আসল নাম: বৈরী হাওয়া

বৈরিতা (জুন ২০১৫)

মোহাম্মদ আবুল হোসেন
  • 0
ঠিক যেন বনলতা সেন!
পাখির বাসার মতো ডাগর ডাগর দুটি চোখ। শিল্পীর তুলিতে আঁকা তাতে মসৃণ, নিমেষ ভ্রæ যুগল। সে চোখ দিয়ে কারো দিকে তাকালে তীরের মতো বিঁধে পড়ে। তার তেজে গলে যেতে পারে হিমালয়ের সমস্ত বরফ। গ্রাস করতে পারে ট্রয় নগরী। সে চোখে তাকালেই ভেসে ওঠে আগ্রার তাজমহল। তার চোখের তারায় পিকে’র অচেনা মনে তোলে ঝড়। আর তার চুল! সেতো আষাঢ়ের নিকষ কালো মেঘ। তপ্ত বুকে চাহিবামাত্র নেমে আসে অঝোর ধারা। দূর সবুজ শ্যামল গাঁয়ে বুলিয়ে দেয় পরশ। মা-বাবা ওর নাম দিয়েছেন তুলি। ওর দিকে তাকিয়ে এমন সব অনুভ‚তি সবারই হয় নাকি পিয়াসের কাছেই এমন মনে হয় তা সে জানে না। তবে সে একটা কথাই ভাল করে জানে এ মেয়ের নাম তুলি না রেখে বনলতা রাখাই উচিত ছিল। বনলতা সেন না হোক বনলতা বন্যাও রাখা যেতে পারতো। ওকে তুলি নামে নয় বনলতা নামেই ডাকবে পিয়াস। কিন্ত কি করে বলা যায় ওকে সে কথা!
আজ মনটা ভীষণ উতলা হয়ে উঠেছে পিয়াসের। ভরা বন্যায় পানি যেমন গৃহস্থের ভিটেয় গিয়ে আছড়ে পড়ে বার বার, ঠিক তেমনটি করে পিয়াসের মনে বার বার কেন যেন এক অব্যক্ত, অস্পৃশ্য ভাল লাগা আছড়ে পড়েছে। তুলির ঢেউ খেলানো চুলগুলোতে তার মন হারিয়ে গিয়ে উন্মাতাল ঢেউ খেলছে, কচি ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে গেলে যেমন মনোহারী এক ঢেউ ওঠে, পিয়াসের মনেও সে রকম ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পিয়াস। জানালা দিয়ে তির তির করে ধেয়ে আসছে দক্ষিণা বাতাস। আম গাছের ডালে দুটি ঘুঘু পাখি ভালবাসায় মগ্ন। একজন আরেকজনের পালকের ভিতর ঠোঁট ঢুকিয়ে দিয়ে কি সুন্দর আঁচড়ে দিচ্ছে। অন্য ঘুঘুটি চোখ বন্ধ করে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে। কখনো বা ঠোঁটে ঠোঁটে ঠোঁটাঠুটি করছে। গলায় আদর বুলাচ্ছে। পাখনা উঁচু করে অন্যজনকে ডেকে নিচ্ছে আরও কাছে।
পিয়াস একভাবে তাকিয়ে আছে তুলির দিকে। দৃষ্টিতে আর কিছু নেই এই মুহ‚র্তে। অপলক দেখে যাচ্ছে তুলিকে। বিধাতা এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন ওকে! কই অন্য কোন মেয়েকে দেখে তো ওর এমন মনে হয় না! তুলিকে মনে হয় আলাদা করে সৃষ্টি করেছেন বিধাতা। ওর মাঝে যে লাবণ্য, সৌন্দর্য্য আল্লাহ ঢেলে দিয়েছেন তা আর কারও মাঝে নেই। একবার ইচ্ছে করে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু সাহস হয় না। যদি চিৎকার দেয়। যদি পিয়াসকে সে খারাপ ছেলে ভাবে, এই ভয়ে পিয়াস অনেকদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। আজ ওর কি হয়েছে তা নিজেই জানে না পিয়াস। একদৃষ্টে যখন তাকিয়ে আছে তুলির দিকে তখন বার কয়েক তুলি লক্ষ্য করেছে পিয়াস তার দিকে তাকিয়ে আছে এক মায়াময় চোখে। বিষয়টা লক্ষ্য করে সে নিজের চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তবে তার মনে নানা প্রশ্ন শুরু হয়েছে- পিয়াস আজ তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? তার চোখের ভাষা আজ বুঝতে পারছে না তুলি, কেন? কি বলতে চায় পিয়াস? তার সুঠাম দেহখানার দিকে তাকালে তুলিরও মন স্থির থাকতে পারে না। তার ওপর ক্লিন সেভ। বুকের একটা বোতাম খুলে আছে, সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার লোমশ বুক। হাঁপরের মতো উঠছে আর নামছে। পড়া করতে করতে তুলির চোখের সামনে প্রতিটি অক্ষর হয়ে ওঠে এক একজন পিয়াস। তবে কি সেও পিয়াসকে ভালবাসে! এই যে ভাল লাগা, ভালবাসা এ নিয়ে এখনও মুখ ফুটে কেউ কাউকে বলতে পারে নি। তবে আজ দু’জনের মনেই ঝড়, দমকা হাওয়া। সব কিছু কি উড়িয়ে নিয়ে যাবে সেই ঝড়!
পিয়াস ভাই! আলতো করে দুরু দুরু বুকে ডাকে তুলি।
পিয়াস কথা বলে না। যেভাবে তাকিয়ে ছিল সেভাবেই তাকিয়ে থাকে।
পিয়াস ভাই শুনছেন!
অকস্মাৎ সম্বিত ফিরে পায় পিয়াস। লাইলি মজনুর কল্পিত দুনিয়া থেকে ফিরে আসে বাস্তবে। এ সে কি ভাবছে! তুলি ধনীর মেয়ে। বিশাল প্রতিপত্তি ওর বাপের। ইচ্ছে করলে দু’চার শত পিয়াসকে দিনের ভিতরে কিনে ফেলতে, গায়েব করে দিতে পারেন তুলির পিতা। পরক্ষণেই অন্য কথা মাথায় আসে তার। ধন-মান আর প্রেম তো এক নয়। অর্থ দিয়ে, বিত্ত দিয়ে, প্রভাব দিয়ে ভালবাসা কেনা যায় না। যে যা-ই বলুক আজ সে মুখ ফুটে নিজেই তুলিকে ভালবাসার কথা বলবে।
হ্যাঁ, শুনছি তুলি বল।
আপনি কি কিছু ভাবছিলেন?
কেন বলতো?
না, মানে আমি তো আপনাকে কয়েকবার ডেকে সারলাম। উত্তর দিলেন না।
তুমি আমায় ডেকেছ?
নয় তো কি?
বল কি বলবে।
তার আগে আপনাকে বলতে হবে আপনি কি ভাবছিলেন।
না তেমন কিছু না।
যেমনই হোক আজ আমি তা শুনবোই, এ আমার আড়ি!
পুকুরে দুটো হাস দেখছিলাম। পানিতে কেমন জলকেলী করছিল!
মিথ্যে কথা পিয়াস ভাই! আপনি কিন্তু আমার সামনে কখনো মিথ্যে কথা বলেন নি। এতদিন পড়াতে এসে আপনি আমাকে নীতিবাক্য শিখিয়েছেন মিথ্যে বলা মহাপাপ।
মিথ্যে কথা?
হ্যাঁ একশত ভাগ মিথ্যে কথা।
মোটেও না।
অবশ্যই। কারণ তখন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পুকুরে হাস দেখলেন কখন? আর এখানে পুকুরই বা আসলো কোথা থেকে?
এবার থত মত খেয়ে যায় পিয়াস। সত্যি তো! সে তাকিয়ে ছিল তুলির দিকে। তার রূপ লাবণ্য দেখছিল অপলক দৃষ্টে। এখন কি বলা যায়। তুলিকে সে পড়াতে এসে আদর্শ মানুষের বৈশিষ্ট তুলে ধরেছে। বলেছে, যাদের মাঝে আদর্শ নেই তারা মিথ্যে কথা বলে। সত্যকে মিথ্যে বলে। মিথ্যেকে সত্য।
না মানে...!
না মানে তো কি?
দেখছিলাম বনলতা সেনকে। যাকে দেখলে ভুবন পাগল হয়ে যায়। যার ছোঁয়া কোনদিন পাওয়া যায় না। কল্পনায়ই এঁকে যেতে হয় তাকে।
কে সেই বনলতা?
আমি বলতে পারবো না তুলি।
না, আপনাকে পারতেই হবে।
অন্য কোন একদিন শুনো।
না আমি আজই শুনবো এবং এক্ষণি শুনবো। বলুন কোথায় সেই বনলতা সেন?
পিয়াসের বুকের ভিতর ঝড় উঠেছে, এখন যদি সত্যি বলে তাহলে তার পরিণতি কি হতে পারে তা ভেবে। পিয়াস এক গরিবের ছেলে। পিতা পড়াশোনার খরচ দিতে পারেন না তাই তাকে টিউশনি করতে হয়। টিউশনি করে যে টাকা পায় তা দিয়ে তার খরচ চলে যায়। কিছু টাকা ব্যাংকে জমাও করতে পারে। অন্যদিকে তুলি হাতেগোনা কয়েকজন ধনীর একজনের কন্যা। তার দিকে কেউ বাঁকা চোখে তাকালে তার চোখ কানা করে দেয়ার ক্ষমতা আছে তার পিতার।
তুলির ধমকের জবাব দিতে পারে না পিয়াস। বার বার ঢোক গেলে।
কি হলো বলুন?
মানে...
কিসের মানে? আপনি পুরুষ মানুষ না? একটা মেয়ের কথার জবাব দিতে এতো ভয়? তাহলে বাকি জীবন চলবেন কিভাবে?
তাহলে কি তুলিও তাকে ভালবাসে! তার কথার মাঝে কেমন যেন সেরকম ব্যাঞ্জনা খুঁজে পায় পিয়াস। এমনটা এতদিনে কোনদিন সে বুঝতে পারে নি। আজ কেন এই মেয়ে এত উতলা হয়ে উঠেছে! তার কেন এত আগ্রহ! পিয়াসের মনের কথা, বনলতা সেনের কথা শুনে তার কি লাভ! নাকি সেও নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে, পিয়াসের হাতে তুলে দেয়ার জন্য! এবার সে ভয়ভীতি দূরে সরিয়ে দেয়। পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইংলিশদের যেভাবে বুক চেতিয়ে মুশফিক বাহিনী কুপোকাত করে ফেলে তেমন বুক চেতিয়ে পিয়াস এবার মুখ খোলে।
সে তো আমার সামনেই।
আপনার সামনে মানে! কই আমি তো আপনাকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
মানুষ নিজেকে কখনো দেখতে পায় না। অসংখ্য মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলেও নিজে একটা জায়গা দখল করে আছে সেটা তার বিবেচনায় থাকে না।
তুলি এবার শিহরিত হয়! তার প্রতিটি রোমক‚প শক্ত হয়ে যায়। তার চারপাশে নানা সুর শুনতে পায়, যেমনটা শুনতে পেয়েছিল সিনড্রেলা। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ তার সারা দেহে খেলা করে যায়। মুখটা শুকিয়ে যায়। বুক ওঠানামা করতে থাকে দ্রুত। তাহলে কি পিয়াস তাকেই ভালবাসে! তার মাঝে সে খঁুঁজে ফেরে বনলতাকে!
মানে আপনি কার কথা বলছেন পিয়াস ভাই!
আমি তোমার কথা বলছি।
আমার কথা?
হ্যাঁ, তোমার কথাই। তোমার নামটা তুলি না রেখে বনলতা রাখাই ভাল ছিল। পুরো নাম বনলতা বন্যা। বনলতা হলো জীবনানন্দ দাসের কবিতার, আর বন্যা হলো রূপের। তোমার মাঝে দুটোই আছে। তাই তুমি বনলতা বন্যা!
তুলির মাথা নিচু হয়ে যায়। এমনভাবে তার রূপের বর্ণনা কোন মানুষ কোনদিন দেয় নি। তাকে কোনো ¯^প্ন দেখায় নি। কৃতজ্ঞতায়, ভাললাগার আবেগে তার চোখ থেকে ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রæ। জীবনের প্রথম রোমাঞ্চকর কথাÑ ভাললাগা, ভালবাসা। এটা তো বার বার আসে না। জীবনে একবারই আসে। তাকে বরণ করতে গিয়ে তার এই অশ্রæফোঁটাগুলো ¯^াক্ষী হয়ে থাকবে সারাটা জীবন। তার চোখ থেকে অশ্রæ ঝরা দেখতে পেল পিয়াস। সে বুঝতে পেল না তুলি কষ্ট পেয়ে কাঁদছে নাকি রাগে ক্ষোভে কাঁদছে। সাহস করে এই প্রথম তুলির দিকে সে হাত বাড়াল। দু’হাতে মুখটা আলতো করে ধরে তার দিকে ধরল। তুলি এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পিয়াসেরও চোখে কান্না চলে আসে। অনেক কষ্টে তা থামিয়ে সে জানতে চায়-
তুলি তুমি কাঁদছো কেন?
আমি এখন থেকে তুলি নই। আমি বনলতা বন্যা। আর কারো কাছে না হোক আমি আপনার কাছে বনলতা বন্যা।
আমার দেয়া নাম তোমার পছন্দ হয়েছে?
অনেক। অনেক। আমি কিন্তু আপনাকে আর আপনি বলে ডাকবো না। এখন থেকে তুমি। পিয়াস আমি তোমাকে ভালবাসি। কতবার এ কথাটি বলতে চেয়েছি, কিন্তু পারি নি। যখন তুমি আমাকে বনলতা সেন পড়াতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হৈমন্তী পড়াতে তখন কতবার ভেবেছি তুমিই একদিন আমাকে হৈমন্তীর মতো করে আপন করে নেবে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে- সে আমার সম্পদ নয়, সে আমার সম্পত্তি। একান্তই আমার। এর ভাগ আর কারো নেই। আজ আমার সেই কল্পনা পাখা মেলেছে। আজ আমি মুক্ত বাতাস, মুক্ত আকাশ পেয়েছি। আমি ডানা মেলে উড়বো সেই আকাশে। ছুটে যাব যেথা খুশি সেথা। সাথে রবে তুমি।
এবার পিয়াস নীরব হয়ে যায়। মূর্তির মতো বসে থাকে সে। এত সহজেই ভালবাসার মানুষকে পেয়ে যাবে ভাবতেও পারে নি। তার মাঝে এতক্ষণ যে ভয়, ভীতি ছিল তা নিমেষে উড়ে গিয়ে বুকটা আকাশের সমান স্ফীত হয়ে গেল। দু’বাহুতে জড়িয়ে ধরল তার বনলতাকে। স্থির চারটি চোখ। অনেক কথা বলে ফেলল কয়েক মিনিটে। বিনিময় হলো ভালবাসার একরাশ কবিতা।
২.
...
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।.......
পিয়াস চমৎকার আবৃত্তি করতে পারে। ইদানীং সেই আবৃত্তির গম্ভীর কণ্ঠ তার আরও গম্ভীর হয়েছে। আরও শ্রæতিমধুর হয়েছে। পিয়াসের আবৃত্তি তাই বার বার শুনতে ইচ্ছে করে বনলতা ওরফে তুলির। অনুরোধ করে জীবনানন্দের অমর সৃষ্টি বনলতা সেন পুরোটা আবৃত্তি করতে। কারণ, ও যখন আবৃত্তি করেন তখন কবিতার বনলতা সেনের মাঝে নিজেকে দেখতে পায় তুলি। তার জন্যই হয়তো এতটা পথ ‘হাঁটিতেছে’ এই পথিক পিয়াস।
কি হলো আবৃত্তি করো না!
এই তো করছি লক্ষীটি!
লক্ষীটি মানে! বল বনলতা বন্যা!
হ্যা, বনলতা বন্যা! এখনই তোমাকে নিয়ে লেখা বনলতা সেন আবৃত্তি করছি। একটা কথা জান, জীবনানন্দ দাস বনলতা সেনের সন্ধান আদৌ পেয়েছিলেন কিনা জানি না। তিনি আমাদের মতো মানুষদের জন্য, তোমার মতো বনলতা বন্যাদের জন্যই বোধ হয় লিখে গিয়েছেন বনলতা সেন। তাই তোমাকে তো বঞ্চিত করতে পারি না আমি!
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’...
বনলতা ওরফে তুলি হারিয়ে যায় কবিতার প্রতিটি শব্দের ভাজে ভাজে। সে বোঝার চেষ্টা করে এর মর্মার্থ। একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে এভাবে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে খোঁজে, ক্লান্ত পথিক হয়ে বিদর্ভ নগর কত পথই না তাকে পাড়ি দিতে হয়। তবেই তো একদিন আসে খাঁটি প্রেম। তার কাছে ধরা দেয় বনলতা সেন। ক্লান্ত পথিককে শান্তি দেয় সে। পিয়াসও কি এমনই প্রতীক্ষা করে ছিল তার জন্য বা সেও কি প্রতীক্ষা করে ছিল পিয়াসের জন্য। এরপর যে ভালবাসা তাদের ধরা দিয়েছে তা কি বাস্তবে রূপ নেবে কোন দিন? কোনদিনও কি সে পিয়াসকে পাবে একান্ত নিজের করে!

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
সত্যি কি শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে, মোলায়েম ধ্বনিতে, সবার অগোচরে! সব রঙ নিভে গেলে জোনাকিরা পান্ডুলিপি খুলে বসে! তখন অন্ধকারে মুখোমুখি বসে বনলতা সেন! আহা কি মধুর কথা। পিয়াস পড়ে আর বনলতা ওরফে তুলি তার মুখের দিকে, চোখের দিকে, মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে। তার মাঝে এক নাবিককে দেখতে পায় তুলি, যে নাবিক পাড়ি দেবে শত বাধা অতিক্রম করে সমুদ্র সফেন। মুখোমুখি বসে সে শোনাবে বনলতা সেন! আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো আলো ঝরাবে সন্ধ্যা তারা। জোসনায় ভেসে যাবে রূপালি পৃথিবী।
পি...য়া....স!
ব..ন...ল....তা!
তুমি এত সুন্দর করে আবৃত্তি করো কিভাবে?
তুমি আছ পাশে তাই।
আমি সারা জীবন তোমার কবিতা শুনে সময় কাটিয়ে দেব।
সারাজীবন?
হ্যাঁ, সারাজীবন।
কিভাবে?
কেন তুমি আমাকে বিয়ে করবে। আমরা একজনকে ছাড়া অন্যজন বাঁচতে পারবো না। তাই বিয়ে করে সারাজীবন একসঙ্গে থাকব।
পিয়াস অবাক হয়। তার বনলতা এ কি বলে! বিয়ে- এও কি সম্ভব তাদের! বনলতা ওরফে তুলি ধনীর দুলালী। আর সে সামান্য এক গৃহশিক্ষক। ওর বাবা শুনলে তো গুম করে ফেলবেন পিয়াসকে।
না। এ হবার নয় বনলতা।
কি হবার নয়।
আমাদের বিয়ে।
কেন?
কারণ, আমাদের ব্যবধান জান তুমি। তুমি ধনীর দুলালী। আমি সাধারণ গৃহশিক্ষক। আমাদের বিয়ে হতে পারে না। সমাজ মানবে না। তার চেয়ে বড় বাধা হবেন তোমার পিতা নয়ন কবির। তিনি আমাদের বিয়ে হতে দেবেন না। আমাদের সামাজিক অবস্থান বৈরী। কেউ একে সমর্থন দেবে না।
আমরা পালিয়ে যাব।
পালিয়ে যাবে?
হ্যাঁ, আমার বিলাসিতা চাই না। অর্থ বিত্ত চাই না। আমি চাই তোমার মতো একজন খাঁটি মনের মানুষ, যার কবিতা শুনতে শুনতে খালি পেটে হলেও রাত কাটিয়ে দেয়া যায়।
বনলতা ওরফে তুলির কথায় মাথা ঘুরে যায় পিয়াসের। তুলি যত সহজে কথাগুলো বলছে জীবন বাস্তবে এত সহজ নয়। আবেগে পড়ে মানুষ অনেক কথাই বলে। বাস্তবে ভিন্ন। তবুও তুলিকে আহত করা যাবে না। তারা দু’জন দু’জনকে ভালবাসে। সামাজিক বৈরিতা তাদের ব্যবধান তৈরী করেছে, এর বাইরে কিছু তো নয়! সত্যি সে পালিয়ে যাবে তুলিকে নিয়ে। সফেদ সমুদ্র পেরিয়ে বহুদূরে যেখানে পৃথিবীর মানুষের চোখ না পড়ে।
৩.
এ কান ও কান হয়ে তাদের প্রেমে কথা চলে যায় নয়ন কবিরের কানে। তিনি শুনে তো অগ্নিশর্মা। রাতে বাসায় পারিবারিক পরিসরে দরবার বসালেন। সবিস্তারে খুলে বললেন সব। বললেন- ওই ফকিন্নির পোলা পিয়াসকে ভালবাসে তুলি। আরে ও তো আমার বাড়ির দারোয়ানও হওয়ার যোগ্য নয়। ওকে টিউশন মাস্টার রেখেছিলাম। ও পড়াশোনার খরচ যোগাতে পারে না তাই। আমার মেয়ে কি কম যোগ্য নাকি! কাল থেকে পিয়াসের এ বাসামুখো আসা নিষেধ। ওর সঙ্গে আমার মেয়ের কেন প্রেম হতে যাবে। লোকজন সব মিথ্যে বলে নারে মা তুলি?
না। মানুষ সত্যি বলে।
সত্যি বলে? মাথা হেট হয়ে যায় নয়ন কবিরের।
হ্যাঁ, সত্যি বলে। আমি পিয়াসকে ভালবাসি।
এসব মিথ্যে কথা।
না, বাবা এটাই সত্যি কথা। আমি পিয়াসকে বিয়ে করতে চাই।
নয়ন কবির বুঝে ফেললেন ঘটনা গড়িয়েছে অনেক দূর। রাখে তার মাথা থর থর করে কাঁপছে। কিন্তু এই মুহ‚র্তে তিনি মাথা যতটা পারেন ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলেন। বাড়তি কোন কথা বললেন না। নির্দেশ দিলেনÑ কাল থেকে যেন সে ঘরের বাইরে না যায়। আর ওই ফকিন্নির পোলা পিয়াস এ বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে।
তার নিদের্শই এ বাড়িতে আইন। তার ওপর দিয়ে কথা বলার কেউ নেই। নির্দেশকে আইন মেনে প্রহরীরা সতর্ক হয়ে গেলেন। তারা পাহারা জোরদার করলেন। পিয়াসকে এরই মধ্যে লোক পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হয়েছে- সে যেন আর তুলিদের বাড়ির ধারে কাছে না ঘেঁঁসে। এ নির্দেশের পরও কয়েকবার চেষ্টা করেছিল পিয়াস। কিন্তু পারে নি বাড়ি থেকে বেরুতে। তাদের বাড়ির চারদিকে সাধারণ পোশাকের কিছু আগন্তুককে দেখতে পাচ্ছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তাকে গুম করে ফেলা হবে।
ওদিকে বাড়িতে রেখেই তুলির বিয়ের জন্য পাত্র দেখাদেখি শুরু হলো। কয়েকজন পাত্র দেখার পর একজনকে পছন্দ হয়ে গেল নয়ন কবিরের। তার নাম শাহজাদা আমির। নামের ধরন দেখেই বোঝা যায় বিলিয়ন ডলারের মালিক। নিজের চলার জন্য চারটি গাড়ি আছে। সকালে একটিতে চড়েন তো দুপুরে আরেকটি। রাতে পার্টির জন্য আরেকটি। তুলির মতামত নেয়া হলো না। বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তুলির হাত-পা বাঁধা। ঘর থেকে বেরুবার সামর্থ নেই তার। সত্যি সত্যি একদিন বিয়ে হয়ে গেল তার।
শাহজাদা আমির দিনভর ব্যস্ত অফিস, আর বিভিন্ন পার্টি নিয়ে। তিনি মোটেও সময় দিতে পারেন না তুলিকে। জোসনা রাতে যখন তাকে বনলতা সেন শোনানোর কথা ছিল পিয়াসের, তখন শাহজাদা আমির ব্যস্ত কোন ম্লান আলোর ঝলকানিতে, অন্য কোন ললনার বাহুতে। হাতে মদের গ্লাস। টলতে টলতে চলে যাচ্ছেন স্পেশাল রুমে। সেখানে টাকা খসানোর আয়োজন। শরীরের সঙ্গে শরীরের সংঘর্ষে স্ফুলিঙ্গ ওঠে।
চার.
চল্লিশ বছর পরের কথা।
এখন আর শরীরে অটুট বাণ নেই শাহজাদা আমিরের। চুল পেকে ধবধবে হয়ে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে। চোয়াল ভেঙে বসে গেছে। এখন নিজে নিজে ঠিকমতো চলতে পারেন না। তাই তার সহায় হয়েছে তুলি। তুলিও দুটি সন্তানের মা। সন্তানরা নিজেদের মতো ঘর সংসার পেতেছে। সাধারণ আর দশটি মেয়ের মতো তারও শরীর ভেঙে গেছে।
অনেক দিন পর একদিন মন ভাল করতে একটি বিয়ের পার্টিতে হাজির দু’জনে। সেই পার্টিতে আয়োজন করা হয়েছে গানের। অতিথিরা বসে আছেন যে যার মতো। সামনের দু’ সারি পরে বসা নয়ন কবির- তুলি কবির।
মঞ্চে এলেন অনেকটা বুড়িয়ে যাওয়া এক গায়ক। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। তবে পাকে নি। মাথার চুল ঝলমল করছে আলোতে। তিনি গান গাইলেন না। গানের বদলে তিনি আবৃত্তি করলেন বনলতা সেনÑ
‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’...
গলাটা, সুরটা কেমন চেনা চেনা মনে হতে থাকে তুলির। তিনি ক্রমাগত অস্থির হয়ে ওঠেন। কে এই পুরুষ! তার কণ্ঠ এত চেনাচেনা মনে হচ্ছে কেন! কোনও দিন কি তিনি এ কণ্ঠ শুনেছেন কোথাও!
আবৃত্তি শেষ হতেই উঠে গেলেন তুলি কবির। মঞ্চ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন আবৃত্তিকার। তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তুলি। তার চোখে চোখ রেখে বললেনÑ আপনার নামটা কি জানতে পারি?
আমার নাম? আমার নাম পিয়াস।
পিয়াস!!! যেন বর্জ্রপাত হয় তুলির মাথায়। তার চোখ থেকে দর দর করে ঝরে পড়ে অশ্রæ। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে পিয়াসের চোখের দিকে।
আপনি?
আমি? আমার নাম তুলি। তুলি কবির।
তুলি। তুলি কবির। নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, আমার আসল নাম বনলতা বন্যা। তুলি আমার মরে যাওয়া নাম। মৃত নাম নিয়ে বেঁচে আছি।
বনলতা বন্যা!!!
এবার ঢুকরে কেঁদে ওঠেন পিয়াস। তিনি আর কথা বলতে পারেন না।
তুমি বিয়ে করনি পিয়াস?
না, বিয়ে তো একবারই মনের টানে করে ফেলেছি। তাকে পাই বা না পাই তাকেই কল্পনায় স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছি। সেই আমার মনের কোণে ঠাঁই নিয়ে আছে। আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই। তারপর ধরেছি গান, কবিতা। এগুলো নিয়েই একা সময়টা কাটিয়ে দিই। সে যাক তোমার কথা বলো। কেমন আছ তুমি?
আমি? ওই যে বললাম মরে বেঁচে আছি। তুলি মরে গেছে। আসল বনলতা বন্যা এখনও বেঁচে আছে তার রাজপুরুষের আশায়। একদিন তার সঙ্গে দেখা হবে। সেদিনের আশায় হয়তো এতটা দিন বেঁচে আছি। এখন আমি শান্তিতে মরতে পারবো। তার আগে কথা দাও তুমি এবার বিয়ে করবে, তোমার সংসার হবে, সন্তান হবে।

সে আমি পারবো না বন্যা। আমিও তো মরে বেঁচে আছি। আর জনমে যদি তোমার সঙ্গে দেখা হয় সেদিন আমাকে চিনে নিও।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তাপস এস তপু ভোট রেখে গেলাম। আমার লেখায় আমন্ত্রণ রইল সাথে :)
সোহানুজ্জামান মেহরান অসম্ভব ভালো লিখেছেন। শুভকামনা ও ভোট রইলো।
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক বেশ ভালো লাগলো পড়ে । ভোট রইলো । রইলো শুভেচ্ছাও ।
হুমায়ূন কবির সত্যি চমৎকার , ভোট থাকল আর আমার গল্পে আমন্ত্রন।
এমএআর শায়েল ঠিক যেন বনলতা সেন! প্রথমেই চমকে উঠেছিলাম। আপনার এ লেখার সাথে আমার লেখার মিল কোথায় জানেন, আপনিও ব্যর্থ প্রেমের গল্প লিখেছেন, আমিও। নায়ককে ব্যর্থ হিসেবে তুলে ধরেছেন। আমার সব লেখাতেই নায়ক ব্যর্থ হয়। প্রেমে পড়ে ব্যর্থ হলে এমনটা সাধারণত হয় না ভাই। যদি মিরাক্কেল বলে কিছু ঘটে থাকে, তবে কোন একদিন নায়িকার সাথে নায়কের দেখা হয়। বাস্তবে হয় না। নায়িকা মুখ ফিরিয়ে নেয়। গল্পতো, গল্পের মতই হয়েছে। আমার গল্পে কোন কাহিনী নেই। সোজা সাপ্টা আমি নায়িক ও নায়কের জীবনের কথাগুলো তুলে ধরি। এজন্য অনেকে আমার সমালোচনা করেন। আপনি ভালো লিখেছেন। তবে বানানের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। ইউনিকোডে লেখবেন। যাতে ভেঙে না যায়। আশা করি আমার লেখাও পড়বেন। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন সবসময়। ধন্যবাদ
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,পাতায় আমন্ত্রন রইল।
জুন শুরুর শব্দটা দেখে চমকে গিয়েছিলাম। ভালো লাগলো অপেক্ষার গল্প... ভালো লাগা সাথে শুভ কামনা। আমার পাতায় নিমন্ত্রণ..

১১ মার্চ - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী