সত্তর ঊর্ধ্ব বাসেত মিয়ার মেজাজ বেশ চড়ে আছে। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে কার্পেটের বেশ খানিকটা তুলে ফেলেছেন। যদিও মুখের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি বেশ ফুরফুরে মেজাজে সকালের চা নিয়ে বসেছেন। ইদানীং তিনি বেশ সব কিছু নিয়েই খিটখিট করেন। বাসেত মিয়া নিজেও জানেন তিনি কি পরিমাণ খিটখিটে। তার ই বা দোষ কোথায়? তিন ছেলের মধ্যে বড়টা দেশে থাকে না, ছোট দু’টো শেষ কবে বাবাকে দেখতে এসেছে তা বোধহয় এখন ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়। স্ত্রী রানু বেগম অজানার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বাসেত মিয়াকে রেখে তা প্রায় বছর দশেক হতে চলল। স্ত্রীর চলে যাওয়া নিয়ে তার আক্ষেপ তেমন নেই তিনি বরং খুশি ই কারণ তার ছেলেদের কর্মকান্ড তার দেখে যেতে হয়নি। এতদিন পর ঈদের চাদের মত তার এক নাতির উদয় হল। তিনি তার ছেলেদের থেকেও তার নাতিদের পছন্দ করতেন। করতেন বলছি কেন? ছেলেরা বড় হয়ে আর বাসেত মিয়ার মত গ্রাম্য থাকেন নি, তারা অনেক আধুনিক মেজাজের লোকজন। সবাই মোটামুটি বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন বড়টা থিতু হলেও বাকি দু’টো পয়সায় মার খেয়ে লেজ গুটিয়ে দেশে ফিরেছে নয়তো তারাও আজ শুদ্ধ ইংরিজিতে ফিরিঙ্গি স্ত্রীদের সাথে রসালাপন করত। সাদা চামড়া কপালে জোটাতে না পারলেও এরা ওখান থেকে তেনাদের “আদব-লেহাজ” নিয়ে এসেছেন। নাতিদের নাম শুনলেই তার মেজাজ লাফিয়ে সীমা অতিক্রম করে। বাংলা নাম তো নেই ই বরং কারও কারও নাম শুনলে মনে হয় এরা বোধ হয় এ জগতের বাইরের কোন গ্রহ থেকে এসেছে। ওনার এই নাতির নাম রড্রিগেজ। তিনি ডাকেন স্বাধীন নামে। এই নামটা তার নাতির মোটেও পছন্দ নয়। নাম ধরে ডাক দিলেই তার নাতির ভ্রু কুঁচকানো পূর্বক আবির্ভাব হয়। নাতির এদেশে আসার কারণ হল এখানকার ভিখিরিদের নিয়ে কিছু গবেষণা করা, ছবি তোলা এবং তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া। পরবর্তীতেএগুলো নাকি ব্রিটেনের কোন জার্নালে ছাপানো হবে। নাতি তার মনের কথা প্রকাশ করার পর থেকে তিনি দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখছেন। যদিও নাতিকে তিনি সরাসরি কিছু বলেন নি, শত হলেও এই একা জীবনে নিজের রক্তের সাথে কে না চায় জীবনের বাকি সময়গুল কাটাতে? এই দেশটাতে দেখার মত কি নেই? এই দেশের কি কোন ভাল কিছুই নেই গবেষণা করার মত? এত কিছু থাকতে ঐ সাদা চামড়াগুলোর কাছে আমাদের ভিখিরিগুলোকে নিয়েই তোর গবেষণা ফাঁদতে হবে? সাদা চামড়া নিয়ে বাসেত মিয়ার আক্ষেপ নেই, আক্ষেপ হচ্ছে যারা আমাদের দুশো বছর রক্ত চুষে গেল তাদেরকে নিয়ে এত হৈ চৈ করার কি আছে? সাদা চামড়ার পর এল রুটি খোর পাকিস্তানিগুলো। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এদেশের মা বোনের গর্ভে সাচ্চা মুসলমানের বীজ বপন করে এদেশকে আজাব মুক্ত করা। বাংলাদেশ ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হে! এদেশকে নয় বরং তোদের কুৎসিত চিন্তাকে ব্লিচিং গুড়ো দিয়ে আচ্ছা মতন ধুয়ে দিতে পারলে বাসেত মিয়ার হাড় জুড়োত। দেশের তরুন প্রজন্মের দিকে তাকালে ওনার মনটা বেশ বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এখন বন্ধুদের আড্ডায় গাজা না হলে আড্ডা তেমন জমে না। কথার ফাকে ফাকে ইংরিজি ছুড়ে না মারলে ছেলেগুল তেমন আধুনিক হয়ে উঠতে পারে না। সিগারেটের ধোঁয়া এখন ফ্যাশন। আর মাদকদ্রব্য তো এখন এতই সহজলভ্য যে তরুন সমাজ তা হাভাতেদের মত গিলছে। বাসেত মিয়ার নিজের তরুন বয়সের কথা মনে পড়ে থেকে থেকে। ষাটের দশকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। তাদের আড্ডার মুল বিষয় থাকত গঠনমুলক। কখনও শের-এ-বাংলা কখনও আলবার্ট আইন্সটাইন এবং বোসের সম্মিলিত গবেষণা নিয়ে চলত আড্ডা। কখনও চলত শুধু মাত্র গানের আসর। এস. ডি. বর্মণের গান শুরু হলে তা থামানোই ছিল মুশকিল। তিনি জানেন তাদের সময় আর এখনকার সময়ের তুলনা চলে না। সময় এখন অনেক এগিয়েছে। প্রযুক্তি বদলে দিয়েছে অনেক কিছুই। জীবনকে করেছে অনেক সহজ। পৃথিবী এখন অনেক ছোট, চাইলেই হাতের মুঠোয় বন্দি করা যায়। এক দেশের সংস্কৃতির সাথে আরেক দেশের সংস্কৃতির বিনিময় চলছে। মানুষ এখন আর আগের মত ছোট্ট গন্ডিতে আঁটকে নেই। এখন জানার পরিসর অনেক বেশি। কিন্তু এত জেনেও মানুষের নৈতিক অবক্ষয় রুখতে পারা যাচ্ছে না। এক দেশের সংস্কৃতি গ্রাস করছে আরেক দেশকে। উত্তাল খোলামেলা আর মেলামেশা এখন আধুনিকতার অংশ। নিজের বলে কিছুই নেই এখন এদের। যার নিজের সংস্কৃতি এত উন্নত, এত প্রাচীন তারা কেন অন্যের অনুকরণ করবে? এদের পরবর্তী প্রজন্ম কি জানবে এদের পূর্ব-পুরুষ সম্পর্কে? নাকি ধার করা এই আধুনিকতাই এদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে? ইতস্তত মনে খালি কিছু কথাই মনে মনে আওড়াচ্ছিলেন তিনি। তার পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তায় মেজাজ বিগড়ে টং। চা হাতে নিয়েও রেখে দিলেন বাসেত মিয়া। মনে পড়ল অনেক আগের কিছু কথা; এ দেশের শুরুর কথা, তার শুরুর কথা। যুদ্ধ শেষে তিনি সবে বাড়ি ফিরেছেন। বাড়ি বলতে দু’টো পোড়া খুঁটি আর বেশ কয়েকটা মরা গরু উঠোনে। যুদ্ধের ভয়াবহতা তিনি দেখেছেন। তিনি জানেন কত ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা এসেছে। কত রক্ত আর মা বোনকে বলি দিয়ে ওনারা উপহার দিয়েছেন এই স্বাধীন ভুখন্ড। ফিরে আসার পর সবাই চায় তার পরিবারকে এই স্বাধীন দেশে নিয়ে বেঁচে থাকতে! কিন্তু কজন পেরেছে? বাসেত মিয়ার পরিবারের কারও কোন হদিস নেই, পরে অনেক খুঁজেও যাদের আর পাননি। জমিজমা বেঁচে ঢাকায় এসে ভাগ্য অন্বেষণের ফাকে হটাৎ পরিচয় হয় রানুর সাথে। আলাদা করে চোখে লাগার মতন নয় তবুও কোথায় যেন একটা মন ছুঁয়ে দেয়া ভাব। কোমর পর্যন্ত ছড়ান চুল যা দেখলেই দীঘির জল মনে হয় আর ইচ্ছে করে সাতার কাটতে। প্রসাধন বলতে চোখের কাজল। এত নির্মম শান্ত চোখ আজ অবধি দেখেছেন কিনা তিনি মনে করতে পারছেন না! ভাললাগা থেকে শুরু সেই গাটছড়ায় একজন আজ ধরণীর ও পাড়ে! সমাজের উচুতলার একজন তিনি, তবে এতকিছুর পরও কখনও তিনি একটা কথা ভোলেননি “এই দেশ তার মা এবং মাটি তার গৌরব”
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।