জব্বার স্যার

শিক্ষা / শিক্ষক (নভেম্বর ২০১৫)

মুহাম্মাদ হেমায়েত হাসান
সকালের আলোটা চোখে এসে লাগছে। কিন্তু আজ মনে হয় জব্বার স্যার বিছানা থেকে উঠতে পারবেন না। সারা শরীল জুড়ে ব্যাথা। মনে হয় জ্বর এসেছে। এই বয়সে এতোটা পরিশ্রম সহ্য করতে পারছেনা বৃদ্ধ শরীলে। অষ্টম শ্রণীর ১ম ক্লাসটা তার। গত ২০ বছর শিক্ষকতার জীবনে তিনি একদিনও স্কুল বন্ধ করেন নাই। একবার বন্যা হল, সারা গ্রাম প্রায় পানির নিচে, তিনি স্কুলে উপস্থিত হয়ে দেখেন ক্লাসরুমে কয়েক জন ছেলে মাছ ধরছে। তিনি যেতেই তারা অবাক। একজন বলে উঠে স্যার আপনে কি আইজো কেলাস নিবেন? জব্বার স্যারের বড় কষ্ট হয়, এলজ্যাব্রাটা ওরা এখনো বেঝেনা। ক্লাসটা নেয়া দরকার ছিল। কিন্তু হাই বেঞ্চটাও পানির নিচে দেখা যায়। সেটা ভেসে থাকলে না হয় ক্লাসটা নিয়ে নেয়া যেত। এখন সে উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই তাকে বলতে হল, না আজ থাক। আর কী ছেলেরা ক্ষণ বিলম্ব না করে আবার মাছ ধরায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।

আর একদিন বৈশাখ মাস জব্বার স্যার দেরী হয়ে গেছে দেখে খুব দ্রুত স্কুলের দিকে যাচ্ছেন। মাঝ রাস্তাতে শুরু হল কালবৈশাখী। তার মধ্যেও তিনি বহু কষ্টে স্কুলে পৌছালেন। হনতো-দনতো হয়ে ক্লাসে ডুকে দেখেন এক পাশের চালা উড়ে গেছে। সেদিনও তিনি মনে খুব কষ্ট পেলেন।

আজ তার শরীলের যে অবস্থাই হোক তাতে তার কোনো চিন্তা নাই। চিন্তা শুধু এ্যলজ্যাব্রাটা নিয়ে। তার ক্লাসটার আজ কি হবে? একইতো গণিতের ক্লাস তার উপর ১ম প্রিওড। কাউকে যে বলে পাঠাবেন তাঁরও কোনো উপায় নাই। তিনি একাই থাকেন। দু’বেলা কিছু ছেলেপুলে পড়তে আসে। তবে তিনি যে শখ করে বা টাকার জন্য পড়ান তা নয়। এক রকম জোর করেই তারা আসে। টাকা পয়সা যে খুব একটা দেয় তাও না। যাই দেয় তাতেও তিনি লজ্জা পান। কারণ বিষয় টাতো তাঁর, তিনি হয়তো ক্লাসে ঠিক ভাবে পড়াতে পারছেন না। তাই তাঁর লজ্জা। তবু পড়ান একা মানুষ সময়টা কেটে যায়। স্কুলের পিওন হরিহরণটা মাঝে মাঝেই এমুখো হয়। তবে জব্বার স্যার তাঁর আগেই স্কুলে চলে যান বলে দেখাটা কদাচিৎ হয় আরকি। কখনো কখনো স্কুলের তালাটাও তিনিই খুলেন। হরিহরণের কৃপাতে মাঝে মাঝে স্কুলের বেল টাও তাকেই বাজাটে হয়। অবশ্য স্কুলের যে কোন কাজ তিনি খুশি মনেই করেন। আজ বেটা হরণটারও দেখা নাই। শরীলটা বড্ড হাচর পাচর করছে। আসুখেরো কোনো সময় জ্ঞান নেই দেখছি, স্কুল ছুটির পর আসতো তা না বেটা অবেলায় এসে বসে আছে।
ব্যাটাতো আর এ্যলজ্যাব্রাটা শিখে নাই। খগেন ডাক্তার কে একটু খবর দিতে পারলেও হত। দু’ফোঁটা হোমিওপ্যাথ মুখে ঢেলে দিলেই তিনি একেবারে তরতর করে সুস্থ হয়ে উঠতেন। খগেনের বেজায় হাতযশ। এ তল্লাটে তারা তিন জনই পুরাতন লোক। তিনি, খগেন আর হরিহরণ টা। হরণ টা আবশ্য একটু বেশি বুড়িয়ে গেছে। ভাল আছে খগেন। ব্যাটা কি খায় কে জানে। গ্রামের লোকের তাঁর উপর অনেক বিশ্বাস। স্রষ্টার পর মনে করে তাঁর ঔষধে যদি কিছু হয়।

আবার শরীরের ভিতর নাড়াদেয়। মাথা ঝিমঝিম করে। ওরে হরণ বাপ কই তুই? একটু যদি আসতি। একটু যদি ধরে ক্লাসে নিয়ে যেতি? তাহলেই আমি সুস্থ হয়ে যেতাম। স্কুলের ক্লাসরুমে ব্লাক বোড এর সামনে নিয়ে দাঁড় করালেই জব্বার স্যার সুস্থ হয়ে যান। এলজ্যাব্রার সূত্রগুলো তার জন্য যেন টনিক এর মত কাজ করে। একবার কি হল, তাঁর প্রচন্ড পেটে ব্যাথা শুরু হল। কয়েক জন মিলে ধরে তাকে অফিস রূমের টেবিলের উপর শুইয়ে দিল। খগেন ডাক্তার এসে নাড়ি টিপেটুপে বললেন, বায়ুরা বেগতিক উঠানামা করছে। নিয়মটাতো বুঝো শুধু অংকের। আর বাকি সব নিয়ম কানুন তো জলে। দেখি কি করা যায়। বলে খগেন তাঁর কাঠের বক্সটা খুলে কি একটা ঔষধ বের করে বার কয়েক ঝাকিয়ে মুখের মধ্যে দিলেন দু’ফোটা। বাস আর কি জব্বার স্যারের ব্যাথা যেন মুহুরতেই দুই গুন বেড়ে গেল। খগেন ডাক্তারও বেজায় ভরকে গেলেন। এমনতো হবার কথা নয়। দু’মিনিটেই কাজ হবার কথা। তিনি বার বার ঘড়ি দেখতে লাগলেন। খগেন ডাক্তারের ঘড়ি দেখা দেখে হরিহরণের খেয়াল হল, সময় তো পেরিয়ে গেছে ঘন্টা দেয়া হয় নাই। সে দ্রুত গিয়ে দিলো ঘন্টাটা বাজিয়ে। তাতেই কাজ একটা হল। জব্বার স্যারতো বেল শুনেই হাসপাস করতে লাগলেন। কোন রকম টেনেটুনে টেবিল থেকে নেমে দিলেন ছুট। সবাই তাঁর পিছু পিছু ছুট। ছেলেপুলেরা সবাই দাঁড়িয়ে যায় সে বসতে বলে ব্লাক বোডে লিখেন, ১ম ঘন্টা, বিষয়-গণিত। তাঁরপর আর কি? সবাই দিরঘ শ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন। খগেন ডাক্তারকে বলতে শুনা গেল, ওর বায়ুটা পেটে না মাথায় চড়েছিল।

জব্বার স্যার শুয়ে শুয়ে চেচাতে লাগলো, ওরে কেউ একটু ধরে আমাকে স্কুলে নিয়ে যা। গণিতের ক্লাসটারে। এ্যলজ্যাব্রার সূত্র গুলো ছেলেপুলে এখন শিক্ষতে পারে নাই। কেউ কি নাইরে? হঠাৎ ঘরের উত্তর দিক হতে কিসের যেন শব্দ শুনা যায়। জব্বার স্যারের মনে মধ্য আশার আলো জ্বলতে থাকে। সে চিৎকার করে উঠে, কে রে ঐখানে? কে? কিন্তু তাঁর গলাদিয়ে চি চি শব্দ বেরুতে থাকে। তবু তিনি চ্যাচাতে থাকেন। কেরে ঐখানে একটু এদিকে আয়। ধীরে ধীরে তাঁর দরজাতে কার যেন ছায়া দেখা যায়। তাঁর ডাক শুনে হোক আর দরজা খোলা দেখে হোক, কেউ একজন এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘরে প্রবেশ করে বার তের বছরের একটি ছেলে। দুই হাত দিয়ে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে। জব্বার স্যার প্রশ্ন করে কে রে হতোচ্ছারা তুই? সে কখন থেকে ডাকছি।
ছেলেটি জবাব দেয়, স্যার আমি মন্নান। জব্বার স্যারের মনে হয়, এতোটুকু ছেলের নাম মন্নান হয় কি করে? সে আবার জিগাস করে কোন মন্নান রে তুই? স্যার আমি ক্লাস এইটের মন্নান। এবার স্যার চিনতে পারে। এমনিতে তিনি সবাইকে চিনেন। কিন্তু আজ অসুস্থ থাকার কারনে মনে হয় এমন হচ্ছে। সে মন্নান কে বলে, এবার বলতো গণিতে কত পেয়েছিলে?
ছেলেটি সরল মনে বলে, স্যার কিছু পাই নাই।
উত্তর শুনে তো স্যার অবাক। পাই নাই মানে কি?
ছেলেটি আবার সরল মনে বলে, মানে স্যার আপনে কিছু দেন নাই।
দেই নাই মানে?
স্যার আমি তো মেলা কিছু লিখছিলাম। কিন্তু স্যার আপনে কোন নম্বর দেন নাই।
আরে হারামজাদা বল, ডিম পাইছস।
জ্বি স্যার আপনে খাতা দেওনের সময়ও তাই কইছিলেন- নে একটা ডিম পাইছস। কিন্তু স্যার আমি খাতা উল্টাই পাল্টাই দেখলাম কিছুই পাই নাই।
জব্বার স্যার কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ চুপকরে থেকে বলেন তোর হাতে কি?
মন্নান সরল মনে উত্তর দেয় কোকিলের ডিম।
কিসের ডিম?
স্যার কোকিলের ডিম। কাকের বাসা থাইকা আনছি।
তুই কেমনে জানলি এইডা কাকের না কোকিলের ডিম?
স্যার আমি দেখছি। একটা কোকিল কাকের বাসা থাইকা ডিম গুলোন নিচে ফালাই দিছে। হেরপর ডিম পাইরা রাইখা গেছে।
জব্বার স্যার আর কিছু বলেননা। মনে মনে বলেন এতোকিছু বুঝিস খালি এ্যলজ্যাব্রাটা বুঝিসনা। হঠাৎ তার খেয়াল হয় মন্নান ক্লাসে না গিয়ে কাকের বাসা থেকে কোকিলের ডিম চুরি করছে। সে অমনি হুংকার ছারে, কিরে তুই আইজ ক্লাসে জাসনাই কেন? আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
মন্নান একটুও ভয় পায়না। জব্বার স্যার আসুস্থ হওয়াতে মনে হয় এমন হইছে। গলায় জোর নাই।
স্যার আবার বলে তুই ক্লাস ফালাইয়া এইখানে কেন?
মন্নান বলে, ও স্যার আইজতো স্কুল বন্ধ। আইজ তো শুক্রবার। স্যার আপনের কি হইছে? শইল খারাপ? খগেন ডাক্তারে খবর দিমু?
জব্বার স্যারের শরীর আস্তে আস্তে মনে হয় ভাল হতে থাকে। আজ শুক্রবার। জব্বার স্যার বিড়বিড় করেন। আজ শুক্রবার।
মন্নান বলে, স্যার কিছু কইলেন?
না। তুই ঠিক কইছস তো আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ?
জ্বে স্যার।তাইলে আমি যাই।
যা।
জব্বার স্যার আস্তে আস্তে শান্ত মনে ঘুমিয়ে পরেন। আর কোন চিন্তা নেই আজ শুক্রবার স্কুল বন্ধ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।
রেজওয়ানা আলী তনিমা খুব সুন্দর সরল প্রকাশ হয়েছে , শুভেচ্ছা রইলো
দেবজ্যোতিকাজল শরীল হবেনা শরীর হবে । ভাল হয়েছে
এস আই গগণ ভাল লিখেছেন, শুভ কামনা আর ভোট রইলো। পাতায় আমন্ত্রণ।

১৯ জানুয়ারী - ২০১৫ গল্প/কবিতা: ১১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“মে ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ মে, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী