রাকিব ট্রেনে ব্যাগটা রেখে টিকেট কাটতে গেল। পাশের সিটটা খালিই ছিলো; জানালার ধারে সিটটাতে রাকিব ব্যাগটা রেখে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে ওর পাশের সিটটা ফাঁকাই দেখলো। আস্তে আস্তে অন্য সব সিট ভর্তি হয়ে গেল ঐ সিটটা খালি থেকে গেল। সকালবেলার ট্রেনটা ঠিক সময়ই ছাড়ে।ট্রেন ছাড়ার সময়ও হয়ে গেছে। রাকিব ভাবলো কেউ আর ঐ সিটটায় বসবেনা তাই নিজের ব্যাগটা সেই সিটে রাখলো। ট্রেন হুইসেল দিয়ে দিলো ছাড়বে ছাড়বে ভাব এমন সময় দেখলো জানলা দিয়ে; একটা মেয়ে ওর কামরার পাশ দিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের কামরার দরজার দিকে যাচ্ছে। ট্রেন ইতিমধ্যে ছেড়ে দিল। ট্রেন চলতে শুরু করলে রাকিব মোবাইলটা বের করে হেডফোন কানে লাগাতে যাবে এমন সময় দেখলো সেই মেয়ে কিছুটা হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের কামরায় ঐ সিট ফাঁকা দেখে ওখানেই এসে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাকিব প্রশ্ন করলো 'আপনি কি এখানে বসবেন?' মেয়েটা উত্তরে বললো 'এই সিট কি খালি' মেয়েটা রাকিবের দিকে না তাকিয়েই বললো 'একটা ব্যাগ দেখছি?' 'ব্যাগটা কার জানেন কি?' রাকিব বললো ব্যাগটা আমার আপনি বসতে পারেন; বলে ব্যাগটা নিয়ে উপরে বাংকারে রাখলো। চেহারায় মেয়েটার একটা নিষ্পাপ ভীত ভাব ; বসবো কী বসবোনা করতে করতে বসে পড়লো কিন্তু একটু কুঞ্চিতভাবেই রাকিবের পাশে বসলো আর হাতের ছোট ব্যাগটা দু'জনার মাঝে রাখলো। সিটটা বড়ই ছিলো কিন্তু মেয়েটির এতো দ্বিধা দেখে রাকিব বুঝলো মেয়েটি লজ্জা পাচ্ছে আর অস্বস্তি বোধ করছে; তাই বলবে কী বলবেনা ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞাসা করলো 'কী কোনো সমস্যা হচ্ছে?' মেয়েটা কুঞ্চিতভাবে বললো না ঠিক আছে। রাকিব নিজেও অপরিচিত জন বিশেষ করে মেয়েদের সাথে যেচে কথা বলতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য না আর এই মেয়েটাকে একটু বেশি অনিচ্ছুক ধরনের মনে হলো। তাই রাকিব তাকে আর কিছু বলতে চাইছিলো না। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা নিজের ভ্যানিটিব্যাগ খুললো খুব তন্নতন্ন করে কী যেন খোঁজা শুরু করলো ; অনেকক্ষণ ধরে খোঁজার পর মেয়েটাকে কেমন বিচলিত মনে হলো। মেয়েটা গরমে একটু ঘেমে গেছিলো ; রাকিব দেখে নিল মেয়েটাকে কিন্তু খুব সাবধানে কারণ রাকিব কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়না আর এই মেয়েটাকে দেখে প্রথমেই মনে হচ্ছিল সে চাচ্ছেনা রাকিব তার সাথে কথা বলুক তাই রাকিব নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকলো। কিন্তু মেয়েটাকে যতখানি দেখলো তার হাবভাবে মনে হলো মেয়েটা কোনো সমস্যায় পড়েছে। বিন্দু বিন্দু রূপালী ঘাম বিন্দু মেয়েটার চন্দনের মতো মুখে জমা হয়ে তার মুখটাকে মনে হচ্ছিল ভোরের শিশির পড়া একটা গোলাপ যে পাতার আড়ালে তার রূপ লুকাতে চায়। এক স্বাভাবিক কিন্তু গভীর সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখে। লাবণ্যভরা সুন্দর মুখে কোন সুক্ষ্ম চিন্তায় সরলতার মাঝে আরক্তিম গোলাপি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। চাঁদের মতো মিষ্টি এক মুখ, ঘন কালো চুল, এক জোড়া বড় বড় কালো ঘন পাপড়িযুক্ত সৎ অভিজাত চোখ বোঝার উপায় নেই সে ক্লাস টেনে পড়ে না অনার্সে পড়ে। হাত জোড়া যা ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজছিলো মনে হয় কোনো শিল্পি যত্ন করে তৈরি করেছে কিন্তু তা ছিলো মানুষের একজোড়া হাত নিটোল আর মনকাড়া সুন্দর। সব মিলে; সুমিষ্ট বাচন , সরল কিন্তু আকর্ষণীয় চেহারা, আর সুরুচির একটা ছাপ মেয়েটার পুরো চরিত্রে বিকশিত। রাকিব মেয়েদের এমনভাবে দেখেনা বরং লম্বা, সুদর্শন মার্জিত রাকিবকেই মেয়েরা দেখে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে কিন্তু তেমন কোনো মেয়েই রাকিবকে পুরোপুরি আকৃষ্ট করতে পারেনি এখন পর্যন্ত কিন্তু আজ হঠাৎ দেখা এই মেয়ে কেন যেন রাকিবের মনে খুব ছোট হলেও সন্তর্পণ একটা আকর্ষণ জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু এ তো মাত্র কয়েক মুহূর্তের অবলোকন মাত্র তাতে এতো টান কেনইবা আসবে? আসলে মেয়েটার রাকিবের প্রতি বেশি নিরাসক্ত মনোভাব রাকিবকে বেশি উৎসুক করে তুলেছে মেয়েটার প্রতি। তবে রাকিবের গায়ে পড়ে কথা বলার স্বভাব বিশেষ করে মেয়েদের সাথে একদমই নেই তাই রাকিব আগ্রহ অবদমন করে একটা গানে মনোযোগ দিতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার পাশে বসে থাকা এক মেয়ে যার শরীর থেকে হালকা একটা মিষ্টি সুগন্ধ এসে তীব্রভাবে ভাসিয়ে নিতে চাচ্ছিল; তার সাথে একটু কথা বলবার তীব্র একটা বাসনা রাকিবকে আরো অস্থির করে তুললো আশ্চর্যজনকভাবে। রাকিব নিজের দিকে চিন্তা ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো । কিন্তু মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে মানুষ তার নিজের প্রতি যতোনা আগ্রহ নিয়ে জীবন কাটায় তার হাজারগুণ বেশি আগ্রহ তার বহির্জগত নিয়ে। সে হয়ত তা নিজেই জানেনা। আর মানুষ যতো বেশি নিজের মাঝে গুটাতে চেষ্টা করে ততোই একটা অজানা শক্তি তাকে চুপিচুপি এসে বলে এতো লুকিয়ে থেকে কী হবে তুমিতো যা চাও তা এ নয় ; তুমি বের হয়ে এসো বের হয়ে এসো বাহিরে।
সেকারণেই বোধহয় এই একেবারে অপরিচিত ; প্রথম দেখা মেয়েটি রাকিবের নিজের কাছে টেনে রাখা মনকে ঐ মেয়েটির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো আর সব চিন্তা গ্রাস করে। কিছুক্ষণ কিছু খুঁজে না পেয়ে মেয়েটা আরো বেশি অস্থির হলো। রাকিব মানুষের মন ভালো পড়তে পারতো। বুঝলো মেয়েটি সাময়িক কোনো সমস্যায় পড়েছে কিন্তু প্রকাশ করতে চাচ্ছেনা। রাকিবের মন আপ্রাণ চাচ্ছিলো মেয়েটা কিছু একটা বলুক কিন্তু রাকিবকে নিরাশ করে মেয়েটি চিন্তিত তবুও খুব শান্ত হয়ে থাকার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মেয়েটি যে কিছু বিষয় নিয়ে খুব আলোড়িত তা বোঝাই যাচ্ছিলো। তবুও তা প্রকাশ করছিলোনা আড়ষ্টতার কারণে। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলোনা। উসখুস করতে করতে বলেই ফেললো ; রাকিবদের সামনে এক পরিবার বসেছিলো গ্রামের সহজ সরল পরিবার বোঝা যাচ্ছিল তাদের কথাতেই তারা স্বামী, স্ত্রী । কিছুক্ষণ পরেই মিষ্টি পাখির মতো কণ্ঠ আবার বেঁজ উঠলো সে সামনের উপবিষ্ট সেই দম্পতিদ্বয়কে উদ্দেশ্য করে বললো আচ্ছা ট্রেন থেকে কি মোবাইলে কল করা যায়? লোকটি হা করে ছিলো কিছু বুঝতে না পেরে তাই মেয়েটি আবার সেই বৃদ্ধ লোকটিকে প্রশ্ন করলো আচ্ছা আঙ্কেল ট্রেন থেকে মোবাইলে কল করা যায়। রাকিব বুঝলো খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু সমস্ত অনুভূতি মনে চেপে কিছুই বললোনা; কারণ যে মেয়ে তাকে উপেক্ষা করে গেল পাশে থাকার পরও তাকে যেচে কিছু বলতে যাওয়া রাকিবের স্বভাবে ছিলোনা। লোকটি যখনি হা করে আছে তার স্ত্রী তাকে একটা গুঁতো দিয়ে বললো মেয়েটা জানি কী জিগায় তোমায় উত্তর দাওনা কেন? লোকটি শান্ত গলায় এবার মেয়েটিকে বললো আমায় কিছু বলো মা। আসলে ট্রেন তখন আশপাশের ক্ষেত, খামার, রাস্তাঘাট, গাছপালা পিছনে ফেলে রেলনাইনের ওপর দিয়ে দোল খেতে খেতে বেশ আওয়াজ তুলে এগিয়ে চলছিলো তাই সব কথা স্পষ্ট বোঝাও যাচ্ছিলো না। আর মেয়েটি যে কী জানতে চাইছে তার উদগ্রীব প্রশ্নে তা পরিষ্কারও না। তাই লোকটির প্রশ্নে মেয়েটি যা বললো তার মর্মাথ হলো সে বাসায় ভুল করে ফোন ফেলে এসেছে আর তার একটা জরুরী কল করা দরকার। লোকটি বললো না মা ট্রেন থাইকা কল করা যায়না আর আমাদের কাছেও কোন মোবাইল নাই। রাকিব জানালার দিকে বাইরের প্রকৃতি দেখার একটা ভাণ নিয়ে থাকলেও তার পুরো মন তখন সেই মেয়ের ঘটে যাওয়া ঘটনার তিলতিল সব জানার জন্য উৎসুক হয়ে ছিলো। বুড়ো লোকটি যখন মেয়েটিকে নিরাশ করলো মেয়েটির হতাশা আরো বেড়ে গেল। লোকটিই প্রশ্ন করলো মা তোমার কি কল করা খুব দরকার? মেয়েটা কাতর গলায় বললো হ্যা একটু দরকার ছিলো। রাকিব ভালো মতোই জানতো লাজুক মেয়েদের একটু দরকার আসলে কতো বেশি প্রয়োজনীয় ব্যাপার বিশেষ করে প্রতিকূল পরিবেশে। কিছুক্ষণ সব নীরব থাকলো বৃদ্ধ লোকটির মাঝ বয়সী স্ত্রী তার কানেকানে কী যেন বললো। লোকটি তখন মেয়েটিকে জিজ্ঞাস করলো মা তোমার বেশি জরুরী হইলে অন্য কারো জিগাও। মেয়েটি ইতস্তত করতে থাকলো। তখন বুড়োলোকটি নিজেই রাকিবকে বললো এই যে শুনেন এই বাচ্চা মাইয়াটা যেন কী সমস্যায় পড়ছে বুঝিনা। রাকিব লোকটির দিকে তাকিয়ে কিছু না বোঝার ভাণ করে বললো আমাকে কি কিছু বললেন? লোকটি উত্তর দিয়ে যখন মেয়েটির সমস্যার কথা বললো রাকিব বললো ও হ্যা বুঝেছি কিন্তু মেয়েটার দিকে চাইলোও না আর শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বললো হুম। রাকিব মনে মনে খুব চাইছিলো মেয়েটা এবার তাকে কিছু বলুক তারপর সে মেয়েটার দিকে মুখ ফিরাবে কিন্তু আশায় গুড়েবালি। মেয়েটা কিছুই বলছেনা। যার সমস্যা সে যদি সাহায্য না চায় তাহলে তাকে যেচে সাহায্য করতে যাওয়াটা হ্যাংলামো হয়ে যায় তাই রাকিব সেই মিষ্টি ভাষার বর্ষণ আরেকবার শোনার উদগ্র বাসনা নিয়ে চুপ হয়ে থাকলো। প্রতিটা সেকেন্ড যেন রাকিবের কাছে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পাড় হচ্ছিল কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিলোনা। তাই হতাশ হয়েই রাকিবের মুহূর্তগুলো ধীরে ধীর কাটছিলো। যখন ঐ মেয়ের কণ্ঠ থেকে কোনো প্রশ্ন আসলোনা হত্যদ্দম রাকিবও নিশ্চুপ থাকলো। সব নীরবতা ভেঙ্গে সেই বৃদ্ধের কণ্ঠই আবার কথা বলে উঠলো ; মেয়েটিকে বললো মা এই বাবারে জিগাও দেখ কিছু করতে পারে কিনা। মেয়েটি যে অদৃশ্য পর্দা টানিয়ে রেখেছিলো তা সে যেন পাথরের চেয়েও শক্ত।
কিছুক্ষণ পর ইতস্তত করতে করতে মেয়েটি রাকিবকে বলেই ফেললো মানে আমি তাড়াহুড়ো করে আমার মোবাইলটা হোস্টেলে রেখে এসেছি আমার বাবা ঢাকায় একটা হাসপাতালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ভর্তি আছে আমি তাকে দেখতে যাচ্ছি কিন্তু যোগাযোগ যে কিভাবে করি তা ভেবে পাচ্ছিনা ;কোন মেডিকেলে আছে তাও ভালো করে শোনা হয়নি আর এখনি বা কেমন আছে তাও জানিনা। রাকিব বললো সমস্যা কী মেডিকেলে আপনার কেউ থাকলে তাকে ফোন করুন বলে নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিলো। মেয়েটা ধন্যবাদ দিয়ে মোবাইল নিয়ে কারো সাথে কথা বললো। মোবাইল কাঁপা কাঁপা হাতে রাকিবকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো অনেক ধন্যবাদ আপনাকে বেশ বিরক্ত করলাম রাকিব উত্তরে বললো বিরক্তির কী আছে এটা সামান্য ব্যাপার তারপরে জানতে চাইলো আপনার বাবা এখন কেমন আছেন, মেয়েটা উত্তরে বললো হ্যা ভালো। মেয়েটি মোবাইল ফিরিয়ে দিয়ে আবার সেই নিরব। রাকিব কিছু বলতে চায় কিন্তু সে অদৃশ্য দেয়াল এতো শক্ত তা ভেদ করা খুব অসাধ্য। কখনো কখনো মনে হয় উঁচু পাহাড় পেরেনোর চেয়ে লাজুক মেয়েদের মন ভেদ করা বেশি দুঃসাধ্য। রাকিব ভিতরে অস্থির কিন্তু বাইরে স্থির হয়ে থাকলো। রাকিবের সাহায্যে আবার সেই বয়স্ক লোকটিই এগিয়ে আসলো। সেই বললো মা তোমার বাবার কী হইছে। মেয়েটি জবাব দিলো আজ ভোরে স্রোোকক করেছে কিন্তু এখন জ্ঞান ফিরেছে কথা বলছে পুরোপুরি সুস্থ নয় । লোকটির আবার প্রশ্নে জানা গেল মেয়েটি মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ারে পড়াশুনা করে ময়মনসিংহে তার বাবাকে অসুস্থ হবার পর টাঙ্গাইলে একটি মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে সে সেখানেই যাচ্ছে। রাকিব তখনও বাইরের বহমান প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর দুইকান তাদের বাক্যালাপ গভীর মনোযোগ দিয়েই শুনে যাচ্ছিলো । সে চায়না ওর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে মেয়েটির প্রতি বেশি আগ্রহ প্রকাশ পাক। আর মেয়েটি রাকিবের কাছে সাহায্য চায়ওনি। যে এড়িয়ে চলে তার সাথে যেচে কিছু করতে যাওয়া গায়েপড়া ব্যক্তির ব্যক্তিত্বহীনতার প্রকাশ। তাই রাকিব দৃষ্টি যদিও অন্যদিকেই রাখছিলো ওর আগ্রহের সবটুকু দিয়ে মেয়েটির কথা শুনছিলো। কী জানি কী একটা ব্যাপার এই উপেক্ষা করা মেয়েটির প্রতি রাকিবকে খুব বেশি আকৃষ্ট করে তুলেছিলো; রাকিব বুঝলোনা কিন্তু রাকিবের মন বলছিলো মেয়েটি আরো কিছু বলুক। রাকিব তবুও অনেক কারণে নিরব থাকলো। কারণ লোকটির সাথে কথোপকথনই রাকিবের নিজের বলা কথার চেয়ে বেশি জানাচ্ছিলো তাই রাকিব চুপচাপ থাকাটা বেশি উপযুক্ত মনে করলো। বয়স্ক লোকটির যেহেতু অতশত ভাবনার কোনো দরকার নেই আর মেয়েটির সাথে গল্প করে ভালোই সময় কাটছিলো তার তাই সে একেরপর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলো আর মেয়েটিও ধীরেধীরে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো আর লোকটির স্ত্রীও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উৎসাহের সাথে তার স্বামীর মেয়েটিকে জেরা করা শুনে যাচ্ছিলো। আসলে যেখানে আগ্রহ কম থাকে সেখানে আলাপ চালিয়ে নেয়া যতো সহজ আর যেখানে প্রবল জানার আগ্রহ সেখানে কিছু জিজ্ঞাসা করা বেশি কঠিন কারণ জিজ্ঞাসু মনে এক ভয় থাকে, বাধা থাকে; বেশি উৎসাহ না আবার ক্ষতির কারণ হয় এই আশংকায় অনেক কথার মনে নানা কথা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে কী বলবে না বলবে তাতে দ্বিধা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর বেশি ভাবনা আর অনুভূতি আমাদের স্বাভাবিক আচরণে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। তেমনি দুই জন দুই ভাবধারার এক জনের খুব বেশি জানবার তাড়না নেই তাই সে নানান কথা বলে যাচ্ছে আর যেই মনে হাজার প্রশ্ন এসে ভিড় করছে সে একটি কথাও বলতে অপারগ। লোকটি তখন আসল প্রশ্নটা করলো তোমার নাম কী মা? মেয়েটি একটু যেন দমে গেল - প্রায় ফিসফিস করে বললো মনোরমা। লোকটি হেসে বললো বাহ্ সুন্দর নাম। আর কিছুক্ষণ পরেই টাঙ্গাইল স্টেশন আসবে মেয়েটি নেমে যাবে। সে গোছগাছ শুরু করে দিলো। রাকিবের মন কেন জানি খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটির সাথে রাকিবের কথাবার্তা হচ্ছিলোনা পাশে থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দূরেই ছিলো তবু রাকিবের মনটা কেমন ভরে ছিলো যতক্ষণ মেয়েটা ছিলো। যে রাকিবের উপস্থিতিতেই যেন বিরক্ত রাকিবের কেন জানি তার জন্য অন্য এক সুগভীর আকর্ষণ মনে সৃষ্টি হলো। যার ব্যাপারে জানেনা কিছু সময়ের দেখা তার জন্য এমন অবাক করা টান কোত্থেকে আসলো; রাকিব কেন যে আজ এই মেয়ের জন্য এতো ব্যাকুল হয়ে উঠলো কেবা জানে। কিন্তু মন যা চায় তা যদি হতো তাহলে বাহিরের পৃথিবীটা আর এরকম থাকতোনা। মনোরমা টাঙ্গাইল স্টেশনে নেমে গেল। পুরো ট্রেন ভর্তি লোক তবুও রাকিবের মনে হলো আশেপাশে কেউ নেই। এক অব্যাখ্যেয় নির্জনতা রাকিবকে ঘিরে ধরলো । চারদিকটা কেমন খালিখালি লাগলো। এক নিমিষে এসে একজন রাকিবকে এতো বেশি নিস্ব করে যাবে রাকিব ভাবতেই পারছিলোনা ওর সমস্ত মনোযোগের জায়গা মনোরমা দখল করে নিল। আসলে ছেলেরা একটা বয়স হলে সে যে ছেলে থেকে পুরুষ হয়ে উঠছে তা নারীর প্রতি আকর্ষণবোধই জানান দেয়। তা যে এতো তীব্র হতে পারে এতো আকুল হতে পারে রাকিব এই প্রথম বুঝতে পেল।
রাকিব ঢাকায় বাসায় ফিরে আসলো। রাকিব ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করে একটি প্রাইভেট ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে চাকরি করছে আর পাশাপাশি দেশের বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘরে ফিরে ওর মায়ের সাথে কথা শেষ করেই মনে চমক দিয়ে একটা কথা এসে ওর নিস্তেজ মনকে সতেজ করে দিলো ;আরে মনোরমা তো একেবারে হারিয়ে যায়নি ওর মোবাইলেই তো ওর বাবার নাম্বার আছে। খুশিতে মন ভরে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল ডায়ালিং দেখলো। কিন্তু রাকিবের মন এতো খারাপ কোনদিন হয়নি। মনোরমা কল করে কোনো ফাঁকে তার বাবার নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছে। রাকিবের মনে মনোরমার প্রতি তীব্র একটা ক্ষোভ জমা হলো। আর সবচেয়ে বেশি আঘাত পেল ; যে কোনদিন যেচে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে যায়নি কোনো মেয়ে যাকে কিছু দিয়েই ভোলাতে পারেনি কতো মেয়েই তো যেচে এসেছে তাদের প্রতি রাকিবের কণামাত্র অনুরাগ জন্মায়নি আর এখন সে যখন একটি মেয়ের নেশায় আচ্ছন্ন সে কল্পনার চেয়েও বেশি মায়া নিয়ে শুধু মরীচিকার মতো ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। পুরুষ মনের সুপ্ত সব ফুলগুলি নারীই পারে ফুটিয়ে দিতে। আবার ফুল ঝরে শুধু কাঁটা হয়ে বুকে বিঁধে সে সেই নারীই। রাকিব মনে মনে ঠিক করলো এই মেয়েকে নিয়ে আর ভাববেনা। আঁধার রাত দেখে যেমন চাঁদের ম্লান আলোর অপরূপ রূপের অভাব অনুভব করা যায় তেমনি অনেক প্রিয়জন থাকলেও না থাকার জনের ভীষণ ব্যথা নিয়ে তাকে জানান দেয়; তাই রাকিব যতোই সেই মেয়েকে ভুলে থাকতে চায় সব পাওয়া বলে সব পাওয়ার কাছে এক না পাওয়াই অনেক বেশি বড়। রাকিব কাজে মন বসাতে পারেনা, খাওয়ার সময় ঠিক নেই, বন্ধুবান্ধব, প্রিয় কবিতার বই সব কেমন নোনতা লাগে। টুকটাক কবিতাও লিখতো কিন্তু চিন্তাগুলো মাথায় গজায় কিন্তু লেখাতে আসেনা। এক মনোরমার কাছে আর সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। রাকিব দেখলো সে মনোরমাকে কখনই ভুলতে পারবেনা। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের এক পরিচয় কেন তাকে এতো বেশি টানে? হয়ত মনোরমা যদি পুরোপুরি সেদিন ধরা দিতো তাহলে তার প্রতি এই দুর্নিবার টান রাকিবের থাকতোনা কিন্তু পুরোপুরি ফুটে যাওয়া ফুলের চেয়ে না ফোঁটা ফুলের কলি যেমন ভাবায় এরপর কী এরপর কী? কেমন হবে সেই ফুলটি তেমনি মনোরমা যতো বেশি অপ্রকাশিত রেখেছিলো নিজেকে রাকিবের ততো বেশি তার প্রতি জানার নেশা পেয়ে বসেছিলো। একি শুধুই জানার সুতীব্র বাসনা না ভালবাসা তা বলা যেমন সহজ তেমনি কঠিন।
হঠাৎ বাসা থেকে রাকিবের ফোন আসলো মা অসুস্থ বাড়ি যেতে হবে আজই। রাকিব বাবার এই অনাকাঙ্ক্ষিত ডাকে খুব মুষড়ে পড়লো ওর বন্ধু রাজনকে নিয়ে বাড়িতে রওনা দিলো। অজানা আশংকা ধেয়ে আসলো বারবার ' মা'র কী হলো?' বাসায় গিয়ে দেখলো সত্যিই মা খুব অসুস্থ। রাকিব আর দেরী করলোনা মাকে নিয়ে সবাই সহ ঢাকায় চলে আসলো ; মাকে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করালো সুচিকিৎসার জন্য ঢাকায়। কয়েকদিনের মধ্যেই ওর মা অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠলো রাকিবের প্রাণান্ত চেষ্টায়। এ কয়েকদিন মাকে নিয়ে খুব টেনশনে ছিলো রাকিব; তারপর একদিন হঠাৎ ওর মনে আবার মনোরমা এসে উপস্থিত কিন্তু রাকিবের সেই অপরিচাতার প্রতি একটা বড় অভিমান মনে জন্ম নিয়েছিলো তাই ওর কথা মনে আসতেই রাকিব চিন্তাকে বেশি প্রশ্রয় দিলোনা। কিন্তু যে মনোরমা রাকিবের কঠিন মনকে আবেগ, অনুভূতি, প্রেম,ভালবাসা আর অভিমানে পূর্ণ করে রেখেছিলো সে যদি সামনে আসে তার সামনে স্বাভাবিক হওয়া আসলেই কঠিন যদিও অপর পাশ থেকে এই তীব্রতার পরিমাপ করা সহজ নয়। রাকিব যখন ওর মায়ের জন্য রিপোর্ট কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালো এক মেয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাপাতে হাপাতে একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে কাতর স্বরে জানতে চাইলো প্লিজ একটু দেখুন এ রিপোর্টগুলো এসেছে কিনা? মনোরমা প্রায় রাকিবকে ধাক্কা দিয়েই ফেলে দিচ্ছিলো। রাকিব একপাশে সড়ে গিয়ে কাউন্টারের গ্লাস ধরে নিজেকে সামলালো। কিন্তু মনোরমার সেইদিকে খেয়ালি নেই। সে খুব ব্যস্ত আর কাতর। কাউন্টার ম্যানেজার পেপারটি হাতে নিয়ে নির্লিপ্তভাবে বললো না আরো এক ঘন্টা পরে আসেন। মনোরমা আরো বেশি কাতর হয়ে বললো না রিপোর্টগুলো এখনি লাগবে আমার বাবার অবস্থা খুব খারাপ রিপোর্ট ছাড়া ডাক্তার আমার বাবাকে কোনো ওষুধ দিবেনা। ম্যানেজার তেমনি যান্ত্রিক কণ্ঠে বললো আমি পারবো না আপনি দুই নাম্বার কাউন্টারে যান। মনোরমা জবাব দিলো ওরাই এখানে আসতে বলেছে। কিছু একটা করুন, প্লিজ! রাকিব চুপচাপ সব দেখছিলো ওর হাতে রিপোর্ট ডেলিভারি নেবার কাগজটা নিয়ে কাউন্টার ম্যানেজার মনোরমাকে উদ্দেশ্য করে বললো আপনি কী শুরু করেছেন ঐ ভদ্রলোককেতো ধাক্কা মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন। আপনি লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়ান সিরিয়াল আসলে আপনি আসবেন। রাকিব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলোনা কেন যেন মনোরমার সমস্যাটা নিজের সমস্যাই মনে হচ্ছিল আর সেদিনের ছোট্ট এক উপকার যাকে করেছিলো সে যে আজ বড় বেশি সমস্যায় তা বুঝতে পারলো। রাকিব ম্যানেজারকে বললো আগে আমার ডেলিভারি নয় ওনার রিপোর্টগুলো দিন। লোকটি আগের মতোই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো আপনারা এতো কথা বললে তো আমার কাজ চালাতে পারবোনা। রাকিব আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। কড়া গলায় বললো দেখছেন উনি কতো বড় বিপদে। মনোরমা যেন সেই কণ্ঠে সম্বিত ফিরে পেল। রাকিবের দিকে তাকাতেই ওর গোলাপি মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। রাকিবকে দেখে মনে হলো সব ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে রাকিব নিজেই মনোরমার হাত থেকে রিপোর্টটা নিয়ে জেদি স্বরে কাউন্টার ম্যানকে বললো আগে আপনি এটির ব্যবস্থা করবেন তারপর অন্যসব। ছেলেটি রাকিবের উদ্ধত কণ্ঠের কাছে পরাজয় মানলো চুপচাপ কাগজটি নিয়ে বললো ওনার রিপোর্টটা আসলে এই কাউন্টারে পাবেননা এটি বাইরে থেকে টেস্ট হয়ে এসেছে ছয় নাম্বার কাউন্টারে যান প্লিজ। রাকিব নিজের রিপোর্টগুলো নিয়ে মনোরমাকে ইশারা করে দ্রুত ছয় নাম্বার কাউন্টারের দিকে চললো অসহায় মনোরমা ওর পিছে পিছে চললো। রাকিব ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ সবাইকে ঠেলে চললো ছয় কাউন্টারে রিপোর্ট নিতে। রাকিব প্রায় আগেও এই ক্লিনিকে ওর মাকে নিয়ে এসেছে তাই ও সব চিনতো। কাউন্টারে ঢুকেই বললো আফজাল ভাই তাড়াতাড়ি এই রিপোর্টটা দেখেন জরুরী দরকার এখুনি। আফজাল সাহেব খুঁজে পেয়ে রিপোর্টটা রাকিবের হাতে তুলে দিলো। মনোরমাকে রাকিব বললো চলুন আপনার বাবার কাছে। মনোরমা কার্ডিয়াক বিভাগে এসে টেনশনে ঘেমে গেল। ওর মাখনের মতো কপাল বিন্দু বিন্দু ঘামে আরক্তিম হয়ে উঠেছিলো। ওখানে অনেক রোগীর ভিড় । ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোই দায়। মনোরমাকে রাকিব দাঁড়াতে বলে ভিড় ঠেলে চেম্বারের দিকে লোকের ভিড়ে হারিয়ে গেল। এদিকে মনোরমা ভীযহইওইনছে অচেনা মানুষকে সবসময় ভয় করতে হয়না অনেক সময় তাদের ওপড় ভরসাও করতে হয়। রাকিব বললো এই ইঞ্জেকশানটা টুয়েন্টি ফোর ফার্মেসি ছাড়া পাওয়া যায়না একটু দূরে, আমি গিয়েই নিয়ে আসি আপনি একটু বাবার কাছে যান। মনোরমা ওর কোমল সাদা গ্রীবা নেড়ে সায় দিলো। রাকিব যখন ফিরে আসলো তখন মনোরমার চোখ ছলছল করছিল কালো পুকুরের মতো গভীর চোখে তখন শুধুই কৃতজ্ঞতা। রাকিব মনোরমার বাবাকে দ্রুত ইঞ্জেকশান দেবার ব্যবস্থা করলো। ডাক্তার বললো পনের মিনিট পড়ে অবস্থা বোঝা যাবে। রাকিব মনোরমাকে বললো আমি একটু মায়ের কাছ থেকে ঘুরে আসি উনি একা আমি এসেছি তার চিকিৎসা করাতে। মনোরমা দীঘল চোখ তুলে রাকিবের দিকে তাকালো ; কোন কোন চোখে মনের ভাষা বোঝা যায় মনোরমা রাকিবের দিকে নির্ভরতা ভরা চোখে তাকিয়ে ক্লান্ত কিন্তু ধীরে বললো আচ্ছা; ওর কণ্ঠ রাকিবের কানে মিষ্টি মধুর বাঁশির ধ্বনির মতো বেঁজে উঠলো। রাকিব কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসলো। ডাক্তারের এসিট্যান্টকে বললো রোগীর অবস্থা কী? মহিলা জবাব দিলো পনের মিনিট পরে জানা যাবে। রাকিবের সুদর্শন চোখ দুটি কঠোর হয়ে উঠলো চাপা কঠোর গলায় বললো আপনি এখুনি আমাকে জানাবেন। মহিলা রাকিবের কথার অর্থ খুব সহজেই বুঝলো। বললো চলেন আমার সাথে। মাথার ওপরে স্ক্রিনে হার্টবিট, পালস রেট, বিপি সব দেখা যাচ্ছিলো। এসিস্ট্যান্ট বললো পালস রেটটা যতো দ্রুত বাড়ার কথা বাড়ছে না আরেকটা ইঞ্জেকশান দিতে হবে। রাকিব বললো আপনি এখুনি ডাক্তার সাহেবকে এখানে নিয়ে আসুন। মহিলা রাকিবের গলার প্রচণ্ডতায় তাড়াতাড়ি চলে গেল। একটু পর ডাক্তার এলেন। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে দ্রুত কিছু লিখলেন আর মহিলাকে বলনেন এখুনি এই ইঞ্জেকশানগুলো স্যালাইনের সাথে পুশ করো। ডাক্তার চলে যাবার সময় বলে গেল ভয়ের কিছু নেই অবস্থা আগের চেয়ে ভালো আমাকে ডেকে ভালো করেছেন এরা সব বুঝেও বুঝেনা। তবে একটু সময় নিবে আপনারা ঘাবড়াবেননা। মনোরমার উৎকণ্ঠা ভরা চোখে স্বস্তির আভাস ফুটে উঠলো। রাকিব রাজনকে ফোন করে আসতে বললো। এক ঘন্টা পর যখন রাজন আসলো রাকিব রাজনকে মনোরমার সাথে পরিচয় করিয়ে বললো আমি একটু মায়ের কাছ থেকে আসি রাজন তুই এখানে থাক। আর বললো আপনি যেহেতু শুধু মাকে নিয়ে বাবার সাথে এসেছেন তাই রাজন থাকলে আপনার ভালো হবে। রাকিব যখন চলে যাচ্ছিলো মনোরমা কাতর কণ্ঠে জানতে চাইলো আপনি কখন আসবেন। রাকিব জবাব দিলো যখন আপনার বিপদ আসবে আমি বিপদের সাথি হয়েই আসবো। মনোরমা রাকিবের যাবার পথের দিকে প্রতীক্ষা কাতর চোখে তাকিয়ে থাকলো। রাকিব বলে গেল আমি রাজনের মোবাইলে খবর নিবো।
পরের দিন সকাল রাজন ছিলোল রাকিবের মায়ের সাথে আর সারারাত রাকিব আর মনোরমা, মনোরমার অচেতন বাবার শিয়রে জেগে। মনোরমার মা গত কয়েকমাস তার অসুস্থ বাবার সেবা করতে করতে ক্লান্ত তাই রাকিব নিজেই বললো আন্টি আপনি ঘুমান না হলে আপনিও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। সারারাত রাকিব আর মনোরমা দুজন জেগেই থাকলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুজনের মাঝে প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি তেমন কথাই হলোনা। এর আরেকটা কারণ ছিলো। মনোরমার আরেকটি মিথ্যা রাকিবকে আরো বেশি আঘাত দিয়েছিলো। মনোরমা ডাক্তারি পড়তোনা বানিয়ে বলেছিলো ; সে আসলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো। রাকিব মনোরমার কাছ থেকেই এটা জানতে পেরে খুব আঘাত পেল। তাই বাড়তি কথা বলার আগ্রহ আর রাকিবের থাকলোনা। এর ফলে তেমন কথাই হলোনা। ভাষা যেখানে নিরব হৃদয় সেখানে খুব সরব তাই দুজন দুজনকে হৃদয় দিয়েই যেন অনুভব করছিলো। একখানে ছিলো তিক্ততা আরেকখানে সীমাহীন মুগ্ধতা বলতে হবেনা সেই মুগ্ধ হওয়া মানুষটি ছিলো মনোরমা। ভোরের দিকে মনোরমার বাবার জ্ঞান ফিরলো। সকালে ডাক্তার এসে বললেন রোগী এখন আশঙ্কা মুক্ত। অঝোর ধারার জলধারা মনোরমার কুমারী মুখ বেয়ে পড়তে লাগলো। ওর ভিঁজে যাওয়া চোখের পাপড়িগুলো ফুলের পাপড়ির মতো চোখে সুদৃশ্য হয়ে কান্নার জলে একাকার হয়ে গেল। এই আর্দ্র চোখই বলে দিচ্ছিলো এই মেয়ে হতে পারে মিথ্যুক কিন্তু ওর চোখের পানি বরষার পানির মতোই পরিশুদ্ধ ; যেই পরিশুদ্ধতা মনোরমার পুরো মুখ জুড়ে শরতের মেঘমুক্ত আকাশের মতোই বিশুদ্ধ এক সৌন্দর্য অপ্রকাশযোগ্য ভাষায় বলে দিচ্ছিলো এই সৎ মুখ যে নারীর তার মন বনের না দেখা ফুলের মতোই বিশুদ্ধতায় পূর্ণ।
তিনদিন কেটে গেল মনোরমার বাবা এখন বেশ সুস্থ। এদিকে রাকিব তার মাকে বাসায় নিয়ে এসেছে। তিনি পুরোপুরি সুস্থ। একদিন গেল মনোরমার বাবাকে দেখতে। আসলে তা অন্য কোনো কারণে নয়। মনোরমার প্রতি রাকিবের যে একটা চাপা রাগ মনে আছে তা তেমনি আছে কিন্তু মনোরমার বাবা খুব ভালো একজন লোক তিনি নিজেই রাকিবকে বলেছেন বাবা যতদিন পুরো সুস্থ না হই তুমি একবার করে এসে সময় পেলে দেখে যাবে তোমাকে দেখলে আমার মন অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়। সেদিন রাকিব গেল মনোরমার বাবাকে দেখতে। মায়েরা যেমন চুপচাপ ছেলের মুখ দেখেই বুঝে ভিতরে কী চলছে বাবারাও তেমন আদরের মেয়ের ভিতরটা পড়তে পারে। মনোরমার বাবা যিনি ছিলেন একজন লেখক মানুষ দ্রুত সব বুঝে উঠলেন। রাকিবকে দেখে তিনিও খুশি হলেন রাকিবকে নিয়ে নিজের বিছানার পাশে বসালেন। মনোরমা আর তার মাকে অন্য পাশে পাঠিয়ে দিলেন। রাকিব বুঝলোনা মনোরমার বাবা কেন তাকে একা চান; অবশ্য একটু পরেই বুঝলো। মনোরমার বাবা বললেন আমার মেয়ে আমি ওকে রমা বলে ডাকি জানোতো আমার একটি মাত্রই সন্তান। বলে তিনি চুপ হয়ে থাকলেন কিছুকাল। তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, বাবা জাননা আমার রমার ওপর দিয়ে কতো বিরাট ঝড় বয়ে গেছে এই ছোট্ট জীবনে। তুমি যদি চাও তো বলি। রাকিব সায় দিলো। উনি বলে চললেন। রমা যাকে মা বলে ডাকে তিনি ওর মা নন; ওর মা ওর জন্মর সময়ই মারা যান। ওর মা আসলে আমার বিধবা বোন। ওর কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই স্বামী আরেকটা বিয়ে করে তাড়িয়ে দেয়। অনেক অত্যাচার করতো সতীন তাই চলে আসে আমার কাছে। রমাকে ঐ নিজের মায়ের মতো লালনপালন করে বড়ো করে তুলে তাই তাকেই সে মা বলে জানে, ডাকে। আর রমার বয়স যখন সতের আমার বড়বোনের বড় ছেলে তখন আমেরিকান সিটিজেন। বড়বোন আমাকে ওরা যখন ছোট তখনি বলেছিলেন তার ছেলের বউ করবেন মনোরমাকে। নিজেদের মধ্যেই তাই আমি রাজি হই । পাঁচ বছর আগে রমার যখন বয়স আঠারো তখন আমার ভাগ্না নোমান রমাকে বিয়ে করে নিয়ে আমেরিকায় চলে যায় মেয়ের ভালোর জন্য আমার প্রিয়তম ধনকে হৃদয় ছিঁড়ে বিদেশ পাঠাই কিন্তু আমার মেয়ে ওখানে গিয়ে এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পড়ে রমা। নোমান ছিলো নেশাখোর, জুয়াড়ি আর তার আরেকটা বউও ছিলো আমেরিকায় তা সে গোপন করে রেখেছলো। শুধু তাই নয় নোমান রমাকে শারীরিক নির্যাতনও করতো। রমার বাবার বয়স্ক, বিশ্বস্ত চোখ দিয়ে জল ধারা বয়ে যাচ্ছিলো। তারপর নোমান ওখান থেকেই চাপ দিয়ে আমার প্রায় সব জমিজমা রমার নামে লিখে নেয় ওর এই দেশী এক বন্ধুকে দিয়ে তা বিক্রি করিয়ে বিদেশে সব টাকা নিয়ে যায়। আমি আর কিছু বলতে পারবোনা কিন্তু রমার এক আমেরিকান বান্ধবী সে রমাকে ঐ রাক্ষসের হাত থেকে রক্ষা করে একদিন দেশের বিমানে তুলে দেয় চুপিসারে । আমার ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটা নির্মম নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরে। তারপর থেকে রমা ছেলেদের দেখলেই ভয় করে ; নিজেকে গুটিয়ে নেয় কিন্তু একমাত্র তোমাকে দেখলাম ও কেন যেন অন্যভাবে দেখছে তুমি কিছু মনে করনা আমি এই অদ্ভুত ব্যাপারটা দেখেই তোমাকে এতকিছু বললাম। রাকিবের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলনা ও শুধু রমার বাবার হাত দু'হাত দিয়ে চেপে ধরলো। দৃশ্য আর অদৃশ্যর মাঝে কতো পার্থক্য মানুষ তা না জেনে কতো সময় কতো ভুল করে রাকিব অবশেষে বুঝলো। রাকিব আসার সময় রমাকে বললো তুমি কি একটু আমাকে গেটে এগিয়ে দিয়ে আসবে। গেটে এসেই রাকিব বললো আমি যাই। রমা বললো এই কয়েক সেকেন্ডের জন্যই আমাকে একা ডাকা বলে স্মিত মধুর হাসি দিলো। রাকিব চলে যাবার সময় বললো তোমার সাথে কয়েক মুহূর্ত একা থাকা আমার জন্য কয়েক যুগের ভালো লাগার সমান। রাকিব চলে গেল কিন্তু রমার হৃদয় গভীরে রুক্ষ শীত শেষে যেমন নব বসন্তের ফুল আবার প্রকৃতিকে সতেজ করে তেমনি ফুল, আনন্দ আর ঘন সৌরভ ওর মনকে কানায় কানায় ভরে তুললো। কেন ও বুঝলো না।
তার পরের দিন রাকিব ক্লাশে যাচ্ছিলো ওর মোবাইলে একটা অজানা নাম্বার থেকে কল আসলো। রাকিব ধরতেই রিনঝিন গানের শব্দের মতো কথামালা এসে ওর কান দিয়ে পুরো মনকে প্লাবিত করে দিলো। ' কি আপনি আজ আসবেননা?' রাকিব প্রথমে বুঝতে পারলোনা কে এই মধুর ভাষিণী পরক্ষণেই বুঝলো রমা। রাকিব জানতে চাইলো তুমি আমার নাম্বার কোথায় পেলে আমিতো দেইনি। রমা হাসতে হাসতে বললো ' সব কথা জানতে হয়না' বলে কল কেটে দিলো। রমা রাজনের কাছে প্রথম রাতেই রাকিবের নাম্বার নিয়ে রেখেছিলো। সন্ধ্যায় রাকিব রমার বাবাকে দেখতে গেল। রমা তখনও জানেনা রাকিব তার অতিত জেনে গেছে । রমার বাবা যেহেতু সুস্থ ঠিক হলো ওরা বারো তারিখে রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। রাকিবের বোন বাড়ি থেকে আসবে তাই রাকিব বেশিক্ষণ না থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেল স্টেশন থেকে ওর বোনকে আনতে।
দুদিন পরে রমার বাবা বললো মা আমিতো অনেকটাই সুস্থ চল আমরা তোর ফুপু সহ কালই চলে যাই। রমার ফুপু বললো কিন্তু রাকিবতো জানে আমরা পরশু যাবো রমার বাবা বললো না আমার একদম এই ক্লিনিকে ভালো লাগছেনা। কালই যাবে। রমার ফুপু আর রমা বাবার সাথে বেশি কথা বললোনা। রমার ফুপু বললো তুমি খুব পাষাণ মনতো বড়ভাই যে ছেলেটার কারণে তোমার জীবন বাঁচলো তার সাথে এরকম করে যাওয়া কি ঠিক হবে। রমার বাবা চুপ থাকলো ওর ফুপু আর কিছু বললোনা কারণ ওরা জানে এই লোকের যেই কথা সেই কাজ। শুধু রমার বুকে একটা অদৃশ্য চাকু মনে হচ্ছিল বুকের হৃদপিণ্ডটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছিলো।
তারপরের দিন সকালে ওদের গোছগাছ, রোগী রিলিজ সব চূড়ান্ত হয়ে গেল। যত দুপর সামনে আসছিলো রমার বুকের ভিতরে অব্যক্ত বেদনা হাহাকার করে উঠছিলো। রাকিবকে আবার কল দেয়া ঠিক হবেনা এখন আর রাকিব আসলে বাবাই বা কী ভাববে আর তাছাড়া রমার অতীত সামনে ভেসে উঠলো ওর বুক থেকে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বের হলো সীমাহীন বাতাসে তা মিলিয়ে গেল; রমা মনে মনে ভাবলো এই যে বাতাস বয়ে যাচ্ছে তা যে কতো ভাঙ্গা বুকের বেদনা নিয়ে যাচ্ছে তা কেউ বলতে পারবেনা। যে বুকে একটি ছেলের জন্য এতো ঘৃণা সেখানেই আরেকজনের জন্য তীর, কূল ভাঙ্গা ভালবাসা এসে ওর ভিতরটা ভেঙ্গেচুরে দিচ্ছিলো। কিন্তু মেয়েদের সুখদুঃখ দুটোই পুরুষের হাতে; রমারটা এখন যেমন তার বাবা আর রাকিবের ওপর। এম্বুলেন্সে সব জিনিসপত্র রাখা হলো। রমার বাবা যেহেতু বসে যেতে পারবেননা তাই সিক বেডেই শুয়ে যাবেন আর তার পাশে থাকবে তার মেয়ে আর রমার ফুপুও। এম্বুলেন্স ছেড়ে দিলে রমাকে খুব কষ্ট করে ওর বেদনা অশ্রু থামাতে হলো। গাড়ি এগিয়ে চললো। হঠাৎ রমার বাবা বললো রাকিব থাকলে ভালোই হতো মনে হয়। মা, ফুপু দুজন চোখ নামিয়ে অব্যক্ত বেদনায় করে চুপ করে থাকলো। এমন সময় ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে একটা সুপুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো ' রাকিব থাকলে ভালো হতো মানে রাকিবতো আছেই। রাকিবের কথা শুনে রমা আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠলো। নিজেকে থামাতে পারলোনা। বলে ফেললো আপনি জানলেন কিভাবে আমরা আজ যাচ্ছি। রাকিব দুষ্টু হেসে জবাব দিলো 'সব কথা সবসময় জানতে হয়না।' সবার মাঝে একটা আনন্দ ধারা বয়ে গেল। রমার অসুস্থ বাবা তখন মিটমিট করে হাসছে ; রমা বাবার দুহাত জড়িয়ে ধরলো। কেন জানি মনে হলো বেদনা সবসময় কষ্টের নয় সুখেরও কারণ হতে পারে এক জীবনে।
০৮ ফেব্রুয়ারী - ২০১৫
গল্প/কবিতা:
১৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪