আট বছর বয়সী ইব্রাহিম কিছুতেই গৃহযুদ্ধ ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তাকেও মা বাবার সাথে চলে যেতে হয়েছিল পাশের দেশটিতে। ইব্রাহিম সেখানকার মানুষগুলোর ককেশীয় চামড়া আর নীল চোখের মাঝে নিজেদের কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। রোদে পোড়া জলপাই চামড়ায় নিজেকে মনে হচ্ছিল একটা বাবলা কাটা।
ভিনদেশী মানুষগুলোর মুখের ভাষাও ইব্রাহিমের মাথায় আসছিল না। কিন্তু তাদের শব্দহীন ভাষা যা ছিল হাসিতে, চোখে আর কড়তলে লুকনো তা ইব্রাহিমের মনে গেঁথেছিল মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।
দেশটিতে ঢুকতেই প্রথম যে তাদের স্বাগত জানিয়ে ছিল সে ইব্রাহিমের সমবয়সী আব্রাহাম। আব্রাহামের হাতের গোলাপটি ছিল ঘ্রানহিন আর পাপড়ি গুলোছিল ষাটোর্ধ বৃদ্ধার ভাঁজ পরা চামড়ার মত নেতানো। ইব্রাহিমের নিজ বাগানের গোলাপগুলোর কথা মনে পড়তেই হাসি পাচ্ছিল কিন্তু সে হাসতে পারছিল না। কারন সে এক ধরণের শান্তি অনুভব করেছিল, যা থাকে শান্ত শাপলার জলে কুয়াশার খেলায় আর বাঘহীণ জঙ্গলে হরিণের।
সৌন্দর্যের শান্তি।
নির্ভয়ের শান্তি।
ইব্রাহিমদের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়নি। তারা ঠাই পেয়েছিল আব্রাহামদের বাড়িতে। ভিন্ন দেশ কিন্তু পাশাপাশি গ্রাম হওয়ায় ইব্রাহিমের বাবা আব্রাহামদের ভাষার কিছুটা জানতেন। আর আব্রাহামদের দিগন্ত ছোঁয়া শস্য ক্ষেতের পরিচর্যার জন্যও লোকের প্রয়োজন ছিল।
আব্রাহামদের বাড়িতে উঠেই ইব্রাহিম বুঝতে পেড়েছিল এখানে ফুলের চাষ হয়না। আর আব্রাহাম তাকে যে গোলাপটি দিয়েছিল সেটি সংগ্রহ করেছিল দূরবর্তী শহরের ফুলের দোকান থেকে। ইব্রাহিম তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল আব্রাহামকে সে তার বাগানের শ্রেষ্ঠ গোলাপ গাছটি উপহার দেবে, সাথে গাঁদা ফুলের বীজও।
মাস তিনেকের মধ্যে গৃহযুদ্ধ থেমে যায়। এই সময়ের মধ্যে ইব্রাহিম ও আব্রাহামের মধ্যে ভাষা-সংস্কৃতি আর ধর্মীও জ্ঞানের বিনিময় ঘটে। বিদায় নেয়ার সময় তারা প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয় প্রতি দুই মাস পর পর একে অপরের সাথে মিলিত হবে। আর প্রথম ধাপ হিসেবে ইব্রাহিম তাদের বাড়িতে আব্রাহামকে নিমন্ত্রন জানায়।
ইব্রাহিমদের দেশে নতুন সরকার গঠিত হল। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে তারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মজবুত কাটা তারের বেড়া নির্মাণ করলো। গোপনে ভূ-মাইন পুতে রাখল।বন্ধু প্রতিম দেশটির সীমান্তও বাদ দিল না।
সীমান্তের ভয়াবহতার ব্যপারটা পরিবারের পক্ষ থেকে ইব্রাহিমকে বুঝানো হল এবং বার বার সতর্ক করে দেয়া হল। মা বাবার বাঁধা সত্ত্বেও ইব্রাহিম দূর থেকে প্রতিদিন লক্ষ্য রাখত সীমান্ত রক্ষীরা কোন পথে হাটে। সে আবিস্কার করতে চাইল একটি পথ যে পথে আব্রাহামকে তাদের দেশে নিয়ে আসা যায়। দুর্ভাগ্য বশতকয়েক সপ্তাহের প্রচেষ্টায়ও সে পথ আবিষ্কারে ব্যর্থ হল।
তাই যেদিন দুজন একত্রিত হওয়ার জন্য কাঁটা তাঁরের কাছা কাছি এল ইব্রাহিম আব্রাহামকে নিজ দেশে আনার কোন উপায় খুজে পেল না। আব্রাহামকে তার বয়ে আনা টবের গোলাপ গাছটি দেখাল। যেটাতে দুটো ফুল ফুটে আছে। সে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। বুঝাতে চাইল কেঁচোর মত মাটি খুড়েও আব্রাহামের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয় কারন ভূমিতে মাইন পুঁতে রাখা আছে।
আব্রাহাম টবের গোলাপ গাছ আর বীজ ভর্তি টিনের জার সহ ইব্রাহিমকে ভণ্ড আর প্রতারকের বাইরে কিছু ভাবতে পারল না। সে পৃথিবীর দুঃখী মানুষদের একজন হয়ে ফিরতে লাগল।
ইব্রাহিম বুঝতে পাড়ল সে কি হারাতে যাচ্ছে- একজন ভিনদেশী । দুঃসময়ের এক বন্ধু। একটা ছায়া।যে জানে কিভাবে ভালবাসতে হয়।
ইব্রাহিম চোখ বন্ধ করল। অনুভব করল অবিশ্বাস।
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল কারন আব্রাহাম বুঝতে শিখবে ভালবাসার প্রতিদানে কিভাবে চরম অবহেলা নিয়ে ফিরতে হয়। অবিশ্বাস নিয়ে কোন জাতির বেড়ে ওঠাকে ইব্রাহিম মেনে নিতে পারলো না। আর কোন ভাবেই নিজেকে প্রতারক হিসাবেও মানতে চাইল না।
সে জারে রাখা বিশেষ কায়দায়পাথড়ে আটকানো ছোট ছোট থলে গুলোকে উপড়ে ছুড়তে লাগল।পাথড় থলেকে হাওয়ায় উড়াল যতটুকু পারা যায়।থলে খুলে বীজগুলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। কোন নির্ধারিত ভৌগলিক সীমারেখাই বীজগুলোকে একক ভাবে আটকাতে পাড়ল না। আর একটার পর একটা পাথড় নিচে নেমে আসছিল খুব ভয়ঙ্কর ভাবে যেন ছোট্ট ইঁদুর ধরতে আসা হিংস্র থাবার ঈগল। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। কালি মাখা ইব্রাহিমের মুখে হাসির আভা। সে প্রমান করতে পেরেছে মিথ্যে বলেনি। দুর্ভাগ্য বশত তখন সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের কেউ ছিল না।
দুই মাস পরে কাঁটা তাঁরের বেড়ার এপার - ওপারে হলুদ গাঁদা ফুলের সমুদ্র।একটা স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে সাদা স্টোনে লেখা-
“ এটা শিশু ইব্রাহিমের কবর। যে বৃক্ষটিতে ফুল ফোঁটার আগেই উপড়ে ফেলা হয়েছে।“
সীমান্তে দু দেশের পতাকা বৈঠক। ভূ-মাইন অপসারণ------
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।