১
মজিদ লাশ নিয়ে যাচ্ছে একটা। কাঁচা লাশ। যেই লাশ মরেছে চব্বিশ ঘন্টাও হয় নি , মজিদের ভাষায় সেটা কাঁচা লাশ । গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে মজিদ খালেক বাড়ির পুকুরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। পিঠে বস্তা , বস্তায় তিন টুকরা লাশ । মাথাটা বস্তায় নেই । মাথা ও আগেই আদম বাড়ির পেছনেই জঙ্গলে কবর দিয়েছে ২ বার কুলহু আল্লাহ পড়ে। ভালই লেগেছে ওর। কিভাবে কি হইলো ভাবতে ভাবতে আগায় মজিদ গ্রামের রাস্তা দিয়ে।
পরশু রাত্রে গ্রামের পরগনা জমিদার আদম খাঁ ওকে ডেকে পাঠায় আদম বাড়িতে। ভাল মনেই খুশি হয়ে যায় ও। চন্দনপুরে কোন মানুষের বাড়িতে রাত্রে মজিদ কে ডাকা মানেই পরের দুই দিনে গ্রামে কোন খুন । সবাই ই মোটামোটি জানে এটা । কিন্তু কেউ বলার সাহস পায় না। তো আদম বাড়িতে আদম খাঁ এর সাথে মজিদের খুব স্বাভাবিক কিছু কথা হয় ।
আদম খাঁ মজিদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বলে , “পঁচিশ হাজার পাবি , কাজ শেষে পুরাটা।”
মজিদ জবাব দেয়, “ দশ আগে দিতে হবে খাঁ সাব, আপনে তো আমার শিশটেম জানেন ই।”
আদম খাঁ কিছুক্ষ্ণ মজিদের দিকে তাকিয়ে থেকে রাজি হয়ে যান । তিনি জানেন , মজিদ কাম নিলে কইরাই ছাড়ে । আরো কিছুক্ষ্ণ কথা বলে মজিদ কে টাকা দিয়ে বিদেয় করেন উনি । তার পরদিন রাত্রেই মজিদ এগুচ্ছে বস্তা কাঁধে।
সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নেই মজিদের। এখন মনে হয় হঠাত যে একটা ধরাতে পারলে মন্দ হত না। এই ভাবতে ভাবতেই আবার গতকালে ফিরে যায় ও।
কুত্তার বাচ্চাটারে খুন করতে ভালই কষ্ট হইছে ওর। একে তো শালার পোয়াতি বউ চিল্লায় বেশি , আবার কুত্তাটা মরার সময় মজিদ রে জ্ঞান দেয় । হাহ , হাসে মজিদ। আরে শালা , তুই মরার সময় মাফ টাফ চাবি , লুঙ্গি ভিজাবি তা না , তুই এই মজিদ রে বয়ান দিস?
আবারো আপন মনেই হেসে উঠে মজিদ।
চাপাতি যখন মজিদ শালার ঘাড়ে লাগালো , শালা বইলা উঠে জয় বাংলা । আরে শালা , আমি কি পাকি বাহিনী নাকি ? যুদ্ধ করতে আইছি আমি ? আমারে জয় বাংলা শুনাস তুই । আবার কুওাটা কয় , যুদ্ধাপরাধী দের বিচার শুরু হইসে। হেহে , আবারো হেসে নেয় মজিদ। শুরু হইসে তো আমি কি করতাম? লুঙ্গি খুলে নাচতাম ? শালার। আমি চন্দনপুর গেরামের কাটা মজিদ। আমারে এত কিছু বইলা লাভ আছে? শালার পুত মুক্তিযুদ্ধ করছে। কি লাভ হইছে ক দেহি শালা । বাইচা ছিলি তো ফকিরের নাহাল । আদম খাঁ রে দেখ , কি সুন্দর পাকি গো গোলামি করতো , আরে শালা তুই তো জানিস না, তোর মা রেও পল্লী তে নিছিলো তো আমাগো আদম খাঁ ই । তখন শালা বাঁচাইতে গেছিলি দ্যাশ । আর এখন ? আদম খাঁ তো ঠিক ই নির্বাচন এ খাড়াইবো , চন্দনপুর চালাইবো । আর তোর কি হইলো? তুই আইলি আমার বস্তার ভিতরে। শালা……।।
তবে যে যাই বলুক , আবারো ভাবে মজিদ। এই খুন টার মজাই ছিল অন্যরকম । গেরামের অন্য দশ টা খুনের মত না। আবার খাঁ সাবের বাড়ির পিছে মাথা টা পুতার সময় ও মজা হইলো ।
আদম খাঁ বলে, “ কি রে মজিদ , মাথায় এট্টা কাফন বাইন্ধা দে হালার। কাফন লইয়া খোদার কাছে বিচার চাউক আমার। ”
খিক খিক করে হেসে উঠে মজিদ। সত্যি ই এক টুকরা সাদা কাপড় মুখে গুঁজে দেয় মাথাটার। গলা দিয়ে, নাক মুখ দিয়ে তখনও রক্ত বেরুচ্ছে লাশের। মাত্রই মাথা কাটা তো ।
২
“ও মুক্তির বাপ , দরজা খুলো তো । আমি পাকের ঘরে। ” খিলখিল করে হেসে বলে উঠে রাত্রি । গলাটা ভাঙ্গা ওর। ঠাণ্ডায় ধরেছে একটু । পলাশের চাপাচাপি তে গ্রামে আসা , এসেই ঠাণ্ডা বাঁধিয়ে বসেছে । ও ঠিক করেছে যতদিন গ্রামে থাকবে ততদিন গ্রামের বউ এর মত কথা বলবে । এজন্যই এভাবে ডাকলো পলাশ কে। মুক্তি হল ওদের সন্তান । হয় নি এখনো , ছয় মাসের অন্তঃসও্বা ও। কিন্তু এখন থেকেই আদর করে ডাকে মুক্তি। ওদের প্রথম সন্তান হবে এজন্য এক মাস পরেই রাত্রি কে ঢাকা পাঠিয়ে দেবে পলাশ । পারলে নিজেও যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু গ্রামের কাজ গুলো মনে হয় যেতে দেবে না ওকে।
কিছুদিন আগের কথা । মুক্তিযোদ্ধা পলাশের নামে চিঠি আসে ঢাকায় । পলাশ দেখে চিঠি পাঠিয়েছে ওর একাওরের প্লাটুন কমাণ্ডার । এখন আর সেই স্যার স্যার সম্পর্ক নেই কিন্তু অনেক স্রদ্ধা করে ও উনাকে। তো চিঠির মূল কথা ছিল এরকম , “যোদ্ধারাই ভাল জানে যুদ্ধ কিভাবে করতে হয়। আমরাই মুক্তিযুদ্ধ করেছি , এখন ও রাজাকার আর যুদ্ধাপরাধী আমরাই সরিয়ে যাবো।”
পরে পলাশ কে ভালমত বুঝিয়ে দেন উনি কি করতে হবে । পলাশের ও অনেক দিন ধরে গ্রামে যেতে মন টানছিলো। বাঙ্গালি তো , শত হলেও নাড়ির টান ভুলতে পারে নি । পরদিন ই ও রওয়ানা দেয় রাত্রি কে নিয়ে। সেই স্বপ্নের চন্দনপুরের দিকে। পুরো পথ রাত্রির মাথা খারাপ করে দেয় ও গ্রামের গল্প করে । এরপর ট্রেন – রিক্সা – নৌকা করে পৌঁছায় ওরা সন্ধার দিকে। নৌকা থেকে নেমেই মাটিতে বসে পড়ে পলাশ । বুক ভরে শ্বাস নেয় দুবার। চোখ দুটো কেন জানি ভরে আসে ওর। মাটি তে একটু আলতো ছুঁইয়ে হাত ও নিজেকেই বলে , “এ গ্রামে , এ স্বপ্নপুরীতে রাজাকার থাকতে পারবে না , কখনোই না।”
পরের কয়েকদিন রাত্রি ইচ্ছেমত নৌকায়, ক্ষেতে , বনে ঘুরে বেড়ায় আর পলাশ তথ্য খোঁজে। পায় ও । মোটামোটি বুঝে যায় ও আদম খাঁ কি । সব তথ্য পাঠিয়ে দেয় থানা শহরের থানায় ।সব শেষ করে পেছনের জানালায় দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না দেখছিল ও ।এমন সময় ই “ও মুক্তির বাপ , দরজা খুলো তো । আমি পাকের ঘরে। ”
রাত্রি টাও না , হেসে এগিয়ে যেয়ে দরজা খোলে পলাশ , ভেতরে ঢোকে মজিদ।
৩
শালার মাথার সাথে দুই হাত ও ফালায় আসা উচিত ছিল গর্তায় , কি ওজন রে । গালি দিয়ে ওঠে মজিদ। আদম খাঁ বলেছে চরের শেষ মাথায় বস্তা চুবায় দিতে। তাই ই করতে যাচ্ছে ও । অন্য কেউ বললে খালের পাশেই ফেলে দিত বস্তা কিন্তু আদম কে ডর লাগে । হাটতে হাটতে আবারো ভাবে মজিদ।
বউটার পেটে লাথি মারতে খারাপ ই লাগছিলো । কিন্তু কি আর করা , পোয়াতি মাইয়ার গলায় জোর থাকে বেশি । দুইডা লাথি দিতেই মইরা গেল বউটা । অবশ্য জোরেই মারছিলাম , ভেবে হাসি ফুটে মজিদের মুখে ।
চরে প্রায় এসে পড়েছে ও । কিন্তু দূরে আলো ক্যান এতো ? মশালের আলো মনে হইতাছে না?
গাঁয়ের সব লোক চরে আইলো ক্যান ?
জনতার ঢল দৌঁড়ে আসে স্রোতের বেগে , একাওরের মত ।
যদি বাংলার প্রতিটি গ্রামে জাগরণ আসে , আমরা এগিয়ে যাবই , আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না ।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪