের পিছন পিছন। আমার সবসময়ই কুকুরাতঙ্ক আছে। কুকুরাতঙ্ক কোন রোগ কিনা জানিনা। তবে জলাতঙ্ক একটি রোগ জানি। পাগলা কুকুর কামড়লে এই রোগ হয়। মানুষ তখন জল দেখলেই ভয় পায়। আমি বোধহয় আরও এক ডিগ্রি বেশি সাবধানি মানুষ। তাই কুকুর আমাকে কামড়ানোর আগেই কুকুর দেখেই আমার আতঙ্ক হয়। আমার হাঁটু কাঁপতে থাকে।

আতঙ্ক একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। প্রাকৃতিক বললাম এই কারণে যে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই আমার এই আতঙ্ক পাশের ভদ্রলোকের হাতে ধরা কুকুরের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে গেল। কুকুরটি কেমন করে যেন তাঁর মালিকের হাত থেকে ছুটে গিয়ে আমার পিছন পিছন ছুটতে লাগল। অমনি আমার কুকুরাতঙ্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। যার কারণে আমি আরও জোরে ছুটতে লাগলাম। আমি যত জোরে ছুটছি আমার পিছনে কুকুরও তত জোরে ছুটছে। শুনতে পাচ্ছি কে যেন চিৎকার দিয়ে ডাকছে, “ডিউক, ডিউক...স্টপ ডিউক!”

ইতিমধ্যে পার্কের অনেকেই ব্যপারটা বুঝতে পেরেছেন। তাঁরাও চেষ্টা করছেন কুকুরের হাত কিংবা দাঁত থেকে আমাকে বাঁচাতে। তাঁরাও ছুটছেন। ফলে দেখা গেল, আমার পিছনে ছুটছে কুকুর, কুকুরের পিছনে ছুটছেন কুকুরের মালিক, তাঁর পিছনে ছুটছে আমার স্ত্রী এবং সবশেষে আমার স্ত্রীর পিছনে ছুটছে গোটা পার্কের উৎসাহী জনতা। এ এক অভাবনীয় দেখবার দৃশ্য!

ধীরে ধীরে আমার দম ফুরিয়ে আসছে। আমার এই বিশাল বপু নিয়ে এত জোরে এত দূরত্ব দৌড়ানো অসম্ভব। আমার দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে, বুক ধড়ফড় করছে এবং পেট দ্রুত ওঠানামা করছে। দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেলে যা হয় আমার তখন সেই অবস্থা। শুধু আমার পীঠের দিকে দেয়াল নেই, আছে কুকুর। মনে মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে আমি হঠাৎই একটা হার্ডব্রেক করে বসলাম। কুকুরসহ কুকুরের মালিক হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের মনে বললাম, “পথে এস বাছাধন!”

তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পজিশন নিলাম। ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো যেরকম করে পেনাল্টি শট নেয়, ঠিক সেরকম করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কুকুর বরাবর একটি পেনাল্টি শট দিলাম। কিন্তু হায় কপাল! কুকুরটি আমাকে ততক্ষণে ডজ দিয়ে দিয়েছে। ফলে শট গিয়ে লাগল পাশের লাইট পোষ্টের গায়ে। আমার গায়ে জোর কম তা আমার অতিবড় শত্রুও বলতে পারবেনা। সুতরাং সর্বশক্তি প্রয়োগ করা লাথিটি যখন কুকুরের গায়ে না লেগে লাইট পোষ্টে লাগল তখন আমি ব্যাথায় পা চেপে বসে পড়লাম।

কুকুরটি তখন বিশ্বজয়ের আনন্দে ওর মালিকের পায়ের কাছে গিয়ে কুই কুই করছে। আর মালিক ভদ্রলোকটি কুকুরের গলার কাছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললেন, “ভাই, লাগে নি তো?”

শিলা ততক্ষণে এসে পড়েছে। কুকুরের মালিকের দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই পুরনো রণমূর্তি ধারণ করে বলল, “ইয়ার্কি হচ্ছে? কুকুর সামলিয়ে রাখতে পারেন না তো পার্কে কুকুর নিয়ে আসেন কেন?”

এত ব্যাথার মধ্যেও আমার চোখে খুশিতে জল চলে এল। এতদিন এই রণমূর্তি শুধু আমিই দেখেছি। আর এখন দেখছেন কুকুরের মালিক ভদ্রলোকটি। বুঝুক মজা!

পার্কের সবাই ধরাধরি করে আমায় পাড়ার ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল। ডাক্তার এক্স-রে করে বললেন, “পায়ে একটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। প্লাস্টার করে দিচ্ছি। বেশ কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে।

শুনে আমার আবার চোখ জলে ভরে গেল । কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার! মৃদু স্বরে গুন গুন করে গাইতে লাগলাম, “আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে...” সকালের কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে আমাকে আর তো দৌড়াতে হবে না।

শিলা অবশ্য পাঞ্জাবী বদলিয়ে একটি ৫০ সাইজের আলখাল্লা নিয়ে এসেছে। আর কোনও চিন্তা নেই ডিজিট কমাবার। ডিজিটে কি এসে যায়! এ কি ডিজিটাল ভালবাসা, যে ডিজিট মেপে চলতে হবে! অ্যা!

জয় কুকুরের জয়!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ফয়জুল মহী সুন্দর এবং সাবলীল প্রকাশ। খুব ভালো লাগল।

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

ডিজিটাল ভালবাসা বলতে আমরা ফেসবুক বা ফোনালাপের মাধ্যমে ভালবাসা বুঝি. আমার মতে ডিজিটাল ভালবাসা আসলে ডিজিট মেপে ভালবাসা. তাই এই গল্প. জীবনে মানিব্যাগের ডিজিট বাড়াতে বাড়াতে সবাই ক্লান্ত, কিন্তু পরিশেষে দেখা গেল অন্য সব ডিজিট বাড়াতে বাড়াতে নিজের ওজন এর ডিজিট বেড়ে গিয়েছে. ভালবাসার জন্য হাতের মুঠোয় প্রাণ নেবার মত শেষ পর্যন্ত ওজনের ডিজিট কমাতে মানুষ কে দৌড়াতে হয়. এই নিয়েই একটি রম্য গল্প.

১৩ এপ্রিল - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪