লোকটি মাথা নিচু করে বসে আছে। কব্জি থেকে ব্লিডিং হচ্ছে। একটু আগে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। ব্যান্ডেজ রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে যাচ্ছে।
মারুফ বুঝতে পারছে না তার এখন কি করা উচিত। সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার লোকটি কোন কথা বলছে না। বোবাও হতে পারে। কিন্তু বোবারাও বিভিন্ন কায়দায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। লোকটা সেই তখন থেকে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে।
পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য সে অনেক কথায় বলেছে-
আমার চেম্বার তো রক্তাক্ত প্রান্তর বানিয়ে ফেলেছেন। রক্তাক্ত প্রান্তর পড়েছেন? মুনির চৌধুরীর লেখা নাটক, পড়েননি? ঘটনা ঘটছে কখন? জমি নিয়ে মারামারি না অন্য কিছু? আর কেউ আহত হয়নি?
আপনার একটা আরটারি কেটে গেছে। একেবারে জায়গা মতো মারছে। দাও দিয়ে কোপ দিয়েছে? আপনার অনেক ব্লিডিং হয়েছে। আপনি কাটা জায়গাটা চেপে ধরে আসবেন না? একটা পাগলও তো বিষয়টা জানে। ব্লাড দিতে হবে। ব্লাড গ্রুপ জানা আছে?
কোন জবাব নেই। অস্বস্তিকর ব্যাপার।
ব্লিডিং বন্ধ করার কোন উপায় মারুফের মাথায় আসছে না। সে একজন ডাক্তার। সে অবশ্যই জানবে ব্লিডিং বন্ধ করতে হলে কি করতে হবে। কিছুই মনে পড়ছে। ভয়ঙ্কর অবস্থা। এভাবে ব্লিডিং হতে থাকলে তো রোগী শকে চলে যাবে।
এক সময় ভালো মন্দ কিছু না বুঝে সে হড়বড় করে বলে ফেলল-
হাস্পাতালে চলে যান। পুরো আরটারি গেছে। অপারেশান লাগবে। এখনি ভর্তি হয়ে যান। এতক্ষণ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেমন করে? আপনার তো শকে চলে যাওয়ার কথা। আপনার সাথে আর কেউ আসেনি?
লোকটা কোন উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে বাইরে চলে গেল। মারুফের মনে হল তার বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। পাথর নিচে বেশিক্ষণ থাকল না। কারণ একটু পরে লোকটি আবার চেম্বারে ঢুকল। লোকটি এবার কথা বলল।
খুব শীতল গলায় স্পষ্ট স্বরে বলল- স্যার, রক্ত বন্ধ করে দিন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রক্ত বন্ধ করেন।
মারুফ মহাবিরক্ত নিয়ে বলল-আপনি এখনও যাননি? পাশেই হাসপাতাল। রিকশা নিয়ে চলে যান। ব্লাড লাগবে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত বন্ধ তো এখানে হবেনা। এজন্য আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলছি। বড় রগ কেটে গেছে। অপারেশন লাগবে। এক কথা কত বার বলব?
লোকটি বোধ হয় মারুফের কথা খেয়াল করেনি। কারণ লোকটি আবার বলল-রক্ত বন্ধ করেন। রক্ত বন্ধ করেন।
হঠাৎ করে মারুফ খেয়াল করলো লোকটা তার হাতের রক্ত নিয়ে তার দিকে ছুড়ে মারছে। সে হাত হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। রক্ত গুলো হাত ফুঁড়ে এসে মুখে লাগছে। লোকটাকে নিষেধও করতে পারছে না। কারণ শত চেষ্টা করেও তার গলার স্বর বের হচ্ছে না।
আটটা বাজে। পার্থ এক গ্লাস পানি নিয়ে মারুফের ঘরে ঢুকল। মারুফ মরার মতো ঘুমায়। তাকে জাগানোর সহজ উপায় ফিল্মি স্টাইলে পানি ছিটিয়ে দেয়া। আজো এর ব্যতিক্রম ঘটল না। মারুফ লাফ দিয়ে উঠল। তার চোখে মুখে মহাবিরক্তি।
মারুফ রেগে আগুন হয়ে বলল-এসব ফাজলামি আমার সাথে করবি না। সব কিছুর একটা সীমা থাকা দরকার। ধ্যাত কানের মধ্যে বোধ হয় পানি চলে গেছে। তোর পাছায় কষে একটা লাত্থি দেওয়া দরকার।
পার্থ নিরীহ গলায় বলল--যা বাবা। যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর। আমি না ডাকলে তো ডেমো ক্লাস মিস করতি।
-আমার জন্য চুরি করতে কবে তোকে আমি বায়না করেছিলাম। তাছাড়া পানি দিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর মধ্যে একটা রোমান্টিকতা আছে। ছেলেদের জন্য ওটা নিষিদ্ধ। বউ বা শালি টাইপ কেউ হলে মানা যায়।
-তোর মুখে খই ফুটতে শুরু করেছে। যাহোক খই ফুটুক আর না ফুটুক, আজ যেতে হবে। আমি গেলাম। তুই বসে বসে খই ভাজ। শামিম স্যারের ক্লাস। আমি নাই নাই নাইরে...
-আরে দাড়া... দাড়া... দুমিনিট লাগবে।
২
-আজ মজার একটা স্বপ্ন দেখেছি, হররও বলা যেতে পারে,শুনবি? যদিও যাকে তাকে স্বপ্ন বলা ঠিক না, এতে স্বপ্নের গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায়।
পার্থর কোন আগ্রহ না দেখে মারুফ আপন মনে বলা শুরু করল--দেখলাম আমি চেম্বারে বসে আছি। হাত কাটা এক রোগী এসেছে। রেডিয়াল আরটারি দুভাগ করা। ফজরের ওয়াক্তে দেখেছি। তাহলে ডাক্তার হয়েই যাচ্ছি।
পার্থ সুবোধ বালকের মতো হু ধরে যাচ্ছে। ছোটবেলায় দাদি-নানির গল্পে যেভাবে হু ধরতে হয় সেভাবে।
-স্বপ্নে একটা খারাপ ব্যাপারও ঘটেছে। এক পর্যায়ে রোগী আমার চোখে মুখে রক্ত ছুঁড়ে মারছিল।
--আর সে মুহূর্তে আমি পানি মারছিলাম। দারুণ কম্বিনেশন তো। তোর স্বপ্নের এই ব্যাপারটায় আমার কাছে কেমন জানি লাগছে। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষের রুহ আকাশের দিকে যেতে থাকে। আকাশে পৌছার পূর্বেই মানুষ যা দেখে তা মিথ্যা স্বপ্ন।
মারুফ বলল--আকাশ বলতে কত দূর বুঝাচ্ছিস?
---ঠিক জানিনা। তবে লাওহে মাহফুজ হতে রুহাইল নামক ফেরেশতা বান্দাকে যা দেখায় সে স্বপ্নই সত্যি হয়।
মারুফ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল--স্বপ্ন তো কঠিন একটা প্যাঁচের ব্যাপার।
পার্থ বিজ্ঞের মতো যেন সবজান্তা শমসের একরম ভাব নিয়ে বলল--তুই তো রক্ত দেখেছিস না?
---হ্যাঁ গড়িয়ে পড়ছিল। একবার ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলাম। বন্ধ হয়না।
---তুই ব্যান্ডেজ করতে জানিস?
---স্বপ্নের ভেতর কিছু জানতে হয়না। রক্ত দেখলে কি হয় জানিস?
---কোন হাত থেকে রক্ত পড়ছিল?
মারুফ কিছুক্ষণ ভেবে বলল--সেটা তো খেয়াল নাই।
পার্থ জ্যোতিষীর মতো বলল--ডান হাতে দেখলে—সম্পদ বাড়বে, আর বাম হাতে দেখলে বন্ধুর সংখ্যা বাড়বে। মারুফের মনে হল সে বোধ হয় ডান হাতই দেখেছে।
৩
ডিসেকশন রুম। সবাই ডেড বডি দেখছে। পার্থ মারুফ ঢুকল। একটু লেট হয়ে গেছে। একটা বিষয় নিয়ে সবাই কনফিউজড।
একটু পরে ভক্ত ঢুকল। সবার ধারণা ভক্ত তাদের কনফিউশন দূর করতে পারবে। প্রেম করার সাথে সাথে ছেলেটা ইদানিং ভালোই পড়াশুনা করছে।
মারুফ বলল--একটা ডেমো দে ভক্ত। এই আইটেম কবে নিবে? কাল, নারে?
ভক্ত ডেমো দিচ্ছিল। এমন সময় মারুফ অ্যাক্সিলা থেকে বের হওয়া সুতার মতো একটা বস্তু ধরে বলল—এটা কিরে ভক্ত। আরটারি, ভেইন নাকি নার্ভ। কিছুই তো বুঝি না।
ভক্ত বলল--ওটা নিয়ে সবার কনফিউশন। সুব্রত বলছে ব্রাকিয়াল ভেইন আর সি ব্যাচের মেহেদি বলছে ভেনি কমিট্যাঙস আর ডি ব্যাচের...
ভক্তর কথা শেষ না হতেই মারুফ টান মেরে সুতার কনফিউশন তৈরি করা বস্তুটি ছিঁড়ে ফেলল। দাঁত বের করে হেসে বলল—যা ঝামেলা শেষ।
ভক্ত—কি হল ভাই এটা?
মারুফ বলল—স্যার এটা নিয়েই প্যাঁচ খেলতো। স্যারের সাথে টম অ্যান্ড জেরি খেলার কোন মানে হয়। ছিঁড়ে ফেলেছি, ঝামেলা শেষ।
ভক্ত সহ আরও কয়েকটি সিরিয়াস টাইপ মেয়ে বলে উঠল--এসব করা উচিত না, মারুফ। একটা মানুষের দেহ কেটেকুটে তুই ডাক্তার হবি। যার ভাগ্যে একটা কবর পর্যন্ত মেলেনি তার প্রতি একটা ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা দেখাবি না?
--ওরে ওরে আমার মানবতাকর্মী রে…
--মানবিক দিকটা তুই বিবেচনা কর... বডিটা তো তোর কোন প্রিয়জনেরও হতে পারে। পারেনা?
--না। পারেনা।
--তোরা যদি এখনি বডি নষ্ট করে ফেলিস, পরের ব্যাচগুলোর কি হাল হবে ভাব।
--ওত ভাবাভাবির মধ্যে আমি নাই। লাশ নষ্ট হবে আবার নতুন লাশ আসবে। দেশে তো লাশের অভাব পড়েনি।
পার্থ তর্ক প্রতিযোগিতার ইতি টানার জন্য বলল--বাদ দে তো। শেষ একটা ডেমো হয়ে যাক।
ডেমোর পরে অডিটোরিয়ামের পেছনে পার্থ এবং ভক্তের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন হয়ে গেল।
পার্থ—কাজ হয়েছে। আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছেনা।
ভক্ত—কি?
পার্থ—বলেছিলাম না। ‘মারুফ অথবা স্বপ্ন’ এ নিয়ে একটা গল্প লিখব। আজ সে নিজের মুখে বলেছে। আমার তৈরি করা স্বপ্নের কথা।
ভক্ত—এভাবে মানুষকে স্বপ্ন দেখানো সম্ভব? ড্রিম মেকিং! আজব তো।
পার্থ—আজও একটা সাসপেন্স থাকছে।
ভক্ত—নতুন কিছু?
পার্থ—আরে না। প্রতিদিন নতুন নতুন হলে ভয় পাবেনা। সেকেন্ড ইপিসোড বলতে পারিস।
ভক্ত—রেকর্ডের শব্দে তার যদি সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙ্গে যায়। দারুণ একটা প্যাঁচ লাগবে বুঝতে পারছিস।
পার্থ—এটাই তো মারুফের দুর্বল পয়েন্ট। সে ঘুম দেয় কুম্ভকর্ণ টাইপ। হাতির শুঁড় দিয়ে পাছায় গুতা দিলেও জাগবে না।
৪
ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। ঘুমঘুম চোখে পড়ার কোন মানেই হয় না। ধুর জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে মারুফ চোখ বুজলো। এবং কিছুক্ষণ পরই সে ঘুমের জগতে চলে গেল।
পার্থর ঘুমহীন জগতে ঘটছে ভিন্ন ঘটনা। সে পা টিপে টিপে মারুফের ঘরে ঢুকে তার কানের পাশে একটা রেকর্ড অন করে দিয়েছে । ফোন থেকে পার্থর গলা ভেসে আসছে। গভীর রাতে ওর গলাটা এতো অদ্ভুত শোনায় কেন, কে জানে।
মারুফ— আপনি আবার এসেছেন। আপনাকে না হাসপাতালে ভর্তি হতে বললাম।
লোকটার স্পষ্ট স্বরে বলল-রক্ত বন্ধ করেন। ডাক্তার সাহেব রক্ত বন্ধ করেন।
মারুফ দেখল লোকটার বগলের নিচ থেকে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে।
সে জিজ্ঞেস করল-কি করে হল?
লোকটা শীতল গলায় বলল--সেটা আপনি জানেন।
-কেটেছে আপনার, জানব আমি? বুঝতে পেরেছি ব্রেইনে অক্সিজেনের ঘাটতি পড়েছে। হাইপক্সিয়া। কনভালশন হচ্ছে। এখনি ব্লিডিঙ বন্ধ করতে হবে। শার্ট খুলুন।
লোকটি একটু দুরে গিয়ে বলল--শার্ট খোলা যাবেনা। রক্ত বন্ধ করেন। স্যার ওষুধ দ্যান। ইনজেকশন নাই ইনজেকশন।
মারুফ বিরক্ত হয়ে বলল--ডাক্তার আমি না আপনি? শার্ট খুলেন।
লোকটি মুচকি হেসে বলল-আপনি ভয় পাবেন। স্যার আপনি ভয় পাবেন।
মারুফ ধমক দিয়ে বলল—চুপ। বেশি কথা বলেবেন না। শার্ট খুলেন। হাতি ঘোড়া গেল তল রোগী বলে কত জল।
লোকটার বুকের দিকে তাকিয়ে মারুফের রক্ত হিম হয়ে এলো। সে খুব জোরে একটা চিৎকার দিতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে কোন স্বর বের হল না।
৫
ডিসেকশন রুম। সবাই বডি দেখছে। কদিন পরে টার্ম পরীক্ষা। মারুফ পার্থ কে নিয়ে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। সে ঘামছিল। তার চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। গতরাতে ঘুম হয় নাই। উল্টা পাল্টা অনেক কিছু ভেবেছে।
---ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপার ঘটেছে, দোস্ত।
পার্থ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল--কি?
---তোকে যে স্বপ্নটার কথা বলেছিলাম, ওটা আবার গতরাতে দেখেছি। পাত্রপাত্রী স্থান কাল সব এক। স্টার জলসার সিরিয়ালের মতো।
---স্বপ্নে ‘রোগী’ দেখার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য আছে। গতকাল মনে ছিলনা। এর মানে কেউ আরোগ্য লাভ করবে বুঝায়।
---বাদ দে ঐ সব ব্যাখ্যা। আমি যখন ওকে শার্ট খুলতে বললাম—বিশ্বাস কর শার্টের নিচে শুধু বন্স। রিবস স্টার্নাম। কঙ্কাল। মনে হচ্ছিলো একটু আগে কেউ মাংস ছাড়িয়ে নিয়েছে। কি ভয়ঙ্কর অবস্থা চিন্তা কর।
পার্থ কিছুক্ষণ ভেবে বলল--আমি অন্য একটা ব্যাপার ভাবছি। পরাবাস্তব কিছু। দেখ ডিসেকশন রুম একটা অপবিত্র জায়গা। এখানে যে লাশ গুলো রাখা হয় তার জানাযা সৎকার কিছুই হয়না।এখানে পরাবাস্তব বা আত্মা জাতীয় কিছুর আসা যাওয়া থাকতে পারে। তুই যে মাঝে মধ্যে লাশের বিভিন্ন অংশ ছিঁড়ে ফেলে দিস। এর সাথেও একটা যোগ থাকতে পারে।
মারুফ পার্থর কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল--এই না হলে তুই পার্থ। ব্রাহ্মণ ও গোয়ালার মধ্যেও সম্পর্কের গন্ধ পাস।
পার্থ বলল--ব্যাপারটা এভাবে ভাব। তুই ডেড বডির রেডিয়াল আরটারি ছিঁড়ে ফেলার পর স্বপ্নে দেখলি এক লোক কাটা হাত নিয়ে তোর কাছে এসেছে। তোকে জানাতে চাচ্ছে তার প্রতিও মানবিক হতে হবে।
মারুফ বলল--চুপ থাক। উল্টাপাল্টা এসব যুক্তি কই পাস?
পার্থ বলল--তাহলে চল একটা এক্সপেরিমেন্ট করি।
---কিভাবে?
---ধর আজ তুই ডেড বডির চোখের ভেতরে লাঠি ঢুকিয়ে দিবি। রাতে যদি দেখিস চোখ ভরতি রক্ত নিয়ে কেউ তোর এসেছে তাহলে বুঝব আমার ধারণা ঠিক। আর যদি না আসে তুই তাহলে জিতে যাবি।
মারুফ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর কণ্ঠে বলল--চল।
ডিসেকশন রুমে গিয়ে মারুফ লাঠি দিয়ে লাশের চোখে কয়েকবার গুতা দিল।
পার্থ বলল--থাক হয়েছে।
মারুফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল--দাঁড়া। বেশি জখম না হলে ডাক্তারের কাছে নাও আসতে পারে। চোখে গরম কাপড়ের শেক দিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে। হাজার হোক বাঙালি আত্মা।
৬
মারুফ--পার্থ আমার ভেগাস কোন কাজ করছে না।
---মানে? কোন ভেগাস?
---ধর আমি স্বপ্নটা দেখলাম। তাহলে কি ধরে নিব আমাকে জীনে ধরেছে। পাড়ার লোকে কয় জীনে ভুতে ধরেছে। মেডিকেল ভাষায় টার্মটা কি হবেরে—সিজোফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া না কি?
পার্থ মুচকি হেসে বলল--যা ঘুমা। নো টেনশন ডু ফুর্তি। অবশ্য শেষ ফুর্তি আমিই করব। শোন ভূতে ধরলেও অসুবিধা নাই। সূরা মুমিনুন এর ১১৫-১১৮ নম্বর আয়াত পড়ে তিনবার মুখে পানির ছিটা আর কানের ভেতর ফুক দিলেই জিনের গুষ্টিসহ পালাবে। আর যদি ঘুম না আসে তারও ব্যবস্থা আছে।
মারুফ যেন পার্থর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেনি। সে আপন মনেই বলছে---বিটা ব্লকার জাতীয় কিছু খাব। হার্ট রেট বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে থোরাসিক কেজ ভেঙ্গে হার্ট বের হয়ে চলে আসবে।
---আরে এতো ডরাস ক্যান। তুই কি ডরাস সখা ভিখারি ভুতেরে। তাইনা?
মারুফ কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জেল খানার কবিতা আবৃত্তি করল। আবৃত্তি করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।
সুন্দর একটা ঘুম হল। যাকে বলে একেবারে ফ্রেশ ঘুম। বদ রোগীটার কোন খবর নেই। পার্থ তখনো ওঠে নাই। রাত তিনটা পর্যন্ত বন্স পড়েছে।
মারুফ এক গ্লাস পানি নিয়ে পার্থর মুখের উপর ঢেলে দিল। সে লাফ দিয়ে উঠলো। মারুফের মুখ হাসি হাসি। তার মানে আজ কোন স্বপ্ন দেখেনি। কেন এমন হল। ভুলটা কোথায়? সে চশমা চোখে দিয়ে চিন্তিত মুখে মারুফের দিকে তাকাল। মারুফ তখন থেকেই বকবক করছিল। এতক্ষণ কিছুই কানে ঢোকেনি। এই মুহূর্তে কিছু কিছু শুনতে পাচ্ছে।
--দোস্ত স্বপ্নের কোন নাতি পুতিরও তো দেখা পেলাম না।
--ভালো করে মনে করে দেখ।
--দেখা আছে। প্রিয় জীন স্পেশালিষ্ট আপনি ফেল মেরেছেন।
--দোস্ত তাহলে কে জিতল?
--আপাতত তুই। তোর ফোন বাজছে ধর।
--ওহ। হ্যালো ভক্ত। কখন আসবি? কি দশটায়?
মারুফের একা যেতে ভালো লাগছিল না। তাই সে পার্থকে ধরল--চল পার্থ বডি দেখে আসি। সাড়ে দশটায় ভক্ত একটা ডেমো দেব। এক্সিলা আর একবার দেখা দরকার।
পার্থ চোখ না খুলেই বলল-যাবনা। দুইবার দেখেছি। তুই যা। দেখে আয়।
মারুফ ব্যর্থ হয়ে বলল--ওকে। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে...
৭
মারুফ ডিসেকশন রুমের বাইরে থেকে দেখল ভক্ত ভেতরে ডেড বডি দেখছে। গলা উঁচিয়ে কয়েকবার ডাক দিল-ভক্ত, ভক্ত...
কোন সাড়া নেই। কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে বলল—কিরে ডাকতেছি শুনতে পাচ্ছিস না?
ভক্ত তার দিকে ফিরল। না, এ ভক্ত নয়। সেই রোগীটা। লোকটার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। কব্জি, বগল থেকে ব্লিডিং হচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা রুম। লোকটা শীতল গলায় কথা বলে যাচ্ছে...
--ডাক্তার সাহেব, আমার চোখ গলে গেছে, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। রক্ত বের হচ্ছে, রক্ত বন্ধ করেন। ডাক্তার সাহেব। রক্ত বন্ধ করেন।
মারুফের গলা শুকিয়ে গেছে। সে প্রাণপণে চিৎকার করছে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছেনা। পা যেন মেঝের সাথে লেগে গেছে। লোকটা একটানা কথা বলে যাচ্ছে। এক ভয়ানক ঘোর তাকে গ্রাস করে ফেলছে। আর কিচ্ছু করার নেই, কিচ্ছু না।
একসময় মারুফের মনে হল সে যেন দৌড়াচ্ছে। ম্যারাথন টাইপ দৌড়। রাস্তার অটো-রিকশা, ভ্যান ওভারটেক করে যাচ্ছে। পথ ফুরাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে যাচ্ছে কোথায়? চারপাশে সবকিছু অচেনা মনে হচ্ছে। আকাশ এতো ভয়ানক ভাবে কাল হয়ে গেছে কেন। আর গাছগুলো, সেগুলো কি কথা বলছে? মারুফ বুঝতে পারছে না। কি ঘটছে। সে কি মারা গেছে? এটা কি আত্মাদের জগত?
এক সময় মনে হল সামনে এক দরজা। হ্যাঁ এটা তো তার ঘর। ঐ তো তার পড়ার টেবিল। র্যা ক। এনাটমির বই। জানালা-দরজা খোলা। কিন্তু সে তো লক করে গিয়েছিল। কি হচ্ছে কি তার সাথে?
সে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর ঢুকল। সারা মেঝেতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ছড়িয়ে আছে। রক্তের একটা স্রোত আসছে বেল্কুনি থেকে। সে বেল্কুনির দরজা খুলল। হ্যাঁ কোনায় অন্ধকারে ঘাপটি মেরে একজন বসে আছে।
সে কোন কথা বলল না। পালানোর চেষ্টাও করল না। সে জানে পালিয়ে কোন লাভ নেই। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। লোকটি এগিয়ে আসছে।
মারুফের খুব ইচ্ছে করল লোকটার ব্লিডিং বন্ধ করতে। কিন্তু কি করবে সে? তার যে এখনও কিছুই শেখা হয়নি...
পরিশিষ্টঃ না পড়লেও চলবে
এরও অনেক আগে যা ঘটেছিল
পার্থ—মারুফ প্রতিদিনই ডেড বডির কিছু না কিছু নষ্ট করছে। ওকে হাফ ডোজের একটা অ্যান্টিবায়োটিক দেব।
ভক্ত—কিভাবে। বেটা ঘাগুমাল।
পার্থ—কাটা দিয়ে কাটা তুলব। আমার প্রসেস তা শোন, প্রথমে মোবাইলে রেকর্ডার দিয়ে ঐ লাশের কিছু কথা রেকর্ড করব।
ভক্ত—লাশের কথা মানে?
পার্থ—লাশই কথা বলবে আমাদের মুখ দিয়ে। যেমন ধর রেকর্ড করলাম—ডাক্তার সাহেব, ডাক্তার সাহেব, আপনি উঠুন, খুব রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত বন্ধ করুন। রক্ত বন্ধ করে দিন।
তারপর ভক্ত ঘুমিয়ে পড়লে ওর কানের কাছে আমি রেকর্ডারটা অন করে দিব। রেকর্ড করা কথা গুলো প্রথমে তার অবচেতন মন জানবে তারপর সে তার চেতনাকে তা জানাতে চাইবে। তখনি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম সে অনুপাতে একটা দৃশ্য তৈরি করবে। স্বপ্ন তৈরি হবে। স্পেশাল রেডিমেড ড্রিম।
ভক্ত—এরকম প্রসেস কোথায় যেন পড়েছিলাম। একটা উপন্যাসে। আচ্ছা, কাজ করার সম্ভাবনা কতটুকু?
পার্থ—ফিফটি ফিফটি। চেষ্টা করতে তো অসুবিধা নাই।
ভক্ত—কোন সাইড ইফেক্ট যদি হয়।
পার্থ—আমি ভাবিনি। বলত দুএকটা...
২০ ফেব্রুয়ারী - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪