এক
‘এই, তুই আমার প্লেট নিয়েছিস। রাখ্ বললাম।’
‘রাখবো না যা, কী করবি তুই?’
‘তোর নিজের প্লেট নাই? ফকির। মানুষের প্লেটে খেতে হয়...।‘
এই, আবার শুরু হয়ে গেল। দুজনের কখনোই হয় না। কিছু না কিছু নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা লেগে আছে। যতক্ষণ বাসায় থাকেন, এই দুজনের ঝগড়া মেটাতেই ব্যস্ত থাকতে হয় মিনারা জামানকে। আজ আর কিছু বলতে গেলেন না। করুগ গে যা খুশি। এত বড় হয়ে গেছে দুইটা। কোথায় মাকে একটু সাহায্য করবে, একটু সংগ দেবে মাকে তা না, এই বয়সে মাকে গিয়ে তাদের ঝামেলা মেটাতে হয়।
‘মা, দেখো না। ও মা, দেখো না আমার প্লেটে খেতে বসেছে। তুমি কিছু বলছো না কেন?’
‘শিমু, চুপ কর। যথেষ্ট বড় হয়েছ তুমি। এই বয়সের মেয়েরা মায়েদের কত সাহায্য করে জান তুমি? সারাদিন বাসায় থাকি না। রাতের খাওয়ার সময়টা অন্ততঃ তোমরা একটু চুপ থাকো।’
মার মেজাজের উত্তাপ টের পেল শিমু। আর একটা কথাও বাড়ায় না সে। সুমন তো পারলে কোনমতে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে। আসলে দুই ভাই-বোনই মাকে বেশ ভয় পায়। মা এমনিতে তেমন কিছু বলে না, কিন্ত মায়ের গাম্ভীর্যকে দুজনেই তোয়াজ করে চলে।
‘মা, শরীর খারাপ তোমার?’ সুমন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘না, আমি ঠিক আছি।’
উঠে পড়ে্ন মিনারা জামান। তেমন কিছুই খেলেন না তিনি। শরীর ঠিক আছে তার। কিন্তু মনটা ঠিক নেই। কেন তা জানা নেই। এভাবেই তো চলছে এতগুলো বছর। মনকে তো ভালভাবেই বশ করেছেন। অকারণে মন খারাপ তো তার ধাতে নেই!
...কিন্তু তিনিও তো মানুষ! জীবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। গোধুলি বেলার ক্রান্তিলগ্নে এসে তারও তো ইচ্ছে করে নির্ভার হতে; পরম নিশ্চিন্তে পাশের মানুষটির হাত ধরে অসীমের কথা ভাবতে। তারও তো মন খারাপ করতে পারে!
পরদিন অনেকটা ভোরে উঠে পড়লেন। ছেলে-মেয়ে দুটিকে বেশ বকা দিয়েছেন কাল রাতে। মনটা কেমন করে উঠলো। সুমনের ঘরে গিয়ে দেখেন, বিছানাতে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা। সুমন আগের চেয়ে আরো এলোমেলো হয়েছে। সারাদিন বাসায় থাকেন না। রুমটাও গুছিয়ে দেবার কেউ নেই। শিমুটাকে বলে লাভ নেই। মেয়েটা তার মোটেও সংসারী হয় নি। পরের বাড়ি গিয়ে কী করবে কে জানে!
ব্যস্ত হাতে ঘর গোছানোয় লেগে পড়লেন তিনি। ঘরভর্তি ছেঁড়া কাগজ। ছেলে ইদানীং কবিতা লেখার চেষ্টা চালাচ্ছে। এটা নিয়ে শিমু মাঝে মাঝে টিপ্পনি কাটে,
‘ ভাবের রাজ্যে পৃথিবী ব্যাড়াছ্যাড়াময়...কবিতা তোমায় আজ দিলাম আড়ি, পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে যাবো মামাবাড়ী...।’
হাসেন মনে মনে। ছেলেমেয়ে দুটি যেন এমনই থাকে। কী কাজ বড় হয়ে?
শিমু, সুমন বিছানা ছাড়ার আগেই মিনারা জামানের আলুর পরোটা তৈরী। ভাই-বোন খুশীতে বাকবাকুম। গপগপ করে সুমন একাই পাঁচটা সাবাড় করে দিল।
‘ঐ ভাইয়া আস্তে খা না। আমাকেও তো খেতে দিবি নাকি?’
‘কে আটকাইছে তোরে? তোর খাওয়া তুই খা।’
‘সুমন, আজ ভার্সিটি যাওয়ার পথে একটু মোড়ের ফার্মেসী হয়ে যাস না, বাবা। পাঁচশটা টাকা পাবে। ফার্মেসী খুলতে খুলতে দশটা বেজে যায়। নইলে আমিই দিয়ে যেতাম। আর...শিমু, কলেজ থেকে সোজা বাসায় চলে আসবা। বান্ধবীদের সাথে আড্ডাটা একটু কম হলেই ভাল।’
তাড়াহুড়ো করে গোসল সেরে অফিসের জন্য তৈরী হতে হতেই কলিং বেলটা বেজে উঠল।
পোস্টম্যান! কী ব্যাপার? এখনো কেউ চিঠি লেখে নাকি? সুমন আর শিমু দুজনেই উলটে পালটে দেখে মার হাতে দিল। চিঠিটা মিনারা জামানের নামে।
ব্যস্তভাবে, কিছুটা বিস্ময়ের সাথে চিঠিটা পড়তে লাগলেন মিনারা জামান।
পড়তে পড়তে দুলে উঠল মাটি। ঘুরে গেল মাথাটা। জ্ঞান হারালেন তিনি।
দুই
‘বুঝেছো মিনু, ছাত্র-ছাত্রীদের মুগ্ধ করতে চাইলে কীট্স, এলিয়ট নখদর্পণে রাখা চাই। জায়গামত আউড়ে দিলেই চলবে।‘
‘তুমিও তাই কর নাকি?’ মিনু, মানে মিনারা জামান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন স্বামীকে।
‘তা মাঝে মাঝে করতে হয় বৈকি।’
‘দেখো আবার, মুগ্ধতার জালে যেন পটাপট ছাত্রীরা আটকা না পড়ে।’
ভার্সিটির ইংরেজী সাহিত্যের সুদর্শন অধ্যাপক রাকিব হাসানের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।
‘I'll put your basket all safe in a nook,
Your shawl I'll hang up on this willow,
And we will sigh in the daisy's eye,
And kiss on a grass-green pillow.’
‘তোমার কীট্স তোমার ছাত্রীদের জন্যই তোলা থাক। ভুল জায়গায় অপব্যয় করছো কেন?’
সুখের হাওয়ায় পাল তোলা সংসার নামক নৌকোটিতে তখনো তার দুজন মাত্র সওয়ার। কবিতা, গান, নিত্য নতুন রান্নার এক্সপেরিমেণ্ট...জীবনের রঙগুলো একটু একটু করে তখন কেবল রংধনুর সাতটি রং খুঁজে ফিরছে। ভার্সিটি থেকে চটজলদি ফিরে আসা, নতুন আবেগের জোয়ারে ভেসে চলা। কী সুন্দর ছিল দিনগুলি!
মিনারা জামানও পাস করেছেন একই ডিপার্টমেণ্ট থেকে। রেজাল্টও মন্দ না। বিসিএস দিয়ে সরকারী চাকুরীতে ঢুকে পড়েন। একে অপরকে পছন্দটা নিজেরা করলেও বাড়ির সম্মতিতেই বিয়ে করেছেন তারা। ভার্সিটিতে রাকিব ছিল মিনারার তিন বছরের বড়। নোট দেওয়া নেওয়ার সূত্রে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে যায় এক ফাঁকে। সংসারের গাঁটছড়া বেঁধে থিতু হতে হতেই জীবনের পট পরিবর্তন হতে থাকে। একে একে আসে সুমন, শিমু। দায়িত্বের বেড়াজালে আটকে যেতে থাকে জীবনের খোলা জানালা।
রাকিব ডিপার্টমেণ্টের ভীষণ জনপ্রিয় শিক্ষক। যেমন অসাধারণ পড়ায় তেমনি দুর্দান্ত হ্যাণ্ডস্যাম দেখতে রাকিব। ভার্সিটির অনেক মেয়েরই গোপন ক্র্যাশ ইংরেজীর অধ্যাপক রাকিব হাসান। প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি উচ্চতা, মেদহীন পিটানো শরীর। আকর্ষণীয় চেহারা এবং সেই সাথে পৌরুষদীপ্ত ঝলসানো ব্যাক্তিত্ব। রাকিবের পাশে মিনারা কেও ভালোই মানিয়ে যায়। চোখটানা দুর্দান্ত রূপসী না হলেও মিনারার সৌন্দর্যে আছে অপরূপ স্নিগ্ধতা। কিন্তু সৌন্দর্য নয়, রাকিব কে আকর্ষণ করেছিল মিনারার প্রখর চাপা ব্যাক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে ঠোঁটকাটা ক’জন বান্ধবী এ নিয়ে রাকিবকে কিছু কম কথা শোনায়নি। কিন্তু ঐ যে, যার নয়নে যারে লাগে ভাল।
শিক্ষক রাকিবকে নিয়েও কৌতুহলের শেষ নেই ছাত্রীদের মাঝে। কারণে অকারণে অনেকেই পড়া বোঝার নাম করে রাকিব স্যারের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। রাকিব সবই বোঝে; খুব যে মন্দ লাগে তা বলতে পারে না। এই অতি উৎসাহী ছাত্রীদেরই একজন, মেহনাজ। ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ুয়া নাকে মুখে ইংরেজীর তুবড়ি ছোটানো, চলনে বলনে তুখোড় স্মার্ট এক অতি আধুনিকা ললনা। প্রথম দিন থেকেই তার তূণে তীর গুঁজে নেয়। ঠিকঠাক নিশানায় ছুঁড়ে মারার জন্য।
এদিকে দুই বাচ্চা, সংসার আর চাকরি সামলিয়ে প্রাণ আইঢাঁই করে ওঠে মিনারার। বার বার ছুটি নিতে নিতে কর্মক্ষেত্রেও লালকালির দাগ লেগে যায়। মাঝে মাঝে দেশের বাড়ি থেকে মাকে এনে রাখে। কিন্তু মার তো বয়স হয়েছে, তাছাড়া বাবাকেই বা কে দেখবে!
দিনে দিনে মলিনতা এসে যায় চেহারায়। এত ঝামেলার মাঝে আর নিজের দিকে তাকানোর সময় কই? অফিস থেকে এসেই চটজলদি রান্নাঘরে ঢুকে পড়া। বাচ্চাদুটোও সারাদিন মাকে কাছে না পেয়ে লাটিমের মত চারপাশে ঘুরতে থাকে। দিন দিন রাকিবও ইউনিভার্সিটির কাজে আরো বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে। আগের মত হুটহাট আর চলে আসে না। আগে মাঝে মাঝে মিনারা কে অফিস থেকে তুলে নিয়ে সবাই মিলে কোন রেস্টুরেণ্টে চলে যেত, কিংবা লং ড্রাইভে শহর থেকে একটু দূরে। এইসব ছোটখাট আনন্দের উৎসগুলোও জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। বিবর্ণ হয়ে আসে মিনারার দিনগুলো।
তিন
রাকিব আস্তে আস্তে বদলে যেতে শুরু করে। প্রথম প্রথম মিনারা এই পরিবর্তন বুঝতে পারে না। কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক বয়ে চলা গতিতে এতটুকু ছন্দপতনও অনেকসময় বড় কোন ঝড়ের আগাম পুর্বাভাষ জানিয়ে যায়।
সেদিন শরীরটা ভাল লাগছিল না মিনারার। একটু তাড়াতাড়িই চলে আসে অফিস থেকে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। মিনারা জানে আজ রাকিবের ক্লাস নেই। প্রতি বৃহস্পতিবারে রাকিব খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। বাসায় এসে দেখে, শিমু রাগ করে ভাত না খেয়ে বসে আছে। বাপ আদুরী মেয়েও জানে যে, আজ বাবা বাসায় এসে খাবে। অতএব সে বাবা ছাড়া কারো কাছে ভাত খাবে না। বাসার কাজের মেয়েটা তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সুমন তার ঘরে বসে ভিডিও গেম খেলছে। মিনারা মেয়েকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
‘কি রে সুমন, তোর বাবা ফোন করেছিল ভার্সিটি থেকে?’
‘না তো।’
মিনারা চিন্তিত হয়। কোন সমস্যা হল না কি! মেয়েকে খাওয়ানো শেষ করে ডিপার্টমেণ্টে ফোন দেয়। জানতে পারে, রাকিব ভার্সিটিতে এসেছিল, কিন্তু অনেক আগেই চলে গেছে।
এবার যথেষ্টই চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ল মিনারা। কোন এক্সিডেণ্ট হল না তো! তখনো মোবাইল ফোন এত হাতে হাতে আসেনি। মিনারা কোন খোঁজ না পেয়ে একেবারে দিশাহারা হয়ে পড়ল। রেস্ট নিতে বাসায় এসেছিল, সেটা মাথায় উঠে গেল। বিকেল ফুরিয়ে যখন সন্ধ্যে গড়াল, মিনারা অসুস্থ হয়ে পড়ল। এমন সময় বেশ নিশ্চিন্ত মনে ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরল রাকিব। কোন ভাবান্তর নেই, যেন কিছুই হয়নি।
‘কোথায় ছিলে সারাদিন? একটা খবর দেবে না? জান, টেনশনে আমার হার্টফেল হওয়ার জোগাড়?’
‘এত টেনশনের কি হয়েছে? কাজ থাকতে পারে না নাকি?’
অবাক হয় মিনারা। রাকিবের কোন ভ্রূক্ষেপই নেই। যেন কিছুই হয়নি। এই রাকিবকে ঠিক যেন চেনে না মিনারা। সেদিনের মত ব্যাপারটা নিয়ে আর কোন কথা হয় না। কিন্তু নিত্য নতুন পরিস্থিতিতে রাকিবের অন্যরকম ব্যবহার মিনারাকে বাধ্য করে বিষয়টা নিয়ে ভাবাতে।
‘কি ব্যাপার রাকিব, তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বল কেন? আগে তো কখনো এভাবে কথা বলতে না তুমি?’
‘তোমার তো স্বাভাবিক কথাও অন্যরকম মনে হয়। সবসময় হেডমাস্টারনীর মত আচরণ না করলে হয় না। সবকিছুতেই বিচার-বিশ্লেষণ।’
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মিরানার। কী কথার কী উত্তর!
‘আমি তোমাকে একটা ছোট প্রশ্ন করেছি রাকিব। এভাবে জবাব দেওয়ার কি মানে হয়?’
বাদানুবাদ একসময় কুৎসিত ঝগড়ায় রূপ নেয়। রাকিব যা তা ভাষায় হেনস্থা করে মিনারাকে। যে রাকিব মনে মনে শ্রদ্ধা করত মিনারাকে, সে মিনারার চেহারা নিয়ে পর্যন্ত কটাক্ষ করে।
‘আয়নায় দেখছো নিজেকে ইদানীং? যা একটা চেহারা বানিয়েছ না!’
‘রাকিব...’ বিস্ময়ে বোবা হয়ে যায় মিনারা।
ধীরে ধীরে অনেক কিছুই সামনে আসতে থাকে। মিনারা জানতে পারে তার নারীত্বের সবচেয়ে বড় পরাজয়ের কথা। দু’বাচ্চার বাবা রাকিব হাসান তার ডিপার্টমেণ্টের এক সুন্দরী ছাত্রীর প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
আত্মসম্মানবোধ প্রখর মিনারার। তবু অবুঝ সন্তান দুটির দিকে না তাকিয়ে পারে না সে। ফিরিয়ে আনতে চায় রাকিবকে। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে ততদিনে।
শেষমেষ একদিন চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাকে।
‘শিমু আর সুমনকে আমার সাথেই নিয়ে যাচ্ছি। আশাকরি, তোমার আপত্তির কোন প্রশ্ন নেই।’
নিষিদ্ধ প্রেমের রসে মজে থাকা রাকিবের কানে কিছুই ঢোকে না।
চার
একে একে কেটে গেছে আঠারোটি বছর। অনেক স্মৃতিই ঝাপসা হয়ে গেছে মিনারা জামানের। হয়তো অনেককিছু সময়ের ভারে মুছে গেছে, আর কিছু স্মৃতি মিনারা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। লোকমুখে জেনেছে, রাকিব তার ছাত্রীকে বিয়ে করেছে। মিনারা নিজেকে স্বামীর সংস্রব থেকে দূরে সরিয়ে এনেছে ঠিকই, কিন্তু এখনো তার নামের সাথে জুড়ে থাকা স্বামীর নামটাকে মুছে ফেলেনি। মিনারা আজো মিসেস রাকিব হাসান।
সুমনের স্মৃতিতে বাবা কিছুটা জীবন্ত, কিন্তু শিমু মনে করতে পারে না বাবাকে।
‘এই ভাইয়া, মা তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। কার চিঠি? কি লেখা আছে?’
শিমু মার চোখেমুখে পানির ঝাপ্টা দেয়। চোখ মেলে তাকান মিনারা জামান। সুমন ততক্ষণে পড়ে ফেলেছে চিঠিটা।
মিনু,
অনেক দেরী করে ফেললাম, তাই না? কখনো আবার লিখবো তোমাকে, সত্যিই ভাবিনি। চাওয়া পাওয়ার হিসেব এত তাড়াতাড়িই মেলাতে বসতে হবে কে জানতো!
আমার জীবনে কী হয়েছে তা জানিয়ে তোমাকে আর বিরক্ত করতে চাই না। শিমু, সুমনের কথা জানতে চাইতেও সংকোচ হচ্ছে খুব। তোমরা কেমন আছো মিনু?
অনেক কষ্টে তোমার ঠিকানাটা জোগাড় করেছি। ভেবেছিলাম, একটিবারের জন্য যাবো তোমাদের কাছে। তোমার মনের অনেক গভীরে যে নরম একটা ঝর্ণাধারা আছে, তার কাছে গিয়ে একটু দাঁড়াবো। মনে আজো ক্ষীণ আশা, হয়তো ফিরাবে না আমাকে। কিন্তু যাওয়া হলনা আমার। জীবনের শেষ হিসেব চুকিয়ে নিতে হচ্ছে। তোমাকে অবহেলার শাস্তি পেয়ে গেছি আমি। হয়তো আর ফেরা হবেনা সুস্থ জীবনে। একটিবারের জন্য যদি আসতে!
না থাক্... ভাল থেকো।
রাকিব
পাঁচ
চিঠির নীচে ঠিকানা দেওয়া।
মিনারা জামান চুপ করে বসে আছেন। শিমু বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উসখুশ করে উঠে গেল। ও বেশীক্ষণ টেনশন নিতে পারে না।
সুমন তাকিয়ে আছে মার দিকে। আশ্চর্যরকম প্রশান্ত দেখাচ্ছে মাকে। একটা বড় কোন ঝড়ো বৃষ্টি শেষে প্রকৃতিকে যেমন প্রশান্ত দেখায়।
মা কত বুড়ো হয়ে গেছে! সুমনের খুব মায়া লাগে মার জন্য। কপালজুড়ে অজস্র ভাঁজের ছড়াছড়ি। কানের পাশজুড়ে বেশ কিছু পাকা চুল। জীবনের এই এতগুলো বছর মা একাই কাটিয়ে দিলেন। ওরা দু’ভাইবোন কি কখনো মার কষ্টগুলো জানতে চেয়েছে? কতদিন মা অনেক রাতে একা একা ঘরে পায়চারি করেছে। ঘুম ভাংগা মাঝরাতে অনেকদিন ও মার ঘরে টুকটাক আওয়াজ শুনেছে। পাশে অঘোরে শিমু ঘুমিয়েছে, কোনদিন কি জিজ্ঞেস করেছে,’মা, তুমি জেগে আছো কেন?’ ওদের অনেক জোরাজুরিতেও মা কখনো একটা ভাল শাড়ি নিজের জন্য কিনতে চাইতো না। মার জীবনের আনন্দের ঝর্ণাধারাটা শুকিয়ে গিয়েছিল সেই কবে!
আচ্ছা, কী ভাবছে মা এখন?
এমনসময় শিমুর ঘর থেকে গান ভেসে আসে। সুমন একটা ধমক দিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়ায়। মিনারা জামান ওর হাত টেনে থামিয়ে দেন।
দরদিকণ্ঠে এক আবেগী শিল্পী গেয়ে চলেছে...
‘ফিরে আসে আর হারায়,
নদীর ঐ অচেনা বাঁকে।
নদী এসে পথ্...সাগরে মিশে যেতে চায়...’