আমাদের এই জগত সংসারে মানুষে-মানুষে গভীর ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব যেমন আছে তেমনি দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ
আর বৈরিতা এসবেরও যেন কমতি নেই । এই বৈরিতা হতে পারে ব্যক্তিস্বার্থে, আবার হতে পারে মতপার্থ্ক্য ও আদর্শগত বিরোধ । কখনো কখনো দেখা যায় এ বৈরিতা শুধু মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না , বরং প্রকৃতিও যেন মানুষের সাথে চরম বৈরি আচরণ করে থাকে । ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৈরি সম্পর্ক যেমন লক্ষণীয় , তেমনি আবার
গোষ্ঠীগত বৈরিতা এবং জাতিগত বৈরিতাও আমরা দেখতে পাই । তাইতো দেশে-দেশে যুদ্ধ, বিদ্রোহ এইসব প্রায়শই সংঘটিত হতে দেখি ।
সুখ-দুঃখ, সাফল্য-ব্যর্থতা , আনন্দ- বেদনা এ সবই আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । জীবন সংগ্রামে সাফল্যের ছোঁয়ায় আমরা যেমন আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠি , অন্যদিকে আবার সামান্য ব্যর্থতায় যেন নিরাশ হয়ে পড়ি । বারবার ব্যর্থতার দেখায় আমরা এতটাই হতাশ হয়ে পড়ি, এতটাই মন ভেঙ্গে যায়, যেন আমাদের দ্বারা এই জগতে কিছুই সম্ভবপর নয় !
তবে জীবন সংগ্রামে ব্যর্থতার জন্য আমরা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু না দায়ী, তার চেয়ে অনেক গুন বেশি দায়ী আমাদের চারপাশের বৈরি পরিবেশ, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা , আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ।
দ্বন্দ্ব-বৈষম্য এসব যেন আমাদের সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক চিত্র । যার যার অবস্থান থেকে আমরা প্রত্যেকেই যেন অনেক বেশি স্বার্থপর । নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত হরণ করতে আমাদের বিবেকে বাধে না । অন্যের প্রাপ্য অধিকার কেড়ে নিয়ে নিজের সাফল্যের পাল্লা ভারী করতেই আমরা খুব বেশি অভ্যস্ত । উপায় যাই হোক না কেন, আমাদের কাছে বাহ্যিক সাফল্যটাই যেন মুখ্য বিষয় । এই সমাজ ব্যবস্থা আমাদের শেখায়, অন্যকে ঠকিয়ে কিভাবে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করা যায়, অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে কিভাবে নিজে বড় হওয়া যায় ।
তাইতো দেখা যায়, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষ কোন না কোন ভাবে বৈরিতার শিকার ।
কারো ক্ষেত্রে হয়তো সেটি সামাজিক বৈরিতা, কারো ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক আবার কেউ বা রাজনৈতিক
বৈরিতার শিকার । আমাদের সমাজে পুজিপতি মালিক শ্রেনী যেমন তাদের শ্রমিকের সাথে বৈরি আচরণ করেন, তেমনি রাজনীতিবিদরাও দেশের জনগণের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন । আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর
কর্মসুচি ও পারস্পরিক আচার-আচরণ দেখলে সহজেই অনুধাবন করা যায় তাদের মধ্যে কতটা বৈরি
সম্পর্ক বিরাজমান । আর তাদের এই বৈরিতার প্রভাব পড়ছে দেশ ও দেশের সাধারণ জনগণের উপর ।
দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন কানুনের কোন রকম তোয়াক্কা না করে বরং তাদের নিজেদের স্বার্থে
তারা যা খুশি তাই করে থাকেন ।
ফলে দেখা যায় ,আমাদের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতা রাত-দিন ঘাম ঝরানো কঠোর পরিশ্রম করেও
তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে , আন্যদিকে কেউ এসি রুমে বসে থেকে রাষ্ট্রের টাকায়
অন্যায়-অবৈধ পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ছে । অভিজাত এলাকায় দামি ফ্ল্যাট আর গাড়ী হাঁকাচ্ছে ।
দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য লোকের যেন এ সমাজে কোন ঠাই নেই , অন্যদিকে চারিদিকে শুধু অসৎ- অযোগ্যদের জয়জয়কার । তাদের ক্ষমতার দাপটে সহজ-সরল সাধারণ মানুষগুলো নিজের জানমাল
রক্ষা করে কোন মতে বেঁচে থাকাটাই যেন বড় দায় ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীটি পরিবারের হাল ধরতে সামান্য একটা চাকরীর জন্যে বছরের পর বছর হন্যে হয়ে ঘুরছে ,অন্যদিকে তারই কোন সহপাঠী নানা রকম ছত্রচ্ছায়ায় শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার আগেই অবৈধ পন্থায় কোটিপতি বনে যাচ্ছে । কেউ বা আবার মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে কিংবা বিভিন্ন রকম পরিচয়ে কোনমতে একটা রেজাল্ট নিয়ে বিশেষ বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হচ্ছে । এরাই আবার ঠিক ভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে নানা রকম তোষামুদি ও চাটুকারিতার আশ্রয়ে দেশের বারোটা বাজাচ্ছে ।
সবাই যার যার ধান্দায় ব্যস্ত , এসব ব্যাপারে কথা বলার যেন কেউ নেই ।
সমাজে এক শ্রেনীর মানুষ আছেন যারা প্রতি পদে পদে বৈরিতার শিকার হচ্ছেন । অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মত মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন । ফুটপাতের পরিত্যক্ত বাসি খাবার খেয়ে ফুটপাতেই কোনমতে রাত্রি যাপন করছেন । কখনো কখনো এমন চিত্রও দেখা যায় , প্রচণ্ড ক্ষুধার যন্ত্রণায় একই পরিত্যক্ত খাবার নিয়ে কুকুরের সাথে টানাটানি করছে অসহায় মানব শিশু । এসব দেখার যেন কেউ নেই । আবার এমন অনেকেই আছেন যারা সামান্য একটু আনন্দ-ফুর্তির জন্যে কোটি কটি টাকা নষ্ট করছেন । কারো কাছে আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকা আর বিলাসিতাই যেন জীবনের উদ্দেশ্য, আর কারো জন্যে দু’বেলা দু’ মুঠো খেয়ে কোনমতে বেঁচে থাকাটাই যেন বড় দায় ।
একই স্রষ্টার সৃষ্টি আমরা , একই মায়ের সন্তান । অথচ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নানা রকম বৈষম্য আর বৈরিতার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে । আমাদের এই সমাজে দেখা যায় , কারো সামান্য সর্দি-জ্বর হলেই সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিশ্বের বড় বড় সব হাসপাতালে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, অন্যদিকে কেউ ক্যান্সারের মত মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে মরলেও তার পাশে দাড়ানোর যেন কেউ নেই । এটাই চরম সত্য, এটাই এই সমাজের বাস্তবতা ।
আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি এক ধরনের বৈরি আচরণ করা যায় । পুরুষরা নির্বিঘ্নে সর্বত্র বিচরণ করতে পারলেও নারীদের ক্ষেত্রে রয়েছে হাজারও প্রতিবন্ধকতা । এই সমাজ নারীদের যথার্থ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ।
নারীরা মায়ের জাতি , এ সত্য আমরা সকলেই জানি । কিন্তু কষ্ট পাই তখনই যখন দেখি বর্ষবরণ উৎসবে
আমাদের মা বোনদের আমরা নিজেরাই লাঞ্চিত করছি , প্রকাশ্যে তাদের বস্ত্র হরণ করছি । শুধু তাই নয় কর্মস্থলেও যেন তারা নিরাপদে কাজ করতে পারেন না । নানা রকম লাঞ্চনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারা ।
সত্যের পথে অটল থেকেও কেউ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন , ফেঁসে যাচ্ছেন মিথ্যা মামলায়, মিথ্যা অভিযোগে । অন্যদিকে খুন-হত্যার মত মারাত্মক সব অপরাধের পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ থাকা স্বত্বেও কেউ কেউ আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন । আবার কেউ বা ক্ষমতা আর টাকার জোরে রাতারাতি সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে দিচ্ছেন । একই দেশে একই সমাজে ব্যক্তিভেদে বৈরি আচরণ প্রকাশ পাচ্ছে ।
অর্থ আর ক্ষমতার নিকট ব্যক্তিত্ব আর মনুষ্যত্ব আজ বড় অসহায় । এ সমাজে ভালো কাজের যেমন কোন স্বীকৃতি নেই , তেমনি ভালো মানুষেরও কোন মূল্যায়ন নেই । যারা প্রতিনিয়ত দেশ ও সমাজের কল্যাণের কথা ভাবেন, দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে কাজ করেন । এক কথায়, যারা দেশ ও
দেশের মানুষের জীবন মান উন্নয়নের চিন্তা করেন, এমন দেশপ্রেমিক নিবেদিত প্রাণ মহৎ মানুষদেরই আমরা অবজ্ঞা আর অবহেলা করি । পদে পদে তাদের অপমান-অপদস্ত করি । অন্যদিকে যারা নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছেন, দেশের সম্পদ লুটপাট আর জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন এবং প্রকৃতপক্ষে দেশের ক্ষতি করছেন, দেশের মানুষের অধিকার হরণ করছেন । তাদের আমরা দেবতুল্য মনে করে মাথায় তুলে রাখি । আর সাধারণ মানুষ নিরুপায় হয়ে সব অন্যায়-অপকর্ম মাথা পেতে নিতে বাধ্য হচ্ছে ।
কেননা এ সমাজে অন্যায়ের প্রতিবাধ করাটাও যে অনেক বড় অপরাধের সামিল !
তবে সবচেয়ে বড় আশার কথা হলো আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব । আমাদের বিবেক-বুদ্ধি রয়েছে , সৃষ্টিকর্তা আমাদের ন্যায়-অন্যায় ও ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝার ক্ষমতা দিয়েছেন । অথচ প্রতিনিয়ত আমরা সেই বিবেকের সাথে প্রতারণা করে চলছি , বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেদের অপরাধী করছি । কিন্তু চাইলেই আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে পারি, সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারি ।
নিজেদের জীবনকে খুব সুন্দর করে সাজাতে পারি, গড়ে তুলতে পারি একটি আদর্শ সমাজ ।
আমরা যদি যাবতীয় লোভ-লালসা ও স্বার্থপরতা সংবরণ করে যার যার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হই । রাষ্ট্রের সংবিধান , প্রচলিত আইন কানুন ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজেদের কর্তব্য কর্ম সঠিক ভাবে পালন করি , অন্যের অধিকার হরণ না করি , তবে বৈরিতার স্থলে প্রতিষ্ঠা করতে পারি ভালবাসায় পরিপুর্ণ একটি মানবিক সমাজ । যে সমাজে মানুষে মানুষে গভীর ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক বিরাজ করবে । নারী-পুরুষ, শ্রেনী-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন পাবে । কারো প্রতি কোন প্রকার বৈষম্য কিংবা কারো অধিকার লঙ্ঘন করা হবে না । সত্যকে সত্য বলে গ্রহণ করা হবে এবং মিথ্যাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা হবে ।
ভালো কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন থাকবে আর মন্দ পরিত্যাজ্য হবে ।
সর্বোপরি, এমন একটি আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখি যে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে ।