হঠাৎ বিস্ময়ঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রাতঃভ্রমণ শেষ করে বাসায় ফিরছি। টি এস সি’র পাশের ফুটপাতে দেখি এক কমলাবিক্রেতা এই সাতসকালেই বসে গেছে কমলার ঝুড়ি নিয়ে। টসটসে কমলাগুলো দেখে এগিয়ে গেলাম। কাজল এর ছেলেটা কমলার ভীষণ ভক্ত। আম-কাঁঠালের দিনেও সে কমলার খোঁজ করে। নীচু হয়ে কমলার দরদাম করছি। আমার পাশে একজন মহিলা তের-চৌদ্দ বছরের এক মেয়েকে সাথে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুটা অস্বস্তির সাথে মনে হল, তারা দুজন আমাকে নিয়েই আলাপ করছে। পাশ ফিরে মহিলার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল। আমি পাশ ফিরতেই মহিলাটির মুখ যেন আলোকিত হয়ে উঠল। কিছু বুঝে উঠার আগেই পা ছুঁয়ে আমাকে সালাম করল। পাশের মেয়েটা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বুঝে উঠতে পারছে না তার ভূমিকা কী হওয়া উচিত। আমি একেবারেই অপ্রস্তুত।
মহিলা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,’স্যার আমাকে চিনতে পারলেন না? আমি শাহানা। শিবগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে সহকারি শিক্ষিকা ছিলাম।’
‘শাহানা? আপনি্...মানে তুমি সেই শাহানা? তোমার একী অবস্থা হয়েছে?’ আমার কণ্ঠে নিখাঁদ বিস্ময়। শিবগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে শাহানা নামে আমি যে একুশ-বাইশ বছরের মেয়েটিকে চিনতাম, তার সাথে এই মধ্যবয়স্কা মহিলার তেমন কোন মিলই নেই। মাথার সামনে চুল পড়ে পাতলা হয়ে গিয়েছে, মুখের চামড়া প্রৌঢ়াদের মত কুঁচকানো, ঢিলেঢালা। চেহারায় লাবণ্য বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। অথচ সেই বয়সে শাহানা ছিল চমক লাগানোর মত সুন্দর। ওকে দেখে চেনা চেনা লাগছিল আমার, সেটা অনেকসময় আচরণগত কারণেও মনে হয়।
আমার কথায় শাহানার মুখে বিষন্নতার ছায়া পড়ল। পাশ ফিরে মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল,’স্যার, আমার মেয়ে...সালাম কর্ মা।’
‘না না, সালাম লাগবে না।’ এতক্ষণে চোখ গেল মেয়েটার দিকে। শাহানার সেই চমক লাগানো সৌন্দর্য থেকে বিধাতা একেবারে বঞ্চিত করেনি মেয়েটিকে।
‘বাঃ, বেশ। এত বড় হয়ে গেছে। শাহানা, তোমার মেয়ে তো ভারী সুন্দর হয়েছে। তুমি দেখতে ঠিক যেমন ছিলে।’
আমার এই কথাতেও শাহানার মুখে যেন কালো ছায়া সরে গেল। আমি বেশ খানিকটা অবাকই হলাম।
‘স্যার, আপনি এখানে কোথায় থাকেন?’
‘আমি ঢাকা ভার্সিটির কোয়ার্টারে থাকি শাহানা। আমার ছেলে কাজল ভার্সিটির শিক্ষক হয়েছে। ঢাকায় থাকতে আমার ভাল লাগে না। ভেবেছিলাম, জীবনের শেষ ক’টা দিন দুই বুড়ো-বুড়ি গ্রামে্র বাড়িতেই কাটিয়ে দিব। ছেলে শুনলো না। জোর করে ঢাকায় এনে বন্দি করে রেখেছে।’
‘বলেন কি স্যার, কাজল ভার্সিটির টিচার হয়েছে? সেই এত্তটুকুন দেখেছিলাম! খালাম্মা কেমন আছেন স্যার?’
‘এই তো একটু সামনেই আমরা থাকি। তুমি আসো না তোমার মেয়েকে নিয়ে।’ মনে পড়ে গেল, আমার স্ত্রী সুজাতা শাহানাকে বেশ স্নেহ করতো।
‘স্যার, আজ যাবো না। কিন্তু আমি আসবো একদিন। আপনার ঠিকানাটা দিন।’
আমি শাহানাকে ঠিকানা দিলাম। বাসায় আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও মেয়েকে নিয়ে একটা রিকশায় উঠল। আমি একরাশ প্রশ্ন আর বিস্ময় নিয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখলাম।
আমাকে খুব বেশীদিন প্রশ্নের ভার বহন করতে হল না। দু’দিন পর এক বিকেলে শাহানা তার মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসলো।
শুরুর গল্পঃ ছেলেটির সাথে আমার পরিচয় ঘটে শিবগঞ্জে।
প্রায় সতেরো-আঠারো বছর আগের কথা। আমি তখন শিবগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। যে সময়ের কথা বলছি, তখনও উপজেলাগুলোতে বিশেষ কোন উন্নয়নের আলো আসে নি। সামান্য বৃষ্টি-বাদলা কিংবা ঝড় তুফানে পুরো এলাকা একেবারে তছনছ হয়ে যেত। বিদ্যুৎ যদিও বা ছিল, কিন্তু ঝড় তুফান শেষে একনাগাড়ে অনেকদিন বিদ্যুৎ বিহীন হয়ে যেত পুরো এলাকা। আমার বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব ছিল প্রায় দুই মাইলের মত। হেঁটেই যাতায়াত করতাম প্রতিদিন। বর্ষাকাল চলছিল। মনে আছে, সেই বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। আমার স্কুলের দেয়াল ছিল ইটের, উপরে টিনের চালা। তাও সবগুলো ক্লাসরূম তৈরী করা সম্ভব হয়নি। ক্লাস ফোর আর ফাইভের ক্লাসরূমে কোন দেয়াল ছিল না। কয়েকটা খুঁটি পুঁতে উপরে টিনের চালা দেওয়া হয়েছিল। বৃষ্টির দিনগুলোতে বাচ্চাগুলোর দূর্দশার কোন অন্ত ছিল না। উপজেলা পর্যায়ে স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যেত না। শিক্ষকদের আন্তরিকতা আর সহনশীলতার দ্বারা অনেক সময় আর্থিক প্রয়োজন মোকাবেলা করতে হত।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়েছি প্রায় আট-ন’ বছর হতে চলল। আমার চোখের সামনেই এর বেড়ে ওঠা। নিজের সন্তানের মত স্নেহে স্কুলটিকে লালন করেছি। স্কুলের শিক্ষকেরাও আমার ভাতৃপ্রতীম। স্কুলে মোট পাঁচজন শিক্ষক, তিনজন শিক্ষিকা। ছোট এই এলাকাটিতে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। পরষ্পরের বাসাতেও আসা যাওয়া আছে। আমার স্ত্রী সুজাতার সাথে শিক্ষিকাদের এবং শিক্ষকদের স্ত্রীদের বেশ সুসম্পর্ক। দু’চারজন বাদে শিক্ষকরা সকলেই প্রায় মাঝবয়েসী। সবচেয়ে অল্প বয়সী শিক্ষিকা শাহানা পারভীন।
মেয়েটি কয়েকমাস হল জয়েন করেছে। হালকা পাতলা গড়নের একেবারেই অল্প বয়সী একটি মেয়ে। কৈশোরের মায়া জড়ানো সারা মুখে। ভারী সুন্দর কমনীয় একটা মুখ। মেয়েটি বিবাহিতা। মাত্র বছরখানেক হল বিয়ে হয়েছে। স্বামী জেলা কৃষি কর্মকর্তা। পোস্টিং চাঁপাইনবাবগঞ্জে। প্রতিদিন শিবগঞ্জ থেকে যাওয়া আসা করতে হয়। শাহানাকে বাসায় একা থাকতে হয়। সুজাতা প্রথম দিন থেকেই শাহানাকে খুব স্নেহ করে। শাহানার বাসা আমার বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। কাজলকে দিয়ে প্রায় দিনই তরকারীটা, আচারটা সুজাতা শাহানার বাসায় পাঠায়। শাহানাও আমার স্ত্রী এবং আমাকে খুব সম্মান করে।
সেই বছরের বিরামহীন বর্ষণে আমার স্কুলটার অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হল। ক্লাস ফোর আর ফাইভের ক্লাসরূমে কয়েকটা খুঁটি ভেঙ্গে গেল। টিনের চালা একপাশে হেলে পড়লো। মাটি কিছুটা উঁচু ঢিঁপির মত করে ভেতরে পানি আটকানোর একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রচুর বর্ষণে মাটি ক্ষয়ে সয়লাব হয়ে গেল। স্কুলের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষার বেশী দেরী নাই। তবু জরুরী পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্কুল কয়েকদিন বন্ধ রাখতে হল। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একত্রিত করে জরুরী সভা বসালাম। বাইরে থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার আশা করা বৃথা।
এর মধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা এর মত স্কুলের দপ্তরী বৃদ্ধ আজিজ মিয়া হঠাৎ করে মারা গেল। স্কুলের বিপর্যয়ে অল্প-বিস্তর সাহায্য সহযোগিতা শেষে সকলের হাতই প্রায় শূন্য। আজিজ মিয়ার অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর মত আর্থিক সংগতি আর কারোরই নেই। তার উপর একজন দপ্তরীবিহীন স্কুলের কার্যক্রম চালানোও অতি দুস্কর। বিপদ যেন চারদিক থেকে থাবা মেলে বসল।
আজিজ মিয়ার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে ছিল। অংকের শিক্ষক কানাই দাস খবরটা জানালেন। কানাই দাসের বাড়ির আশেপাশেই আজিজ মিয়া তার স্ত্রী আর এই ছেলেটাকে নিয়ে থাকতেন। ছেলেটিকে কোন কাজে লাগানো যায় কি না এই ব্যাপারেও নাকি অনেকদিন আজিজ মিয়া কানাই স্যারের কাছে ধর্ণা দিয়েছে। এই ছেলেটিকে দপ্তরী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে আজিজ মিয়ার পরিবারটিও আর্থিক বিপর্যয় থেকে বেঁচে যায়।
ছেলেটাকে ডেকে আনা হল। সুঠাম দেহী এক যুবা। কম কথা বলে। মনে হল, কাজের হবে। একে স্কুলের দপ্তরী হিসেবে নিয়োগ দিলে কাজে-কর্মে বেশ সুবিধা পাওয়া যাবে। সকলের মতামত নিয়ে সামান্য কিছু নিয়ম কানুন শেষে আজিজ মিয়ার ছেলে মনোজকে স্কুলের দপ্তরী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল।
মনোজ কাজে নেমেই একেবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। পারিবারিক এই ভয়ংকর সংকটে দপ্তরীর এই চাকরীটা তার কাছে সোনার হরিণ পাওয়ার মতই দামী। কৃতজ্ঞতার নমুনা হিসেবে স্কুলের যাবতীয় কাজ সে মহানন্দে তার কাঁধে তুলে নিল। পড়ে যাওয়া খুঁটিগুলো মেরামত করে ক্লাসরূম গুলোকে অল্পসময়েই ক্লাস নেওয়ার উপযোগী করে তুললো। সকলের যাবতীয় ফাইফরমাশ থেকে শুরু করে স্কুলের এটা ওটা সকল কাজেই মনোজ ছাড়া কারো আর চলে না। শিক্ষকদের খুশী রাখতে সে প্রাণপাত করে ছাড়ল। ছাত্রদের মুখেও সারাক্ষণ মনোজ ভাই, মনোজ ভাই। গাছের আম, ডাব পাড়তে মনোজের চেয়ে পারদর্শী আর কেউ নেই। ছোট ক্লাসের ছেলেদের জন্য পাখির বাসা পেড়ে আনা, পাতা দিয়ে নানান জিনিস বানানো, বিছুটি পাতার সন্ধান দেওয়া...মহাব্যস্ত দিন কাটতে লাগল মনোজের। স্কুলের দপ্তরী সমস্যার এমন সুন্দর সমাধা হওয়ায় আমিও বেশ খুশী হলাম।
কিন্তু বাধ সাধলো অন্য জায়গায়। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক সমস্যা এসে আমাকে বেশ বিচলিত করে তুললো।
একদিন স্কুল আর টিউশনী শেষে বাসায় এসে দেখি, শাহানা গল্প করছে সুজাতার সাথে। সুজাতার মুখ বেশ গম্ভীর। আমাকে দেখে শাহানা একটা সালাম দিয়েই কেমন যেন তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসু মুখে তাকালাম আমার স্ত্রীর দিকে।
‘তোমার স্কুলে দপ্তরী হিসেবে নতুন যে ছেলেটা এসেছে...মনোজ না কী যেন নাম, ছেলেটা কেমন?’
‘কেমন মানে? কেমন মানে কি? খুব ভাল ছেলে। কেন কি হয়েছে?’
সুজাতা কেমন যেন ইতঃস্তত করতে লাগল।
‘ঐ, মানে, শাহানা বলছিল, ছেলেটা...মানে ছেলেটা ঠিক ভাল না।’
‘ভাল না মানে? কারো কোন নালিশ নাই, শাহানা এমন কথা বলবে কেন?’ আমার একটু যেন রাগই লাগল।
আঃ...বোঝ না? ছেলেটার নজর ভাল না। বেশী কিছু বলতে পারবো না। বুড়া হয়ে গেছ। কিছুই বুঝতে পারো না।’
আমি ভালোই ঝামেলায় পড়লাম। গিন্নী কী যে বোঝাতে চাইছে ঠিক যেন ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। মনোজ এত চমৎকার একটা ছেলে। আর তা ছাড়া সে হচ্ছে সামান্য একজন দপ্তরী। শিক্ষিকার দিকে খারাপ নজর দিবে এত সাহস তো তার হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শাহানাও তো বানিয়ে বানিয়ে কথা বলার মত মেয়ে না। অন্য আপারা যখন নিজেদের মধ্যে পুটুর পুটুর করে গল্প করে, শাহানাকে দেখি এক কোণায় চুপ করে বসে বই পড়ছে, নয়তো কিছু একটা লেখালেখি করছে।
স্কুলের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। ব্যাপারটা মাথা থেকে প্রায় সরে গেল।
পরীক্ষা শেষে একদিন স্কুলের চারপাশটা একটু ঘুরে দেখছি। শিক্ষক কমনরূমে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মাঝে একটা গুমোট আবহাওয়া লক্ষ্য করলাম। পরিবেশ বুঝিয়ে দিচ্ছে, কিছু একটা হয়েছে। শাহানা এক কোণে মাথা নীচু করে বসে আছে। দু’জন আপা ওর কাছে বসে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেন। আমাকে দেখে সবাই কেমন যেন চুপ মেরে গেলেন। আমি দু’জন সিনিয়র শিক্ষককে আমার রূমে ডেকে পাঠালাম।
ঘটনা ভয়াবহ। শাহানা আর চুপ করে থাকতে পারেনি। বিষয়টা সামনে আনতে বাধ্য হয়েছে। মনোজের হাব ভাবে শাহানা প্রথম থেকেই ওকে এড়িয়ে চলতো। দপ্তরীই হোক আর যাই হোক, যুবক বয়সের ছেলে। ছেলেটা অন্য কিছু না, চোখ দিয়ে গিলতো ওকে। বিষয়টা কাউকে বলার মত না, তাই শাহানাও চুপই করে ছিল। ভেবেছিল পাত্তা না দিলেই হবে। আজ দুপুরে শিক্ষিকাদের জন্য বরাদ্দকৃত ছোট রূমটাতে শাহানা বসে ছিল। কখন চোখ ধরে এসেছে বুঝতে পারেনি। চেয়ারেই গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ মনে হল, ওর পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। খুব কাছাকাছি। নিঃশ্বাস এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে দেখে, পাশে মনোজ দাঁড়িয়ে আছে।
শাহানার বয়স কম। অল্প বয়সী মেয়েরা অনেকসময় প্রতিবাদের সঠিক ভাষাটা বুঝতে পারে না।
আমি মনোজের স্পর্ধায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ওকে আর আমাদের দরকার নেই লিখে চিঠি পাঠিয়ে দিলাম।
মনোজকে আর ঢুকতে দেওয়া হয়নি স্কুলে। নতুন দপ্তরী খুব তাড়াতাড়িই নিয়োগ দেওয়া হল।
এর দুবছর পরই আমার বদলী হয়ে যায় অন্য একটা স্কুলে। অন্য উপজেলায়। মায়া পড়ে গিয়েছিল শিবগঞ্জের উপর, আমার নিজের হাতেই গড়া স্কুলটার উপর।
খুব খারাপ জিনিস এই মায়া। সব বাঁধনের মত এর বাঁধনও একসময় কাটাতে হয়।
সেদিন বিকেলেঃ শাহানাকে দেখে আমার স্ত্রী রীতিমত ঘাবড়েই গেল। ঘাবড়ানোরই কথা। কী মেয়ে কেমন হয়েছে!
সুজাতাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল শাহানা। যেন বাঁধভাঙ্গা প্লাবন।
ভাগ্য কোন্ বিচিত্র বাঁকে ঘুরিয়ে দিয়েছে ওর জীবনটা তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত।
‘আপনারা চলে আসার পর কিছুদিন খুব খারাপ লেগেছিল। আপনি তো জানেন খালাম্মা, আমি কারো সাথে তেমন একটা মিশতে পারি না। আপনার কাছেই অনেক কিছু নিয়ে কথা বলতাম। আমার স্বামীও সারাদিন বাসায় থাকতো না।
এদিকে বেশ কিছুদিন আড়ালে থাকার পর মনোজ প্রকাশ্যে আমাকে জ্বালাতন শুরু করল। স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমার রাস্তা আটকে দাঁড়াতো, আজে বাজে কথা বলতো। বলতো, আমার জন্য ওর চাকরী গিয়েছে; সে আমাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেবে না। কাউকে কিছু বলারও সাহস পেতাম না। কেমন যেন একটা তীব্র ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়াতো। মনোজের বেপরোয়া ভাব দেখে মনে হত, ও যে কোন কিছুই করতে পারে। আমার স্বামীকে বলতেও দ্বিধা সংকোচে ভূগতাম। মনে হত, যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে।’
শাহানার কথা শুনে বাকরূদ্ধ হয়ে গেল আমার। একজন পূর্ণবয়স্কা মেয়ে, চাকরী করে...একটা অশিক্ষিত, নোংরা মানসিকতার ছেলের বিরুদ্ধে কাউকে বলতে পর্যন্ত ভয় পাচ্ছে; এটা কী করে হয়! সামাজিকতার ভয় কী এতই সাংঘাতিক?
সুজাতাও আমার মনের কথাই বলল, ‘তুমি, এসব কি করে চুপচাপ শুনে যেতে? তোমার কি আত্মসম্মান নেই? তোমার স্বামীর কাছেই বা কেন গোপন করলে?’
‘মনোজ আমাকে উলটাপালটা ভয় দেখাতো। আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোন স্কুলে বদলী হওয়া যায় কি না চেষ্টা তদবির করছিলাম। তাহলে আর কোন ঝামেলা থাকে না। কিন্তু এর মাঝেই বুঝতে পারলাম, আমি অন্তঃসত্তা। স্কুলে প্রতিদিন যেতে পারতাম না। মনোজ কিভাবে যেন ব্যাপারটা জেনে গেল। এরপরে সে শুরু করলো তার আসল বদমায়েশি। আমার স্বামীর কাছে উড়া চিঠি আসতে লাগল। নোংরা, অকথ্য ভাষা সেসব চিঠির। যার মূল বক্তব্য হচ্ছে, মনোজের সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক আছে। যে আসছে সে ও তারই। আমার স্বামী আমাকে জেরা করা শুরু করলো। আমি তাকে সব খুলে বললাম। স্কুলের আপাদেরও ডেকে আনলাম। কিন্তু আমার স্বামী কারো কথাই বিশ্বাস করলো না। তার এক কথা, এত বড় ঘটনা আমি কিভাবে চেপে গেলাম। আমি কেঁদেকেটে ওকে কত বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমাকে না হয় না বিশ্বাস করল স্কুলের আপারাও কি মিথ্যা কথা বলছে? কিন্তু সে মানতে নারাজ। বলে, অন্যরা হয়তো পুরোটা জানেনা। আমার স্বামী দাবি করল যে সে যেহেতু অন্য জায়গায় থাকে আমি অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি।’
আমরা দুজন নির্বাক হয়ে শুনছি। আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে শাহানা বলতে থাকে... ‘আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করলো। আমার পেটের বাচ্চাকে স্বীকৃতি দিল না। বাসা থেকে বের করে দিল আমাকে। শিবগঞ্জে থেকে এই অবস্থায় বাসা ভাড়া করে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া সেই আর্থিক সংগতিও আমার ছিল না। চলে গেলাম পাবনা, আমার বাবার বাড়ি।’
‘তোমার চাকরী?’
‘চাকরীটা অনেক কষ্টে বেঁচে গেল। পাবনায় পোস্টিং নিতে পারলাম ম্যালা কষ্টে। সে বিশাল গল্প। শিবগঞ্জ থেকে আসার আগে ভেবেছিলাম, একবার শেষ চেষ্টা করবো। স্বামী আমার কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু মনোজকে আমি ছাড়বো না। আর কী হারানোর আছে আমার? পরে বাদ দিলাম। সে তো আমাকে আগেই বলেছে, আমাকে সে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেবেনা। তার ওয়াদা সে রক্ষা করেছে। পেটে বাচ্চা সমেত যে স্ত্রীকে তার স্বামী ত্যাগ করে, এই সমাজ তাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেয়না। কিন্তু আমার স্বামী তো তার ওয়াদা রাখতে পারলো না। আমার পিতামাতার কাছে দেওয়া তার ওয়াদা।’
বিষে বিষে ক্ষয়ঃ শাহানার মেয়ে পাশেই বসেছিল। বোঝা যায়, মায়ের এ যুদ্ধে সে তার সহযোদ্ধা।
‘ঢাকায় কেন এসেছো শাহানা?’ কিছু একটা বলতে হয় তাই যেন বলা।
‘প্রায়ই অসুস্থ থাকি। মেয়ের জেদে ঢাকায় এসেছি। আমাকে বড় ডাক্তার দেখাবে। ভাইয়ের বাসায় উঠেছি।’
থেমে খানিকটা শ্বাস নিল শাহানা। হাঁপানি রোগীর মত।
তারপর থেমে থেমে বলতে লাগলো, ‘কিন্তু আমি তো জানি আমার কী হয়েছে। আমি তো আর ভালো হব না। শরীরটা পচে গেছে আমার। এক বিষাক্ত ছোবলে শরীরে বিষ ঢুকে গেছে। চোখের ছোবল। এও যে এত সাংঘাতিক জানা ছিল না আমার। আমার মেয়েটাকে দেখে কেউ যখন সুন্দর বলে, শরীরটা কেঁপে ওঠে আমার। ভয়ে আঁৎকে উঠি, না জানি কোন্ কালনাগ ফণা তুলে আছে। এক কালনাগের ছোবলে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেছে, আমার মেয়েটাকে যেন এমন পরিণতি বরণ করতে না হয়।’
বলতে বলতে অজানা কিছুর আশংকায় সত্যি সত্যি কেঁপে ওঠে শাহানা।