যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি

ত্যাগ (মার্চ ২০১৬)

পারভেজ রাকসান্দ কামাল
  • ৩০
১)
“অ্যায় রফিক, কী দেখছিস অমন হা করে?” ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করে সজীব। চমকে উঠে রফিক বলে, “কই না তো কিছু দেখছি না তো।”
“আমি দেখলাম ক্লাশে স্যারের পড়ানোর দিকে কোনো মন নেই তোর। সব মনোযোগ যেন টেনে নিচ্ছে পাশের বেঞ্চ। কাউকে মনে ধরল নাকি?”
পাশের বেঞ্চে ক্লাশের মেয়েরা বসে। স্যারের পিছন পিছন ক্লাশের ঢোকে আবার স্যারের সাথে সাথেই ক্লাশ ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ক্লাশে কোন ছেলের সাথে খুব একটা কথা-বার্তা হয় না তাদের। সজীবের কথা শুনে রফিক থতমত খেয়ে কিছু বলে না।
কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে সজীব-রফিকেরা। সামনে তাদের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। কিন্তু কলেজের কোন ছাত্রের মনেই পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ নেই। দেশের এই অবস্থায় মনোযোগ থাকবারও কথা নয়। গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পায় দুই পাকিস্তান মিলে। কিন্তু পাঞ্জাবীরা বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা দিতে চাইছে না। এই নিয়ে সারা দেশ এখন উত্তাল। যেকোন সময় যেকোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সবাই মনে মনে তারই মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে কলেজের বাইরে চায়ের দোকানে এই নিয়ে তুমুল আলোচনা-ঝগড়া-যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চলছে। সাধারণত এই সব আলোচনায় কলেজের অন্যান্য মেয়েরা খুব একটা অংশগ্রহন করে না। এর মধ্যে ব্যাতিক্রম হল শর্মিলা। অনেকে মনে করে শর্মিলার মেয়ে হয়ে জন্মানোর চেয়ে ছেলে হওয়ায় ভাল ছিল। তাঁর তুখোড় যুক্তির কাছে কেউই পাত্তা পায় না। সে জন্য রফিকের শর্মিলা কে বেশ ভাল লাগে। ক্লাশের ফাকে ফাকে পাশের বেঞ্চের দিকে তাকিয়ে শর্মিলাকে দেখতে থাকে।
কথায় কথায় একদিন শর্মিলা রফিক কে বলে, “এইবার ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে বেশ ঘটা করে ২১শে ফেব্রুয়ারী পালন করা দরকার।”
কথাটা রফিকের বেশ মনে ধরেছে। কলেজ ছাত্র সংসদের কোন এক সম্পাদকের পদে রফিক আছে। রফিক মনে মনে ভাবতে লাগল, ফেব্রুয়ারী মাসের ২১ তারিখ প্রতিটি বাঙ্গালীর জন্য স্বাধীকার আন্দোলনের বীজমন্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা এই দিনটিকে খুব একটা পছন্দ করে না- বেশ ভয় পায়। বেশ ঘটা করে পালন করতে পারলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখে ঝামা ঘষে দেয়া যাবে। ইট-কাঠ-পাথরের তৈরী শহীদ মিনারের উপর তাদের অনেক রাগ। তাই শহীদ মিনারে ফুল দেয়া কে তারা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বলে মনে করে থাকে। রফিক মনে মনে হাসতে থাকে আর বিড় বিড় করে বলে, “জড় বস্তুর উপর খামাকা রাগ করে কী যে লাভ হয় সামরিক জান্তাদের কে জানে।”
কথাটা শর্মিলার কানে যায়। প্রতিউত্তরে শর্মিলা বলে, “আরে রাগ তো আর শহীদ মিনারের উপরে না, রাগ হচ্ছে বাঙ্গালীর চেতনার উপর। বাঙ্গালীয়ানার উপর। ওরা খুব ভাল করে জানে যে, বাঙ্গালী চেতনা জাগলে তাদের কে আর দমিয়ে রাখা বেশ শক্ত। ঠিকই তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিবে।”
রফিক মুগ্ধ চোখে শর্মিলার দিকে তাকিয়ে তাঁর কথা শুনতে থাকে। এমনিতে শর্মিলা কথা বলে বেশ সুন্দর করে। কলেজ ডিবেটিং ক্লাবের অন্যতম সেরা সম্পদ সে। সে যাই হোক, শর্মিলার সুন্দর কথার কারণেই হোক বা দেশ মাতৃকার অমোঘ টানেই হোক রফিক কলেজ ছাত্র সংসদের মিটিংএ কথাটা তুলল। দু’একজন পশ্চিম পাকিস্তানপন্থি ছাড়া আর কেউই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করল না। শুরু হলো ২১শে ফেব্রুয়ারী আয়োজন পর্ব। ছেলেদের পাশাপাশি কলেজের মেয়েরাও এই আয়োজনে সাথে নিজেদের শরিক করে নিল। খুব খাটাখাটনি করে সবাই মিলে পালন করল ২১শে ফেব্রুয়ারী।
ওই দিন একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ রফিক করে ফেলল। শহীদ দিবসের অনুষ্ঠান শেষে শর্মিলাকে বাড়ি পৌছিয়ে দেবার সময় রফিক শর্মিলা কে নিজের মনের কথা বলল। সব শুনে শর্মিলা কেমন যেন একটু চুপ করে গেল। এর পর থেকে শর্মিলা যেন রফিক কে এড়িয়ে চলতে লাগল। শর্মিলার চুপ করে থাকা রফিকের বুকে শেলের আঘাতের মত মনে হচ্ছিল। নিজেকে রফিকের খুব অপরাধী মনে হতে লাগল। রফিকের মনের ভিতর কেবলই হাহাকার রব উঠছিল যে সে কি তবে কোন ভুল করে ফেলল। চিরজীবনের জন্য শর্মিলা কে আপন করে চাওয়া তবে কি অপরাধ হল। তাঁর আর শর্মিলার মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তার কি কোন ইতি ঘটল। রফিক যতই ভাবতে থাকে ততই বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ওদিকে শর্মিলাও কথাটি শোনার পর নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে লাগল। মুখে কিছু বলতে পারল না।
২)
দেখতে দেখতে মার্চ মাস চলে এল। মার্চের শুরু তে সারা ঢাকা শহর সহ অন্যান্য জেলা শহরে পাকিস্তানের চাঁদ-তারা পতাকা বাদ দিয়ে সবুজের ভিতর লাল বৃত্ত আর সেই বৃত্তের মাঝে সোনালী রঙ্গের পূর্ব-পাকিস্তানের ম্যাপ সম্বলিত পতাকা উড়তে লাগল। শুধু সরকারি অফিসে সেই পুরোনো চাঁদ-তারা পতাকা উড়ল। দেশটার নাম কখন যে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে গেল রফিক-শর্মিলারা ঠিক বুঝতেই পারল না। এই সব দিন পার করতে করতে চলে এলো ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের স্বাধীনতার ডাক। এভাবে এগিয়ে চলল একেকটি দিন। নিরস্ত্র বাঙ্গালীর জীবনে নেমে আসল ২৫শে মার্চের কাল রাত্রি। বাঙালিরা অবশ্য ভুল করল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ২৬শে মার্চ ঘোষণা করল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ।
রফিকের মনে হল সব কিছু যেন চোখের সামনে দ্রুত ঘটে গেল। কয়েকদিন পর রফিক খবর পেল যে বাংলাদেশ কে হানাদার মুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করা হচ্ছে। শোনা মাত্র রফিক ঠিক করল সে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিবে। রফিকের মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই নিষেধ করল মুক্তিবাহিনীতে যেতে। কিন্তু রফিক বলল, “আমার বাঁচার মত যদি বাঁচতে হয় তবে যুদ্ধে যেতেই হবে। নইলে বেঁচে থেকেও আমি মরে থাকব।”
যেদিন রাতে রফিক গেরিলা ট্রেনিং নিতে ভারত যাবে সেদিন কিভাবে যেন খবর পেয়ে শর্মিলা এল রফিকের সাথে দেখা করতে। হাতে একটি লালসালু কাপড়ে মোড়া বাক্স। বাক্সটি রফিকের হাতে দিয়ে শর্মিলা বলল, “পরাধীন এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-বাষ্প আছে চারদিকে। আমি হিন্দু আর তুমি মুসলমান। আমাদের প্রেমের পরিনতি পাকিস্তানের মত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে সম্ভব হবে না। তাই এতদিন চুপ করে ছিলাম। যেদিন যুদ্ধ জয় করে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসবে, সেদিন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে আমাদের প্রেমের পূর্ণতা পাবে। কথা দিলাম।” কথা শুনতে শুনতে রফিক লালসালুতে মোড়া বাক্সটি ততক্ষেণে খুলে ফেলেছে। বাক্সের ভিতর থেকে একটি ছোট সাইজের বাংলাদেশের পতাকা বের হল। লাল সবুজের মাঝে সোনালী রঙ্গের বাংলাদেশের ম্যাপ। রফিক বুঝল যে, এই পতাকাটি শর্মিলা নিজে হাতে রফিকের জন্য বানিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে এই পতাকাটি রফিক কপালে বেধে নিল। শর্মিলা বলল, “তোমার মায়ের দোয়া আর এই পতাকা তোমার রক্ষা কবচ। তুমি বিজয়ী হবেই।”
কলেজের শহীদ মিনার ও রাতের এক ফালি চাঁদ কে সাক্ষী রেখে রফিক চলল তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি, প্রিয় মা-বাবা ও প্রিয়তমা কে পিছু ফেলে গেরিলা ট্রেনিং নিতে ভারতে। আর ভাবতে লাগল, রাতের আঁধার কেটে কবে আসবে নতুন ভোর।
৩)
দেখতে দেখতে প্রবাসী সরকার গঠন হল। রফিকেরা ভারতে গিয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে গেরিলা ট্রেনিং শেষে দেশে ফিরল হাতে স্টেনগান নিয়ে আর চোখে হানাদার মুক্ত স্বদেশের স্বপ্ন নিয়ে। তাদের সবার মুখে দাড়ি-গোফের জংগল। চোখ গুলো যেন কোটরের ভিতর ঢুকে গিয়েছে। পরণে লুঙ্গি, মাথায় গামছা পেচিয়ে তাঁরা গ্রামের ভিতর দিয়ে চলাফেরা করে। কাউকে হঠাৎ দেখলে ঠিকমত চেনা যায় না। শুধু রফিকের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা পেচানো। রফিকেরা দেশে ফিরলে সবার মনে একটি চাঞ্চল্য দেখা দিল। এলাকার অধিকাংশ মানুষ যেন একটু হাফ ছেড়ে বাঁচল। কারণ গ্রামের অদূরে যে কলেজে রফিকেরা পড়ত সেখানে পাক মিলিটারিরা ক্যাম্প খুলে বসেছে। আর তারা নিত্যদিনের উদর পূর্তি ও মনোরঞ্জনের রসদ যোগাড় করছে গ্রাম থেকে রাজাকারদের সহায়তায়। এটাই নাকি রাজাকারদের গ্রাম রক্ষা কর্মসূচি। এর নাম নাকি শান্তি কমিটি। প্রকৃতপক্ষে এইসব রাজাকারদের দৌলতে গ্রামবাসী সর্বশান্ত হলেও সাহায্য হচ্ছে পাক আর্মির। তাঁরা সহজেই জানতে পারছে যে কার ঘরে কী আছে, কে মুক্তি বাহিনী বা আওয়ামী লীগ করে ইত্যাদি। আর কলেজটি যেন একটি পাক মিলিটারির অত্যাচারের জল্লাদখানায় পরিণত হয়েছে। নিরাপরাধ মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে কী অমানুষিক অত্যাচারটাই না করা হচ্ছে। আর সেটার সহায়ক বাহিনী হল রাজাকারের দল। তাদের কাছে হিন্দু বা মুক্তি বাহিনীরা মানুষ না বরং গণিমতের মাল। মানুষের পাপ বেশি হয়ে গেলে তাঁরা ভয়ে ভয়ে থাকে। রফিকেরা গেরিলা বেশে ফিরলে সেই সমস্ত রাজাকারেরা সহ পাক আর্মিরা যেন একটু ভয় পেয়ে গেল। কারণ গ্রামে ফিরে মুক্তিবাহিনীরা পাক মিলিটারিদেরকে দৌড়ের উপর রেখেছে। মুক্তিবাহিনীদের পরিচালিত ঝটিকা আক্রমণের কাছে পাক মিলিটারিরা বেশ নাজেহাল হচ্ছে প্রতিদিন।
তবে এই সব যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীরও বেশ কিছু সদস্য আহত নিহত হচ্ছে প্রায়ই। সেই আহত মানুষগুলোর সেবা করার মহৎ দ্বায়িত্ব নিয়েছে এলাকার মুক্তিকামী মেয়েরা। আর তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে শর্মিলা। সবাই ভারতে পালিয়ে গেলেও শর্মিলারা বাবা পরিবার নিয়ে ভারতে যায় নি। তাঁর বাবাকে অনেকেই বলেছে, ভারতে পালিয়ে যেতে। কিন্তু শর্মিলা ও তাঁর বাবার একই কথা, “এটা তাঁদের দেশ, এই দেশ ছেড়ে কোথাও তাঁরা যাবে না। মরলে এদেশের মাটিতেই মরবে।”
শর্মিলা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পায় বিচ্ছু রফিক নামে এক দুর্ধর্ষ ছেলে পাকবাহিনীর উপর এমনসব আক্রমন করছে যে, বাছাধনরা পালাবার পথ খুজে পাচ্ছে না, এক অর্থে দিশেহারা হয়ে নাকানি চুবানি খাচ্ছে। মিলিটারি ক্যাম্পের প্রধান মেজর সালিম খান নাকি ইদানিং ভয়ে ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে না। শুনে গর্বে মাঝে মাঝে শর্মিলার বুকটা ভরে ওঠে। অসাম্প্রদায়িক এক নতুন দেশের স্বপ্ন দেখতে থাকে সে। যে দেশে নদীর তীর ধরে ধানক্ষেতের পাশে পাশে রফিকের হাত ধরে ছুটে বেড়াবে মুক্ত বিহঙ্গ এর মত। তবে মনের ভিতর কখনও কখনও কু ডাকে। এত সুখ তাঁর আর এই পোড়া দেশের কপালে সইবে তো।
৪)
এর মাঝে একদিন হঠাৎ করে একটা খবর আসে যে, মেজর সালিম খান এর বাহিনীর সাথে বিচ্ছু রফিকের বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে বিচ্ছু রফিক গুরুতর আহত হয়ে মারা গিয়েছে। কথাটি শোনার পর থেকে শর্মিলা কেমন যেন হয়ে যায়। চোখের জল শুকিয়ে যায়, মুখের চোয়াল দু’টো শক্ত হয়ে যায়, ঘাড়ে রগ দু’টোও ত্যাড়া হয়ে যায়। শর্মিলার চোখে মুখে আগুনের হল্কা বের হতে থাকে। সিদ্ধান্ত নেয় সে মেজর সাহেব কে চরম শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব। শর্মিলা ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে শর্মিলা ঠিক করে, যে দেশের মুক্ত বাতাসে রফিক নিঃশ্বাস নিবে না সে দেশে তাঁরও বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। কিন্তু মরবার আগে মেজর কে ও তাঁর বাহিনী কে সে দেখে নেবে। তাই কালবিলম্ব না করে শর্মিলা অনেকটা ইচ্ছা করেই ধরা দেয় পাক মিলিটারির ক্যাম্পে। পাক মিলিটারিরা শর্মিলা কে টেনে হিচড়ে মেজর সাহেবের মুখোমুখি করে। মেজর তাঁর স্বভাব সিদ্ধ জানোয়ারের হাসি দিয়ে ঘুরে ঘুরে শর্মিলা কে দেখতে থাকে। উর্দুতে জিজ্ঞেস করে, “তোম হারা নাম কিয়া হ্যায়।”
শর্মিলা ছোট বেলায় স্কুলে মাঝে মাঝে অন্যান্য বান্ধবীদের সাথে উর্দু ক্লাশ করত। তাই কিছুটা উর্দু জানা আছে তাঁর। সেটাই কাজে লাগিয়ে উত্তর দিল, “ আমার নাম সুফিয়া।”
মেজর আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি মুসলমান?”
শর্মিলা বলিষ্ট ভাষায় উত্তর দেয়, “হ্যা। কেন আমার উত্তর শুনে বুঝতে পারছ না?”
শর্মিলার স্মার্টনেস, সৌন্দর্য দেখে মেজর শর্মিলা কে বিয়ে করবার প্রস্তাব দেয়। শুনে শর্মিলা মনে মনে বেশ খুশিই হয়। কারণ মেজর তাঁকে বিয়ে করলে অন্য সৈন্যরা তাঁর দিকে নজর দিবে না। আর সেও মেজরের একটা চরম ক্ষতি করার সুযোগ পাবে। শর্মিলা তো মরবার জন্যই এসেছে। তাঁর এই আত্মত্যাগের জন্য যদি দেশের উপরকার হয় তবে ক্ষতি কি? তাঁর তো আর হারাবার কিছু নেই। শর্মিলা মেজর কে বলে যে, এই বিয়ে তে সে রাজি। মেজরের আর তর সয় না। সৈন্যদের মধ্যে থেকে মৌলভী গোছের একজন কে বলে বিয়ে পড়াতে। আর শর্মিলা কে একটি ঘরে আটকিয়ে রাখে। স্যাতস্যাতে একটি ঘর। তার ভিতর চারদিক অন্ধকার বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অত্যাচারের নমূনা। জাতির সুর্যসন্তানদের কে এই ঘরে অত্যাচার কর হয়, শর্মিলা বুঝতে পারে। এখানে সেখানে কাঁটা আঙ্গুল, ছোপ ছোপ রক্ত, মানুষের গোঙ্গানির শব্দ আর মেয়েদের চাপা কান্না। শর্মিলা সবাই কে ধৈর্য ধরতে বলে। আরও বলে যে, মেজর তাঁকে বিয়ে করতে চাইছে। তারপর দেখা যাক কি হয়। সব শুনে অন্যান্য মেয়েরা বলে যে, মেজর তাঁদের কেও বিয়ে করে ভোগ করেছে আর ভোর হলেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছে অধস্থন সৈন্যদের কাছে। এই মেজর আসলেই একটি জানোয়ার।
সন্ধ্যার দিকে মেজরের সাথে শর্মিলার বিয়ের নাটক হয়। শর্মিলা কে নিয়ে মেজর তাঁর ঘরে ঢোকে। আস্তে আস্তে রাত বাড়ছে। মেজরের এক অসাবধানতার মুহুর্তে শর্মিলা ক্লোরোফরম মেশানো রুমাল মেজরের নাকের কাছে চেপে ধরে। সেবা ক্যাম্প থেকে খুবই গোপনীয় ভাবে শর্মিলা ক্লোরোফরমের এই শিশি আর রুমাল নিয়ে আসে। এমনিতেই মেজর ছিল মদ্যপ অবস্থায়। তার উপর ক্লোরোফরমের ধকল সইতে পারল না। ঘুমিয়ে পড়ল। শর্মিলা তখন তাঁর চুলের খোপার ভিতর থেকে ধারাল চুলের কাঁটা দিয়ে মেজরের গলায় আমূল বিধিয়ে দিল আর সর্বশক্তি দিয়ে মুখ চেপে ধরল। গোঙ্গানির মত উঠে মেজর অজ্ঞান হয়ে গেল। শর্মিলার তখন তাঁর বাবা ও রফিকের কথা মনে পড়ছিল। চোখ দু’টো জলে ভরে আসতে চাইছিল। শর্মিলা চোখ মুছে উঠে দাড়াল। এখন কান্নার সময় নেই। দুরে টর্চার সেল থেকে নারী-পুরুষের ভয়ার্ত আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। মাঝে শর্মিলার মনে হল পালিয়ে যাই। কিন্তু এখান থেকে তো পালানো সম্ভব নয়। আর তাছাড়া পালিয়েই বা লাভ কি? যদি মুক্ত স্বদেশে রফিক কে সে না পায়। তারচেয়ে নিজের আত্মদানের মাধ্যমে দেশকে সাহায্য করার মধ্যে আনন্দ আছে।
চৌকির নিচ থেকে মদের বোতলের সাথে কিছু স্পিরিটের বোতল পায় শর্মিলা। সবকয়টি বোতলে নিজের কাপড় কেটে সলতে তৈরি করে সে। এরপর এলো সেই ক্ষণ। প্রতিটি বোতলের মুখে আগুন জ্বালিয়ে মেজরের ঘর থেকে বাইরে এসে একটার পর একটা বোতল ছুড়ে মারে অস্ত্রাগারের দিকে। দিনের বেলাতে মেজরের সাথে কথা বলার সময় সে দেখে নিয়েছে মেজরের ঘরের ডান দিকে কোণাকুনি যে ঘরটা দেখা যায় সেটি অস্ত্রাগার। অস্ত্রাগারে দু’জন পাক আর্মি পাহারায় ছিল। ঘটনার আকষ্মিকতায় তাঁরা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষন পর স্টেনগান উচিয়ে গুলি করতে লাগল শর্মিলা কে। কিন্তু ততক্ষনে যা হবার তাই হয়ে গিয়েছে। সমস্ত অস্ত্রাগারে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত বোম, গ্রেনেড, মর্টার শেল বা অ্যামুনিশন একসাথে ফেটে গেল। ধুম!!!
খবর পেয়ে গ্রামবাসির সাথে অন্যান্য মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও আসল পাক ক্যাম্পে। পুরো কলেজটি যেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কলেজের ভিতরে আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ রফিকের চোখ পড়ল শর্মিলার লাশের দিকে। হাতে তখনও স্পিরিটের বোতল ধরে আছে সে। বুকটা গুলিতে ঝাঝরা হয়ে গিয়েছে। রফিক শর্মিলার লাশ জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
৫)
দেশ স্বাধীন হল এর কয়েক মাস পরই। বিজয়ের পর এক দশক, দুই দশক করে চার দশক পার করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। রফিক আর বিয়ে থা করে নাই। শর্মিলার বাবা কে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেখে রেখেছে। বুকের ভিতর লোনা ব্যাথা নিয়ে রফিক আজও শহীদ মিনার বা জাতীয় স্মৃতিসৌধে শর্মিলার স্পর্শ পায়। মাঝে মাঝে ভাবে এক অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখত শর্মিলা। মনে মনে বলে, “ তোমাকে হারিয়ে শর্মি আমি মুক্ত স্বদেশ পেয়েছি। বলতে পার তোমার দামে কিনেছি বাংলাদেশ। দেশ কে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করার আর দেশ গড়ার যুদ্ধটা আজও চলছে। তারপরই আমি ফিরে আসব তোমার কাছে।”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোহাঃ ফখরুল আলম ভাল লাগল। আমার কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
আব্দুল্লাহ আল মারুফ তনু কবিতা টি দয়া করে পড়েন
Fahmida Bari Bipu ভালো হয়েছে। তবে ছোট গল্প একটু বেশি বর্ণণাধর্মী হলে মনোযোগটা অনেক বেশি দিতে হয়। বিষয়টা মাথায় রাখা জরুরি। শুভেচ্ছা।
ফয়েজ উল্লাহ রবি অসাধারণ! ভোট রইল।
অনেক ধন্যবাদ ভাই ভাল থাকবেন
রুহুল আমীন রাজু দেশ স্বাধীন হল এর কয়েক মাস পরই। বিজয়ের পর এক দশক, দুই দশক করে চার দশক পার করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। রফিক আর বিয়ে থা করে নাই। শর্মিলার বাবা কে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেখে রেখেছে। বুকের ভিতর লোনা ব্যাথা নিয়ে রফিক আজও শহীদ মিনার বা জাতীয় স্মৃতিসৌধে শর্মিলার স্পর্শ পায়। মাঝে মাঝে ভাবে এক অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখত শর্মিলা। মনে মনে বলে, “ তোমাকে হারিয়ে শর্মি আমি মুক্ত স্বদেশ পেয়েছি। বলতে পার তোমার দামে কিনেছি বাংলাদেশ। দেশ কে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করার আর দেশ গড়ার যুদ্ধটা আজও চলছে। তারপরই আমি ফিরে আসব তোমার কাছে।” খুব ভালো লাগলো গল্পটি.
অনেক ধন্যবাদ ভাই ভাল থাকবেন
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,আমার কবিতা ও গল্প পড়ার আমন্ত্রন রইল।ভোট রেখে গেলাম।

১৩ এপ্রিল - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪