হিমেল রেডি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্য যেই রুম থেকে বের হবে, অমনি নরম তুলতুলে দুটি হাত পিছন থেকে তাঁর বুককে পেঁছিয়ে ধরল। হিমেলের এই পরশটি খুব ভাল লাগছে কিন্তু অফিসে যেতে হবে তাই পিছনে ফিরে শরমীকে একটু জড়িয়ে ধরে বলল- লক্ষি বউ আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে, প্লিজ রাগ করো না।
হিমেল আর শরমীর বিয়ে হয়েছে প্রায় দু’মাস। হিমেলের চাকুরীর বয়সও কাঁচা, মাত্র এক বছর হলো। তাই ঘনঘন ছুটিও নিতে পারছে না বলে তাঁদের হানিমুনটাও করা হচ্ছে না। শরমী আর হিমেলের বিয়েটা পরিবারের পছন্দের বিয়ে। শরমী তাঁর পরিবারের একমাত্র আঁদরের মেয়ে। আঁদরের মেয়েদের চাল-চলনটাও থাকে সৌখিনতায় ভরা। বছরের যে কোন উৎসব প্রবণে, ওই উৎসবের সাঝে ম্যাচিং করে সাঝতে ভালোবাসে। বৈশাখিতে বৈশাখী সাঝ, বসন্তে বসন্তের সাঝ। হিমেল ঠিক তাঁর উল্টো, সে সাদাসিদে ভাবে চলতে ভালোবাসে। কম কথা বলে, হৈ হুলোড় তেমন একটা পছন্দ করে না। সাদাসিদে হলেও বউয়ের সাথে রোমান্টিকতায় কমতি রাখার চেষ্টা করে না। হিমেল বুঝতে পারছে শরমীর আজ কিছু বলার আছে, কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না। তাই নিজ থেকে এগিয়ে, আমাল লক্ষি বউ কি আমায় কিছু বলবে?
না, কি বলব?
মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চাচ্ছ।
হু... বলতে তো চাই, বললে রাগ করবে নাতো।
রাগ করবো কেন?
সামনে তো বসন্ত কাল, আমাকে একটি বাসন্তী রং’এর শাড়ী কিনে দিবে।
হিমলের হাঁসিটি কিছুটা মলিন হয়ে আসলেও বউ’র মনে কষ্ট না দেয়ার জন্য বলল- এতে রাগ করার কি আছে! আমি অফিস থেকে ফিরতে কিনে আনবো।
শরমীর শাশুড়ী মহিলা ভাল হলেও এ’সব বৈশাখ, বসন্ত উদযাপন একেবারে পছন্দ করে না। আর এ’কারনে হিমেল সব সময় একটু গুটিয়ে চলার চেষ্টা করে।
যথারিতী সন্ধ্যায় হিমেল অফিস থেকে আসার পর শরমী কেমন জানি অভিমানী হয়ে আছে। প্রয়োজনের বাইরে হিমেলের সাথে কোন কথাই বলছে না। হিমেল শাড়ীর কথা বেমালুম ভুলে গেছে, সে বুঝতেও পারছে না কি কারনে শরমীর এ’অভিমান। শরমীকে চোখের ইশরায় তাঁদের রুমে ডেকে নিয়ে যেই জড়িয়ে ধরতে যাবে, শরমী দু’হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করলো।
বুঝলাম, তুমি আমার সাথে রাগ করেছ! কিন্তু আমার অপরাধটা বলতে হবে না।
শরমী তাঁর মুখটি অন্য দিকে ফিরিয়ে খাটের এক কোনায় বসে আছে।
হিমেল শরমীর মুখের দু’পাশে তাঁর হাঁত দু’টি দিয়ে, প্লিজ লক্ষি সোনা আমার! তুমি যদি আমার সাথে এমন কর, কষ্ট পায় না বুঝি।
শরমী তাঁর অভিমানটি আর বেশিক্ষন চুপসে রাখতে পারলো না- তুমি কথা দিয়েছিলে, অফিস থেকে আসার সময় আমার জন্য বাসন্তী রং’এর শাড়ী নিয়ে আসবে।
ওহ.. এই জন্য বউ আমার রাগ করছে, আচ্ছা টিক আছে কাল আর ভুল হবে না।
না, আর আনতে হবে না। আনলেও আমি আর পরবো না।
দেখ, আমি চাইলে আজকে আনতে পারতাম! কিন্তু মা এসব একেবারে পছন্দ করে না।
কেন? মা পছন্দ করবে না কেন? আমি তো ঘরে পরবো।
শুনেছি মাও এক সময় এগুলো পছন্দ করতো, কিন্তু এখন একেবারে পছন্দ করে না।
কেন পছন্দ করে না?
আমি পুরোপুরি জানি না, তবে আমার এক ফুফুকে নিয়ে বসন্ত কাল নিয়ে কি কি সমস্যা হয়েছিল, সে জন্য।
ওটার সাথে আমার বাসন্তী রংয়ের শাড়ীর সম্পক কি?
জানি না, তুমিবরং মা’কে বলে দেখ! মা যদি রাজি হয় তাহলে তোমাকে বসন্তের প্রথম দিনে কোথাও বেড়াতে যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি মা’কে বলে দেখব।
(দুই)
বসন্ত কাল যত ঘনিয়ে আসছে, শরমী তত তার শাড়ীর আরো কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে। আগে যেখানে প্রয়োজনের বাইরে কথাই বলতো না এখন সেখানে নানা ধরনের গল্প-গুজব করে, কখনো তাঁর বাপের বাড়ির কথা, কখনো জানতে চায় শাশুরীর বিয়ের প্রথম দিকের কথা। এ সবের একটাই উদ্দেশ্য- বসন্তের প্রথম দিনে বাসন্তী শাড়ী পরে হিমেলের সাথে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি নেয়া। কিন্তু সাহস করে বলতেও কিছু পারছে না।
একদিন আলাপছলে বলেই ফেলল- জানেন মা, গত বছর বসন্তের প্রথম দিনে আমাদের কলজে কি সুন্দর অনুষ্ঠান হয়েছিল। আমি বাসন্তী রং’য়ের শাড়ী পরে গিয়েছিলাম।
শরমী খেয়াল করলো, শাশুরী তাঁর কথায় কান না দিয়ে নিজের মত করে হাতের কাজটি করে যাচছে। সেও নাছোড় বান্দার মত, শাশুরীর সামনে বসন্তের নানা আলাপ-আলোচনা করেই যাচছে। শাশুরী এবার শরমীর দিকে তাঁকিয়ে বলল- বউ মা! আমি এসব পছন্দ করি না। বৈশাখ, বাসন্তী এসব এই ঘরে হবে না।
শরমী একটু ভয় পেয়ে- ঠিক আছে মা! এ ঘরে এসব হবে না। কিন্তু আমি শুনেছি আপনি এগুলো আগে পছন্দ করতেন, তাহলে এখন পছন্দ করেন না কেন?
এখন আমার ভাল লাগে না তাই! আর এসব এ ঘরের জন্য সুন্দর না।
বাবা-মা’র একমাত্র মেয়ে হওয়াতে জিদটাও ভীষন শরমীর- কেন ভাল লাগে না মা।
শোন তাহলে, কেন ভালো লাগে না আমার।
সে অনেক বছর আগে, আমার একমাত্র ননদ সুমী তখন কলেজে পড়ত। দেখতে ঠিক তোমার মত সুন্দর ও ছটপটে। সারাক্ষন পুরো ঘর মাতিয়ে রাখতো হাঁসি গল্প করে। সেও তোমার মত বৈশাখ, বসন্তে নানা ধরনের সাঝ সজ্জা করতে ভালোবাসতো। প্রতি বসন্তে সামনের নদির পাড়ে যে শিমুল গাছটি আছে সেখানে গিয়ে তাঁর মনের মানুষের সাথে দেখা করত। তাঁর মনের মানুষটি আমাদের গ্রামে থাকতো সরকারী ডাক পোষ্ট মাষ্টার এর চাকুরীর সুবাধে। সুমীর কলেজে যাওয়ার পথে ডাকঘরটি হওয়ায় প্রতিদিন দেখা দেখিতে একজন অন্যজনকে কখন যে মন দেয়া নেয়া হয়ে উঠে কেউ বুঝতে পারেনি।
তাঁদের প্রেম ভালোবাসা চলতে থাকে, আমরা একটু আধটু জানতে পারলেও বাঁধা দেইনি। ছেলে সরকারী চাকুরী করে, দেখতে শুনতেও ভাল। তাঁদের প্রেম ভালবাসার কথা পুরা গ্রামের লোকে জানত। বসন্তের আসার আগে সুমী, কয়েকটি বাসন্তী রং’য়ের শাড়ী, শাড়ীর সাথে মিল করে চুঁড়ি, গয়না কিনে রাখতো।
কেনা পর পাগলীটা এক একটা পরে আমাকে দেখিয়ে বলত- কেমন দেখাচ্ছে ভাবী।
আমি হাঁসতাম আর বলতাম- তোকে দেঁখে তো সে পাগল হয়ে যাবে রে!
আমার কথা শুনে সুমী কি যে লজ্জা পেত!
বসন্তের প্রথম দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, বাসন্তী রং’য়ের শাড়ী পরে, চুড়ি পরে, মাথায় শাড়ীর সাথে ম্যাচ করে ফিতা বেঁধে নদির পাড়ে শিমুল গাছের তলায় অপেক্ষারত মনের মানুষের সাথে দেখা করার ছুটে যেত।
যখন তাঁরা দু’জন শিমুল গাছের নিচে দেখা করত। গাছে বসা কোকিল কুহু কুহু ডাকে গান করত, নদির জোয়ারের পানিতে শিমুল ফুল ভেসে বেড়াত, বাতাস সুরে সুরে দোলত তাঁদের আশেপাশে। সে কি প্রেম!
শরমী মুখ হাঁ করে তাঁর শাশুরীর কথা শুনে উৎসাহ আরো বেড়ে গেল, তাঁরপর কি হয়েছে মা।
কি আর হবে! ছেলেটার চাকুরী বদলি হল অন্য জেলায়। যে দিন বদলি হয়ে চলে যাবে সেদিন ছিল বসন্তের প্রথম দিন। এই প্রথম বসন্তের প্রথম দিন সুমীকে কাঁদতে দেখলাম, সে কি কান্না। সুমী প্রতি বসন্তের মত এই দিনও বাসন্তী রং’য়ের শাড়ী, চুঁড়ি আর মাথায় ফিতা দিয়ে শেষবারের মত তাঁর মনের মানুষের সাথে দেখা করতে গেল নদির পাড়ে শিমুল গাছের তলায়।
ওই দিন কোকিল কুহু কুহু করে ডাকেনি, নদিতে জোয়ারও ছিল না, শিমুল ফুলও ঝরেনি, বাতাসের কোন সুর আসেনি। সুমীকে ছেলেটি কথা দিয়েছিল, সে কয়েকদিন পর তাঁর বাবা-মা’কে নিয়ে এসে সুমীকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
শরমী- মা, তাঁদের বিয়ে হয়নি?
না হয়নি! ছেলেটি আসবে বলে সেই যে গেল আর আসলো না।
শরমী- সুমী আন্টি কি আর বিয়ে করেনি!
না করেনি! আমরা অনেক চেষ্টা করেছি তাঁকে অন্য খানে বিয়ে দিতে। সে রাজী হত না। সারা বছর ঘরে বসে বসে কাঁদত, যখনই বসন্তের প্রথম দিন আসতো তখনই বাসন্তী রং’য়ের শাড়ী, চুঁড়ি আর চুলে ফিতা দিয়ে নদির পাড়ে শিমুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদত তাঁর মনের মানুষ ফিরে এসে তাঁকে নিয়ে যাবে এই আশায়।
শরমী- উনি এখন কোথায়?
এইতো কয়েক বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অনাহারে, অনিদ্রায় তাঁর দেহে ননা রোগ বাসা বাঁধে, এই রোগ আর তাঁর মনের মানুষের শোকে তাঁকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হলো মনের মানুষকে একটু করে না দেখার অতৃপ্তি নিয়ে।
শরমী বড় কটি নিঃশ্বাস নিয়ে শাশুরীকে বলল- মা আমার বাসন্তী শাড়ী লাগবে না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আমি না জেনে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
লাগবে না কেন? আমি খোকাকে বলব তোমার জন্য একটি বাসন্তী রং’য়ের শাড়ী নিয়ে আসতে। যে ভালোবাসার পূণর্তা সুমী করতে পারেনি এই ঘরে, তুমি তা পূণ করে দিতে পারবে তো মা!