ছায়ামূর্তি

ভয় (এপ্রিল ২০১৫)

অয়ন রহমান
  • ১০
  • ২১
দীর্ঘ কাদা-জলের পথ পেরিয়ে ষ্টেশনে যখন পৌঁছলাম- ঘড়িতে তখন নয়টা পঞ্চাশ। সবকিছু ঠিক থাকলে এখনই কিংবা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই রাতের শেষ ট্রেনটি চলে আসার কথা। ঘন গাছপালায় ঘেরা ছোটখাটো ষ্টেশন। ষ্টেশনের চারদিকটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। শুধু ফ্লাটফর্মে গুটিকয়েক বৈদ্যতিক বাতি টিপটিপ করে জ্বলছে। মফস্বলের ষ্টেশন বলেই হয়ত স্বল্প ভোল্টেজের কারণে বাতি গুলোর এই রুগ্ন দশা। পুরো ষ্টেশন জুড়ে যেন শ্মশান-শূন্যতা। খা-খা করছে চারদিক। কোথাও কোনো জনমানুষের দেখা নেই। হঠাৎ বুকটা কেমন যেন ধ্বক করে উঠল। অথচ দু’দিন আগেই ঢাকা থেকে আমি যখন এই ষ্টেশন এসে নামলাম, তখন এই স্থানটি বেশ জমজমাট ছিল। হকার ফেরিওয়ালাদের হাকডাকে ষ্টেশন মুখরিত ছিল। সেটা ছিল অবশ্যি দিনের বেলা। এই ষ্টেশনের রাতের পরিবেশ আমার জানা নেই। এই অঞ্চলে আমি আগে কখনো আসি নি। রোহানপুরে আমি এবারই প্রথম।
এনজিওতে কাজ করার এই একটাই সমস্যা- প্রায়শই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গিয়ে কাজের তদারকি করতে হয়। রোহানপুরে এখন পুরোদস্তুর বর্ষা। অধিকাংশ রাস্তা-ঘাট প্রায় তলিয়ে গেছে। সারাদিন কাদা-জলের পথে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে আমি যথেষ্ট ক্লান্ত। সন্ধ্যায় বসে আছি রোহানপুর আঞ্চলিক কেন্দ্রের অফিস বারান্দায়। বাইরে বৃষ্টির সাথে হালকা বাতাসও আছে। ক্লান্তিতে আমার ঘুম চলে আসার মতো অবস্থা। বিছানায় গেলেই আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। ভেসে যেতাম ঘুমের বন্যায়। সময়টা ভর সন্ধ্যা বলে বিছানায় যাওয়া সম্ভব হয় নি। অফিসের পিয়নকে ডেকে কড়া লিকারের চায়ের কথা বলেছি। চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঢাকা থেকে রায়হান কবির স্যারের জরুরী ফোন। যে করেই হোক রাতের মধ্যেই ঢাকায় ফিরতে হবে। দাতা সংস্থার দু’জন প্রতিনিধি আমাদের কার্যক্রম দেখতে ঢাকায় আসছেন আগামীকাল। এখানে ওদের আসার কথা ছিল না। ওরা আসবে মূলতঃ ইন্ডিয়া আর নেপাল সফরে। ফাঁকতালে ঢাকায় আমাদের অফিসটাও নাকি ঘুরে যেতে যায়। রায়হান স্যার এমনিতেই দূর্বল চিত্তের মানুষ। বিদেশী প্রতিনিধি আসার খবর শুনে তিনি অস্থির হয়ে গেছেন। এই লোক এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান চালায় কী করে- আমি বুঝতে পারি না। অবশ্যি দাতাদের সন্তুষ্ট রাখতে না পারলে সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনাও আছে। অগত্যা ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে রাতেই একটা ভ্যানগাড়ী নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ষ্টেশনের দিকে।
ভ্যানচালক ঠান্ডু মিয়া বাচাল প্রকৃতির মানুষ। একটা কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে দশটা। আমি আশংকায় আছি যথা সময়ে ষ্টেশনে পৌঁছাতে পারব কি না।
‘ষ্টেশনে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?’
‘সময় বেশি লাগব না স্যার। একটানে লইয়া যামু।’
‘টান দিতে পাববেন তো! আপনার নিজের অবস্থাই তো মনে হচ্ছে কাহিল।’
‘চিন্তা করবেন না স্যার। এই ঠান্ডু মিয়ার ভ্যানে চড়ছেন না। আর কোনো চিন্তা নাই। একটানের মামলা।’
কিছুদূর আসার পর মনে হলো- চিন্তার অনেক কিছুই আছে। ঠান্ডু মিয়ার কথায় ঠিক ভরসা করতে পারছিলাম না। একটু পর পর ভ্যানের চাকা কাদায় আটকে আটকে যাচ্ছিল। মুখে খুব দাপটের সাথে বারবার একটানের মামলা বললেও মাঝে-মধ্যে খালি গাড়িই সে কাদা থেকে টেনে তুলতে পারছিল না। এইভাবে আসতে থাকলে ষ্টেশনে পৌঁছতে আমার সারা রাত লেগে যেত। অবস্থা বেগতিক বুঝে আমি নিজেই জুতো খুলে ভ্যানগাড়ি থেকে নেমে পড়েছি। গাড়িতে ধাক্কাও দিয়েছি কয়েকবার। বর্ষা কবলিত গ্রামের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা কঠিন এক অভিজ্ঞতা। পিচ্ছিল কাদায় পায়ের তলায় সুড়সুড়ি লাগে। এই দু’দিনে বেশ কয়েকবার এই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। প্রথম প্রথম সুড়সুড়িটা একটু বেশি অনুভূত হলেও পরবর্তিতে অনেকটা অভ্যস্থ হয়ে গেছি। খালি পায়ে হাঁটার ফলে হুক ওয়ার্মের জীবাণু যে শরীরে ঢুকে গেছে সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। শুধু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না ট্রেন ধরতে পারার বিষয়টি। ষ্টেশনের এই ভূতুরে পরিবেশ দেখে আমি কিছুটা হলেও শংকিত।
সাহস নিয়ে খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল পাহারাদারের। জানা গেল, তিনিই এখন এই ষ্টেশনের সবেধন নীল মণি। তার গলায় ঝুলছে বাঁশি। এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে লাঠি। পাহারাদারকে খুঁজে পেয়ে মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। ট্রেনের খবর জানতে চাইলে কোনো কথা না বলে পাহারাদার এগিয়ে গেল রেল লাইনের দিকে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যেই সে লাইনে গিয়ে কান পাতল। খানিক বাদে উঠে এসে ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দিল- ‘কোনো খবর নাই’। জানা গেল রাতের ট্রেন আজ আর না আসার সম্ভাবনাই বেশি। এর মধ্যে নাকি লাইনের বিভিন্ন জায়গায় পানিও উঠে গেছে।
বইয়ে পড়েছিলাম, বিপদ যখন আসে- আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন সবাইকে নিয়ে একসাথেই আসে। বইয়ের কথা সত্যি প্রমাণ করে শুরু হলো মূষলধারায় বেপরোয়া বৃষ্টি। সাথে প্রচন্ড বাতাস। বাতাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে ইলেকট্রিসিটিও চলে গেল। মাঝে মাঝে বিদ্যুচ্চমকের ধমকে চারপাশটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। উপায় না দেখে রাতটা কোনোমতে ষ্টেশনেই কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উদ্দেশ্য, ট্রেন যখনই আসুক- কিছুতেই যেন সেটা মিস না হয়। তাছাড়া, ইচ্ছে থাকলেও এখন আর রোহানপুর কেন্দ্রে ফিরে যাওয়া সম্ভব না। ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার পর ঠান্ডু মিয়াও তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে চলে গেছে।
ষ্টেশনে রাত কাটাতে হলে পাহারাদার ব্যক্তিটিই আমার একমাত্র ভরসা। লোকটির নাম জব্বার মিয়া। বেঁটেখাট মানুষ। বয়স পঞ্চাশের মতো। দাড়িতে তাকে খানিকটা আর্নেষ্ট হেমিংওয়ের মতো দেখাচ্ছে। যদিও শরীরের গঠন অনেকটাই দূর্বল টাইপের। আমি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে জব্বার মিয়ার সাথে কথা বলছি। বিদ্যুচ্চমকের আলোতে হঠাৎ সামান্য দূরে আরেকটা লোকের দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু পরক্ষণের ঝলকেই তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। দেখতে না দেখতেই লোকটি আবার আড়ালে চলে গেল। পাগল-টাগল হবে বোধ হয়। বাংলাদেশে এমন কোনো রেলষ্টেশন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একটা পাগলও নেই। হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে জব্বার মিয়া বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে হাঁক ছাড়ল-
‘এই নুরা, এত রাইতে এইহানে কী চাস? গেলি ইষ্টিশন থাইক্যা..’।
‘ক্যান যামু রে জব্বাইরা, ইষ্টিশনডা কি তুই ইজারা লইছস? না কি তোর বাপের সম্পত্তি?’ আড়াল থেকে লোকটির পাল্টা জবাব।
‘বাপ তুইলা কথা কবি না কইয়া দিলাম। আমি ইষ্টিশন ইজারা নিলে তোর কোনো সমস্যা আছে রে হারামজাদা? ভালা চাস তো তাড়াতাড়ি ভাগ এইখান থাইকা। ’
‘এহ্, কইলেই অইল? সরকারের খাইয়া কাম নাই তোর মতো দুই পয়সার চৌকিদারের কাছে ইষ্টিশন ইজারা দিব?’
‘দিব না ক্যান রে হারামজাদা, আমি ছাড়া তোর আর কোন বাপ আছে এত রাইতে ইষ্টিশন দেহাশুনা করবার লাইগ্যা?’
লোকটির আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। জব্বার মিয়াও আর কথা বাড়াল না। লাঠি হাতে তাড়া দিতেই লোকটি কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। বোঝা গেল লোকটি পাগল প্রকৃতির কেউ না। লোকটি পাগল না হওয়ায় তার প্রতি আমার আগ্রহ খানিকটা বেড়ে গেল। কিছু জানতে চাওয়ার আগেই জব্বার মিয়া বলল, ‘ছিঁচক্যা চোর, বুঝলেন স্যার। ওই ছ্যাঁচড়া গুলার লাগ্যাই তো রাত জাইগা ইষ্টিশন পাহারা দেওন লাগে। এই জব্বার পাহারাদার না থাকলে লাইনের পাত তুইলা মাইনষে এত দিনে কডকডি কিন্যা খাইত।’ ষ্টেশন পাহারা দেবার মতো মহৎ কাজ করতে পেরে জব্বার মিয়ার বুকটা যেন গর্বে খানিকটা ফুলে উঠল।
‘আচ্ছা, আমি তো আজকের রাতটা ষ্টেশনেই কাটিয়ে দিতে চাইলাম। এখানে থাকাটা কি নিরাপদ হবে?’
‘আমি থাকতে আফনের কোনো সমস্যা নাই স্যার। নুরা চোরা চইল্যা গেছে। এই বৃষ্টির রাইতে আইজ আর আইব বইল্যাও মনে হয় না। আর যদি আহেও- কোনো সমস্যা নাই। আমি তো আছিই।’
‘দেখুন, আমার কাছে কিন্তু মূল্যবান তেমন কিছু নেই। মোবাইল, ঘড়ি বা টাকা-পয়সা যা সামন্য কিছু আছে এগুলো খোয়া গেলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই ল্যাপটপটার যা দাম- তার চেয়েও অনেক মূল্যবান জিনিস আছে এটার ভিতরে। আর এই ব্যাগের মধ্যে আছে বেশকিছু দরকারি কাগজ-পত্র। এগুলো চুরি হয়ে গেলে আমি কিন্তু ভীষণ বিপদে পড়ে যাব।’
‘কোনো টেনশন কইরেন না স্যার। আমি থাকতে কেউ আপনার একটা সুতাও লইবার পারব না ইনশাল্লাহ। আহেন আমার লগে।’ টর্চ লাইট জ্বেলে জ্বেলে সে এগিয়ে চলল।
জব্বার মিয়া ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে দিল বলাটা ঠিক হলো না। দরজা খোলাই ছিল- শুধু ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হল। ঘরের ভ্যাপসা জলজ গন্ধ থেকে বোঝা গেল অনেকদিন ধরেই বন্ধ রয়েছে এই ঘর। একটা মাত্র জানালা। টিকেট কাউন্টারের জানালার মতো ছোট। একসময় সম্ভবত এই রুম থেকেই ট্রেনের টিকেট দেওয়া হত। এটিকে ওয়েটিং রুম না বলে এখন ষ্টোর রুম বলাই ভালো। ঘরের তথৈবচ অবস্থা দেখে আমি চমকে উঠলাম। ঘর ভর্তি ভাঙ্গা আসবাবপত্র আর মাকড়সার ঝুল। একটি মাত্র লং বেঞ্চ দেয়ালে হেলান দিয়ে কোনোমতে এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটি বিশাল এবং কুৎসিত মাকড়সা পেটে ডিম নিয়ে বসে আছে। কাঠের স্তুপের মধ্যে হঠাৎ শব্দ হলো। ইঁদুর-ছুঁচো হতে পারে। সাপ-খোপ থাকাটাও অসম্ভব কিছু না। আমি তাকিয়ে আছি মাকড়সাগুলোর দিকে। ছোটবেলা থেকেই আমার মাকড়সা ভীতি আছে। একবার পলান-টুক খেলতে গিয়ে এমন এক চিপা জায়গায় পালিয়েছি কারো সাধ্য নেই খুঁজে বের করার। হঠাৎ চোখের সামনে আবিষ্কার করলাম মস্তবড় একটা মাকড়সা। গায়ের রঙ কালো কুঁচকুঁচে। চোখ টকটকে লাল- জ্বলজ্বল করছে। এক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চিৎকার দিয়ে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম।
অষ্ট্রেলিয়া-আফ্রিকায় বিষাক্ত মাকড়সার কামড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায়। আশার কথা হলো- আমাদের দেশে এখনও এমনটা শোনা যায়নি। তবুও এই নিরীহ প্রাণীটিকে আমি অসম্ভব রকমের ভয় পাই। এদের ছায়া দেখলেও আমার গা ঠান্ডা হয়ে আসে। জব্বার মিয়াকে পঞ্চাশটা টাকা দিলাম ঘরটা পরিস্কার করার জন্যে। টাকাটা সে গ্রহণ করল না, বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিল। কিছু কিছু মানুষ থাকে- যারা অভাব অনটনের মধ্যে থেকেও আত্মসম্মানবোধটা ধরে রাখে। এই লোকটিকেও আমার কাছে তা-ই মনে হল। কিছুটা হলেও লোকটির প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হল। এর মধ্যে সে ঘর পরিস্কারের কাজে লেগে গেছে। পরিস্কারের কি করল কে জানে! শুধু লং বেঞ্চিটা একটু ধূলামুক্ত মনে হলো। ঘর যেমন ছিল তেমনই রইল। আগে মাকড়সা যে কয়টা ছিল এখন তার চেয়ে কয়েকটা বেশিই দেখা যাচ্ছে।
জব্বার মিয়া কোথা থেকে যেন একটা হ্যারিকেন যোগাড় করে এনেছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম রুমে ইলেকট্রিসিটির বাতি আছে। জব্বার মিয়া হাসল- ঝড়-বৃষ্টি না থামলে কারেন্ট আসবে না। অদ্ভুত নিয়ম- প্রয়োজনের সময় কারেন্ট থাকবে না। ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেলে আমি কারেন্ট দিয়ে কী করব! হ্যারিকেনের কোনো ভরসা নাই। তেল কতটুকু আছে কে জানে। তেল থাকলেও একটু পরে সলতে নাগাল পাবে কিনা সেটাও একটা ব্যাপার। তাছাড়া বাতাসের ঝাপটা লেগেও নিভে যেতে পারে।
‘দিনের বেলাতেও এই যাত্রী রুমে কেউ ঢুকে না। তাই রুমের এই বেহাল অবস্থা।’ ষ্টেশনের দৈন্য-দশার কথা অকপটে স্বীকার করে নিলেন জব্বার মিয়া। তার লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ষ্টেশনের এই অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।
‘আমাকে নিয়ে আপনি ভাববেন না। সামান্য একটা রাতেরই তো ব্যাপার।’
জব্বার মিয়া ইতস্তত করে বলল, ‘রাইতে ঘর থাইক্যা বাইরে বাইর হইলে একটু শব্দ-টব্দ কইরা বাইর হইবেন। এই অঞ্চলে সাপখোপের উপদ্রব একটু বেশি। বিশেষ করে কেউটে সাপ। গত বর্ষা মৌসুমে সাপের কামড়ে আমার একটা গরু মারা গেল।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি স্যার। বর্ষা মৌসুম তো সাপেরই সময়। বেবাক জায়গা বানের পানিতে ডুইব্যা গ্যাছে। শুকনা জায়গার বড় অভাব।’
সাপের ভয়ে আমার গা হিম হয়ে গেল। এ তো দেখছি মহাযন্ত্রণা! ষ্টেশনের পিছনেই থই থই পানি। বৃষ্টি কিছুটা থেমে গেছে। আকাশে এখনও মেঘ ডাকছে। আমার সমস্যা হল- আকাশে মেঘের ভাব দেখা দিলেই ঘনঘন বাথরুমে যেতে হয়। হ্যারিকেনের আলোটুকুই যা ভরসা। আলোতে সাপ কাছে আসে না। সাপ কার্বলিক এসিডের চেয়েও বেশি ভয় পায় আলোকে। তবুও ভয়ের ব্যাপারটি মাথায় রেখে জব্বার মিয়াকে গাল-গল্পের সঙ্গী বানানোর চেষ্টা করলাম।
‘আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না?’
‘জব্বার মিয়া জড়োসড়ো হয়ে লম্বা বেঞ্চির এক কোণায় বসল।’
‘যদি স্যার বেয়াদবি মনে না করেন তো আমি পা উঠিয়ে বসি।’
‘বসুন বসুন। আপনার যেভাবে আরাম হয় সেভাবেই বসুন। কোনো সমস্যা নেই।’
জব্বার মিয়া পা উঠিয়ে বসল। সম্ভবত সাপের ভয়েই সে পা উঠিয়ে বসল। আমি আগেও দেখেছি, অধিকাংশ দাড়োয়ান-পাহারাদারা হয় ভীতু টাইপের মানুষ। গল্প করার সুযোগ পেয়ে জব্বার মিয়া তার জীবনের রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলো আমাকে শোনাতে শুরু করে দিল। এক সময় আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- এই লোক একের পর এক শুধু সাপের গল্পই বলে যাচ্ছে। বিচিত্র বিচিত্র সব সাপের গল্প। একবার সে স্বপ্নে দেখেছে একটা সাপ নাকি তাকে ছোবল তাড়া করছে। সে সাপের ছোবল থেকে বাঁচতে সে প্রাণপণ ছুটছে। ছুটতে ছুটতে সে হাঁফিয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় হঠাৎ নাকি তার ঘুম ভেঙে যায়। সে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকাল। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় সে লক্ষ্য করল সত্যি সত্যি একটা সাপ নাকি কুন্ডলী পাকিয়ে তার মশারীর ওপর শুয়ে আছে। একবারে আসল সাপ। শঙ্কচূড়।
বৃষ্টির মাত্রা আরো খানিকটা মনে হয় বেড়ে গেল। একটানা বৃষ্টি, থামার কোনো লক্ষণই নেই। একেক সময়ের বৃষ্টি একেক রকম। সকালের বৃষ্টি একরকম, দুপুরের বৃষ্টি আরেক রকম, নিশিরাতের বৃষ্টি সম্পূর্ণ অন্যরকমÑ কিছুটা শীতল, কিছুটা গা-কাঁপানো। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। ঘড়ির কাটা মাত্র এগারটা পেরুল। সেই সন্ধ্যাবেলা থেকেই ভীষণ ক্লান্তি ভর করেছে আমার শরীরে। আমি বিরস মুখে বসে আছি। জব্বার মিয়া যতটা আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে, আমি ঠিক ততটা মজা পাচ্ছি না। ভাবছি, এ জায়গায় রাত্রিযাপন ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছি না। মাকড়সার সাথে এখন সাপের ভয়টাও আমাকে চিন্তিত করছে। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘সাপের গল্প শুনতে আর ইচ্ছা করছে না। দয়া করে অন্য গল্প বলুন।’
জব্বার মিয়া চুপ করে গেলেন। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। সম্ভবত সাপের গল্প ছাড়া অন্য কোনো গল্প সে জানে না কিংবা আমাকে শোনোনোর মতো কোনো গল্প সে খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে আবার শুরু করল সাপের গল্প। তার মা একবার ঘরের শিকেয় ঝোলানো হাঁড়ির মধ্যে চারটা হাসের ডিম রেখেছিলেন। কিছুদিন পরে ডিম নেওয়ার জন্যে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে হাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়েই তিনি লাফিয়ে টুল থেকে নেমে পড়লেন। ঠান্ডা তুলতুলে কিছু একটা হাতের সাথে লাগতেই তিনি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন হাসের বাচ্চা ফুটেছে। পরে তার মনে হলো, হাসের বাচ্চার গা তো গরম হওয়ার কথা। তাছাড়া শিকেয় তুলে রাখা ডিমে তা দেওয়া ছাড়া হাসের বাচ্চাই বা ফুটবে কী করে? শিকে সহ হাঁড়ি নামিয়ে আনা হল ঘরের বাইরে। পুরো আট হাত লাম্বা একটা জাত সাপ নাকি ডিম চারটা খেয়ে আরামে ঘুমিয়ে ছিল সেই হাড়ির মধ্যে।
আমার বিরক্তি বুঝতে পেরে আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এবার সে শুরু করল সাপের সঙ্গম দৃশ্যের বর্ণনা। চৈত্র মাসের কোনো এক ভরা জ্যোৎস্নায় সে এই দৃশ্য দেখেছে। বর্ণনা শুনে আমার গা ঘিনঘিন করতে লাগল। জব্বার মিয়া বলল, ‘সাপের শঙ্খ লাগলে সেইখানে নতুন কাপড় বিছায়ে দেওন লাগে। শঙ্খ লাগা কাপড় যত্ন কইরা রাইখা দিলে সংসারে লক্ষী উপচাইয়া পড়ে। মামলা মোকাদ্দমায় জিত হয়। তাছাড়া ঐ জায়গার মাটি কবচে ভইরা কোমরে বাঁইন্ধা রাখলে পুরুষত্বও বাড়ে।’
আধুনিক যুগে এসব কী অদ্ভুত কথা! পৃথিবী কোথায় চলে গিয়েছে- এই জব্বার মিয়া তা জানে না। চাঁদের পিঠে মানুষের জুতোর ছাপ পড়েছে। ভয়েজার ওয়ান এবং টু উড়ে গেছে বৃহষ্পতির কিনারা ঘেষে। ভাইকিং, স্পিরিট ও কিউরিওসিটি রোবট নেমেছে মঙ্গলের মরুভূমিতে। ধুমকেতুর বুকেও রোবট নেমেছে। অথচ এই লোক এখনও কোথায় পড়ে আছে। অবশ্যি, জব্বার মিয়ার মতো একজন পাহারাদারের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কী-ই বা আশা করা যায়। আমি ঠাট্টা করার জন্য বললাম, ‘আপনি কি কাপড় বিছিয়ে দিলেন?’
সে আমার ঠাট্টা বুঝতে পারল না। সরল ভঙ্গিতে বলল, ‘জ্বি না স্যার।’
‘আর শঙ্খ লাগা মাটি?’
জব্বার মিয়া এবারও না সূচক মাথা নাড়ল।
জব্বার মিয়া লোকটি অনেকটা নির্বোধ প্রকৃতির। নির্বোধ মানুষের সাথে গল্প করতে আমার ভালো লাগে না। একে এখানে বসতে বলাই ভুল হয়েছে। এখন এই লোক নিজে থেকে উঠতেও চাইছে না। সাপ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সে আমাকে না জানিয়ে ছাড়বে বলেও মনে হচ্ছে না। একেবারে মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো অবস্থা। একবার মনে হলোÑ এই লোক আমাকে শুধু শুধু ভয় দেখানোর জন্যে বানিয়ে বানিয়ে আজগুবি সব গল্প বলছে। গ্রাম এবং মফস্বলের লোকেরা সুযোগ পেলেই শহরের লোকদের নানান ভয়ের গল্প শোনায়। কিন্তু তার মনে এরকম কোনো ইচ্ছা থাকলে, সে শুধু সাপের গল্পই বা বলবে কেন? সে বুনোহাতি কিংবা বাঘের ভয়ও দেখাতে পারত। এই নির্জন জঙ্গুলে পরিবেশে হঠাৎ বাঘ-হাতি বেরিয়ে আসাও অসম্ভব কিছু না। তাছাড়া মানুষ মিথ্যা বলে প্রয়োজন এবং স্বার্থের কারণে। এই লোকের সেই সমস্যা নেই বলেই মনে হচ্ছে। সাপের গল্প থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য এক সময় আমি বলেই ফেললাম, ‘সারাদিনের পরিশ্রমের পর কাদা-জলের জার্নিতে অনেক টায়ার্ড হয়ে এসেছি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বেঞ্চিটাতে আমি একটু লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতে চাই। আপনি বরং বাইরে থেকে আর একবার ঘুরে আসুন।’
জব্বার মিয়া পকেট থেকে পানের কৌটা বের করল। পান-সুপারি-জর্দা দিয়ে অতি যত্ন করে একটা পান খেতে খেতে আরেকটা নাতিদীর্ঘ সাপের গল্প বলে ফেলল। ওয়েটিং রুম থেকে সে যখন বের হলো তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। যে লোকটি এতক্ষণ ক্রমাগত সাপের ভয়ংকর সব গল্প বলল- তার দেখলাম তেমন ভয়-ডর নেই। হাতে টর্চ থাকতেও তা না জ্বেলে দিব্যি হনহন করে বের হয়ে গেল।
বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা মনে হয় কমে এসেছে। ষ্টেশনের ছাদে বৃষ্টির মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাসায় থাকলে এসময় নিশ্চিন্তে কাঁথার নিচে আবেশে তলিয়ে যেতাম বর্ষাঘুমে। কিন্তু এই পরিবেশে ঘুমানোর কথা চিন্তাও করতে পারছিনা। আমি সিগারেট ধরিয়ে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করলাম। অন করতে যাব, ঠিক তখনই একটা কান্ড হলো। আমার মনে হলো- ভিজিয়ে রাখা দরজার ও-পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। জব্বার মিয়া কি তাহলে এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ? নাকি সেই নুরা চোর ফিরে এসেছে ? নাকি অন্য কেউ ? অকারণে প্রচন্ড ভয় লাগল আমার। নিজের অজান্তেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম- কে, কে ওখানে? আর তখনি শুনলাম থপথপ শব্দ তুলে কেউ একজন যেন দূরে চলে যাচ্ছে। আমি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। চাঁদের আলোয় চারদিক থৈ-থৈ করছে। কোথাও কেউ নেই। জব্বার মিয়াকেও তো দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। সম্ভবত সে ঘাপটি মেরে কোথাও ঘুমিয়ে আছে। সমস্ত পাহারাদারের মধ্যেই সুযোগ বুঝে এই ঘাপটি মারা ঘুমের বাতিক থাকে। কিন্তু আমি ভেবে পেলাম না, হঠাৎ এই অস্বাভাবিক ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করল কেন? হাত দিয়ে দেখলাম- আমার গা এখনও ঘামে ভিজে আছে। হৃদস্পন্দনও অনেকখানি বেড়ে গেছে। আমি ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাতাসের অক্সিজেনের পরিমান হঠাৎ করেই আনেকখানি কমে গেছে। একবার মনে হল আমি যেন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। ভয় নামক ব্যাপারটি যে কত প্রবল এবং কী-রকম সর্বগ্রসী, তা এই প্রথম আমি টের পেলাম।
ভয়টা যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনি হঠাৎ চলেও গেল। আমি শারীরিকভাবে পুরোপুরি স্বাাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলাম। হাল্কা বাতাস দিচ্ছে। বেশ লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইলেকট্রিসিটি চলে এলো। আমি নিশ্চিন্ত মনে ওয়েটিং রুমে ফিরে এলাম ঠিকই- কিন্তু বারবার মনে হতে লাগল কিছুক্ষণ আগের এই অস্বাভাবিক ভয়টা কেন পেলাম? রহস্যটা কী? আমি খুব-একটা সাহসী মানুষ এরকম দাবি করি না ঠিক। কিন্তু অকারণে এত ভয় পাবার মতো মানুষও আমি নই। একা একা বহু জায়গায় বহু রাত কাটিয়েছি আমি। দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে বেঞ্চিতে বসা মাত্র ঠিক আগের মতো মনে হলো। ইলেকট্রিসিটিও আবার চলে গেল। বিপদসংকুল রাতগুলো নাকি ধীরে ধীরে প্রলম্বিত হতে থাকে। এখন আমার প্রতিটি সেকেন্ড কাটছে গুনেগুনে।
মার্ফি’স ল বলে একটা ব্যাপার আছে Anything that can go wrong, will go wrong. আমার বেলায়ও তাই হলো। প্রথম ভয়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে দরজার কড়ায় আবার টন করে একটা শব্দ হয়ে খানিকটা খুলে গেল। কাঁচের চুড়ির টুং-টাং শব্দের মতো মনে হলো। হ্যারিকেনের আলো কমে আসায় বাইরের জ্যোৎস্নার আলো দেখা গেল। ঠিক এমন সময় কিঞ্চিৎ ফাঁক হওয়া দরজায় প্রলম্বিত একটি ছায়া দেখা গেল। একবার ভয় কেটে গেলে দ্বিতীয়বার মানুষ চট করে আর ভয় পায় না। আমিও পেলাম না। সাথে সাথেই ঘটল অদ্ভুত এক ঘটনা। সুন্দরী এক তরুণী এসে ঢুকলো ওয়েটিং রুমে। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে মেয়েটি। সিক্তবসনা মেয়েদের রূপ-সৌন্দর্য এমনিতেই কয়েকগুন বেড়ে যায়। আলো আঁধারির মাঝে দেখে বুঝলাম দীঘল কালোকেশী এই মেয়েটি আসলেই রীতিমতো সুন্দরী। কী মিষ্টি চেহারা! ছিপছিপে শরীর, দীর্ঘ পল্লব, ছায়াময় চোখ। গায়ের রং শ্যামলা, তবে উজ্জ্বল। মেয়েটি এসেছে খালি পায়ে। কলকাতার ছবিতে দেবশ্রী নামের এক নায়িকাকে দেখেছিলাম, এই মেয়ের চেহারা অনেকটা তার মতো।
আমি পা গুটিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। বসতে বলায় মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বেঞ্চির এক কোণায় বসে পড়ল। হাত দুটি বুকের উপর আড়াআড়ি রেখে থরথর করে কাঁপছে। আমি কোমল গলায় বললাম, ‘শীত লাগছে?’ মেয়েটি কোনো কথা না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। আমি ব্যাগ থেকে আমার শুকনো তোয়ালেটা বের করে এগিয়ে দিলাম। মুখের পানি মুছে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতে চাইলে তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে নিতে বললাম। এরপরও দেখলাম সে কাঁপছে। হয়ত ঠান্ডায়, নয়ত ভয়ে। আমি রুমের কোণায় জমিয়ে রাখা ভাঙা চেয়ার-টেবিলের কাঠগুলো একত্রিত করে আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। তাৎক্ষণিক বুদ্ধিটা বেশ কাজে লাগলো। এবার সে খানিকটা স্বস্তি পেল বোধ হয়। তাছাড়া প্রজ্জ্বলিত আগুনে দারুণ একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশও সৃষ্টি হল আমাদের ঘিরে। খেয়াল করলাম আগুনের তেজ কমে আসার সাথে সাথে মেয়েটিও যেন আস্তে আস্তে একেবারে আমার কাছে চলে এসেছে। তার ভেজা চুলের গন্ধে কেমন এক মাদকতা টের পেলাম। আগুন নিভে গেলে নিকষ অন্ধকার আবরও গ্রাস করে ফেলল পুরো ষ্টেশন। হ্যারিকেনটা কখন নিভে গেছে টের পাই নি। চাঁদটাও ডুবে গেছে। বৃষ্টি খানিকটা কমে গেলেও ঝড়ো বাতাস এখনও বইছে। মেঘগুলো ক্ষিপ্ত জন্তুর মতো গুতোগুতি করছে আর গোঙ্রাচ্ছে। হঠাৎ তীব্র বজ্রের গর্জনে মেয়েটি আমার হাত চেপে ধরলো। কেমন এক অচেনা অনুভূতি যেন দোলা দিয়ে গেল আমার সমস্ত দেহে। ঝাঁকুনি খেয়ে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। চোখ খুলে দেখি জব্বার মিয়া আমার হাত ধরে ধাক্কাচ্ছে।
‘স্যার, ও স্যার, তাড়াতাড়ি উঠেন। টেরেন আইয়া পড়লো তো।’
‘আপনি?’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি জব্বার মিয়ার দিকে।
‘হ স্যার, আমি! অবাক হওনের কী হইল? টেরেন আইতাছে তো।’
আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলাম। তবে কি এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? কিন্তু স্বপ্ন এতটা বাস্তব হয় কী করে? মেয়েটির চেহারা এখনও আামর স্পষ্ট মনে আছে। ওয়েটিং রুমের মেঝেতে পোড়া কাঠের কয়লায় এখনও আগুনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। তাহলে প্রকৃত ঘটানাটি আসলে কী? আধিভৌতিক কোনো ব্যাপারেও আমার একেবারেই বিশ্বাস নেই। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই ঘটে না, ঘটতে পারে না। বস্তুজগতের প্রতিটি বস্তুকেই নিউটনের গতিসূত্র মেনে চলতে হয়। তবুও আমি যেন খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। এই ঘটনার রহস্য আমাকে জানতেই হবে। পুরো ব্যাপারটা জব্বার মিয়াকে খুলে বলতে চাইলাম। কিন্তু কীভাবে শুরু করা যায়? আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?’
‘জ্বি না। এইসব হচ্ছে কুসংস্কার। এই ষ্টিশনেই অনেক পুরান একটা রেন্টি গাছ আছে। লোকে নানান কথা কয়। কী কী নাকি দ্যাখে। আমি কোনোদিন দেখি নাই। অথচ রাইত-বিরাতেই আমার কাজ-কারবার। তয় হুনছি জ্বীন বইল্যা একটা জিনিস আছে।’
আমি কৌতুহলি হয়ে বললাম, ‘আপনি জ্বীন বিশ্বাস করেন?’
‘করুম না ক্যান? অবশ্যই করি। বিশ্বাস না করনের তো কিছু নাই। কোরান শরীফেই তো একটা সূরা আছে- সূরায়ে জ্বীন। পরিস্কার লেহা আছেÑ জ্বীন আর ইনসানের কথা। হাশরের দিনে মাইনষের যেমুন পাপ-পুণ্যের বিচার হইব জ্বীনেরও বিচার হইব।’
‘আপনি জ্বীন দেখেছেন কখনো?’
‘জ্বী না, স্যার। সাধারণ মাইনষে তো দ্যাখে না। তাছাড়া বাতাস আমরা চোউখ্যে দেখি না কিন্তু বিশ্বাস করি। তাই না দেইখ্যাও অনেক সময় অনেক কিছুই বিশ্বাস করন লাগে।’
আমি মনে মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। জব্বার মিয়া লোকটি আসলেই অসাধারণ। কোনো রকম বিশেষত্ব নেই। আমার হঠাৎ ভয় এবং রাতের মেয়েলি ঘটনার সঙ্গে এই লোকটিকে কিছুতেই জড়ানো যাচ্ছে না। সরাসরি এই প্রসঙ্গটা আনতেও অস্বস্তি লাগছে। তবু একবার বললাম, ‘আপনি রুম থেকে বের হয়ে আসার পর রাতে কেমন করে যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে যাই।’
জব্বার মিয়া সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ‘সাপ জিনিসটা তো ভয়েরই। ভয় পাওয়াটা ভালো। সাবধানে চলাফেরা করবেন। এইট্টু অসাবধান হইলেই সর্বনাশ। রাইত-বিরাতে ঘরের বাইর হইলে আলো নিয়া বাইর হইবেন। শব্দ কইরা কইরা পাও ফেলাইবেন।’
আমি আবারও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। জব্বার মিয়া যেন সাপ ছাড়া কোনো কথাই বলতে পারেন না। যে কোনো প্রসঙ্গেই উনি সাপের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। একটু পরেই ট্রেন চলে এলো। ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে আমি এই অস্বাভাবিক ঘটনাটি স্মৃতি থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলার চেষ্টা করলাম। নিজেকে বোঝালাম যে দুনিয়ায় ব্যাখ্যার অতীত কোনো কিছুই ঘটে না। সমস্ত ঘটনাটিই ছিল আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের একটি কল্পনামাত্র। মফস্বলের একটি রেলষ্টেশনের নির্জনতা কোনো-না-কোনভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছে। ঠিক এমন সময় আমি আবারও সেই চুড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম চলন্ত ট্রেনের পাশাপাশি প্লাটফর্ম ধরে দৌঁড়ে আসছে রাতের সেই মেয়েটি। ট্রেনের গতি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় এক সময় সে থেমে গেল। তার দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে দেখা গেল এক ধরনের প্রতীক্ষার ভঙ্গি।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সোহানুজ্জামান মেহরান ভাল জিনিসের ভান মান,তাই তো ভাল ভোট টা করে গেলাম।
ধন্যবাদ সোহানুজ্জামান মেহরান ভাই ।
Fahmida Bari Bipu আপনার লেখায় অত্যন্ত বিখ্যাত একজন লেখকের ছায়া খুঁজে পেলাম। লেখাটি ভাল লাগল।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি যখন যাঁর বই পড়ি, আমার লেখায় তাঁর ছায়া খুব প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, আপনি একজন ভাল মানের সচেতন পাঠক। আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
Hajera moni ভালো গল্প....অযাচিত মনের কল্পিত চরিএ গুলো অসাধারন. ভোট দিলাম
Hajera moni আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হুমায়ুন কবীর দাদা, সুন্দর গল্প লিখেছেন। একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, কাল রাত থেকে সকাল ৯ টা পর্যন্ত দেখলাম, আপনার গলপ ৫৩৩ জনে পড়েছে। এখন ৬শ পার হয়ে গেল, ভাবতেই অবাক লাগেল। তবে সুন্দর লেখার জন্য ভোট দিলাম। শুভ কামনা রইল
ধন্যবাদ হুমায়ুন কবীর ভাই, আপনার জন্যও অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
অতশী রহমান খুব সুন্দর লিখেছেন। ভোট এবং শুভ কামনা রইল।
ধন্যবাদ আপনাকে।
এমএআর শায়েল Dada, Kub Sundor Ekta lika likesen. amar page e sagotom
ধন্যবাদ শায়েল ভাই।
আখতারুজ্জামান সোহাগ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পটা লিখেছেন দারুণ দক্ষতায়, পাঠক পড়া থামাতে পারবে না বলেই আমার বিশ্বাস। রাতের স্টেশন, জব্বার চরিত্রটি, কিংবা মেয়েটির চরিত্র- সব কিছু আপনি এত নিখুঁতভাবে তৈরি করেছেন যেন পাঠকের চোখের সামনে ভাসে তা। মুগ্ধতা রেখে গেলাম। আর শুভকামনা আপনার জন্য।
ধন্যবাদ সোহাগ ভাই।
রবিউল ই রুবেন ভাল লাগল। ভোট রইল।
অসংখ্য ধন্যবাদ রুবেন ভাই।
Tumpa Broken Angel আমার কলেজের বাংলা স্যারকে প্রার্থনা করতে শুনতাম তার উপর যেন পরী ভর করে। ওমন পরী বোধয় আপনার গল্পের নায়কের উপর ভর করেছে। হাহাহা গল্পটা খুব সুন্দর হয়েছে। পড়ে স্বাদ পেলাম। শুভকামনা জানবেন।
Tumpa Broken Angel আপনার জন্যও অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
শামীম খান লেখাটিতে যথেষ্ট ম্যাচুরিটি । কাহিনী বিন্যাস , শব্দ চয়ন সবই ভাল লেগেছে । ভোট আর শুভ কামনা রেখে গেলাম ।
ধন্যবাদ ভাই শামীম খান।

২৫ ফেব্রুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“এপ্রিল ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ এপ্রিল, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী