১
এই ঝামেলা এড়ানোর জন্যই ট্রেনে যাবে কিনা মনস্থির করতে পারছিল না আবীর। ট্রেন জার্নি ভীষণ ভালো লাগে আবীরের। দু'পাশের দৃশ্যপট কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। স্থিরচিত্র থেকে চলমান। আস্তে আস্তে চলমান দৃশ্যগুলোতে গতি সঞ্চার হয়। মৃদু,মসৃণ...তারপর সমান্তরাল গতি। বাসে এলে এই অনুভূতিটা টের পায় না সে। বাস মানেই যেন টেনে চলা, গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়াহুড়ো।
কিন্তু ট্রেন সার্ভিসের খবর যে একেবারে রাখে না আবীর তা নয়। কমপক্ষে দু'তিন ঘণ্টা লেট না হলে মান থাকে না ট্রেনের। তাই বাসে যাওয়াই স্থির করলো সে। কিন্তু বিধি বাম। ঠিক শেষ মুহূর্তে টিকিট কাটতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেল। ঈদ না পূজো না, সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেল কেন বুঝতে পারছে না। ঠিক তখনই মনে পড়লো, সামনে তিনদিন ছুটি আছে। শুক্র, শনিবারের সাথে একদিনের সরকারী ছুটি যোগ হয়েছে। লোকজন এই তিনদিনের ছুটিকে মিস করতে চাইছে না। যে যারমত বাড়ীমুখো রওয়ানা হচ্ছে। অগত্যা দেরী না করে ট্রেনের কাটতে ছুটলো সে। ট্রেনের টিকিট না পাওয়া গেলে প্রোগ্রামটাই মিস হয়ে যাবে।
ভাগ্য ভালো ছিল আবীরের। সেকেণ্ড ক্লাসের একটা টিকিট পেয়ে গেল। আগামীকাল সকাল ন'টায় কমলাপুর ষ্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে। বরেন্দ্র এক্সপ্রেস। রাজশাহী যাচ্ছে আবীর। কত দিন পর! দীর্ঘ পঁচিশ টা বছর। একটি একটি করে দিনগুলি কোথা দিয়ে উড়ে গেল! চোখ বন্ধ করলে মনে হয় এই তো সেদিন...কলেজের চৌকাঠ পেরোনো টগবগে তারুণ্য। মাঝখানের এতগুলো দিন শুধু তো ঊত্তরণের। নিজেকে তৈরী করার। পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ টাই পেল কখন! হয়তো তাকানো হতোও না আর...যদি না বন্ধু সজল আর শান্ত এই প্রস্তাবটা দিত।
২
পরদিন যথাসময়ে ষ্টেশনে চলে এল আবীর। ন'টা বেজে সাড়ে নয়টা, দশটা বাজতে চললো। ট্রেন বাবাজীর হদিস নেই। অবশেষে তিনি এলেন যখন ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। কী অবস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ের! ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা দুটো টনটন করছে। ষ্টেশনের তিন চার কাপ চাও পেটের মধ্যে কিলবিল করছে। দশ বছর আগে হলেও একটা কথা ছিল। বয়স বাড়ছে। এখন খাওয়া দাওয়ার উল্টোপাল্টা অনিয়ম শরীর বরদাস্ত করতে চায় না। অভিযোগ করে বসে। যদিও মনে প্রাণে নিজেকে এখনও যুবক ভাবে আবীর। পঁয়তাল্লিশ বছরের বয়স্ক যুবক। বয়স তো বাড়ছে শরীরে, মন তো এখনও নিজের দখলে।
ট্রেনে নির্ধারিত সিংগেল সিটটিতে বসে সামনের সিটের সহযাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে আবীর। ট্রেন জার্নিতে কথা বলার মত একজন সহযাত্রী পেলে চমৎকার হয়। যদিও আবীর খুব বেশী কথা যে বলে তা নয়। কিন্তু যাত্রাপথ দীর্ঘ। এতক্ষণ তো আর মুখ সেলাই করে বসে থাকা যায় না।
ষ্টেশনের হট্টগোল, ব্যস্ততার মাঝে আবীর ডুবে গেল ভাবনার জগতে। হুট করেই রাজশাহী যাবার প্ল্যানটা করেছে। রাজশাহী মানেই আবীরের কাছে শৈশব কৈশোরের উচ্ছল দিনগুলি। জীবনের অনেকক'টি প্রিয় বছর সেখানে পার করে দিয়েছে। এইচ,এস,সি পাস করে উচ্চশিক্ষার তাগিদে ঢাকায় চলে আসা। পেছনে পড়ে থাকে সোনালী দিনগুলো। বাবা-মা চলে যান দেশের বাড়িতে। আর আসা হয়নি রাজশাহীতে। আবীরের ছোটমামা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি প্রায়ই আবীরকে বলতেন ঘুরে যেতে। তাগিদ বোধ করেনি কখনো। ঢাকা ভার্সিটিতে এপ্লাইড ফিজিক্সে পড়াশুনা করে একটা মোবাইল কোম্পানীতে যোগ দিয়েছে। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এখন। বিয়ে করেছে। থিতু হয়েছে জীবনে। এতদিন পরে নূতন করে কোন তাগিদ বোধ করবে সত্যিই ভাবেনি। ফেসবুকে পুরনো অনেক বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ আছে আবীরের। কলেজের বন্ধু সজল আর শান্তই প্রস্তাবটা করে বসে।
"চল, আমরা কলেজের ক্লাসমেটরা একটা গেট টুগেদার করি।"
"সে তো করাই যায় যে কোন দিন। বাসায় চলে যায়।" আবীরের স্মার্ট জবাব।
"উহু, সেই রকম গেট টুগেদার নয় বন্ধু যে, বউ-বাচ্চা নিয়ে তোমার বাসায় যাব, বউএর হাতের মজাদার রান্না ডেকচি ভরে সাজায়ে রাখবা আর আমরা পেটপুরে খেয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় ছবি তুলে বাসায় চলে আসবো।"
"কী করতে চাস তাহলে?"
"অরিজিনাল গেট টুগেদার ইন অরিজিনাল প্লেস।"
"মানে?"
"ঢাকায় আমরা রাজশাহী কলেজের আমাদের ব্যাচের নয়-দশ জন আছি। ফেব্রুয়ারীতে দেশের বাইরে থেকে কয়েকজন আসবে। রাজশাহীতে আছে বেশ অনেকজন। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা খারাপ হবে না।"
সজল আর শান্ত অসাধারণ দক্ষতায় সবার সাথে যোগাযোগ করে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে একটা ডেট ঠিক করে ফেললো। আবীর
'না' বলার ফুরসতই পেল না।
চলতে শুরু করেছে ট্রেন। ইতিমধ্যে সামনের সীটে একটা বাইশ তেইশ বছরের ছোকরা এসে বসেছে। কানে ইয়ার ফোন। নিবিষ্ট মনে গান শুনছে। মাঝে মাঝে ফোনে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলছে। ওর সামনে যে একজন কেউ বসে আছে খবরই নেই। অগত্য হাতে একটা বই তুলে নিল আবীর। কী আর করা! মাঝে মাঝে চশমার ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য করছে ছেলেটিকে। এই জেনারেশনটাকে সে ঠিকমত বুঝতে পারে না। যুগটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চলে এরা। প্রযুক্তির যাবতীয় আশীর্বাদ হাতের নাগালে। আশীর্বাদ না অভিশাপ কে বলবে!
আবীর জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ফাল্গুন মাস চলছে। প্রকৃতিতে কেমন যেন উদাসী মাদকতা। অকারণে হু হু করে ওঠে মনটা। খুব ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোন গভীর গোপন অনুভূতি যেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। পঁচিশ বছর পেছনের মদির মাখা বসন্ত দিনের কোন কৈশোর পেরোনো সদ্য তরুণ যেন হাতছানি দিয়ে ডাক দিয়ে যায় তাকে। আবীর ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
৩
কলেজে ওদের সাথেই পড়তো মেয়েটা। একই সেকশনে। মিথিলা। ঠিক ঠিক মনে পড়ে যায় নামটি। অথচ এতগুলো বছরে একবারও...। আসলে প্রকৃতি, সময়, স্থান আশ্চর্য রকম প্রভাব ফেলে মানুষের মনে।
কলেজের নামকরা ছাত্র ছিল আবীর। এক নামে চিনতো সবাই। সাংস্কৃতিক অংগনেও ছিল পরিচিত মুখ। ভালো কবিতা লিখতো। আবৃত্তিও করতো কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। রাজশাহী কলেজে তাদের ব্যাচে ছাত্র সংখ্যা ছিল অনেক। সায়েন্স, আর্টস, কমার্স মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশোর মত। কম্বাইন্ড কলেজ। মেয়েদের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। সদ্য স্কুল পেরোনো তরুণ বয়সে মেয়েদের প্রতি আগ্রহও ছিল সীমাহীন। ক্লাসের বেঞ্চিতে অমুক+তমুক, ব্ল্যাকবোর্ডে বিশেষ কাঊকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখা, কিংবা পদার্থ বিদ্যার গ্যালারী ক্লাসরুমে পেছনে বসে সামনে লক্ষ্য করে বাক্যবাণ ছুঁড়ে মারা.........আহা সেই দিনগুলি! বন্ধুদের দু'একজন ঝুলেও গেল। কিন্তু আবীর জাতে মাতাল হলে কী হবে, তালে একদম ঠিকঠাক। একটু আধটু মজা কর ঠিক আছে। ঐ পর্যন্তই। কবিতার ছন্দে মিল দেওয়া আর তুমুল পড়াশুনায় আবীর তার লক্ষ্যে স্থির। কিন্তু একদিন তার কবিতা ছন্দ হারিয়ে ফেললো। হঠাৎই চোখে পড়লো মেয়েটিকে। হয়তো আগে খেয়াল করেনি। একদিন বাংলা ক্লাসে স্যার বদল হলেন। নূতন স্যার প্রত্যেকের নাম জিজ্ঞাসা করছিলেন। সেদিনই প্রথম দেখা। মিথিলা। ভারী সুন্দর নাম। কবিতার মতই। ভাসা ভাসা চোখদুটোও ছিল কবিতার মতই। শোরগোল পড়ে যায় মনের অলিতে গলিতে, ইথারে ইথারে। বসন্ত বুঝি এসেই গেল!
কলেজের দুই বছরে মিথিলার সাথে আবীরের তেমন কোন কথাবার্তাও হয়নি। মিথিলা ছিল চুপচাপ শান্ত স্বভাবের। মিথিলার দু'তিনজন বান্ধবীর সাথে আবীরের মাঝে মাঝে এটা সেটা নিয়ে আলাপ হলেও মিথিলার সাথে কথা বলা হয়ে ওঠেনি কখনো। পরীক্ষার ডামাডোলে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সবাই। মহাব্যস্ত আবীর। মাঝে মাঝে মনে পড়তো.........। যেদিন পরীক্ষা শেষ হল, বন্ধুরা মিলে আড্ডা জমায় কলেজ ক্যান্টিনে। সেদিনই মিথিলাকে শেষ দেখেছিল আবীর। আবীরের স্পষ্ট মনে আছে, মিথিলা পূর্ন দৃষ্টি মেলে আবীরের দিকে তাকিয়েছিল। একবারের জন্যই। তারপরই সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। আবীর অনেক ভেবেছিল, সেই দৃষ্টির মাঝে লুকিয়ে থাকা কোন না বলা সম্ভাবনার কথা।
"আংকেল, আপনি কি 'ন হন্যতে' পড়ছেন? একটু দেখতে পারি বইটা?"
সামনের সীটে বসা ছেলেটির ডাকে সম্বিত ফিরে পায় আবীর। বইটি হাতে নিয়ে অনেক কথা বলে ছেলেটি। বইটি সম্পর্কে। মৈত্রেয়ী দেবী সম্পর্কেও বেশ জানে বোঝা গেল তার কথায়।
আবীর মৃদু হাসে। এই জেনারেশনটাকে সত্যিই সে বুঝতে পারে না।
৪
রাজশাহী ষ্টেশনে একটা ব্যাপক সংবর্ধনা অপেক্ষা করছিল আবীরের জন্য। মামা- মামী তো এসেছেনই, আরও এসেছে শান্ত, সজল এবং আরও কয়েকজন। দারুণ লাগলো আবীরের। পরদিন দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মামা-মামীর সাথে বাসায় ফিরলো সে।
রাজশাহীতে পা দিয়েই মনটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল আবীরের। ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা, মিথিলার কথা। এমনটা হবার কোন কারণ নেই যদিও। কিন্তু ভালো লাগছে স্মৃতিচারণ করতে। পরদিন কলেজ প্রাঙ্গনে পা দিয়েই চমকে ঊঠলো আবীর। করেছে কী সজলরা?! ছুটির দিন বলে কলেজ বন্ধ। প্রশাসনিক ভবনের সামনে একটা ছোটখাট র্যাললীর মত করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। প্রায় এক-দেড়শো জন তো হবেই। কত সব চেনা মুখ! কত দিন পর! মুহুর্তেই একাত্ম হয়ে গেল আবীর। হৈ হৈ করে কাটতে লাগলো সময়টা। আবীর এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খোঁজে। নেই। আসেনি হয়তো। কোথায় আছে এখন কে জানে!
ইতিমধ্যে ঘোরা হয়ে গেল সব ক্লাসরুম গুলো। স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত সবাই তখন। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ঘুরছিল সবাই। আবীর ঘুরতে ঘুরতে একটু দলছাড়া হয়ে পড়ে।
"আপনি আবীর না?" -চমকে পেছনে ফিরে চুপচাপ হয়ে যায় আবীর।
৫
টানটান মুখশ্রীতে ভাগ বসিয়েছে সূক্ষ্ণ কিছু কুঞ্চন, মেঘ কালো কুন্তলে ধুসরিমা যেন, ভাসা ভাসা চোখ গুলো ডুবতে বসেছে প্রায়...তবু চিনতে ভুল হয় না আবীরের।
"কেমন আছো?" বুদ্ধিদীপ্ত আবীর আরো যেন সপ্রতিভ।
"এই তো...আপনি ঢাকায় যাবার পরে আর যোগাযোগ রাখেন নি কেন কারও সাথে? আমরা কিন্তু প্রায়ই আপনার কথা আলাপ করতাম। খুব সুন্দর কবিতা লিখতেন আপনি।" মিথিলা প্রগলভ হয়ে ওঠে।
আবীর কেন যেন ফেরার তাড়া অনুভব করে। একবার ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করে,"তুমি আমার কবিতা পড়েছো?" দমন করে ইচ্ছে টা। থাক্ না...। কী লাভ ফেরারী বসন্ত কে খুঁজে ফিরে?
০১ ডিসেম্বর - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
৬৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৫.৮৭
বিচারক স্কোরঃ ৩.২৭ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.৬ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী