অভির পুরো নাম ছিল অভিরূপ নার্জিনারী। এখন এই সংশোধানাগারে(নাবালকদের সংশোধানাগারে) অভিকে সবাই গুরু বলে ডাকে; কেউ ভালোবেসে, কেউ শ্রদ্ধা করে, কেউ ভয় পেয়ে।
যখন, অভির বয়স সাত, তখন অভির মা – ‘কিরণ নার্জিনারী’ মারা যান।তার ১ বছর পর, অভির ৮ বছর বয়সে বাবা আবার বিয়ে করেন ঝিনুক নামের একজনকে। অবাক চোখে অনেক ঘেন্না নিয়ে সে বাবার বিয়ে দেখে। বাবা হাসছে! কিভাবে? ঠিক যেভাবে বাবা মার সাথে কথা বলতে বলতে হাসত আগে। প্রচন্ড ঘেন্না; অভির সারা শরীর কাঁপে। একবার মনে হয় সৎ মা আর বাবার মুন্ডু দুটো দা-এর এক কোঁপে কেটে নামায়। তার মা একজনই। মা যখন গল্প শোনাতেন, কোলে অভির মাথা রেখে ঘুম পাড়ানি গান শোনাতেন, অভির মন হারিয়ে যেত স্বপ্নের রাজ্যে। মা আর নেই, তাই তার কেউ নেই; এমনটাই ভেবে ছিল অভি।তার ঘেন্না পেত সৎ মায়ের কন্ঠস্বরে, সৎ মায়ের পায়ের আওয়াজ যত কাছে আসত, অভির গলায় কি যেন, ফাঁস তত মজবুত হতে থাকত। প্রথম যেদিন সে সৎ মা বলে ডেকেছিল, বাবা রেগে কেঁপে গিয়েছিল, শরীর রাগে কেঁপে উঠেছিল হয়ত বাবার।
কাঁপুক। ভারী মজা বাবার অসহায় রাগ দেখতে। আগুনে তো সেও জ্বলত। প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্ত। আর বাবা তখন সত মার সাথে আরামে থাকত। বেঁচে থাকাকালীন মা কি শুধু অভিরই খেয়াল রাখত? না তো। মা তো কত ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন, সবার আগে বাবাকে চা করে দিতেন।বাবার অফিস, বাবার মিটিং এসব নিয়ে মার চিন্তা ছিল সবচেয়ে বেশী। বাবা না খাওয়ার আগে রাতের খাবার খেতেন না।
সৎ মাও খান না। বাবা আগে বলতেন-“কিরণ, তুমি খেয়ে নেবে, শরীর-স্বাস্থ্য সবার আগে। শুধু শুধু আমার জন্য কেন দেরী কর?” বাবা এখন বলেন-“ঝিনুক, তুমি খেয়ে নেবে, শরীর-স্বাস্থ্য সবার আগে.........”-ইত্যাদি ইত্যাদি। বাড়িতেও মায়ের জায়গাটাও একটু একটু করে দখল করছিল ঐ তালমিছরির ছুরি সত মা। মিষ্টি কথায় অভিরও মন ভোলাতে চেয়েছিলেন। হায় রে; সত দিদিমার হাতে তৈরি তিলের নাড়ু। পা দিয়ে পিষে ফেলেছিল সে। চাই না অমন নাড়ু। ওর থেকে বিষ খাওয়া ভাল। বাড়ির রান্নাবান্না ভাগ্যিস, ঠাম্মা করেন, নইলে না খেয়ে মড়তে হত অভির। বাবা বলেছিলেন, ‘নতুন মা’ করে ডাকতে। অভি বলেছিল, তার একটাই মা।
অভির ভাল মনে আছে সেদিনের কথা।সত মায়ের মুখে থুথু ছিটিয়ে বুকে ছুড়ি বসিয়েছিল সে। কী সাহস মহিলার। বলে কিনা, অভির কাছ থেকে ওর মার ছবি নিয়ে সরিয়ে রাখতে, নয়ত ও যত দেখবে ওর তত মন খারাপ হবে। অভি জবাব দিয়েছিল- “বাবার ঘর থেকে মার ছবি কবেই সরেছে। তোর আর বাবার ছবি একসাথে ঝোলে, এবার আমার কাছ থেকেও মা’কে কাড়বি তুই, শয়তানের বাচ্চা!” এবং এসব বলে আর দেরি করেনি সে।
স্পট ডেড হয়েছিল সৎ মা। মুখে রক্ত ছিটেছিল অভির। বাবা-র সেদিন আর অভিকে মারার সুযোগ হয়নি। শুধু পুলিশ কমপ্লেন হয়। সবাই কি খুশী অভি এখানে আসায়; আপদ বিদেয়। ঠাম্মাও একফোঁটা কাঁদেনি।
অভিও কাঁদেনি। সেদিন সেও খুব খুশি হয়েছিল। ফাইনালি বাবার থেকে, ফাইনালি বিশ্বাসঘাতকের দলের থেকে সে অনেক দূরে। কত মানুষই না থাকে, মা-বাবা ছাড়া। এবং খুব ভাল থাকছে সে। অমন বাবার দরকার নেই। জেলের জীবন অনেক সুন্দর। এখানে সে খুব ভাল আছে।
অভিদের এখানে গত শুক্রবার এক মহিলা এসেছিলেন। মা এর মতই কপালের বাঁ পাশে একটা তিল। আজ আবার এসছেন তিনি।সোহিনী ম্যাম অভির কাছে জানতে চান না কিছুই, শুধু বললেন-
-“জানি তোমার সে বসময় যা ঠিক মনে হয়েছিল, সেটাই করেছ। কিন্তু তোমার যেটা ঠিক মনে হয় সেটা করলে জেল–এ যেতে হয়।”
-“জ্ঞান দিচ্ছেন, আমি কিন্তু আপনাকেও মারতে পাড়ি।” - অভি বলে।
শান্তভাবে হাসেন সোহিনী ম্যাম। বলেন- “তোমার বা তোমার মার ক্ষতি করেনি, এমন মানুষকে তুমি মারবে, এত বড় শক্তি তোমার এখনও হয়নি।”
অবাক চোখে তাকায় অভি। কে এউই সোহিনী ম্যাম? এন জি ও চালান একটা। অভিদের নিয়ে নাটক, গান, নাচ, মঞ্চানুষ্ঠান করতে চান। ওদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে চান।
সোহিনী ম্যাম মৃদু হেসে জানতে চান-“সবার সমান অধিকার পৃথিবীতে সমাজে বাস করবার, তোমারও, অভি।”
অভি প্রথমে ৩ বছর বাদে কারও গলায় নিজের ডাকনাম শুনে একটু চমকায়।পরমূহুর্তেই বলে ওঠে-“এসব কথা গানেই শোনায় ভালো।”
“কিন্তু লাখ লাখ লোক যে সেই গান কে সম্বল করেই বাঁচে। কিছু লোকের জীবন যে খুব বেশী করে সে গানের জন্য কান পেতে থাকছে।” – বলেই সোহিনী ম্যাম একটু চুপ করেন।আবার বলেন- “আর তোমাকে তো তোমার বাবার, পরিবারের মন থেকে সরে যেতে হয়েছে, মায়ের স্মৃতিজড়ানো বাড়ি থেকেও চলে আসতে হয়েছে।”
- “ওদের মনে আমার মায়ের স্মৃতি নেই, তাই আমিও থাকব না। আর আমার মায়ের স্মৃতির আর আমার থাকার জন্য বাড়িটা খুব ছোট ছিল।”- এটুকু বলে অভিও উঠে যায়।
সোহিনী ম্যাম মাঝেমধ্যেই আসেন, অভিকে নাটকে, গানে অংশ নিতে বলেন। কথা হয় সোহিনীম্যামের সাথে মাঝেওমধ্যেই । অভির উত্তেজিত তর্কে একটু একটু করে বাঁধা দেন ম্যাম। ক্রমেই নীচু হয়ে আসে অভির গর্বিত মাথাটা। ক্রমেই সে অভি ডাক শোনার অভ্যেস করে ফেলে। ম্যাম বলেছিলেন সেদিন- “তোমার সৎ মার উদ্দেশ্য কি ছিল জানি না। কিন্তু তোমার কষ্টের গভীরতা না বুঝলেও কষ্টটুকু যে আছে, তা তিনি বুঝেছিলেন বলেই হয়ত, তোমার ভিতরের হিংস্র পশুটাকে মাড়তে চেয়েছিলেন। পদ্ধতি যেমনই হোক, উনার ইচ্ছাতে খামতি ছিল না কোনও। তোমার বাবা হয়ত, তারপর আরও একটি সৎ মা তুলে এনেছেন ঘরে। তোমার সত মা তোমার মায়ের দেশে আছেন। চোখ মেলাবেন কীভাবে তোমার মা তার সাথে?”
অভি পায়ের নখ খোঁটে। একটি কথাও সে কাটতে পারে না। সোহিনীম্যাম চুলে হাত রাখেন অভি-র। ঠিক যেন মায়ের হাত। তার সারা শরীর অনুশোচনায় কাঁপে এবার। অনুশোচনায় মড়তে মড়তে এবার সে ভাবে, জেলের জীবনের চেয়েও বেশি সুখ অনুশোচনায় মড়াতে। মঞ্চে উঠে গান গায় সে সেদিনের অনুষ্ঠানে,-
“আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এজীবন পুণ্য কর..................”
-তাকে সোহিনী ম্যাম একটা ফোটোফ্রেম দেন, সে ওটাতে মার ছবিটা ঢুকিয়ে রাখে। আগে রোদে দাঁড়িয়ে পুড়তে ভাল লাগত তার।এখন সে রোদে দাড়ালে সোহিনী ম্যাম পিছনে এসে রোদটুকু শুষে নিয়ে নেন নিঃশব্দে।
অনুষ্ঠানের তিনদিন পরে সে ম্যামের সাথে যায় মা এবং সত মায়ের সমাধিতে। মার সমাধিতে অনেকক্ষণ কাদে সে, ফুল রাখে। সত মায়ের সমাধিতে গিয়ে কাঁদার বা ছুঁয়ে দেখার সাহস পায় না। শুধু মাথা নিচু করে বলে- “আমি পেরেছি নতুন মা, পশুটাকে মাড়তে পেরেছি আমি। আমার ভেতরের মানুষটা জিতেছে। বিজয় হয়েছে চেতনার।”