বীণা

বৈরিতা (জুন ২০১৫)

এস আহমেদ লিটন
  • ৪৬
বীণা সাত আট বছর বয়স থেকে জোয়ার্দার বাড়ি কাজ করে। সকাল থেকে গভীর রাত অব্দী কাজের বিনিময়ে আধা পেট ভাত আর দুখানা পুরাতন কাপুড় পায়! অধিকাংশ সময় বাসি বা আঁচড়া ভাত তরকারি ক্ষেতে হয়। পান থেকে চূন খসলে বকার অভাব নেই। গায়ে হাত তুলতেও অনেকের বাঁধে না। বাড়ির ছোট বড় সবায় যেন একই শিক্ষায় শিক্ষিত। সবার রক্ত গরম এই একজনের উপরে। প্রত্যকের ব্যক্তিগত কাপুড়, সকালের কাপুড়, যাবতীয় জিনিস ধুতে হয়, লন্ড্রি করতে হয়, রান্না-বান্না গৃহস্থলীর কাজের কোন শেষ নেই। তবে মাঝে মধ্যে মাছ মাংস থাকলে চুরি করে দু এক পিচ খেয়ে নেয়। খাবেই বা না কেন? এত খাটুনির পরও নিজ হাতে কেটেকুটে রান্না-বান্না করার পরও নিজের ভাগ্যে জোটে না বললেই চলে। তবে কখনো কখনো উটকো লোকজন বা কুকুর বিড়ালে খেলেও দোষ কাজের মেয়ের কাঁধে চাপে। এর জন্য মাঝে মাঝে দু চারটে চর থাপ্পর খেতে হয়। এগুলো আমাদের সমাজের নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। ইদানীং জোয়ার্দার সাহেব রাগারাগী বা বকাবকী করে না। একটু ভাল কাপুড় কিনে দেয়। বেশ ভালও বাসে। এতদিনে বীণার বয়স চৌদ্দ পার হয়ে পনরই পড়ছে। চেহারা খারাপ না। কাজের মেয়ে হলে মোটামুটি ভালই। আর পাঁচ জনের সাথে মিশে যায় তবে স্নো পাউডার ক্রিম মাখলে বেশ ভাল লাগে। এতদিন কাজ না থাকলে জোয়ার্দার আর ওনার স্ত্রী তানজিলা বেগমের হাত পা টিপে দিত, এমন কি মাজা থেকে নিচের অংশে পর্যন্ত। বেশ মজা লাগত। এখনো জোয়ার্দার সাহেবের হাত পা টিপে দেয় তবে যতটা সম্ভব স্ত্রীর আড়ালে কেননা স্ত্রী এখন আর আগের মত এসব ভাল চোখে দেখে না। মেয়েটও নাকি বেশ ডাগর হয়ে উঠছে, এ সময় স্বামী থেকে একটু দূরে রাখা মঙ্গল মনে করছেন। তাই স্ত্রী বাইরে গেলে পুরা শরীর ম্যাসাজ করিয়ে নেয়। বেশ ভালও লাগে। তাছাড়া বীণা এখন জোয়ার্দার সাহেবের ঘরে ঘুময় কেননা ছেলে মেয়ে দুটো বড় হওয়া এক সাথে থাকতে দিতে তানজিলা বেগম মন সাই দেয় না। ফলে উপায়ান্তর না দেখে নিজের ঘরে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার নিজেও বেশ কিছুটা অসুস্থ তাই মেয়েটি তাড়িও দিতে পারছেন না।জোয়ারেজার সাহেবের বয়স ৪৫ আর স্ত্রীর ৪০ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সের স্বামী-স্ত্রীর রুমে ১৫ বছরের একটা মেয়ে রাখা ঠিক না তা তানজিলা বেগম জানে কিন্তু কিছু করার নেই। ওদিকে ছেলে উনিশে পড়ছে, তাই ছেলের কথা চিন্তা করেই নিজের রুমে রেখেছে। মাঝে মাঝে জোয়ার্দার সাহেব বীণাকে জিজ্ঞাসা করে গভীর রাতে তোর ঘুম ভাঙ্গে কি না। বীণা প্রায় সবসময় চুপ থাকে কোন উত্তর দিতে চাই না তবু জোয়ার্দার সাহেব নাছরবান্দা শুনতেই হবে। এসব কথায় বীণা লজ্জায় যেন লাল হয়ে যায়। এই শুনতে চাওয়া নিজেরা সতর্ক হওয়ার জন্য নয় একটু ফ্রি হতে চাওয়া।ঘুসঘাস শব্দ ফিসফিস কথা বলা, তাছাড়া তানজিলা বেগম অসুস্থ থাকাতে স্বামীর চাহিদা পুরাপুরি মেটাতে পারে না এসব বিষয় নিয়েও বেশ কথা হয়। তাই গভীর রাতে যে ওর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে তা দুজনই জানে। জোয়ার্দার সাহেব এসব কথা বলে কাজের মেয়ের সাথে একটু ফ্রি করতে চাই। কিছু একটা বুঝাতে চাই। বীণা সব বুঝেও না বুঝার ভান করে যতটা সম্ভব দূরে থাকে! কাজের মানুষের উপর প্রভাব খাটানো, সুযোগ নেয়া খুব সহজ! আর বীণা বড় অসহায়।অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়ার চেষ্টা তো করবেই।


তানজিলা বেগম বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাবে। বেশ কয়েক বছর যাওয়া হয় না। তাই কয়টা দিন বেশি থাকতে হবে। গ্রীষ্মের ছুটি পেয়েছে ছেলে মেয়েরা। মামা বাড়ির আম কাঁঠালের যে মজা। তাই ছেলে মেয়েরা বায়না ধরেছে মামা বাড়ি যাবে। যাওয়ার আগে তানজিলা বেগম জোয়ার্দার সাহেবকে বিভিন্ন আদেশ উপদেশ দিয়ে বলে, "ঠিক মত খাওয়া দাওয়া কর, শরীরের যত্ন নিও, আর বীণাকে ক' দিনের জন্য আজই বাড়িতে পাঠিয়ে দাও।"
তানজিলা বেগম মনে মনে ভাবে ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে তারপর যাওয়া উচিত ছিল। বীণাকেও বলে, "আজি কিন্তু চলে যাবি।" জোয়ার্দার সাহেব হু, হ্যা বলে সবাইকে নিয়ে স্টান্ডে এসে গাড়িতে তুলে দিয়ে বাসায় ফিরে আসে। এদিকে বীণাও কাপুড় গুছিয়ে নিয়েছে কিন্তু জোয়ার্দার সাহেবের কাজের ব্যস্ততা আছে তাই আজ যেতে পারবে না, সম্ভব হলে কাল সকালে গিয়ে দিয়ে আসবে। বীণা এতে বেশ চিন্তায় পরে গেল। খালাম্মা বাসায় নেই, একা থাকতে হবে। খালুজান আসে অনেক রাত করে। খালুজান পুরুষ মানুষ। আবার নিজেই ভাবে, খালু বলে ডাকি, বয়স্ক মানুষ, অসুবিধা নেই।
জোয়ার্দার সাহেব কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বের হয়ে গেছে কখন আসবে তার কোন ইয়োত্তা নেই। প্রতিদিনের রুটিন গভীর রাতে বাসায় ফিরা। আজ একটু আগেই চলে এসেছে, সাথে দুটি শাড়ি আর কিছু স্নো পাউডার। এই গুলো বীণার হাতে দিয়ে বলল, "যা ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়ত দেখি কেমন মানায়।" বীণা যেন আকাশ থেকে পড়ল। দু দুটো শাড়ি। তাও এই প্রথম, এর আগে কখনো শাড়ি পড়ে নি। মেয়ের পুরনো সেলোয়ার কামিজ দিয়েই চলছে।হাত মুখ ধুয়ে পড়তে যাবে এখন দেখে ব্লাউজ নেই। খালুজানের কাছে এসে বলল, "খালু খালুজান ব্লাউজ নেই"
জোয়ার্দার সাহেব বলল, "আচ্ছা ওভাবেই পড়ে আয়।"
সবে মাত্র শরীর গড়ে উঠছে! কাজের মেয়ে হলেও চেহারা বেশ সুন্দর। অগোছাল, অপরিপাটি থাকে বলে খুব সুন্দর দেখায় না তাছাড়া সারাদিন কাজে থাকে, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত হয় না। তাই চেহারায় তেমন আকর্ষণ ভেসে উঠে না! আজ বেশ পরিপাটি লাগছে, মাজার নিচে নেমে আসা চুল নিজেই বেনী করেছে!
জোয়ার্দার সাহেব বলল, খেয়েছিস?
বীণা জবাব দেয়, "না খাই নি, আপনার ভাত টেবিলে আছে খেয়ে নিন! আমি পরে খাব।"
:পরে কেন, এখনি খেয়ে নিতি!
বীণা কোন উত্তর না করে চুপ করে থাকে।
জোয়ার্দার সাহেব ক্ষেতে বসলে বীণা এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে আর গায়ের কাপুড় ঠিক করছে। আগে কখনো শাড়ি পড়ে নি, তারপর ব্লাউজ নেই। তাই একটু সতর্ক থাকতে হচ্ছে। তাই বেশ ইতস্ততবোধ করছে। জোয়ার্দার সাহেব বেশ ইনজয় করছে। ব্যাকা চোখে মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে। আর এক সময় বীণাকে বলে উঠে, তুই বেশ বড় হয়ে গেছিসরে বীণা।"
বীণা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।



বীণা জোয়ার্দার সাহেবের বেড গুছিয়ে দেয়। বেডে বসে বীণাকে বলে, যা একটা পান বানিয়ে নিয়ে আয়। একটা পান দিয়ে জোয়ার্দার সাহেবের মন ভরে না, বড় বড় দুটো পান লাগে। কালো আর তাগরা জোয়ান লোকটা। গায়ে শক্তিও যেন অসুরের মত। পান খেতে খেতে এ গল্প সে গল্প শুরু করে। এদিকে রাতও বেশ হয়েছে। বীণা নিজের বেড গুছিয়ে অন্য রুমে যেতে গেলে জোয়ার্দার সাহেব বাঁধা দিয়ে বলল, "একা একা কোথায় শুবি, ওখানেই শুয়ে পর।" বীণার যেন বুক কেপে উঠে কিন্তু কিছু বলার নেই। কোন শব্দ না করে নিজের বেড ঠিক করে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম হল না। বেশ কিছু সময় পর জোয়ার্দার সাব ডাকে, "বীণা, ও বীনা, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?"
বীণা আর বুঝতে বাকি রইল না। ভয়ে বুক কেপে উঠে, বেশ কয়েকটা ডাক দেয়ার পর উত্তর নিল, "জ্বী খালুজান।"
:বেশ মাথা ধরেছে, একটু টিপে দিবি।
বীণা শিয়োরে দাড়িয়ে মাথা টিপে দিতে শুরু করল। জোয়ার্দার সাহেব বলল, "বসে শরীরটাও মেসেজ করে দে, অনেক দিন দিস না।"
বীণা সরিষার তেল নিয়ে এসে জোয়ার্দারের শরীরে ঘোষতে শুরু করে। বীণার মুখ যেন কাল আঁধারে ঢেকে গেছে! মেসেজ কিভাবে করতে হয় তা আগেই জানে। কিন্তু আগের মেসেজ আর আজকের মেসেজ যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সারা শরীর, পা, উরু সব জায়গা ঘোষতে হয়। এদিকে কথার ফুলঝুরি ছুটছে জোয়ার্দার সাহেবের মুখে। কামনাও জেগে উঠে। আর পানের গন্ধে যেন নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে বীণার। লজ্জায় মুখ ঢেকে নেয় শাড়ির আঁচল দিয়ে। জোয়ার্দার সাহেব আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় পিঠে। আতংকে কেঁপে উঠলেও কিছুই বলতে পারে না। ভয়ে ভিতরটা কুকরে যায়। এক সময় বুকের কাছে নিয়ে নেয়। বীণা বলে উঠে, " খালুজান!" মুখের কাছে টেনে নিয়ে চুমু দেয়। পানের পিক ঠোঁটে, মুখে লেগে যায়। গন্ধে যেন বমি আসছে! বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নব্বই কেজি ওজনের শরীরের নীচে বীণা যেন বড় অসহায়। নিজের হাত পা নাড়ান ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। অসুরের মত যেন বিধ্বস্ত করে দিল ক্ষনিকের মধ্যেই। নিজের অসহায়ত্বের আর্তচিৎকার মিশে গেল বাতাসে। নিস্তব্ধ হয়ে যায় সব! যত হাসি, যত কান্না, যত স্বপ্ন এক নিমিষেই সব শেষ হয়ে যায়। যাকে খালু বলে সম্বোধন করে, বাবার মত শ্রদ্ধা করে, তার কাছে এভাবে নিজের অস্তিত্ব বিলীন হবে তা ছিল কল্পনাতীত। এ যেন কল্পনাকেও হার মানায়! মনুষত্ব্যের মাঝে পশুর হিংস্র থাবায় সব শেষ হয়ে যাবে কা জানত।


বীণা ঘুম থেকে উঠে দেখে বেশ বেলা হয়ে গেছে। খালুজানের বেডেই শুয়ে আছে, পাশেই নাক ডেকে, নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে। সারা শরীর ব্যাথা, কোমরে যেন আরো বেশি ব্যাথা। পা দুটো যেন নড়াতেই পারছে না। একবার উঠে যেতে গিয়েও পারে না। অস্বস্তি স্বত্তেও শুয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ।
এদিকে জোয়ার্দার সাহেব উঠে গোসল সেরে কিছু শুকনা নাস্তা করে বের হয়ে গেল। কয়েকবার বীণা বীণা বলে ডেকেছে অবশ্য। কিন্তু বীণা কোন জবাব দেয় নি। আরো কিছু সময় পর উঠে বাথরুম সেরে বেশ লম্বা সময় নিয়ে গোসল করে। নাস্তা আর করা হয় না। এখন কি করবে ভাবতে শুরু করে। বাড়িতে চলে যাবে কি না? কাকে বলবে, আপন বলে তো কেউ নেই। এক মা আছে তাও অসুস্থ। কাউকে বললে নিজেকেই সবাই খারাপ বলবে, ছি: ছি: করবে। মাকে বললে আরো কষ্ট পাবে। মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখা ছাড়া কোন গতান্তর নেই। এই মুহূর্তে একা গেলে নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে! অনেক ভেবে চিন্তে বাসা থেকে আর বের হওয়া হয় না।
জোয়ার্দার সাহেব আবারও বেশ কিছু জিনিস কিনে নিয়ে এসেছেন বীণাকে খুশি করতে, জিনিসগুলো বীণার হাতে দিলেও তাকিয়েও দেখে না। অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করলেও একটা কথাও বের হয় না, গম্ভীর মুখে বসে থাকে বীণা। অনেক বুঝিয়ে রাতে কিছু খাওয়ালেন। কিন্তু বীণাকে নিজের বেডে রেখে দিলেন। এতে বীণা ভয়ে আবারো কুকড়ে যায়। এখনো পুরা শরীর ব্যাথা, হাঁটতে পারছে না, তার উপর নতুন করে.......! ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। অসহাত্বের করুন পরিণতিতে আবার পতিত। এভাবেই চলতে থাকল রাতের পর রাত। সব থেকে অবাক করা বিষয় যে, এত কিছুর পরও জোয়ার্দার সাহেবের আচার ব্যবহার যেন কিছুই ঘটে নি। সব কিছু স্বাভাবিক, চোখে মুখে অপরাধের কোন ছায়া নেই।

দশ বার দিন কেটে গেলো। তানজিলা বেগমের ফিরে আসার সময় হয়েছে। বীণার শরীরেও বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছে! নব্য বিবাহীত মেয়েদের যেমন শরীর পরিবর্তন দেখা দেয়। তানজিলা বেগম আসার আগেই বীণাকে তার বাড়িতে দিয়ে আসে।


একে একে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। তানজিলা বেগম বারবার বীণাকে নিয়ে আসার কথা বললেও জোয়ার্দার সাহেব সে কথা কানে তুলে না, একথা সেকথা বলে কাটিয়ে দেয়। অনেক পিড়াপিড়িতে অবশেষে যেতেই হল। কিন্তু গিয়ে দেখে ওদিকে আরেক কান্ড ঘটে গেছে। বীণা প্রায়ই বমি করে, খেতে পারে না, বেশ অসুস্থ। জোয়ার্দার সাহেবের আর বুঝতে বাকি রইল না কি ঘটেছে। দ্রুত বীণাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে, হসপিটাল থেকে ক্লিনিক, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা। এ টেস্ট সে টেস্ট! কোন কাজ হল না! বড্ড দেরি হয়ে গেছে, পেটে বাচ্চা বেশ বড় হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে কোন সিদ্ধান্তে গেলে মা মারা যেতে পারে, তাই এবোর্শনের রিস্ক নিতে কোন ডাক্তার রাজি নয়। অনেক টাকা পয়সার লোভও কোন কাজ হয় না। অবশেষে ঢাকায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বীণাকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে নিজে বাড়িতে ফিরে আসে। জোয়ার্দার সাহেব বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বড় অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও এক মুঠো ভাত খায়। স্বামীর আকর্ষিক পরিবর্তন দেখে তানজিলা বেগম বার বার জিজ্ঞাসা করলেও কোন জবাব দেয় না। রাতেও ঘুম হয় না। তানজিলা বেগমও বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন স্বামীর এ অবস্থা দেখে, কিন্তু কোন কথা মুখ দিয়ে বের করতে পারলেন না!

এদিকে বীণা আর তার মা সারা দিন কেঁদে কেঁটে একাকার করে ফেলে। কখনো মেয়েকে বকে, কখনো নাম বলতে বলে যে কে তার সর্বনাশ করেছে, কিন্তু মেয়েটা বড় মাড়ি আঁটা কোন কথায় বলে না! পাড়া প্রতিবেশীরা ছি: ছি: করে যাচ্ছে! ক্ষোভে দুঃখে বীণা যেন সুইসাইড করতে মন চাচ্ছে, আবার ভাবে আমি কেন সুইসাইড করব? আমার কি দোষ? কিন্তু বাচ্চার সমাজে কি পরিচয়? কে বাবা? না আর ভাবতে পারছে না কান্না চলে আসে। ইতোমধ্য ঢাকায় বড় ডাক্তার দেখানো হয়েছে কোন কাজ হয় নি। এখন বাচ্চা জন্ম দেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। অসুস্থ মা রাতদিন চিল্লাতে থাকে আর বকতে থাকে।
গতান্তর না দেখে জোয়ার্দার সাহেব, নিয়মিত সাংসারিক খরচ দিতে থাকে। নইলে নাম বললে অনেক প্রব্লেম হবে। সামাজিক ও সাংসারিক জীবনে ভয়াভয় দুর্যোগ নেমে আসবে!
এভাবে কেটে গেল আরো কয়েক মাস! এক সময় জন্ম নিল একটি ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। জোয়ার্দার সাহেব মেয়ে মেরে ফেলতে চায়লেও বীণা রাজী নয়। কোনভাবেই বীণাকে আর রাজী করান গেল না! এতদিন জোয়ার্দারের মুখের উপর কোন কথা না বললেও এখন দুই একটা বলতে শুরু করছে বীণা। সন্তানের বাবার পরিচয় দিতে জোয়ার্দার সাহেব কোনভাবেই রাজী নয়। সংসারের যাবতীয় খরচ দিবে পরিচয় দিবে না। এই নিয়ে সামাজিক বিচার বসেছে, সেখানে কোন নাম না বলায়, জোয়ার্দার সাহেবের কোন বিচার করা যায় নি। যদিও বীণা জানে বলেও কোন লাভ নেই। সব কিছুই এদের হাতের মুটোই, যদি খরচের টাকা না দেয়, এই ভেবে নাম বলে না কিন্তু সে খরচটাও বেশিদিন দেয় না। বছর যেতে না যেতেই খরচও বন্ধ।



বাবার নাম না থাকায় সরকারি নতিতে নাম অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব হয় নি। ছোট্ট খুকি দিনে বড় হতে থাকে। বীণা নাম দিয়েছে বন্যা। বন্যা এখন স্কুলে যায়। স্কুলেও বাবার নাম দেয়া হয় নি, মায়ের নামেই পরিচিত। প্রায় স্কুলের অন্য বাচ্চার বাস্টার্ড বা জারজ বলে গালি দেয়, ওর সাথে কেউ মিশতে চায় না। বন্যা সেদিন মায়ের কাছে প্রশ্ন করে বসে, "মা মা বাস্টার্ড মানে কি?" সবায় আমাকে বাস্টার্ড বলে কেন? জান মা আমার সাথে কেউ মিশতে চাই না! খেলাও করে না! কেন মা? আমি কি দোষ করেছি? এ কথায় যেন বীণার বুক ফেটে যায়। ক্ষণিকের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যায়। আবার যেন বুকে ঝড় উঠে! মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাচ্চাটি চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, "আর কেঁদ না মা, আমি আর কখ্খনো এই কথা বলব না! চুপ কর না মা, তুমি কাঁদলে আমারো কান্না আসে!"
বীণা বলে, না মা তুই কোন দোষ করিস নি। ওদের কথায় কান দিস না! লেখা পড়া ঠিক মত কর, ভাল রেজাল্ট করলে ওরা আর কিছু বলবে না। আর মনে মনে ভাবে সত্যি তো, বাচ্চার কি দোষ? দোষ যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে ওর বাবা মায়ের! ও কেন দোষী হবে? সারা জীবন কেন এর দায়ভার বয়ে বেড়াবে? কেন বা সব জায়গা বাবার নাম লাগবে? আমি কি ওর কেউ না? কে দেবে এই প্রশ্নের জবাব?

এই যুগেও সরকারের খাতায় নাম বিহীন একটি মেয়ে বেড়ে উঠছে! সামাজিক অনাচার অত্যাচার সহ্য করে! এই কোঁচি মুখটা যেন সমাজের অনাচারের মূল কারন! যাত্রাকালে দেখলে হয় অযাত্রা! সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেই দিনটা হয় অশুভ! যেমন সমাজের অনাচার কুসংস্কারের শিকার, এক ঘরে হয়ে থাকতে হয়! তেমনি সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত! এভাবে লড়াই করেই বেড়ে উঠছিল মেয়েটি! শত বাঁধা উপেক্ষা করে, বঞ্চনা-গঞ্জনা তুচ্ছ করে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল! তখন আবারও শক্ত দেয়াল হয়ে দাড়াল ঐ সরকারি নিয়ম নীতি। এস এস সি পরীক্ষার জন্য নাম রেজিস্ট্রি করবে। কিন্তু ফর্ম পূরণ করতে বাবার নাম লাগবে। বন্যা কোন অবস্থায় বাবার নাম লিখতে রাজি নয়। টিচাররাও বাবার ঘর শুন্য রেখে জমা নিতে পারছে না। বিষয়টি বেশ কিছু জাতীয় পত্রিকায় এলেও কোন সুরাহা হয় নি। আর সুরাহা হয় নি বলেই এখনো ডাস্টবিনে, পয়:নিষ্কাশনের লাইনে, শুনতে পাই শিশুর কান্না! সে কান্নার করুন সুর আজও বেঁজে উঠে নি সমাজ কিম্বা সরকারের কর্ণ কুহরে!! আজও বোঝে নি ওরা, প্রতিটি সন্তান জন্ম নেয় একজন মানুষ হিসেবে, মনুষ্য সন্তান হিসেবে! জন্ম পরিচয় মুখ্য নয়, জন্মই মুখ্য!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপস চট্টোপাধ্যায় খুব ভালো লাগলো . আমার পাতায় আমন্ত্রণ .
শামীম খান পাকা হাতের লেখা । ভাল লাগলো । শুভ কামনা আর ভোট রইল ।
Fahmida Bari Bipu এই সমাজের আনাচে কানাচে কত যে ঘটছে এমন অমানবিক, নোংরা ঘটনা তার ইয়ত্তা নাই। আপনার লেখা ভাল লাগল। লেখাটি পাঠানোর আগে কয়েকবার রিভিশন দিয়ে নিলে ভাল হয়। ছোটখাট বানান ভুল অনেকসময় প্রথমবার ধরা পড়ে না। শুভকামনা এবং ভোট রইল।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।

০২ এপ্রিল - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪