১ -
গ্যালারীতে চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছে। ঠিক প্রদর্শনীও বলা যায় না। আসলে , সেরা ছবি নির্বাচনের জন্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। চারুকলার শেষ বর্ষের ছাত্রদের আঁকা ছবি নিয়ে প্রতিযোগিতা। ফারহানও একটা ছবি জমা দিয়েছে। ছবির নাম, “ছুঁয়ে দেখবে”। প্রথম দুইদিনে প্রায় দেড়শটি জমা দেয়া ছবি প্রদর্শনী হয়েছে। আজকে বিকেলে সেরা ছবি ঘোষণা হবে। ফারহান দুপুরের দিকে এসেছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। ক্ষুধাও সেরকম লাগেনি। কোত্থেকে শুনেছিল , নিকোটিন নাকি ক্ষুধার মাত্রা কমায়। তাই , বাস থেকে নেমে পরপর দুটো সিগারেট খেয়েছে। মুখ দিয়ে সিগারেটের গন্ধ বের হচ্ছে। অনেক গণ্যমান্য মানুষ এসেছে। কারো সাথে কথা বলার সময় সিগারেটের গন্ধে বিরক্ত হতে পারে দেখে , মানুষজনকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। রাশেদকে দেখা যাচ্ছে , তাও ইচ্ছে করেই ওকে এড়িয়ে গ্যালারির এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে।
সংস্কৃতি মন্ত্রী এসে গিয়েছে। সবাই , ব্যস্ত হয়ে গেটের দিকে যাচ্ছে। মন্ত্রীকে বরণ করে নিতে হবে। ব্যস্ততা সংক্রামক রোগের মত। কেউ হঠাৎ করে ব্যস্ত হয়ে পড়লে , পাশের লোকজন নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। নিজেও কারণ জানার আগেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবাই গেটের দিকে আগাচ্ছে , দেখে ফারহানও এগুলো। সবাই মহা উৎসাহে মন্ত্রীকে বরণ করে নিল। মন্ত্রীরা এসে সচরাচর যেগুলো করে , সেটা হচ্ছে গম্ভীর মুখে এসে আসন গ্রহণ করে। তিনিও সেটা করলেন। তারপর , আয়োজকরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছু ছবি দেখায়। মন্ত্রীরা কিছু বুঝলেও গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে , না বুঝলেও তাকিয়ে থাকে। তিনিও সেরকম করলেন। শেষে , আয়োজকদের সাথে বসে – একটা বক্তৃতা দিলেন , চিত্রকলার প্রসারে এ ধরণের অনুষ্ঠানের জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে , অবশ্যম্ভাবী ভাবে চিত্রকলার সাথে কিছুটা রাজনীতির আলাপ করে বক্তৃতার ইতি টানলেন। সবাই তালি দিতে থাকলো। এরপর আয়োজকরা সেরা তিন ছবি ঘোষণা দেয়ার জন্যে উপস্থাপিকার হাতে কাগজ গুজে দিয়ে স্টেজে পাঠালেন। সেজে-গুজে থাকা সুন্দরী উপস্থাপিকাদের ক্ষেত্রে ফারহান একটা জিনিস খেয়াল করেছে। এরা যখন পুরস্কার ঘোষণা করে , এদের মুখে তখন একটা সূক্ষ্ম অহংকার ফুটে ওঠে। তারা জানে , পুরস্কার তারা দিচ্ছে না , দিচ্ছে আয়োজকরা। তবুও কেমন জানি , একটা সূক্ষ্ম অহংকার ফুটে উঠে। ফারহান এইসব সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম জিনিস সবসময়ই খেয়াল করে। চারুকলায় পড়ার সময় একবার বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বলেছিল , “জানিস , তুই যদি কোন জুতার দোকানে জুতা কিনতে ঢুকিস , দেখবি সেলসম্যান ঢুকার সাথে সাথে তোর মুখের দিকে না প্রথমেই জুতার দিকে তাকাবে।” বন্ধুরা বিশ্বাসই করলো না। তখনই ফারহান বলল , “চল নিউমার্কেট যাই , তোদের আজকে দেখাবো।” তিন বন্ধু মিলে নিউমার্কেট গেল , জুতার দোকান খুঁজে খুঁজে বের করল। কয়েকটা জুতার দোকানে তারা ঢুকল আর আবিষ্কার করল , কথা আসলেই সত্য। সব সেলসম্যান আগে মুখের দিকে না তাকিয়ে , পায়ের জুতার দিকে তাকায়। তাকিয়ে বের করে , এই লোকের পছন্দ কি , বাজেট কিরকম ইত্যাদি! যাই হোক , বন্ধুরা অবাক হয়েছিল। দুই বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে অবাক হয়েছিল লতা। রাশেদ এমন একটা ভাব মেরে বলল , “যে সব্বাইতো এটা বুঝে , এটা আবার নতুন কি?” লতা বলেছিল , “তোর ভিতরে শিল্পী সত্ত্বা আছে , সবাই যেটা দেখে তুই তার মধ্যে অতিরিক্ত কিছু দেখিস! তুই সত্যিকারের শিল্পী হতে পারবি , আর আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।” ফারহান বলেছিল , “ধুর , বাদ দেতো , তুই স্যান্ডেলের মধ্যেও শিল্পসত্ত্বা খুঁজে পাইছিস , তোরে আর কি বলবো। আমি তো দেখতে পাইতেছি , স্যান্ডেল ব্যবসায় আমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। জীবনে বড়সড় স্যান্ডেল ব্যবসায়ী হতে পারবো , হা হা হা...” কথা শুনে , লতার সে কি হাসি। ফারহান মনে মনে বলেছিল , “খোদা , যাকে এরকম হাসি দিয়েছে , তার মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে এই জীবন অকাতরে সঁপে দেয়া যায়।”
“এই ফারহান , ফারহান” , রাশেদ ধাক্কা দিতে দিতে বলল। ফারহান চোখ খুলল। এতক্ষণ , লতার কথা চিন্তা করতে করতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। উপস্থাপিকা একরকম বিরক্তির সুরে বলছে , “আমি আবারো বলছি , প্রথম হয়েছে কনটেসটেনট নাম্বার সেভেন্টি সেভেন , ফারহান আকতার’কে স্টেজে উঠে পুরস্কার গ্রহণের জন্যে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।” রাশেদ সামনের দিকের চেয়ারে বসেছিল। পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে ফারহান চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিঙের দিকে মুখ করে আছে। এদিক দিয়ে উপস্থাপিকা দুইবার কনটেসটেনট নাম্বার সেভেন্টি সেভেনকে ডেকেছে। ফারহান খেয়াল করছে না দেখে , রাশেদ উঠে ফারহানকে ধাক্কা দিয়ে ডাকছে। ফারহান উঠে স্টেজে ধীরে ধীরে উঠলো। পুরস্কার নিল। এক লক্ষ টাকার চেক আর ক্রেস্ট। ক্যামেরার ফ্লাশে বিদ্যুৎ ঝলকের মত ছবি উঠতে থাকলো – হাসি হাসি মুখে সবাই , একমাত্র পুরস্কার হাতে নিয়ে ফারহান গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কি যেন গভীরভাবে ভাবছে।
২-
ছবির নাম “ছুঁয়ে দেখবে”। ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা নীল আর সাদার খেলা। একটা খোলা মাঠ। হালকা সবুজের কাজ। দূরে দিগন্ত ছোঁয়া আকাশ। আবছায়াভাবে বোঝা যাচ্ছে , একটা নারী মূর্তি। আকাশী রঙের শাড়ির আঁচল উড়ছে। এমনভাবে আঁকা হয়েছে , বোঝা যাচ্ছে খুব দূর হতে কাউকে যেমন ছোট দেখা যায় , সেরকম। মনে হচ্ছে যেন , নারী মূর্তিটি দিগন্তের আকাশের রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে। এই কাজটা সবচেয়ে কঠিন ছিল। রঙতুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে এক একটা আঁচড় পরম মমতায় দিয়েছে ফারহান। এই অংশটা করার সময় কখন দিন ছিল , কখন রাত ছিল এইসব ভাবার সময় পায়নি। শাড়ির রঙ যেন , দিগন্তের আকাশী রঙের সাথে মিলে যায় , আবার না মিলে যায় – এই দুটো জিনিস করা ছিল , সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্যালেটের রঙ শুকিয়ে গিয়েছিল। তার উপরে ঐ কাজটা করা হয়েছে জলরঙে। এরপর , ক্লোজ শটে একটা হাত। এমন ভঙ্গিমায় যেন দূর হতে ডাকছে সেই শাড়ি পরা মেয়েটিকে। দিগন্তের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি , আর একটা হাত আকুল হয়ে ছুঁতে চাইছে মেয়েটিকে। কিন্তু , অসম্ভব দূরত্ব হাত আর শাড়ির আঁচলের মধ্যে। কোনদিন ছোঁয়া সম্ভব না। মনে হচ্ছে , শাড়ির আঁচলের আকাশী রঙ আর দিগন্তের আকাশী রঙ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে , কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর , হারিয়ে যাবে নারী মূর্তিটি। এই হচ্ছে , ছবি।
“কনটেসটেনট নাম্বার সেভেন্টি সেভেন” আইডি কার্ড পরে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। এতক্ষণ আইডি কার্ড পকেটে ঢোকানো ছিল। এখন , ভাবল পরা দরকার। ছবি জমা দেয়া ছাত্ররা ভিড় করেছে। গুঞ্জন চলছে , নিজেদের মধ্যে। এই ছবির মধ্যে কি এমন আছে , যে একে পুরস্কার দিতে হবে ? এককে জন একেকটা ব্যাখ্যা করছে। কিছু কিছু ছাত্ররা আবার ফারহানকে এসে বিরস অভিনন্দন করে যাচ্ছে। করার খাতিরে করা এরকম। ফারহান বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। আয়োজকরা অনেক সময় ব্যাখ্যা করে না , কেন পুরস্কারটা দেয়া হল। ছবিটা কেন সেরা। এবারেও , ব্যাখ্যা করল না। তরুণ চিত্রশিল্পীদের একটা দোষ আছে , তারা কখনো সমবয়সী চিত্রশিল্পীদের নিজের চেয়ে ভাল শিল্পী মনে করে না। নিজেদের মধ্যে একটা অহংকার থাকে। এটা শিল্পী হওয়ার পর্যায় , এই পর্যায়ে অনেকের ভ্রান্তি থাকে। পরে , অবশ্য ভ্রান্ত চিন্তা ভাঙ্গে। বুঝতে শিখে , শিল্পীর কোন বয়স নেই। শিল্পের কোন সীমানা নেই। চিত্রশিল্পী বলে কিছু নেই , আছে তুলি , রঙ , ক্যানভাস আর মহাকাল। এই চার জিনিসের পরীক্ষায় উৎরে যেতে পারলে , সঙ্গী হিসেবে চিত্রশিল্পীও টিকে থাকে। একজন চিত্রশিল্পীর অস্তিত্বের প্রমাণ – তার ছবি।
কোত্থেকে রাশেদ এসে হাজির হল , বলল , “দাঁড়িয়ে আছিস কেন।”
“এমনিই , ক্যান?”
“ছবি ফাস্ট প্রাইজ পেয়েছে , আর তুই ক্যামুর মত রাতদিন অ্যাবসারডিস্ট হয়ে কাকতাড়ুয়ার মত দাঁড়িয়ে আছিস , কারো সাথে কথাও বলছিস না। পুরো গল্প-উপন্যাসের নায়ক নায়ক ভাব। এজন্যেই বললাম আরকি।” বলেই হাসল রাশেদ।
খসখসে হাসি হাসল ফারহান। অনেকসময় হাসিই উত্তর। রাশেদ হাল ছেড়ে দিল। আগে অনেক হাসিখুশি ছিল ফারহান। গত কয়েক মাসে অনেক বদলে গিয়েছে। এতটাই বদলে গিয়েছে , যে আবারো সব অদল-বদল করে আগের মত বদলে যাওয়া অসম্ভব।
ফারহান বলে উঠল , “বাসায় যাওয়া দরকার।”
“এখনই?”
“হু , তুই থাক , আমি গেলাম। আর ধর , এইসব হাবিজাবি রাখ।” বলে চেক আর ক্রেস্টটা হাতে দিল রাশেদের।
“মানে , আমি এই গুলা নিয়া কি করবো।”
“কি করবি , বুঝিস না ? চেকটা ভাঙিয়ে আমার আর তোর বাকি তিন মাসের মেসের ভাড়া দিবি , আর বাকী টাকা নিয়ে কুমিল্লায় যাবি। তোর না, দুই সপ্তাহ পর বোনের বিয়ে। যেয়ে অন্তত বাড়ির জমিটার বন্ধক ছুটা।”
বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল , ফারহান। রাশেদ চেক আর নেকলেসের বাক্সের মত ক্রেস্টটা হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদের বোনের বিয়ে কয়দিন পরই। অভাবের সংসারে বিয়ে কোন উৎসব নয় , হাসি মুখে উৎযাপন করলেও ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়। অর্থাভাবে কিছুই করা হয়নি। শেষমেশ ভিটেমাটি বন্ধক করে , সামান্য কিছু টাকা ঋণ করে সাদামাটা বিয়ের আয়োজন। রাশেদের ভেতরটা এতদিন লজ্জায় পুড়ছিল। কিভাবে যাবে , কোন মুখে ? একে বড় ভাই , তাও আবার খালি হাতে। শুধু কোনমতে নিজের খরচটা উঠায় টিউশনি করে। এরপর কিছুই থাকে না।
কিছুক্ষণ আগে ফারহানকে গল্প-সিনেমার নায়ক বলে ইয়ার্কি করছিল। এখন বুঝতে পারল , গল্প-উপন্যাসের সাজানো প্লটের মাঝের নায়ক-নায়িকাদের চেয়ে বাস্তব জীবনের নায়ক-নায়িকারা অনেক সত্য , অনেক উঁচুতে। এতোটাই উঁচুতে , যতটা উঁচুতে কখনো গল্পও-উপন্যাসের প্লট উঠতে পারে না। রাশেদ রুমাল বের করে। পুরুষদের চোখের পানি অলক্ষুণে , এটা কাউকে দেখতে দিতে নেই। এমনকি জানতে দিতেও নেই।
ফারহানের সাথে রাশেদের পরিচয় হয়েছিল চারুকলার প্রথম বর্ষেই। আরেকজনের সাথেও পরিচয় হয়েছিল , লতা। তিনজন একসাথে চলতে চলতে ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছিল। এরপর , বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। তিনজন একসাথে চলতো-ফিরতো। ক্লাস করতো। ফারহান ছিল অনেক লাজুক প্রকৃতির। তিনজন বন্ধু হলেও ফারহান লতার সাথে কথা-বার্তা বলত কম। লতাও এই সুযোগে খোঁচাতো ফারহানকে। এভাবেই চলছিল। একদিন ফারহান বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলে। সোজাসুজি ঢাকা মেডিকেল কলেজ। ব্যান্ডেজ করে ঘরে পুরোপুরি এক মাস বিছানায়। প্রতিদিন লতা আসত , খোঁজ নিতে। প্রথম প্রথম ফারহান আসতে মানা করতো , “এতবার আসিস ক্যান?” লতার সহজ জবাব ছিল , “আমার ইচ্ছা হইছে , আসছি। তুই ন্যাংড়া মানুষ এতো ফচফচ করিস ক্যান! ওষুধ খাইছিস নাকি বল?” ফারহান চুপ মেরে যেত।
ফারহান এক মাস পর ভাল হয়ে যায়। একদিন ক্যাম্পাসে বসে আছে লতা, রাশেদ আর কিছু বন্ধু-বান্ধব । দূর থেকে ফারহান এসে বসলো। ওইদিন ফারহান একদম চুপচাপ। কেউ কিছু জিগ্যেস করলে , হু-হা বলে এড়িয়ে গেল। যখন সবাই চলে যাবে। তখন , ব্যাগ থেকে ফারহান র্যাপিং পেপারে মোড়া একটা ডায়রি লতার দিকে এগিয়ে দিল। বলল , “একটা ডায়রি আছে। আমার পক্ষ থেকে তোর জন্যে উপহার।” লতা হাসতে হাসতে জিনিসটা নিল। র্যা পিং খুলতে গেলে , ফারহান রীতিমত চিৎকার করে বলল, “এখনই খুলিস না , প্লিজ!” লতা দুষ্টুমি হাসি হেসে র্যাপিং খুলে ফেলল। ফারহান খোলা দেখে রীতিমত দৌড়ে পালাল। ডায়রি খুলতেই , একগাদা কাগজ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ডায়রির ভাজে ভাজে ছেঁড়া কাগজ। সবগুলি প্রেমপত্র। লতার কাছে লিখা ফারহানের প্রেমপত্র। আশেপাশে , আরও বন্ধু-বান্ধব ছিল। সবাই রীতিমত হৈ হৈ করে চিঠিগুলো নিয়ে টানাটানি করতে লাগলো। তিরিশটা চিঠি। সবগুলোই গত একমাসে ফারহান বেডে শুয়ে শুয়ে লিখেছে। লতা লজ্জায় পালাল , শুধু চিঠি থেকে গেল। সবাই গোল হয়ে মিলে , প্রেমপত্র পড়া শুরু করল। সেকি হাসাহাসি। এক একটা প্রেমপত্র শুরু হয় , সবাই মিলে শিষ দিতে থাকে। সেদিন সব বন্ধুবান্ধব হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছিল। গল্পের মত রোমান্টিক স্টাইলে ফারহানের প্রেম নিবেদন হয় নি। হয়েছে , এই অদ্ভুততম উপায়ে। একমাত্র রাশেদ সেদিন গম্ভীর হয়ে বসে বসে দেখছিল। মাঝে মাঝে সবাই হাসলে , নিজেও হাসি হাসি মুখ করার চেষ্টা করছিল। সেদিনের কথাগুলো , রাশেদের আজও স্পষ্ট মনে আছে।
ফারহান ছিল , রাশেদের জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু। ফারহানের জন্যে রাশেদ জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিতে পারে। আজ , ফারহান যে ছবিটা এঁকেছে , ফারহান ছাড়া একমাত্র সেইই জানে ছবির নারীটি লতা। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া লতা। হাতটা ফারহানের।
৩ –
ফারহান রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। পকেটে হাত দিল। মোটমাট বাইশ টাকা আছে। দশ টাকা বাসে চলে যাবে। দুটো সিগারেট কেনা যায়। টং এর দোকানগুলি থেকে দুটো সিগারেট কিনলো। বাস আসতে দেখে না ধরিয়েই বাসে উঠে পড়ল।
এপ্রিলের গরম। এই গরমের বিকেলে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। তবে , আজকে হচ্ছে। বাসের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখার মত অবস্থা নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ফার্মগেটের বাস। একটু যাত্রী বেশিই থাকে। বাস থেকে নেমে কোনমতে বৃষ্টি বাঁচিয়ে একটা দোকানের ছাউনির নিচে গিয়ে উঠলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেট বৃষ্টির পানিতে আধভেজা। তবুও ধরাল। বৃষ্টি যেভাবে এসেছিল , সেভাবেই চলে গেল না। অতিথি যদি আসে মানুষ খুশী হয় , যখন প্রত্যাশিত সময়ের বেশি সময় বসে থাকে তখন বিরক্ত হয়। লম্বা সময়ের বৃষ্টিও এমন। অতিথি যখন যাবেই না , তখন সে একাই রওয়ানা হল। পকেটে এক পয়সাও নেই। থাকলে সবার মত রিকশায়ই যেত। বাধ্য হয়েই , বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে রওয়ানা হল। ঝুম বৃষ্টি , এরকম বৃষ্টি ঢাকা শহর খুব কমই দেখেছে।
নিজের রুমে পৌঁছল ফারহান। এই রুমে রাশেদ আর ও থাকে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানিতে দাঁত কপাটি লেগে যাবার মত অবস্থা। কোনরকমে , জামা কাপড় খুলে পাজামা আর পাঞ্জাবিটা পড়ে শুয়ে পড়ল। ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকার ঘর , সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শরীর খুব খারাপ লাগছে। ফারহান বুঝতে পারল, আজকে কঠিন জ্বর আসবে। গা-হাত পা কাঁপছে , মাথার চিন্তাশক্তি ভোঁতা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে , পুরো পৃথিবী ঘুরছে। কোনমতে শুয়েই ঘুমিয়ে এলিয়ে পড়ল। বাইরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এমন বৃষ্টি যেটা দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয় – এই বৃষ্টি অনন্তকাল ধরে চলুক।
“ফারহান , ফারহান ...উঠে পড় , এতো ঘুমাচ্ছ কেন?”
“কে , কে ?”
খিলখিল করে হাসির শব্দ আসলো। বলল , “এখনো চিনলে না...”
“ও লতা , তোমার হাসি কি ভুলতে পারবো। কথা বলার আগে হাসলেই তো হত ...”
“তুমি তো বদলাও নি , একটুকুও। আমিও অবশ্য বদলাইনি , শুধু যা বদলাবার সময়টা বদলেছে।”
“ভালই বলেছ ... আচ্ছা তুমি এখন কোথায়?”
“কোথায় আবার , তোমার কাছেই তো আছি।”
“আমি ভাবিনি , তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। সত্যি , তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছো... বল না।”
“আরে বাহ ... যে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার কথা , তুমিই আবার আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে বসলে।”
“আমি ভাবিনি , তুমি এরকম করবে।”
ওপার থেকে নীরবতা।
“আচ্ছা , তুমি আমার কাছে এসে বস না।”
লতা এগিয়ে আসল। বিছানার পাশে বসল। ফারহান হাত এগিয়ে দিল। হাতে-হাত রাখল দুজন।
“আচ্ছা লতা , তুমি সুইসাইড না করলে কি পারতে না। ভালবাসা কি এতই ঠুনকো , যে বাস্তবে কাছে আসতে না পারলে ভালবাসার অর্থ নেই।”
“তুমি পুরুষ মানুষ। দার্শনিক বুলি আওড়াচ্ছ। সেসময়ের পরিস্থিতি আমাকে ওটা করতে বাধ্য করেছিল। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। ঐদিনই আমার বিয়ে ছিল। মেনে নিতে পারছিলাম না। সত্যিই , খুব কষ্ট হচ্ছিল।”
“জানো , এরপরের থেকে কোনদিন আমি ঘুমাতে পারিনি , প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি। শিউরে উঠেছি ঘুম থেকে। বিছানার পাশের পানির গ্লাস কাঁপা হাতে নিতে গিয়ে কত গ্লাস ভেঙ্গেছি , সে হিসেব নেই।”
“জানো , আমি কিন্তু বেঁচে গিয়েছি। শুধু তোমার কষ্টগুলো ছাড়া আমাকে আর কিছু কষ্ট দেয় না। আমি সময়ের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে গেছি। কিছুই আমাকে আর বাঁধা দেয় না।”
“তুমি হয়ত বেঁচে গিয়েছ। আমি বাঁচি নি। আমি দুঃস্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছি। আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারিনি। তুমি বলেছিলে , আমাদের পালিয়ে বিয়ে করতে। আমি বলেছিলাম , আমার ক্যারিয়ারের কথা। পরিবারের কথা। বলেছিলাম , যাও বিয়ে করে ফেল। শেষমেশ , ঐসব অযথা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়া দার্শনিক বুলি। সত্যি আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
“আমি কিন্তু নিজেকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমাকেও ... এই পৃথিবী আমার কাছে চিরদিন অর্থহীন ছিল। এখন , অর্থপূর্ণ হয়েছে। জানো , আমি আকাশে ভেসে বেড়াই , তোমাদের মাঝে ভেসে বেড়াই। কেউ আমাকে বাঁধা দেয় না। দেখে না , আমি ঠিকই দেখি। সবাই নিয়মমাফিক কাঁদছে , হাসছে , চিৎকার করছে...”
ফারহান চুপ করে থাকল , এখনো বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। লতা আবার বলল -
“আচ্ছা , মনে আছে সেদিনের কথা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কুয়াকাটা বেড়াতে গিয়েছিলাম , সবাই। সেদিন যখন সূর্যাস্ত দেখছিলাম , তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে। দুজন হাতে হাত না ধরলেও , তুমি আমাকে আঙুল দিয়ে সূর্যাস্তের দিকে হাত দিয়ে বলেছিলে , ঐ যে দেখো দিগন্ত , যেখানে সূর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে যদি , দুজন হারিয়ে যেতে পারতাম?”
“হ্যাঁ , আমি হেসে বলেছিলাম , ভালই তো হত। কোন সময় থাকতো না , সেখানে। পৃথিবীর কেউ জানত না , দেখত না। দুজন হারিয়ে যেতাম , অনন্তকালে।”
“সূর্য ডোবার সময় সবাই ক্যামেরার ক্লিকে হাত দিতে ব্যস্ত ছিল। শুধু , আমি আর তুমি সেদিন চোখ ভরে তাকিয়েছিলাম ঐদিকে। ক্যামেরার দরকার নেই , সেই ছবি আমার চোখে চিরতরে গেঁথেছিল। ছবি বললে ভুল হবে , আসলে সেই স্বপ্ন গেঁথেছিল চিরকাল।”
“আচ্ছা , জানো তোমার জন্যে আমি একটা ছবি এঁকেছিলাম। সেই দিনকে মনে করে , তুমি যেদিন হারিয়ে গিয়েছিলে ঐ দিগন্তে।”
“আরে বাহ , জানবো না। আমি তো তোমার পিছে বসে বসেই তোমাকে ছবি আঁকতে দেখেছি।”
“আচ্ছা , তুমি কি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছ ঐখানে। আমি ছবিটার নাম দিয়েছি , ছুঁয়ে দেখবো। কাকে ছুঁয়ে দেখবো জানো , তোমাকে।”
“সত্যিই আমাকে ছুঁয়ে দেখবে...”
“সত্যিই , বিশ্বাস করো সত্যিই।”
“এই যে তুমি তো আমার হাত ধরেই বসে আছো। আবার কি ছুঁয়ে দেখবে। ”
“আমি জানি জ্বরের ঘোরে অবচেতন মনে তোমাকে দেখছি। এটা অবাস্তব , মিথ্যে। আমি তোমাকে সত্যিকারের মত আবার ছুঁয়ে দেখতে চাই , ফিরে পেতে চাই। ”
“সত্যি যদি আমার কাছে আসতে চাও , তাহলে কিন্তু আমার পথেই যেতে হবে। ”
“তাহলে সেটাই করব।আমার কাছে অন্য পথ নেই , যা ছিল , সেসব অনেক আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে। ”
“তোমার ডেস্কে সিডাইল এর দুটো পাতা আছে না।”
“হ্যাঁ , আছে তো। তুমি তো আগে থেকেই জানতে আমার ইনসোমনিয়া আছে। সবসময়ই ওইটা থাকে। ”
“ দুই পাতা নাও , গ্লাসের পানিতে ডুবিয়ে গুলিয়ে ফেল। এরপর ... “
“ থাক , আর বলতে হবে না। বুঝেছি ... ”
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ডেস্ক থেকে ওষুধগুলো বের করলো। বের করে , পানিতে ফেলে দিল। কিছুক্ষণ সময় দিল গলে যাবার জন্যে। এরপর , গুলেই লতার চোখে চোখ রেখে কয়েক ঢোকে গিলে ফেলল।
“আচ্ছা , খুব ঘুম পাচ্ছে। বুঝেছ , মাথাটা হালকা হালকা লাগছে।”
“আমারও এরকম হয়েছে , এখন ঘুমিয়ে পড়। ঘুম থেকে উঠে দেখবে , তুমি আমাকে ছুঁয়ে আছো। তুমি আমি সেই সূর্যের দিগন্তের মাঝে হারিয়ে গিয়েছি। কেউ খুঁজে পাবে না , কেউ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টাটাও করবে না , দেখো।”
ফারহানের চোখ জ্বলজ্বল করছে। কথা বলার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। থাক, আর কথা বলে কি হবে? কথা বলার জন্যে তো, সামনে অনন্তকাল অপেক্ষা করছে। লতা, ফারহানের হাত ধরে বসে আছে। ঘর অন্ধকার, বৃষ্টিও অনেক আগে থেমে গিয়েছে। চারদিক কেমন যেন নিস্তব্ধ ছিল , সব আরো বেশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রাত গভীর ছিল , রাত আরো গভীর হল।