স্বপ্নের ব্যাগ এবং একটি মৃত উঁকুন

শ্রম (মে ২০১৫)

মনিরুজামান Maniruzzaman লিংকন
মোট ভোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.৫৩
  • ৭৪
রে¯েঁÍারার মলিন আলোয় ওয়েটার এসে রেখে গেল খিচুড়ির প্লেটটা। আরেকটা প্লেটে রাখল শসার টুকরা, টমেটোর চাকতি, টুকরো পিয়াজ আর কয়েকটা কাচা মরিচ। সস দেয়া হয়েছে একটা ছোট বাটিতে গলা মোম ঢেলে দেয়ার মত।

অ¯^স্তি কাটাতে ওয়েটার তার শার্টের বাম হাতার বোতামটা খুলল আবার লাগাল। তার হাবভাব দেখে মনে হল তাহেরের উচিত খাওয়া রেখে ওয়াসরুমে ব্রাসে পে¯ট লাগিয়ে দাঁত ঘষা। সে তাহেরকে দেখতে পেল পচা পেট ফুলা মাছের মধ্যে। যার ¯হান হওয়া উচিত রেস্তোঁরার স্যাঁতস্যাঁতে ডা¯টবিনে যেখানে কুকুরেরও মুত আসা বন্ধ হয়। সে টেবিলের উপর কোকাকোলার বোতলটা রাখল ঠক্ শব্দে। যেন দফতরির ছুটির শেষ ঘন্টা পেটানো, যার পরে আর কিছু থাকতে পারে না। কুকুরের ঝোল চাটার শব্দ শোনার অপেক্ষাতো নয়ই !

পিয়াজের টুকরোটায় কামড় বসাতে গিয়ে তাহেরের চোখ পড়ল শষার উপর উকুঁনটায়। শসার টুকরোটা ক্রিকেটের সাইড স্ক্রিনের মত দেখাল ওটার চিৎ হওয়া পা যেগুলো লেপ্টে আছে বুকের উপর। একটা কঙ্কাল। মৃত। আর বিচার প্রার্থনার অধিকারহীন।

তাহের নিজের চুলে হাত না বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সব ঠিকঠাক আছে কিনা। ফাঁক বুঝে শষার টুকরো সহ উকুঁনটা ঢুকিয়ে ফেলল পকেটে, যেন লাশ সহ কফিনের গর্ত যাত্রা।

উকুঁনের কথা জানালে দোষটা তার ঘারেই পড়ত। উকুঁন! উকুঁন! বলে চিৎকার করলে দাতেঁর চিকিৎসার জন্যে যেতে হত শের ই বাংলায়। যেখানে সিটের অভাবে পড়ে থাকতে হত ফ্লোরে। আর ভদ্রভাবে উকুঁনটা দেখালে বিল না দেয়ার অপকৌশলের জন্য কানের লতি অবশ্যই লাল হত।

রেস্তোরাটা শ্রমিকদের জন্য নয়। বিশেষ করে হাড় ধোয়া কারখানার ¤্রমিকদের জন্য অবশ্যই নয়। অলিখিত ভাবে তা পেট্রোল পাম্পে জলন্ত সিগারেটের মত ভয়ঙ্কর ভাবে নিষিদ্ধ । তার পোষাকে না বুঝলেও কথাবার্তায় কয়েক মিনিটে প্রকাশ পেত বৃক্ষের নাম। যাদের অধিকার ছালা দিয়ে ঢাকা হোটেলে যাবার যেখানে চায়ের কাপে লাল পিপঁড়া ভাসলে সবাই ধরে নেয় দুধের সড়।

তাহের দামি রেস্তোরায় কখনও আসেনি ঠিক খাবারে মরা উকুঁন দেখার মত কখনও না। এমনকি আগে আসার কথা কখনও ভাবেনি পর্যন্ত। কিন্তু বদলী হওয়া শ্রমিকদের তালিকায় যখন নাম উঠল না তখন পেটের ভিতর থেকে একটা বুদবুদ বাইরে বেড়িয়ে এসে যেন বলছিল নতুন কিছু করার জন্য। অবশ্যই মরা উকুন খাওয়ার জন্য বলেনি। যদিও বড় লোকের সব কিছুই বড় আর ভাল। এমনকি ধনীদের ইয়েটাও বড় আর ভাল।

একমাস ধরে চলছিল শ্রমিক অসন্তোষ। ফুলেফেপে উঠছিল যেন দশ নম্বর সংকেত খাওয়া সমুদ্র জল। মালিক পক্ষ শুধু আন্দোলন সমুদ্রের তলদেশ থেকে বেস প্লেটটা সরিয়ে নিল আর মূহুর্তেই আন্দোলন মরা খাল।

তাহের কখনও কারখানা অচল করার পক্ষে ছিল না। কোন রকম ভাঙ্গাভাঙ্গির কথা শুনলেও সে তখন কাদার তলার বাইম মাছ। সে ভাবত তার বিবাহযোগ্য বড় বোনের কথা, মা আর প্রাইমারিতে থাকা ছোট ভাইয়ের কথা। শিশু অব¯হায় যেদিন প্রথম এল হাড় ধুতে সে দিনের কথা।

নতুন আর পুরানে সরকারি বইগুলো ছিল পুরানো ক্যালেন্ডারের মলাটে। র‌্যাকের উপর বইগুলোতে পুরো ধূলো জমা পর্যন্ত সেগুলো অপেক্ষায় ছিল উষ্ণতার। একসময় ¯^প্ন ভঙ্গ হল বইগুলোর আর জাতির মেরুদন্ড থেকে ছিটকে পড়া বালকের।

শ্রমের বার বছরে সে বুঝেগেল দূর্গন্ধযুক্ত কিছুকে কিভাবে আরোগ্য লাভের হাতিয়ারে টার্ন করা যায়। চাকুরি তাকে সব কিছু দিয়েছে ভাত, করলা ভর্তা আর বোনের বিয়ে নিয়ে ¯^প্ন দেখার অধিকার।

পাশের সুতা মিলের শ্রমিক ওয়াহেদ তার বন্ধু। ওয়াহেদের বড় ভাইয়ের সাথে বোনের বিয়ে
ঠিকঠাক। ভাইয়ের বাড়ির পাশে হাটে মুদি দোকান। তারা চেয়েছে শুধু পাখির পালকের মত পরিবার। যা পাথড় হবে না। ভাইয়ের চাকুরি আর পরিবারের সদস্যদের সংক্ষিপ্ত তালিকা তাহেরদের নিয়ে এসেছে পছন্দের শীর্ষে। আর সংবাদটা তখন আনন্দ দিল নতুন কোন গায়কের টপচার্টে মাস ব্যাপি শীর্ষে থাকার মত কিম্বা তার থেকে বেশী।

পুরো একমাস বন্ধুর সাথে সাক্ষাত হয়নি। সুতা মিলের শ্রমিকদের এতটাই ব্যস্ত করে রাখা হয়েছিল শুধু ঘুমানোর জন্য তারা রুমে যেত পারত। এমনকি ফ্রি খাবারের ব্যব¯হা করা হয়েছিল মিলের মধ্যে। আকস্মিক এবং চাতুর্যতার সাথে। আর সেটা ছিল ভাইরাসের মত দ্রুত ছড়িয়ে পরা আন্দোলন প্রতিরোধের হাতিয়ার।

সুতামিলে একমাসে উৎপাদন বেড়েছিল দেড়গুন। একই শ্রমিক সংখ্যায়। তাই পুরু¯কার একজনের প্রাপ্য হয়েছিল। মালিক পক্ষ থেকে ব্যব¯হাপককে সম্বোর্ধনা দেয়া হয়েছিল শ্রমিকদের আরও বেশী খাটানোর জন্য, আরও বেশী আধমরা করার জন্য এমনকি তাদের কল্পনা শক্তিকে ভোতা করার জন্যও। কারনগুলো সর্বদা গোপন ছিল আর গোপন রাখার জন্য প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়ে রইল।

সম্বোর্ধনার পরে বন্ধু এসেই তাহেরকে বলল বিয়ের প্র¯তুতির জন্য। সংবাদটা ছিল সম্বোর্ধনায় চাপাবাজদের থেকে পাওয়া বন্ধুর আনন্দের ভাগাভাগি।

রো¯ঁতারার সামনের রাস্তাটায় বাসটা চলে গেল তাহেরের পাশ ঘেষে। বাড়তি হাওয়ার ঝাপটায় হাতের ব্যাগটা দুলে উঠল পাখির ডানার মত। দুলে উঠল নেল পলিস, আলতা , পাউডার, ক্রিম। আর একটা ¯^প্নও।

এরকম একটা বাসে উঠেছিল আন্দোলনের সময়। তাহের সবকিছুকে এরানোর জন্য সেদিন বেরিয়ে পরেছিল আগেই। দাড়োয়ান হীন ছিল গেটটা। ভয়ে পালিয়েছিল দাড়োয়ান।

মিছিলটা ছিল গতিতে।

অসাবধান আর বেপরোয়া।

তাহের পিছন ফিরে দেখছিল পুলিশের কাটাতারে আটকে যাওয়া মিছিলটা। মনে হচ্ছিল আঙ্গুর রক্ষার জালে আটকে যাওয়া ছটফটে পাখি। তার পাশেও কয়েকজন শ্রমিক ছিল । হয়ত তারই মত কিম্বা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

মালিকের ভাড়া করা গুন্ডা আর চকচকে লাঠি হাতে পুলিশের জটলা ছিল মহাসড়কের পাশে। তারা যেন পথচারি আর শ্রমিকদের মধ্যে পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করছিল। ঠিক করতে পারছিল না আচরনটাও। আর তাদের পথ দেখাতেই যেন মিছিলটা থেকে চিৎকার করে তাহেরদের উস্কে দেয়া হচ্ছিল মহাসড়কের উড়ন্ত বাসগুলো ভাঙ্গার জন্য।

তাহেরের নিজেকে মনে হয়েছিল শিকার করতে আসা একঝাক সিংহ থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ। যেন ডিসকভারির একপাল মহিষ ধারালো শিং নিয়ে তার দিকে ছুটে আসছিল। ওরা ছিল চকচকে লাঠির পুলিশ আর মালিকের ভাড়া করা গুন্ডার দল। ভাঙ্গার ভয়ে পলায়নরত বাসটাকে মনে হচ্ছিল দোল খাওয়া সাপের ফণা। তাহের ঝাপিয়ে পড়েছিল বাসটার অন্ধকার গুহা মুখের মত দরজাটায়।

মিলন হয়েছিল গতির সাথে গতির, আর হাতের সাথে হাতলের। পিছনের গ্লাস দিয়ে মহিষ গুলোকে মনে হয়েছিল এলোমেলো মার্বেল।

উদ্দেশ্যহীন।

যাত্রিদের যাদের দিকে চোখ পড়ছিল তাদের হলুদ আর পান খাওয়া কাল দাগের দাতেঁগুলোর হাঁ তখনও চোখে পড়ছিল।

ঐদিনই ছিল আন্দোলনের শেষ দিন। যে কজন আন্দোলন ¯ফুলিঙ্গে অক্্িরজেন যুগিয়েছিল তারা মালিক আর শ্রমিকদের কাছে নিজেদের গুরুত্ব এতটাই বাড়িয়ে নিতে পেড়েছিল যে আন্দোলনের আর মানে খুজে পেল না। কর্মী ছাটাইয়ের বিরুদ্ধে নেতারা ছিল সোচ্চার। কারণ সেটা ছিল তাদের নেতা হওয়ার পূর্ব শর্ত। আর আন্দোলন দমনে সেটাই পরিনত হল মূল অ¯্র।ে নেতারা মালিকপক্ষকে সাহায্য করেছিল বদলীর তালিকা তেরি করতে।

বদলীর সিদ্ধাšত হয়েছিল বরিশার থেকে কক্স’সবাজার। যা ছিল শ্রমিকদের উপর আমের ডালে কালবৈশাখির হানার মত ভয়ঙ্কর। বদলীর নামে ছাটাইয়ের অনন্য কৌশল।

আজও বাসটা থামল না ঠিক অন্যান্য দিনের মত। সুতা আর হাড় কারখানার শ্রমিকদের নামাতে বাস কখনও থামেওনা এখানে। হামাগুড়ি দিয়ে হলেও চলে। এমনকি মহিলা ¤্রমিকদেরও নামতে হয় বাসের র‌্যাকে মালপত্র রাখার মত নিজ দায়িত্বে।

কারখানার গেটে লম্বা লাইনটা ছোট হতে হতে তাহেরকে পৌছে দেয় নিরাপত্তা কর্মীর কাছে। সে ডান হাতে তাহেরকে বের করে আনে মরা চাল বাছাইয়ের মত। দাড় করিয়ে রাখে অন্য কারও না আসা পর্যন্ত। আরেকজন নিরাপত্তা কর্মী এসে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয় তাহেরের হাতে। বলল ”কালকে জয়েনিং। সী ট্রাকের সময় এখনও আছে। লক্ষীপুর গিয়ে চিটাগং হয়ে সোজা কক্্র’সবাজার। কাল যেকোন সময় জয়েনিং নিতে মালিকের বলা আছে”।

তহেরের চিৎকার করে কাউকে শোণাতে ইচ্ছে করল তার ¯^প্নের কথা-বোনের বিয়ের কথা। পরক্ষনেই মনে হল তার কোন ¯^প্ন থাকতে নেই কারন সে শ্রমিক। শষার উপর একটা মৃত উকুঁন! যার বাম হাতে ¯^প্নের ব্যাগে নেল পলিস, আলতা, ক্রিম, পাউডার আর ডান হাতে ¯^প্নের মৃত্যু বার্তা।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Mim Masqur উপমাগুলও যেন ধারাল পাতের মতো কেটে কেটে বসিয়েছে প্রযোজ্যতাকে :) ভাল লাগল। অভিনন্দন :)
নাসরিন চৌধুরী লেখা ভেঙ্গে যাওয়ায় পড়তে বিরক্ত লেগেছিল। কিন্তু লেখা ভাল হয়েছে। শুভেচ্ছা জানবেন।
জুন ভালো ছিল। বিশেষ করে শিরোনামটা চমতকার। শুভ কামনা রইলো।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল ।
সোহানুজ্জামান মেহরান অনেক ভাল হয়েছে গল্পটি,শুভকামনা এবং ভোট রইলো।আমার প্রথম লেখা কবিতাটি সময় করে পড়বেন।

১০ এপ্রিল - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ৭ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.৫৩

বিচারক স্কোরঃ ৩.৭৩ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ১.৮ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪