১. রাজা আজহার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাজা। যেমন একগুঁয়ে তেমনি বদমেজাজি। তার রাজ্যের সীমা এতোবড় ছিলো যে সে নিজেই পুরোটা ঘুরে শেষ করতে পারতোনা। তার তিন মেয়ে রিতা, মিতা আর অজন্তা। রাজা খুব আয়েশি ছিলেন আর তার সম্পদ, মান, প্রতিপত্তির দম্ভে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তার বেগম, রানী অল্প বয়সে তৃতীয় মেয়ে অজন্তার জন্মকালে মৃত্যু বরণ করেন। রাজার যত্ন, সেবায় তার দাসদাসীরা সবসময় তটস্থ থাকতো কারণ একটু কিছু এদিকওদিক হলে রাজা সোনা, রূপার বাটি চাকরবাকরদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারতেন আর বেশি রেগে গেলে চাকরবাকরদের লাথি দিয়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করতেন না। তার তিন মেয়ের বড় দু'জনের বিয়ে হয়ে গেছে ছোট মেয়ে অজন্তার বয়স আঠারো বছর । রাজার একটা ভালো গুণ ছিলো সে তার মেয়েদের নিজের প্রাণের অধিক ভালবাসতেন। রাজার বয়স শেষের দিকে যাচ্ছিলো তাই তার ইচ্ছে হলো আর রাজ্য শাসন নয় তিনি তার তিন মেয়ের মাঝে তার রাজত্ব ভাগ করে দিয়ে নিজে সব ঝামেলা থেকে দূরে থেকে আরাম আয়েশ করে শেষ জীবনটা কাটাবেন।
২. রাজার একজন প্রিয় বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছিলেন রাজপুরের জমিদার সুলেমান আজম; তিনি রাজার সবচেয়ে কাছের আর বড় হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। রাজা যেমন ছিলেন বীর দিগবিজয়ী তেমনি অতিমাত্রায় আরাম প্রিয়, দাম্ভিক, বদমেজাজি তাই তার আশপাশের মন্ত্রী, সিপাহসালার থেকে সেবকরাও রাজার ওপর নাখোশ ছিলেন। কিন্তু জমিদার সুলেমান জানতেন রাজা বদরাগী হলেও ছিলেন ভিতরে কোমল প্রাণ আর উদারমনা তাই সুলেমান আজম সবসময় ভয়ে থাকতেন কখন না রাজার ক্ষতি করে ফেলে তার শত্রুরা তাই জমিদার রাজাকে সবসময় কড়া পাহারায় রাখতেন। সুলেমানের ছেলে আমির ছিলো অকুতোভয়, রাজাভক্ত, সুদর্শন যুবক আর তার ছিলো বিরাট এক যোদ্ধা বাহিনী তারাই রাজাকে পাহারায় রাখতো সমূহ কোনো বিপদ থেকে রক্ষা করতে। আর আমিরের তত্ত্বাবধানে রাজার অনেক হারানো জমিদারিও উদ্ধার হয়েছিলো ; আমিরও তার বাবার মতো রাজাকে আলাদাভাবে দেখতো তাই কালক্রমে আমির রাজা আজহারের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। এদিকে রাজার রাজ্য হঠাৎ করে মেয়েদের মাঝে ভাগ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে জমিদার সুলেমান রাজাকে বুঝালেন এখনও সময় আসেনি তার রাজত্ব ভাগ করে দেবার; রাজা আরো কিছুদিন সময় নিক। কিন্তু নাছোড়বান্দা রাজা যা মনস্থির করেন তাই করেন। তিনি তার তিন মেয়ের নামে তার রাজত্ব ভাগ করে দিবেন কারণ দীর্ঘকাল রাজত্ব করে তার এখন বিশ্রামের সময়। রাজা শিকার করতে খুব ভালবাসতেন। তাই রাজা ঠিক করলেন তিন মেয়েকে তার সমস্ত সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে তিনি শিকার করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিবেন। কিন্তু তার আগে রাজা একটা পরীক্ষা করবেন; তিনি তিন মেয়ের পরীক্ষা নিবেন কে তাকে কতো বেশি ভালবাসে।
৩. একদিন সব মন্ত্রী, সভাসদ, সিপাহশালা, জমিদারদের ডেকে তিনি তিন মেয়েকে হাজির করলেন তার শাহী দরবারে তিনি নিজ কানে শুনবেন কোন মেয়ে তাকে কতো ভালবাসে। রিতা, মিতা তাদের স্বামী সহ আর কুমারী রাজকন্যা অজন্তা তিনজনই উপস্থিত হলো তাদের বাবার ভালবাসার পরীক্ষা দিতে। রিতা, মিতা রাজার নিজের মেয়ে হয়েও ছিলো লোভী, হিংসুটে আর রাজাকে তারা মন থেকে ভালবাসতে পারতোনা কারণ দুইবোন জানতো রাজা তাদের ছোটবোন অজন্তাকে খুব বেশি ভালবাসে। তাই মুখে মধু থাকলেও দুইবোনের অন্তরে তাদের বাবা আর ছোট বোনের জন্য ছিলো বিষ; মুখরা আর ছদ্মবেশী দুই বোন পুরোপুরি তৈরি হয়ে আসলো রাজার ভালবাসার পরীক্ষা দিতে। এদিকে অজন্তা যে ছিল রাজকন্যা হয়েও সাদামাটা, বিনয়ী, নিরহংকার সে ভালোমতোই জানতো তার দুই বোন তাকে আর তার বাবাকে মন থেকে ভালবাসেনা। যা করে লোক দেখানো; তাদের নিজ পরিবার আর নিজেকে নিয়েই সমস্ত লোভ লালসা। অজন্তা ছিলো নম্র, অনিন্দ্য সুন্দরি, রূপ, লাবণ্য আর গুণে রাজার এতো বড় রাজত্বের চেয়েও বেশি আলোকিত; সে ছিলো মিষ্টিভাষী, বিনয়ী, কোমল হৃদয় কিন্তু ভালো আর মন্দের পার্থক্য ঠিকমতো বুঝতে পারতো। অজন্তা এটাও জানতো ভিতরে ভিতরে দুই বোন ফন্দি আঁটছে কিভাবে রাজাকে তাড়াতাড়ি উৎখাত করে রাজত্ব নিজেদের করে নিবে। তাই অজন্তা জমিদার সুলেমান আজম আর তার নিজের সেবাকারীদের সার্বক্ষণিক তার বাবার দিকে সতর্ক খেয়াল রাখতো। অজন্তা তার দাস, দাসীদের নিজের দামি দামি স্বর্ণালংকার দিয়ে তুষ্ট করে তার বাবার খেয়াল রাখতে বলতো তার বাবার অজান্তেই। তাই বাবার এই দ্রুত সিদ্ধান্তে অজন্তা মনে মনে একটু অস্থির হয়ে পড়লো। কিন্তু জানে তার বাবা যা বলেন তাই করেন তাই বাবার এই অদ্ভুত পরিকল্পনা মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও সে অবিচলভাবে ভালবাসার পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হয়ে থাকলো।
তারপর সেই বিশেষ ক্ষণে রাজা তিন মেয়েকে ডেকে বললেন এখন তোমরা বলো কে আমাকে কতোটা ভালবাসো? বড় মেয়ে রিতা বললো আমার প্রিয় বাবা এই বিশাল রাজ্যের রাজাধিরাজ চোখ দিয়ে সব দেখা যায় কিন্তু কথা দিয়ে বলে সব বুঝানো যায়না। আমার ভাষার সেই ক্ষমতা নেই আপনাকে কতটুকু ভালবাসি তা প্রকাশ করবে। আমি নিজের দুই সুন্দর চোখ, পৃথিবীর যতো স্নিগ্ধতা আমাকে জড়িয়ে রাখে; যে ভালবাসা দিয়ে আপনি আমাকে তিলে তিলে বড় করেছেন তারচেয়ে বেশি ভালবাসি আপনাকে। রাজ্যের সব মণিমুক্তা, আপনার শস্যশ্যামল ভূমি, আকাশের শেষ সীমা যতদূর তারচেয়েও সীমাহীন এই ভালবাসা। সব সম্মান, শ্রদ্ধা, যার তুলনা করার সাধ্য কারো নেই ততটুকু বা তারচেয়েও বেশি এই মনে আপনার স্থান। যে ভালবাসা ভাষাকে নির্বাক করে দেয়, পরিপূর্ণকে আরো ভরাট করে, জগতের কোনো মেয়ে তার বাবাকে যতটুকু ভালবাসতে পারে তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি এই ভালবাসা আপনার জন্য রাজাধিরাজ। আপনার সব যন্ত্রণা আমি নিজ বুক পেতে নিতে রাজি কারণ আমার মনের সবটুকু জুড়ে শুধুই আপনার খেয়াল। রাজা বড় মেয়ে রিতার এই মিষ্টি কথায় এতো আপ্লুত হয়ে পড়লেন যে সাথে সাথে তাকে তার রাজ্যের তিন ভাগের এক ভাগ দান করে দিলেন। রিতা সেটি পেয়ে আনন্দে ফেটে পড়লো নিরব মনে। এবার মেজ মেয়ে মিতার পালা সে বলবে সে তার বাবাকে কতোটা ভালবাসে । মিতাও রিতার মতো সুচতুর তাই তার মিথ্যার ফুলঝুরি শুরু হলো এবার। মিতা বললো প্রিয় বাবা, মহারাজ এই উর্বর স্বর্ণালি রাজ্যের অধিপতি ; আমার বড়বোন আমার মনের সব কথা বলে দিয়েছেন। আমাকেও আপনার আশীর্বাদের যোগ্য করুন। শুধু বলবো পৃথিবীর সব আনন্দই আমার পরম শত্রু যদিনা আমি আপনাকে ভালবাসতে পারি। সব মধুই বিষ লাগে আপনাকে ছাড়া। আপনি ছাড়া জগতের সব ঐশ্বর্যই ম্লান ; আপনার প্রতি আমার অনুরাগ যে আপনার ভালবাসার দান। আপনাকে ভালবাসতে পারা ছাড়া আমার অনুভূতি আর কোনো স্নেহ, মমতা, মায়ায় সাড়া দেয়না। পৃথিবীর সব সোনাদানা একদিকে আর আপনি একদিকে হলেও আমি বলবো আমি আমার বাবাকেই বেছে নিবো। আপনাকে ভালবাসতে গিয়ে দেখেছি নিজের জন্য আমার কোনো ভালবাসি নেই, চাওয়া নেই। রাজা মেজ মেয়ের স্তুতি শুনে ভীষণ আহ্লাদিত হলেন। বললেন কী অপরিসীম ভালবাসা আমার মেয়েদের আমার জন্য। মিতাকে আমি আমার রাজ্যের আরেক সম্পদশালী অংশ দিয়ে দিলাম। এবার আমার ছোট মেয়ে বলবে যাকে ভালবেসে জগতের সব কিছু এতো রঙিন হয়ে যায় আমার; বলো আমার আদরের কনিষ্ঠা তোমার ভালবাসা সবাই শুনুক কতো ভালবাসো তুমি আমাকে। নিশ্চুপ অজন্তা তার দুই বোনের কথায় বেদনাহত সে জানে তারা কতো মিথ্যার ফাঁদে ফেলে তার প্রিয় বাবাকে এমন বোকা বানিয়ে সম্পদ কুক্ষিগত করলো। সে মনে মনে ভাবলো 'বাবা তোমার জন্য আমার হৃদয়ের ভালবাসা এতো ঐশ্বর্যময় যে আমার মুখের ভাষায় তা দেখানো সম্ভব নয়।' তাই সত্যবাদী, স্পষ্টভাষী অজন্তা বললো আমি আপনাকে কতোটুকু ভালবাসি প্রিয় বাবা তা আমি বলতে পারবোনা। আমার বলার মতো কিছু নেই যা দিয়ে বুঝাই কতোটুকু ভালবাসি আপনাকে। আপনি আমাকে যে ভালবাসা দিয়েছেন তার প্রতিদান আমি দিতে অপারগ। আমাকে অনিঃশেষ স্নেহে বড় করে তুলেছেন, তিলে তিলে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। আমার বড় দুইবোন তাদের নিজের জীবন স্বামী, সংসারের চেয়ে আপনাকে ভালোবাসার সব কথা বলে দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার নিজের জীবনকেও যেমন ভালবাসি আপনাকেও ততটুকু ভালবাসি। অর্ধেক ভালবাসা যদি নিজের জন্য বাকিটুকু আপনার। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। বললেন- যে আমার সবচেয়ে আদরের, যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ তার মুখে এই কথা? তুমি বলো তুমি আমাকে কতটুকু ভালবাসো? অবিচল অজন্তা বললো। মহারাজ একজন মেয়ের তার বাবাকে যতটুকু ভালবাসা উচিৎ তার এক বিন্দু কমও নয় একবিন্দু বেশিও নয় এই ভালবাসা। রাজার রাগ এবার চরমে উঠলো বজ্র কণ্ঠে বললো ' এই কি শেষ কথা?' অজন্তা উত্তর দিলো 'জ্বি আমার বোনদের মতো সব কিছুর চেয়ে আমি আপনাকে ভালবাসতে পারবোনা; আমার ভালবাসার একটা সীমা আছে এর বাইরে কিছুই করার নেই আমার। ভালবাসা এমন এক অনুভব যার পরীক্ষা হয়না; ভালবাসা এতো অদ্ভুত মানুষ কোনো মাপকাঠিতে তা মাপতে পারেনা।' রাজা এবার চূড়ান্ত রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন দূর হয়ে যাও এক্ষুণি এই চোখের সামন থেকে আজ তুমি পরিত্যাজ্যা আমার সব থেকে ভালবাসা, স্নেহ, সম্পদ, এই রাজদরবার থেকে তুমি ত্যাজ্য ; তুমি আমার কেউ না চলে যাও আমার দৃষ্টি সীমারও বাইরে। এই চোখ আর কোনোদিন তোমাকে দেখবেনা, এই ভালবাসা আর দয়াময় হবেনা তোমার প্রতি। আমি যাকে অন্ধের মতো ভালবেসে গেছি তার হৃদয়ে নেই একবিন্দু ভালবাসা আমার জন্য। এই প্রাসাদে তুমি অবাঞ্ছিত । রাজা এই বলে অজন্তাকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করে অজন্তার সম্পদ দুই মেয়েকে ভাগ করে দিয়ে চলে গেলেন; একবারো আর দেখলেননা তার প্রিয় মেয়ের মুখ। যাকে সবচেয়ে ভালবাসে মানুষ তাকেই যে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতে পারে; যে সবচেয়ে কাছের সেই যে সবচেয়ে দূরের হয় তাই প্রমাণিত হলো। ক্ষিপ্ত রাজার যাবার সময় শুধু জমিদার সুলেমান বললেন মহারাজ একবার ভালো করে দেখুন। অজন্তা যা বলতে চেয়েছে তা ভালো করে বুঝুন। রাজা সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। পুরো রাজ্য অর্ধেক করে পেয়ে দুইবোন খুশিতে পাগল হয়ে গেল ভিতরে ভিতরে। তাদের আনন্দ আরো বহুগুণ বেড়ে গেল এই কারণে যে তাদের শত্রু অজন্তা সর্বস্ব হারিয়ে নি:স্ব হয়ে গেল। তাদের দুজনের মনের সব কামনার ষোলআনা পূর্ণ হলো।
৪. সে রাতে রাজা চলে যাবার পর সবাই চলে গেল একে একে একা পড়ে থাকলো অজন্তা না একা নয় জমিদার সুলেমান আর তার ছেলে আমির থাকলো শুধু। সব আলো নিভে একটা নিভু নিভু মশাল জ্বলছিলো; তাতে অজন্তার শোকাচ্ছন্ন, বাকরুদ্ধ মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছিল। বর্ষার পানির আঘাতে ফুল যেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তেমনি কিন্তু তারচেয়ে বেশি রক্তিম আর আঁধারেও উজ্জ্বল। লাবণ্যভরা আর্দ্র সৌন্দর্য আরো প্রস্ফুটিত ; এতো বড় আঘাত আর উৎকণ্ঠা তবুও অবিচল মনের শক্তি মনোরম দুই চোখে রক্তাভ হয়ে ফুটে উঠেছে। জমিদার সুলেমান কাছে এসে বললো মা তুমি একা নও আমি আছি ; তোমার সত্যবাদিতা আজ তোমার শত্রু হলো ; তোমার সহজ সুন্দর মন আজ তোমাকে একা করে দিলো। আমি অন্ধ হয়ে যাইনি আমি তোমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখে রাখবো। অজন্তা উত্তর দিলো তাতে আপনার বিপদ টেনে আনা হবে। নির্ভীক আমির এগিয়ে আসলো পাশ এসে হাঁটু গেড়ে অজন্তার কাছে হাত বাড়িয়ে বললো 'এই হাত এই ছোট্ট জীবনে শুধু দিয়েই আনন্দ পেয়েছে; আজ আমি একটা জিনিস চাই রাজকন্যা তার ঐ দুইহাত আমার এই হাতে সঁপে দিক' উত্তরে অজন্তা বললো আমাকে রাজকন্যা বলে আর ভুল করবেন না। আমির জবাব দিলো আপনি রাজকন্যা না হলে দুনিয়ার সব রাজকন্যারা যে বৃথা। 'আমি কি খুব বেশি আস্পর্ধার কাজ করে ফেললাম?' আমির দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললো। অজন্তা জবাব দিলো যার পৃথিবীতে কিছুই নেই তার কাছে কোনো আস্পর্ধা সাজেনা। আমির বললো আপনি যে মাটিতে পা দিবেন সে মাটিই রাজার প্রাসাদ হয়ে যাবে; আপনি যদি পরিত্যক্ত ভূমিতে স্থান নেবেন তাও রাজবাড়ি হয়ে যাবে; আপনার হাতের মুঠোয় যদি ধূলিকণার আশ্রয় হয় তাও সোনা হয়ে যাবে। আপনি যেই ঘরে থাকবেন সেই ঘর স্বর্গ কুঞ্জ হয়ে যাবে। উত্তরে অজন্তা বললো আঁধারে জমিদারপুত্র ভুল দেখছে তাই যা সত্য নয় তাই বলছে। আমির উত্তর দিলো আঁধার রাতেও চাঁদ থাকে যদিও সে চাঁদের আলো আলোকিত করেনা যার মনের চোখ আছে সেই উপলব্ধি করে লুকিয়ে থাকা সেই চাঁদের সত্যতা। চাঁদ আঁধারে হারালেও সে চাঁদই। আজ আমি আপনার মাঝে যে সত্য, সুন্দর আর সাহস দেখেছি তা সবার মাঝে থাকলে অন্ধকারের প্রতিটা কোণ থেকে আলো ঠিকরে বের হতো; 'রাজকন্যা কি তার চির প্রার্থিত হাত এই ভরসার হাতে রাখবে?' অজন্তা তার দক্ষিণ হাত দিয়ে আমিরের দক্ষিণ হাত ধরে গভীর আস্থায় আমিরের সৎ, আয়ত দু'চোখে তার অভিজাত দুইচোখ রাখলো। খুশিতে জমিদার ভেসে গেল। বললো যা বাবা যা এখুনি এখান থেকে চলে যা। আমির অজন্তাকে তার ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে নিমিষে উধাও হয়ে গেল।
৫. রাজা আজহার অজন্তার কোনো কথা আর শুনতে রাজি না সে কোথায় গেল কী করলো; সে বুকে পাথর বেঁধে তার শিকারের নেশায় দিনরাত পাড় করতে লাগলো। এদিকে রিতা আর মিতা অজন্তা রাজার মেয়ে হয়েও যে এক নিতান্ত জমিদার ছেলের সাথে বিয়ে করেছে এটা নিয়ে তাদের স্বামী আর সভাসদ নিয়ে খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হাসাহাসি করতে লাগলো। আর আমিরকে তাদের রাজ্যে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলো। কিন্তু রাজা আজহারের জমিদার সুলেমানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন থাকায় তাকে কিছু করলো না। রাজা জমিদারকে নিয়ে আর শতশত শিকারি আর সেবকদের নিয়ে সবসময় শিকারে ব্যস্ত থাকে আর রাজার প্রাসাদে তার দুই শঠ, আমুদে মেয়ে তাদের স্বামী, বন্ধুবান্ধব নিয়ে সবসময় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে থাকে ; ভোগবিলাস আর উৎসবে। রাজ্যের শাসনকাজ সব গোল্লায় গেল। প্রজাদের ওপর অন্যায়, অত্যাচার আর নিষ্পেষণ শুরু হলো; পুরো রাজত্ব ধীরেধীরে ভঙ্গুর হতে থাকে কিন্তু রাজার দুই মেয়ের উন্মত্ত জীবন সেভাবেই চলে ফুর্তি আর আনন্দ, উৎসবে। মন্ত্রী, সিপাহশালার, রাজকর্মীদের লোক যাচ্ছেতাইভাবে লুটপাট করতে থাকে প্রজাদের সর্বস্ব ; প্রজাদের জমির ফসল লুটতরাজ শুরু হয়; ধনসম্পদও কুক্ষিগত করতে থাকে অসহায়ের রাজার দুই জামাই ; রাজ্যে শুরু হয় চরম নৈরাজ্য । ওদিকে আমির রাজ্যের দক্ষিণে জঙ্গলে তার নতুন জমিদারি শুরু করে নব উদ্যমে অজন্তাকে তার স্ত্রী হিসেবে পেয়ে। অসীম সাহসী, কর্মোঠ আমির আর তার স্ত্রীর উদার ভালবাসা, উৎসাহ, বিচক্ষণতায় তাদের জমিদারিতে আসে সোনালি সাফল্য। আমিরের অনুগত শত শত যোদ্ধা ছিলো তারা অল্প দিনেই বনের পাশের পড়ে থাকা পতিত জমিতে সোনা ফলায়, ঘোড়া, পশুপাখি লালনপালন করে ; ধীরে ধীরে আমির, অজন্তার জমিদারিতে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি আসে। অজন্তার তখন সুখের জীবন কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে তার বাবার জন্য সবসময় পুঁড়ে তাই আমির তাকে সান্ত্বনা দেয় একদিন তোমার বাবাকে ফিরে পাবে কথা দিচ্ছি । আমির প্রিয়তমা অজন্তার দুইহাত ধরে প্রতিজ্ঞা করে; অজন্তা মনে মনে শান্তি আর শক্তি পায় সে জানে তার সত্যনিষ্ঠ স্বামী একবার যা মুখ দিয়ে বলবে সে তা কাজে করে দেখাবে। অন্যদিকে প্রতাপশালী রাজা আজহারের কাজকর্মে বাধা আসে। রাজ্যের ভার বেসামাল দুই মেয়ে আর তাদের লোভী দুই স্বামীর হাতে পড়ে নি:স্ব হতে থাকে। ধীরেধীরে দুইবোন রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে যায়। রাজা শতশত চাকরবাকর আর হাতিঘোড়া নিয়ে শিকারে যায় তাতে দুইবোনের ঘোরতর আপত্তি শুরু হয়। তার মাঝে রাজাকে তার প্রাসাদ, রাজকীয় খাবার আর আরাম আয়েশ থেকে দূরে রাখা শুরু হয়। বড় মেয়ে সরাসরি রাজাকে বলে তুমি একা মানুষ তোমার এতবড় প্রাসাদের কী দরকার? রাজাকে প্রাসাদের বাইরে একটা ছোট ঘর তুলে সেখানে রাখা হয়। তার শিকারের লোকজন আর চাকরবাকর ছাঁটাই করা হয়। কিছুদিন পরে রাজার ঘরের পাশে দেয়াল তুলে তাকে একঘরে করে রাখা হয়; যতদিন যায় রাজার কদরও কমে সুযোগও কমে যায়। আস্তে আস্তে রাজার শিকার একবারে বন্ধ হয়ে যায়। মেজ মেয়ে মিতা বলে রাজ্যের লোক খেতে পারেনা আর তোমার অহেতুক এই বাড়াবাড়ি শিকার বন্ধ ; রাজার রাজকীয় ঘোড়া, গাড়ি সব বন্ধ করে একাকী রাখা হয় তাকে দেয়া হয় দাসদাসীদের খাবার। এক সময় আসে রাজার কোনো দাসদাসীও থাকেনা রাজা পুরো বন্ধু শূন্য হয়ে যায়। রাজা আজহার বিষাদে চূর্ণ মনে দুই মেয়ের অকৃতজ্ঞতা দেখে নির্বাক হয়ে যায়। চুপিচুপি জমিদার সুলেমান তার খোঁজ নেয়। রাজকীয় খাবার নিয়ে আসে ; রাজা বলে এ খাবার তো আমার মেয়েরা দেয়নি তুমি পেলে কোথায়? সুলেমান বলে উপরঅলা রাজা বানান কারো উছিলায় তিনিই এর ব্যবস্থা করেন। রাজার ঘর ধীরেধীরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে রাজা সেখানে থাকে অবর্ণনীয় কষ্টে। রাজা দুই মেয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় মনের ভিতরে ভেঙ্গে পড়েন। মানসিক সব শক্তি হারিয়ে ফেলেন। বঞ্চিত রাজা সারাদিন ঘুরেঘুরে তার নিজের রাজপ্রাসাদ দেখেন আর দূর থেকে শুনেন গান, বাজনা, আনন্দ, পানোৎসবে মাতোয়ারা তার মেয়েদের উন্মত্ত আনন্দধ্বনি। তার দুই মেয়ে তাদের বাবাকে পাগল আখ্যা দিয়ে প্রাসাদের যাতে ত্রিসীমানায় প্রবেশ করতে না পারে তাদের সৈনিকদের আদেশ দেয়। দুই মেয়ের অনেক অবৈধ সঙ্গী আর তোষামোদকারী জুটে যায়। এদিকে রাজ্যের দীনতা দুই ব্যভিচারী মেয়ের কারণে বাড়তে থাকে মানুষ বুকে বেদনা চেপে থাকে কিন্তু অত্যাচারের ভয়ে থাকে মুখ বুজে। এ সব খবর অজন্তাও জেনে যায় প্রিয় বাবার জন্য সে কাতর হয়ে পড়ে, অসুস্থ হয়ে যায় চুপিচুপি বাবার খোঁজখবর রাখে। আমির বুঝে সময় এসে গেছে কিছু করার রাজা আজহারের হাজার হাজার প্রজা সমৃদ্ধ আমিরের এলাকায় চলে আসে এসে আমিরের কাছে বলে জমিদার আমির আপনি আমাদের এই অনাচার থেকে রক্ষা করুন আর এর বিহিত করুন। আমিরের লোকবল আর সমৃদ্ধি দিনিদিন বাড়তে থাকে।
৬. ওদিকে রিতা, মিতার উন্মত্ততা বেড়ে যায় তারা নিজেদের ভোগবিলাসে প্রজাদের সর্বস্ব তাদের সৈনিকদল দিয়ে কেড়ে নিয়ে গুটিকয় আস্থাভাজন কুচক্রীদের নিয়ে বেপরোয়া জীবনযাপন চালাতে থাকে। পাগল রাজা সারাদিন হেঁটেহঁটে নিজের রাজ বাড়ি দেখার চেষ্টা করে আর অজন্তা, অজন্তা বলে বিলাপ করে। একদিন এক মন্ত্রী যাকে রাজা আজহার দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করেছিলো নতুন রানী রিতা, মিতাকে বুঝায় রাজ্যের এই যে করুণ দশা নিশ্চয়ই কোনো পাপিষ্ঠর কুনজরের কারণে ঘটেছে। রিতা, মিতা তাদের সেই পছন্দের মন্ত্রীর কাছে এর সুরাহা চায়। মন্ত্রী বলে গণক ডেকে এর কারণ বের করতে হবে। দুই রানীর সম্মতি আর নির্দেশে মন্ত্রীর পছন্দে গণক আসে। গণক এসে গণনা করে বলে তাদের বাবা বিগত রাজার কুনজরে রাজ্যের এই অভিশপ্ত অবস্থা। গণক বলে দেয় রাজার দুই চোখ উপরে না ফেললে রাজ্য থেকে অভিশাপ যাবেনা। নিষ্ঠুর দুই মেয়ে নির্দেশ দেয় রাজার দুই চোখ অন্ধ করে দেয়া হোক। তার পরের দিনই রাজাকে বন্দী করে রাজপ্রাসাদে এনে জল্লাদ দিয়ে তার দুই চোখ উপড়ে ফেলে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে জঙ্গলে নিক্ষেপ করা হয়।
পরদিন এক রাখাল বালক রাজাকে উদ্ধার করে তার কুঠিরে নিয়ে যায়। আহত রাজাকে সেবা করে সুস্থ করে তুলতে থাকে। এক রাতে অসুস্থ রাজা খুব শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলে আমাকে একটা কম্বল দাও না হয় আমি শীতে মরে যাবো। রাখাল কম্বল পায়না তাই খড়কুটো জ্বালায় ; শীর্ণ রাজা বলে কতদিন কতো সোনাদানা পায়ের লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছি কিন্তু আজ দেখলাম এক টুকরো খড়ও জীবনের জন্য কতো অমূল্য। কিছুদিন পর মৃতপ্রায় রাজাকে জমিদার সুলেমানের লোকেরা উদ্ধার করে জমিদারের বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা, সেবা, যত্ন করে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তুলে। অন্ধ রাজা সারাদিন কাঁদে আর অজন্তাকে দেখতে চায়। জমিদার আমিরের কাছে খবর পাঠায়; অজন্তা বাবার এই করুণ কাহিনি শুনে আরো বেদনায় কাতর হয়ে যায়। এক রাতে লুকানো রাজাকে দেখতে তারা হাজির হয় জমিদারের বাসায়। তখন মাঝরাত রাজা ঘুমিয়ে অজন্তা আর আমির আসে সাথে সৈনিকদল। রাজার ঘুম ভেঙ্গে যায় কিছুদূরে বসে অজন্তা বাবাকে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পাগল রাজা চিৎকার করে ওঠে সুলেমান, সুলেমান আমার অজন্তা এসেছে ; আমি এইমাত্র স্বপ্নে দেখলাম আমার কেমন মনে হচ্ছে অজন্তা আমার পাশেই আছে। তোমরা আমার অজন্তাকে এনে দাও। না, না অজন্তা আছে কাছেই ওকে আমার কাছে এনে দাও। যে সুবাতাস আজ বইছে তার বুকে আমার অজন্তার সুগন্ধ। সুলেমান বলে জাঁহাপনা আপনি অন্ধ আপনি কিভাবে দেখলেন অজন্তা এখানে। রাজা উত্তর দেয় সুলেমান অন্ধ হয়েই আমার চোখ খুলে গেছে। আমি যখন চোখে দেখতাম তখন বুঝিনি। সত্য মিথ্যার পার্থক্য করতে পারিনি। আজ অন্ধ হয়েই আমি বেশি দেখছি। অজন্তা বসে আমার জন্য কাঁদছে আর আমার সেই বাঘিনী দুই মেয়ে তাদের বিষ দাঁত দিয়ে আমার সোনার রাজ্য রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। সুলেমান আমার হৃদয় দিয়ে আজ দুটি ধারা বইছে; একটি আমার দুই মেয়ের অকৃতজ্ঞতার রক্ত ধারা আর একটা আমার বঞ্চিতা মেয়ের জন্য ভালবাসার অশ্রু ধারা। আমার যখন দুই চোখ ছিলো আমি এতবড় মিথ্যা বুঝতে পারিনি আর আজ যখন আমি অন্ধ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। সুলেমান আমার হিংস্র দুই মেয়ে ভালোই করেছে আমাকে অন্ধ করে দিয়ে এখন সত্য কী তা বুঝতে শিখলাম। রাজা বলতে বলতে বিলাপে ভেঙ্গে পড়েন। সুলেমান বলে জাঁহাপনা আপনার প্রিয় মেয়ে যাকে ভুল বুঝে আপনি বঞ্চিত করেছিলেন সে আপনাকে ভুলেনি। সে সবসময় আপনার খবর নিত আপনার ভালো থাকার সব ব্যবস্থা করতো। সে দূর থেকে আপনার সব খবর রেখেছিলো; আপনার খাবার, পোশাক সব সেই পাঠিয়ে দিতো । সে আর তার স্বামী আমার পুত্র এখন অনেক শক্তিশালী জমিদারির মালিক তারা এসেছে আপনার দুই চোখ হয়ে তাদের দুজনকে দিয়ে আজ আপনি আবার নতুন করে দেখছেন। রাজা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে কোথায় আমার মা এই দুনিয়ায় আমার সবচেয়ে যে আপন তাকে আমি সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছি তাই আজ আমার এই পরিণতি। রাজা কেঁদে বলে মা তুমি কাছে আসো আমি দেখছি আমার বেদনায় তোমার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুবিন্দু নয় রক্ত ঝরছে; আমাকে আরেকবার সুযোগ দাও আমি ভালবাসা দিয়ে আমার অপরিণাম পাপের প্রায়শ্চিত্ত করি; এখন তো আমি নি:স্ব, রিক্ত শুধু তোমাকে দোয়া দিয়েই আমি আমার এই দেহ ত্যাগ করি। অজন্তা কেঁদে ফুঁপিয়ে ওঠে ; রাজা দুইহাত বাড়িয়ে দেয় অজন্তা এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। রাজা বলে মা আমি বিরাট রাজত্ব হারিয়েছি; আমি বেদনায় দগ্ধ হয়ে বুঝেছি জীবন্ত মানুষ জ্বলন্ত আগুনে পুঁড়ে কী বেদনা পায় কিন্তু তুমি বিবেকহীন বাবাকে ঘৃণা পেয়ে যে ভালবাসা দিয়ে গেছ তাতে আমার সব বেদনা, কষ্ট একেবারে দূর হয়ে গেল। যাদের একদিন সবটুকু ভালবাসা দিয়েছিলাম তারা বিনিময়ে তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি যন্ত্রণায় বিষে আমাকে দগ্ধ করেছে আর যাকে কিছু না দিয়ে শূন্য হাতে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম সেই আমাকে ভালবেসে দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মা। অজন্তা কাঁদে বাবার জীর্ণ শরীরে আদর করে দেয়। আমির বলে জাঁহাপনা আপনি যে কোনো ভুল করেননি অজন্তা তার প্রমাণ ; সে যোগ্য রাজার মেয়ে তাই আমার মতো সাধারণ এক জমিদারের ছেলে যে আপনার রাজ প্রাসাদের একটি কামরার চেয়েও মূল্যবান নয় হয়ত: তাকে স্বামী হিসেবে ভালবাসা, প্রেরণা আর উৎসাহ দিয়ে শক্তিশালী, সাহসী আর উদ্যমী এক সফল মানুষ করে তুলেছে। অজন্তার হয়ত হাতের মুঠোয় কোনো মণিকাঞ্চন ছিলোনা কিন্তু ওর মনের অফুরান সম্পদ যা আপনার কাছে পেয়েছে তাতে যেখানেই হাত দিয়েছে তাই সোনা হয়ে গেছে। রাজা কাঁদে আর বলে সেদিন কেন আমি তোমাকে এতো কষ্ট দিলাম আর পাষাণ মন তা বুঝতেও পারলোনা। আজ তোমার সত্য ভালবাসা তোমার বাবার দুই চোখ খুলে দিয়েছ। সুলেমান সেদিন তুমি আমাকে সত্য দেখতে বলেছিলে আমি বুঝিনি আজ আমি বুঝলাম- আর লোক দেখানো ভালবাসা যে কতো বিপদজনক হতে পারে আর সত্য ভালবাসা যে কতো দামি হতে পারে তা আমি বেদনায় বেদনায় বুঝলাম। আমি এতবড় রাজা ছিলাম তবুও তোমাদের সবার কাছে কতো ঋণী! হায় ঐশ্বর্য মানুষকে কতো বেশি অন্ধ করে দেয়। আমির বললো মহারাজ আপনি আমাকে হুকুম দেন তো আমি আপনার অকৃতজ্ঞ দুই মেয়েকে এই রাজ্যচ্যুত করি। রাজা বললো 'আমির, তুমি শুনেছি নিজের সুবিচার, সততা, পরিশ্রম, ন্যায়পরায়ণতা আর বীরত্বে জমিদারীকে রাজত্ব্যে বিস্তার করেছ।' এখন তুমি ভালো বুঝ, কী ঠিক আর কী ঠিক নয়; তোমার বাবা আর তুমি আমাকে যে ভালবাসা দিয়েছ তাতে তোমরা যা করবে তাতে আমার পূর্ণ মত সবসময়।' ' আর অতিলোভের অশুভ পরিণতি তুমিই পারো নির্মূল করতে। যারা আমার ভালবাসা আর বিশ্বাস ঘৃণা, মিথ্যা, নির্মমতা দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করেছে তাদের তুমি কঠোরতম সাজা দাও। তোমাকে আমি ছোটকাল থেকে চিনি। যাও তুমি জয়ি হয়ে আসো।'
৭. ওদিকে আমিরের নেতৃত্বে আমিরের সৈন্য, যোদ্ধা আর রাজা আজহারের প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে রাজ প্রাসাদে অন্যায় আর জুলুমের বিরুদ্ধে হানা দিলো সেই রাতেই । রাজার দুই মেয়ে, দুই দুষ্ট চরিত্রা তখন জৌলুশ, আরাম, আয়েশ আর বেহিসাবি জীবনযাপন করে রাজার রাজ্য নি:শ্বেস করে দিয়েছে। তাদের যোদ্ধা বাহিনীও ছোট আর দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই এক রাতের যুদ্ধেই তারা আমিরের বাহিনীর হাতে পরাস্ত হলো রাজার দুই মেয়ে, তাদের স্বামী আর কুচক্রী মন্ত্রীদের বন্দী করা হলো। তারপরের দিন পুরো রাজ্য জুড়ে আনন্দের ঢেউ উঠলো। রাজা তার রাজকন্যা আর রাজত্ব ফিরে পেল। প্রজাদের মনে ফিরে আসলো শান্তি। সবাই চাইছিলো পাষণ্ড দুই মেয়ে আর তার দোসরদের মৃত্যুদণ্ড কিন্তু অজন্তা তাদের নিবৃত্ত করলো। রাজা আজহারের নির্দেশে আমিরকে রাজা বানানো হলো অজন্তা রানী আর সুলেমান প্রধানমন্ত্রী হলো। রিতা আর মিতা পেল আজীবন কারাদণ্ড। দেশে আবার মঙ্গল ফিরে আসলো। অজন্তাকে পেয়ে রাজা আবার সুস্থ হয়ে উঠলো। কিছুদিন পর অজন্তার ছেলে সন্তান জন্ম নিল অজন্তা বাবার নামে ছেলের নাম রাখলো রাজকুমার আজহার।
একরাতে রাজা ঘুমিয়ে ছিলেন এমন সময় তার ঘর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো ; চমকে অন্ধ রাজা উঠে বসলেন তার রাজ কক্ষে; অবাক রাজা জিজ্ঞেস করলো এতো আলো কিসের মা অজন্তা; অজন্তাও চমকে উঠলো বাবা আপনি দেখতে পারেন ? না মা চোখে দেখতে পারিনা আমার দুইচোখ অন্ধ হয়ে গেলেও মনের চোখ যে খুলে গেছে। অজন্তা কেঁদে উঠলো, বললো বাবা আজ আপনার নাতীর জন্মদিন তাই সব প্রজারা সারারাত আনন্দ করবে, ভোজ করবে। রাজা বললো অজন্তা তোমার ছেলে একেবারে আমার মতো হয়েছে আর তোমার মতো শান্ত, বিচক্ষণ; ও যে চোখ দিয়ে এই পৃথবীকে দেখবে তাতে আমার না দেখার অতৃপ্তি ঘুচে যাবে। রাজা এগিয়ে গিয়ে অজন্তার ছেলেকে এক হাত দিয়ে আর এক হাত দিয়ে অজন্তাকে জড়িয়ে ধরলো ; ডাকলো আমির তুমি আসো ; সুলেমান তুমিও আসো আজ আমি আমার এই প্রাসাদে এক টুকরো স্বর্গ খুঁজে পেয়েছি। বাইরে থেকে আনন্দধ্বনি এসে প্লাবিত করে দিচ্ছিলো রাজপ্রাসাদ; এ কোনো কামাতুর আনন্দধ্বনি নয় স্বর্গীয় এক মধুর ক্ষণ পুরো রাজ্যকে মুখরিত করলো সুখানন্দে; বেশ দূর থেকে রাজার দুই পাপিষ্ঠা বন্দী মেয়ে সেই ধ্বনি শুনে দু' চোখ দিয়ে না দেখেও বুঝলো এ কোনো আসক্তিকর আনন্দক্ষণ নয় হৃদয়ের গৌরবময় আনন্দের বহিঃপ্রকাশ যেখানে সব ভালবাসা এক হয়ে সবার মাঝে বিলীন হয়ে যায় মধুর অনুভূতিতে।